বাংলাদেশের নির্বাচনে একপেশে নীতি ভারতের পক্ষে যাবে না by ভারত ভূষণ
বাংলাদেশের
অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে পক্ষপাতপূর্ণ ভূমিকা রাখার মধ্য দিয়ে ভারত শ্রীলঙ্কা
ও নেপালের মতো একই ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারে। বৃটিশ আইনজীবী লর্ড
আলেক্সান্ডার কার্লাইলকে দ্রুত বিতাড়নের ঘটনা তেমন একটি বিষয়ই নির্দেশ করে।
কার্লাইল দিল্লিতে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে চলমান আইনি মামলার বিষয়ে দিল্লিতে একটি সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখতে চেয়েছিলেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি একটি বিজনেস ভিসা পেয়েছিলেন। কিন্তু এরকম একটি সাদামাটা ঘটনাকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঢাকার চাপের মুখে একটি সম্ভাবনাময় ফৌজদারি তৎপরতায় রূপান্তরিত করেছে। লর্ড কার্লাইল মধ্যরাতে অবাঞ্ছিত ঘোষিত হলেন।
লন্ডনে ফেরার পথে কার্লাইল একটি স্যাটেলাইট লিংকের মাধ্যমে ভারতের প্রেসের সঙ্গে কথা বলেন, যা গোটা অঞ্চল জুড়ে ব্যাপক মিডিয়া কাভারেজ লাভ করে, যেমন প্রচার হয়তো অন্যভাবে করা সম্ভব ছিল না।
এই ঘটনায় একটি সংকেত ছড়িয়ে পড়ল যে, বাংলাদেশের কেবল একটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সঙ্গেই ভারতের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। এই ঘটনা ঘটল এমন একটি সময়ে যখন ভারতীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের আগামী সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী বিএনপির সঙ্গে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত (এনগেজ) করতে শুরু’ করেছিলেন। এবং হঠাৎ করেই ওই ধরনের পদক্ষেপকে অগ্রাহ্য করা হলো এই বার্তা রটিয়ে যে, সম্পর্কটা আগের মতোই সংকীর্ণ এবং একপেশে রয়ে গেছে।
এর ফলে বিএনপির অভ্যন্তরে ভারতীয় বিরোধী মহল নতুন করে অক্সিজেন পেয়েছে। এতে দলটির ভেতরের সেই অংশটিকে কোণঠাসা করে ফেলেছে, যারা সাহসভরে ভারতের সঙ্গে নতুন করে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে নিজদেরকে স্পষ্টভাষী করে তুলেছিলেন। এই দৃষ্টিভঙ্গিটা যদি অ-শোধরানো অবস্থায় থেকেই যায়, তাহলে বাংলাদেশে তার সম্পর্ক উন্নয়নের পরিসর বাড়ানোর সুযোগ ভারত হাতছাড়া করবে। বাংলাদেশ ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচনে যাচ্ছে।
২০১৪ সালের যে সাধারণ নির্বাচনটি বিএনপি বয়কট করেছিল, সেই নির্বাচনে অনেকের মতে ভারত একটি পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকা পালন করেছিল। সামনের মাসগুলোতে বাংলাদেশে যেহেতু রাজনৈতিক ঝড়ো হাওয়া বৃদ্ধি পেতে থাকবে, তাই ভারত কিভাবে আচরণ করে সেটা গুরুত্বপূর্ণ বলে গণ্য হবে।
আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মধ্যে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এতটাই প্রকট যে, যখন যে ক্ষমতায় থাকে, তখন অন্যের জীবন ধারণ করাই প্রায় একটা অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ২০০৯ সালের পরে ২০১৪ সালে পুনরায় ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ তার অনুকূলে গড়ে তোলা একটি নির্বাচনী ব্যবস্থা উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে বিএনপিকে নাস্তানাবুদ করার চেষ্ট করেছে। সহজে প্রভাবিত করা যায় দেশটির এমন বিচারবিভাগ, সংসদ, নির্বাচন কমিশন, নির্বাহী বিভাগ এবং আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে এমনটা করা হয়েছে। