রাতের উল্লাসে ফরাসি চুম্বন
দমকলের
ইঞ্জিন বা পুলিশের গাড়িকে জনতার উৎসবে শামিল হতে দেখেছেন কখনও? আমি
দেখলাম। প্যারিসের শঁজে লিজে-তে দাঁড়িয়ে। কুড়ি বছর পরে ফ্রান্সের ফের
বিশ্বজয়ের আবেগের স্রোত তখন বয়ে যাচ্ছে ইতিহাসপ্রসিদ্ধ রাজপথে।
আবেগ কি শুধু প্যারিসে? খেলা শেষ হতেই মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট কোলিন্দা গ্রাবার-কিতারোভিচকে চুম্বন করলেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরঁ। আকাশ ভেঙে নেমে এল বৃষ্টি।আর আমি দেখছি শ্যাম্পেনের বৃষ্টি। তাই দাঁড়িয়েছি রাস্তার ধার ঘেঁষে। সারা বছর তো গাড়িগুলো এ ভাবে হর্ন বাজায় না! আজ তারা হর্ন বাজাচ্ছে পাগলের মতো। সেই সঙ্গে টানা বেজে চলেছে পুলিশ আর দমকলের গাড়ির সাইরেন! উদ্বেগে নয়, আনন্দে। গাড়ির গায়ে ঝুলছে ফ্রান্সের জাতীয় পতাকা। কত লোকের হাতে ভুভুজেলা, কেউ বা গান গাইছে। আকাশ আলোয়-আলো আতসবাজিতে।
ঢাকার নারায়ণগঞ্জের ছেলে আমি। প্যারিস ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছি। থাকি নোয়াজ়ি শ্য এলাকায়। প্যারিস এখান থেকে ট্রেনে ২০-২৫ মিনিট। প্রায় গোটা বিশ্বকাপটাই বাড়ির টিভিতে দেখেছি। এমনিতে আমি আড়ালজীবী মানুষ। বন্ধুদের পীড়াপীড়িতে সেমিফাইনাল দেখতে গিয়েছিলাম প্যারিসের ‘ওতেল দ্যু ভিল’-এর বড় স্ক্রিনে। সে কী পাগলামি! বুঝে গিয়েছিলাম, একটা ঢেউ এসেছে, আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যেতে।
অঁনে অঁ ফিনাল... অঁনে অঁ ফিনাল! আমরা ফাইনালে। সেমিফাইনালের পর থেকেই উড়ে বেড়াচ্ছিল সুরটা। ওই সুর মাথায় নিয়েই আজ তৈরি হচ্ছিলাম ফাইনাল দেখব বলে।
‘ওতেল দ্যু ভিল’-এই যেতাম। হঠাৎ সকালে ইরানের বন্ধু আলি-র ফোন। আমার পরিকল্পনা শুনে বলল, ‘‘পাগল! বাস্তিল প্যারেড যেখানে হয়, সেই শ্যন দু মার্সে এসো। কয়েক হাজার লোক বড় স্ক্রিনে খেলা দেখবে।’’
বেলা ২টো নাগাদ সেখানে পৌঁছে দেখি, যাহ্! গেট বন্ধ। বিন্দুমাত্র জায়গা নেই। এগোলাম শঁজে লিজের দিকে। একটা পানশালা দেখে মনে হল, এখানে খেলাটা দেখা যাবে। ঢুকে পড়লাম ‘দ্য আইডিয়াল বার’-এ। বসার জায়গা পাওয়ার প্রশ্ন নেই। ঠান্ডা পানীয়ের বোতল নিয়ে একটা টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে গেলাম।
‘‘আলে লে ব্ল্যু, আলে লে ব্ল্যু’’— টিভিতে চোখ রেখে ‘নীল দলের’ এগিয়ে যাওয়ার গান গাইছে সদ্য-যুবক থেকে বৃদ্ধ। টলতে টলতে একটা ছেলে এসে বলল, ‘‘দিনটা কিন্তু ফ্রান্সের।’’
খেলা শুরু হতেই গর্জনে কেঁপে উঠল বার। মদ্রিচকে টিভিতে দেখেই বিদ্রুপ— ‘‘বুড়োর দল, বাড়ি যাও!’’ সেখানে এমবাপেকে ওঁরা বলছেন ‘প্রোশেইন প্রেসিদঁ’। মানে? পরবর্তী প্রেসিডেন্ট! গোড়ায় অবশ্য ‘বুড়োদের’ বেশ ধারালোই মনে হচ্ছিল। এমন সময়ে আত্মঘাতী গোলে এগিয়ে গেল ফ্রান্স। দেখি, বারের মালিকও ভিড়ের মধ্যে এসে নাচছেন। আমি এক পাশে দাঁড়িয়ে ঘামতে ঘামতে লিখছিলাম। মালিকের স্ত্রী এগিয়ে এসে কথা বললেন। তার পর এক গ্লাস ঠান্ডা জল আর কয়েকটা টিসু দিয়ে গেলেন।
বলতে বলতে গোল শোধ ক্রোয়েশিয়ার! মনে হল, একটা বাজ পড়ল ঘরের মধ্যে। মদ্রিচ-পেরিসিচদের নিশানা করে ছুটল অভিশাপের বন্যা। এক বুড়ো তো বিয়ারের গ্লাসটাই ছুড়ে ফেললেন। তার পর গ্রিজম্যান, পোগবা, এমবাপে পরপর গোলগুলো করার পরে স্বস্তি পেলেন সবাই। অপেক্ষা তখন শুধু উৎসব শুরুর। শেষ বাঁশি বাজতেই ভিড়টা ছুটল দরজার দিকে। তাড়াতাড়ি পৌঁছতে হবে শঁজে লিজেতে!