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী চ্যালেঞ্জ জানানোর ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ব্যর্থ করে দিতে ওই যে ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে, বাংলাদেশিরা তাকে একটি ‘শান্তিপূর্ণ কারচুপি’ হিসেবে গণ্য করছেন।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি নিরেপক্ষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যুদ্ধ করেছিল। কিন্তু ক্ষমতায় এসেই তারা সেই বিধান বিলোপ করেছে। তত্ত্বাধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ৯০ দিন আগে সংসদ বিলোপ করতে হবে, যাতে ক্ষমতাসীন সংসদরা তাদের প্রতিপক্ষকে মোকাবিলায় একটি বিশেষ অনুকূল অবস্থা গ্রহণ না করতে পারে। ওই ইস্যুকে কেন্দ্র করেই বিএনপি ২০১৪ সালে নির্বাচন বয়কট করেছিল।
উপরন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নির্বাচনকালে সেনবাহিনীকে ব্যারাকে রাখতে আইন সংশোধন করেছিল। দৃশ্যত এটা একটা যুক্তিসঙ্গত পদক্ষেপ। কিন্তু ২০১৪ সালে যেভাবে ব্যাপকভিত্তিক সহিংসতা ও নৈরাজ্য সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল, তাতে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন দিতে বেসামরিক আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সামর্থ্য যে সত্যিই নেই, সেটাই প্রমাণিত হয়েছে। সুশিল সমাজের কর্মীরা প্রশ্ন তুলছেন সেনাবাহিনী যদি পাঁচ তারকা হোটেল, নির্মাণ প্রকল্প ও হাসপাতাল পরিচালনা করতে পারে, তাহলে তারা কেন নির্বাচনকালে ভোটারদের নিরাপত্তা দিতে পারবে না।
দেশটির নির্বাহী বিভাগ এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ইতিমধ্যেই সরকারের তালুবন্দি হয়ে পড়েছে, এই অবস্থায় বিরোধী দলের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা চালানোটাই কঠিন হয়ে পড়েছে, কারণ তাদের রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ করার অনুমতি নিয়মিতভাবে নাকচ করা হয়ে থাকে। নির্বাচন কমিশনের ক্ষেত্রে বিরোধী দলের অভিযোগ হলো এটি আওয়ামী লীগ সমর্থকদের দ্বারা গঠন করা হয়েছে।
সরকার তার প্রতিপক্ষকে অ?েযাগ্য ও অক্ষম করে তুলতে আইনি প্রক্রিয়া ব্যবহারকে একটি রুটিন মাফিক বিষয়ে পরিণত করে ফেলেছে। দুই বছর বা তার বেশি মেয়াদের কারাদণ্ড একজন প্রার্থীকে নির্বাচনে অযোগ্য করে। বেগম খালেদা জিয়াকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। বিএনপির অন্য শীর্ষ নেতারাও ফৌজদারি মামলা মেকাবিলা করছেন। এবং নির্বাচনের আগে তারাও কারাদণ্ড লাভ এবং নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা হতে পারেন। ১৮ লাখ বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে এপর্যন্ত প্রায় ৭৮ হাজার ফৌজদারি মামলা করা হয়েছে।
আরো অভিযোগ উঠেছে যে, সরকার দুতার্তে স্টাইলে মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনা করছে, যার আওতায় ইতিমধ্যে ১৩০ জনের বেশি লোকের মৃত্যু ঘটেছে। আর এই অভিযানটাও সরকারের ‘আগ্রহের ব্যক্তিদের’ বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে।
এমনকি বিরোধী দল যদি আগামী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ করে নিতেও পারে, তাহলেও তাকে ব্যালট কারচুপি, ভোটারদের ব্যালট পেপার না দেয়া এবং নির্বাচনী এজেন্টদের ধাওয়া করার মতো বিষয় মোকাবিলা করতে হবে। সামপ্রতিক স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে এসব কূটকৌশলের ব্যবহার লক্ষ্য করা গেছে, যাকে আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে প্রয়োগের একটি মহড়া হিসেবে দেখা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগ উপলব্ধি করেছে যে, তারা ২০১৪ সালের নির্বাচন, যেটি প্রধান বিরোধী দল বয়কট করেছিল, সেটির আর পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারবে না। বিরোধী দলের অংশ গ্রহণ ছাড়া তার বিজয়ের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। সেকারণে তারা বিএনপিকে প্রতিযোগিতায় দেখতে আগ্রহী, আর সেটা খণ্ডিত বিএনপির অংশগ্রহণ নির্ভর হলেও। তাই বিএনপিকে ভেঙ্গে ফেলার গুজব প্রবল। এই প্রক্রিয়ায় ভারতীয় এজেন্সিগুলো সম্পৃক্ত বলে অভিযোগ উঠছে।
এটা বোধগম্য যে, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে ভারত খুশি। শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে নিরাপত্তা সহযোগিতা চমৎকার। সীমান্ত সমস্যার নিষ্পত্তি ঘটেছে। এবং একটি ট্রানজিট চুক্তি সই হয়েছে।
এর বিপরীতে বিএনপির ১৯৯১-১৯৯৬ এবং ২০০১-২০০৫ শাসনামলে বাংলাদেশে ভারত বিরোধী ইসলামি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছিল। ভারতীয় বিদ্রোহীদের কাছে অস্ত্রের চোরাচালান পৌঁছাতে কক্সবাজার পরিণত হয়েছিল একটি পছন্দের বন্দরে। এছাড়া বিএনপি জোটের অংশীদার জামায়াত ইসলামি ভারতবিরোধী অবস্থানের জন্য পরিচিত।
কিন্তু যাই হোক না কেন, আগামী জানুয়ারিতে ঢাকায় যে সরকারই আসুক না কেন, তার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে ভারতকে প্রস্তুত থাকতে হবে। দুই দশক আগে বাংলাদেশ যেখানে ছিল সেখানে বাংলাদেশ নেই। এবং বিশ্বে ভারতের অবস্থানেরও পরিবর্তন ঘটেছে। এই বাস্তবতা উপলব্ধিতে নিতে বিএনপি একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। ২০১২ সালে বেগম খালেদা জিয়া তার দিল্লি সফরের সময় ঘোষণা করেছিলেন যে, যদি তার দল আবার ক্ষমতায় আসে তাহলে বাংলাদেশ ভূখণ্ডকে ভারতবিরোধী তৎপরতার জন্য আর কখনও ব্যবহার করতে দেয়া হবে না।
ভারতকে এখন শুধু তার ভালো উদ্দেশ্য ঘোষণা করলেই হবে না, ভারতকে এটা অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে যে, তারই ঘরের কাছে চীনের সঙ্গে তার স্ট্রেটেজিক প্রতিযোগিতা বিকাশমান পর্যায়ে রয়েছে। এই সন্ধিক্ষণে, বাংলাদেশে তার বিকল্পগুলো (রাজনৈতিক দল) বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে তার পক্ষে কোনো সংকীর্ণ নীতির অনুসরণ করাটা কোনো অর্থ বহন করে না। কারণ ভারত কোনো ভুল পদক্ষেপ নিলেই তা থেকে ফায়দা নিতে উদগ্রীব থাকবে বেইজিং। বাংলাদেশে একটি রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ঘনায়মান বলেই মনে হচ্ছে। তাই এই অবস্থায় বাংলাদেশ রাজনীতির কোনো খেলোয়াড়ের দিকেই ভারতের পক্ষে ঝুঁকে পড়া অবশ্যই কোনোমতে ঠিক হবে না। নেপাল, শ্রীলংকা ও মালদ্বীপ যেই পথে গেছে, সেই পথে বাংলাদেশকেও ঠেলে দেয়া ভারতের স্বার্থের অনুকূল হতে পারে না।
(লেখক ভারতভিত্তিক একজন সাংবাদিক, গতকাল বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডে প্রকাশিত তার নিবন্ধের অবিকল তর্জমা ছাপা হলো)
কার্লাইল দিল্লিতে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে চলমান আইনি মামলার বিষয়ে দিল্লিতে একটি সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখতে চেয়েছিলেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি একটি বিজনেস ভিসা পেয়েছিলেন। কিন্তু এরকম একটি সাদামাটা ঘটনাকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঢাকার চাপের মুখে একটি সম্ভাবনাময় ফৌজদারি তৎপরতায় রূপান্তরিত করেছে। লর্ড কার্লাইল মধ্যরাতে অবাঞ্ছিত ঘোষিত হলেন।
লন্ডনে ফেরার পথে কার্লাইল একটি স্যাটেলাইট লিংকের মাধ্যমে ভারতের প্রেসের সঙ্গে কথা বলেন, যা গোটা অঞ্চল জুড়ে ব্যাপক মিডিয়া কাভারেজ লাভ করে, যেমন প্রচার হয়তো অন্যভাবে করা সম্ভব ছিল না।