আজ প্যারিসে রাত নেমেছে ঠিকই। নামেনি প্যারিসবাসীর চোখে।
সূত্রঃ আনন্দবাজার পত্রিকা
আবেগ কি শুধু প্যারিসে? খেলা শেষ হতেই মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট কোলিন্দা গ্রাবার-কিতারোভিচকে চুম্বন করলেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরঁ। আকাশ ভেঙে নেমে এল বৃষ্টি।আর আমি দেখছি শ্যাম্পেনের বৃষ্টি। তাই দাঁড়িয়েছি রাস্তার ধার ঘেঁষে। সারা বছর তো গাড়িগুলো এ ভাবে হর্ন বাজায় না! আজ তারা হর্ন বাজাচ্ছে পাগলের মতো। সেই সঙ্গে টানা বেজে চলেছে পুলিশ আর দমকলের গাড়ির সাইরেন! উদ্বেগে নয়, আনন্দে। গাড়ির গায়ে ঝুলছে ফ্রান্সের জাতীয় পতাকা। কত লোকের হাতে ভুভুজেলা, কেউ বা গান গাইছে। আকাশ আলোয়-আলো আতসবাজিতে।
ঢাকার নারায়ণগঞ্জের ছেলে আমি। প্যারিস ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছি। থাকি নোয়াজ়ি শ্য এলাকায়। প্যারিস এখান থেকে ট্রেনে ২০-২৫ মিনিট। প্রায় গোটা বিশ্বকাপটাই বাড়ির টিভিতে দেখেছি। এমনিতে আমি আড়ালজীবী মানুষ। বন্ধুদের পীড়াপীড়িতে সেমিফাইনাল দেখতে গিয়েছিলাম প্যারিসের ‘ওতেল দ্যু ভিল’-এর বড় স্ক্রিনে। সে কী পাগলামি! বুঝে গিয়েছিলাম, একটা ঢেউ এসেছে, আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যেতে।
অঁনে অঁ ফিনাল... অঁনে অঁ ফিনাল! আমরা ফাইনালে। সেমিফাইনালের পর থেকেই উড়ে বেড়াচ্ছিল সুরটা। ওই সুর মাথায় নিয়েই আজ তৈরি হচ্ছিলাম ফাইনাল দেখব বলে।
‘ওতেল দ্যু ভিল’-এই যেতাম। হঠাৎ সকালে ইরানের বন্ধু আলি-র ফোন। আমার পরিকল্পনা শুনে বলল, ‘‘পাগল! বাস্তিল প্যারেড যেখানে হয়, সেই শ্যন দু মার্সে এসো। কয়েক হাজার লোক বড় স্ক্রিনে খেলা দেখবে।’’
বেলা ২টো নাগাদ সেখানে পৌঁছে দেখি, যাহ্! গেট বন্ধ। বিন্দুমাত্র জায়গা নেই। এগোলাম শঁজে লিজের দিকে। একটা পানশালা দেখে মনে হল, এখানে খেলাটা দেখা যাবে। ঢুকে পড়লাম ‘দ্য আইডিয়াল বার’-এ। বসার জায়গা পাওয়ার প্রশ্ন নেই। ঠান্ডা পানীয়ের বোতল নিয়ে একটা টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে গেলাম।
‘‘আলে লে ব্ল্যু, আলে লে ব্ল্যু’’— টিভিতে চোখ রেখে ‘নীল দলের’ এগিয়ে যাওয়ার গান গাইছে সদ্য-যুবক থেকে বৃদ্ধ। টলতে টলতে একটা ছেলে এসে বলল, ‘‘দিনটা কিন্তু ফ্রান্সের।’’
খেলা শুরু হতেই গর্জনে কেঁপে উঠল বার। মদ্রিচকে টিভিতে দেখেই বিদ্রুপ— ‘‘বুড়োর দল, বাড়ি যাও!’’ সেখানে এমবাপেকে ওঁরা বলছেন ‘প্রোশেইন প্রেসিদঁ’। মানে? পরবর্তী প্রেসিডেন্ট! গোড়ায় অবশ্য ‘বুড়োদের’ বেশ ধারালোই মনে হচ্ছিল। এমন সময়ে আত্মঘাতী গোলে এগিয়ে গেল ফ্রান্স। দেখি, বারের মালিকও ভিড়ের মধ্যে এসে নাচছেন। আমি এক পাশে দাঁড়িয়ে ঘামতে ঘামতে লিখছিলাম। মালিকের স্ত্রী এগিয়ে এসে কথা বললেন। তার পর এক গ্লাস ঠান্ডা জল আর কয়েকটা টিসু দিয়ে গেলেন।
বলতে বলতে গোল শোধ ক্রোয়েশিয়ার! মনে হল, একটা বাজ পড়ল ঘরের মধ্যে। মদ্রিচ-পেরিসিচদের নিশানা করে ছুটল অভিশাপের বন্যা। এক বুড়ো তো বিয়ারের গ্লাসটাই ছুড়ে ফেললেন। তার পর গ্রিজম্যান, পোগবা, এমবাপে পরপর গোলগুলো করার পরে স্বস্তি পেলেন সবাই। অপেক্ষা তখন শুধু উৎসব শুরুর। শেষ বাঁশি বাজতেই ভিড়টা ছুটল দরজার দিকে। তাড়াতাড়ি পৌঁছতে হবে শঁজে লিজেতে!
আজ প্যারিসে রাত নেমেছে ঠিকই। নামেনি প্যারিসবাসীর চোখে।
সূত্রঃ আনন্দবাজার পত্রিকা
No comments