এই ঘটনায় একটি সংকেত ছড়িয়ে পড়ল যে, বাংলাদেশের কেবল একটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সঙ্গেই ভারতের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। এই ঘটনা ঘটল এমন একটি সময়ে যখন ভারতীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের আগামী সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী বিএনপির সঙ্গে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত (এনগেজ) করতে শুরু’ করেছিলেন। এবং হঠাৎ করেই ওই ধরনের পদক্ষেপকে অগ্রাহ্য করা হলো এই বার্তা রটিয়ে যে, সম্পর্কটা আগের মতোই সংকীর্ণ এবং একপেশে রয়ে গেছে।
এর ফলে বিএনপির অভ্যন্তরে ভারতীয় বিরোধী মহল নতুন করে অক্সিজেন পেয়েছে। এতে দলটির ভেতরের সেই অংশটিকে কোণঠাসা করে ফেলেছে, যারা সাহসভরে ভারতের সঙ্গে নতুন করে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে নিজদেরকে স্পষ্টভাষী করে তুলেছিলেন। এই দৃষ্টিভঙ্গিটা যদি অ-শোধরানো অবস্থায় থেকেই যায়, তাহলে বাংলাদেশে তার সম্পর্ক উন্নয়নের পরিসর বাড়ানোর সুযোগ ভারত হাতছাড়া করবে। বাংলাদেশ ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচনে যাচ্ছে।
২০১৪ সালের যে সাধারণ নির্বাচনটি বিএনপি বয়কট করেছিল, সেই নির্বাচনে অনেকের মতে ভারত একটি পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকা পালন করেছিল। সামনের মাসগুলোতে বাংলাদেশে যেহেতু রাজনৈতিক ঝড়ো হাওয়া বৃদ্ধি পেতে থাকবে, তাই ভারত কিভাবে আচরণ করে সেটা গুরুত্বপূর্ণ বলে গণ্য হবে।
আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মধ্যে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এতটাই প্রকট যে, যখন যে ক্ষমতায় থাকে, তখন অন্যের জীবন ধারণ করাই প্রায় একটা অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ২০০৯ সালের পরে ২০১৪ সালে পুনরায় ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ তার অনুকূলে গড়ে তোলা একটি নির্বাচনী ব্যবস্থা উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে বিএনপিকে নাস্তানাবুদ করার চেষ্ট করেছে। সহজে প্রভাবিত করা যায় দেশটির এমন বিচারবিভাগ, সংসদ, নির্বাচন কমিশন, নির্বাহী বিভাগ এবং আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে এমনটা করা হয়েছে। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী চ্যালেঞ্জ জানানোর ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ব্যর্থ করে দিতে ওই যে ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে, বাংলাদেশিরা তাকে একটি ‘শান্তিপূর্ণ কারচুপি’ হিসেবে গণ্য করছেন।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি নিরেপক্ষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যুদ্ধ করেছিল। কিন্তু ক্ষমতায় এসেই তারা সেই বিধান বিলোপ করেছে। তত্ত্বাধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ৯০ দিন আগে সংসদ বিলোপ করতে হবে, যাতে ক্ষমতাসীন সংসদরা তাদের প্রতিপক্ষকে মোকাবিলায় একটি বিশেষ অনুকূল অবস্থা গ্রহণ না করতে পারে। ওই ইস্যুকে কেন্দ্র করেই বিএনপি ২০১৪ সালে নির্বাচন বয়কট করেছিল।
উপরন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নির্বাচনকালে সেনবাহিনীকে ব্যারাকে রাখতে আইন সংশোধন করেছিল। দৃশ্যত এটা একটা যুক্তিসঙ্গত পদক্ষেপ। কিন্তু ২০১৪ সালে যেভাবে ব্যাপকভিত্তিক সহিংসতা ও নৈরাজ্য সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল, তাতে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন দিতে বেসামরিক আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সামর্থ্য যে সত্যিই নেই, সেটাই প্রমাণিত হয়েছে। সুশিল সমাজের কর্মীরা প্রশ্ন তুলছেন সেনাবাহিনী যদি পাঁচ তারকা হোটেল, নির্মাণ প্রকল্প ও হাসপাতাল পরিচালনা করতে পারে, তাহলে তারা কেন নির্বাচনকালে ভোটারদের নিরাপত্তা দিতে পারবে না।
দেশটির নির্বাহী বিভাগ এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ইতিমধ্যেই সরকারের তালুবন্দি হয়ে পড়েছে, এই অবস্থায় বিরোধী দলের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা চালানোটাই কঠিন হয়ে পড়েছে, কারণ তাদের রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ করার অনুমতি নিয়মিতভাবে নাকচ করা হয়ে থাকে। নির্বাচন কমিশনের ক্ষেত্রে বিরোধী দলের অভিযোগ হলো এটি আওয়ামী লীগ সমর্থকদের দ্বারা গঠন করা হয়েছে।
সরকার তার প্রতিপক্ষকে অ?েযাগ্য ও অক্ষম করে তুলতে আইনি প্রক্রিয়া ব্যবহারকে একটি রুটিন মাফিক বিষয়ে পরিণত করে ফেলেছে। দুই বছর বা তার বেশি মেয়াদের কারাদণ্ড একজন প্রার্থীকে নির্বাচনে অযোগ্য করে। বেগম খালেদা জিয়াকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। বিএনপির অন্য শীর্ষ নেতারাও ফৌজদারি মামলা মেকাবিলা করছেন। এবং নির্বাচনের আগে তারাও কারাদণ্ড লাভ এবং নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা হতে পারেন। ১৮ লাখ বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে এপর্যন্ত প্রায় ৭৮ হাজার ফৌজদারি মামলা করা হয়েছে।
আরো অভিযোগ উঠেছে যে, সরকার দুতার্তে স্টাইলে মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনা করছে, যার আওতায় ইতিমধ্যে ১৩০ জনের বেশি লোকের মৃত্যু ঘটেছে। আর এই অভিযানটাও সরকারের ‘আগ্রহের ব্যক্তিদের’ বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে।
এমনকি বিরোধী দল যদি আগামী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ করে নিতেও পারে, তাহলেও তাকে ব্যালট কারচুপি, ভোটারদের ব্যালট পেপার না দেয়া এবং নির্বাচনী এজেন্টদের ধাওয়া করার মতো বিষয় মোকাবিলা করতে হবে। সামপ্রতিক স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে এসব কূটকৌশলের ব্যবহার লক্ষ্য করা গেছে, যাকে আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে প্রয়োগের একটি মহড়া হিসেবে দেখা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগ উপলব্ধি করেছে যে, তারা ২০১৪ সালের নির্বাচন, যেটি প্রধান বিরোধী দল বয়কট করেছিল, সেটির আর পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারবে না। বিরোধী দলের অংশ গ্রহণ ছাড়া তার বিজয়ের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। সেকারণে তারা বিএনপিকে প্রতিযোগিতায় দেখতে আগ্রহী, আর সেটা খণ্ডিত বিএনপির অংশগ্রহণ নির্ভর হলেও। তাই বিএনপিকে ভেঙ্গে ফেলার গুজব প্রবল। এই প্রক্রিয়ায় ভারতীয় এজেন্সিগুলো সম্পৃক্ত বলে অভিযোগ উঠছে।
এটা বোধগম্য যে, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে ভারত খুশি। শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে নিরাপত্তা সহযোগিতা চমৎকার। সীমান্ত সমস্যার নিষ্পত্তি ঘটেছে। এবং একটি ট্রানজিট চুক্তি সই হয়েছে।
এর বিপরীতে বিএনপির ১৯৯১-১৯৯৬ এবং ২০০১-২০০৫ শাসনামলে বাংলাদেশে ভারত বিরোধী ইসলামি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছিল। ভারতীয় বিদ্রোহীদের কাছে অস্ত্রের চোরাচালান পৌঁছাতে কক্সবাজার পরিণত হয়েছিল একটি পছন্দের বন্দরে। এছাড়া বিএনপি জোটের অংশীদার জামায়াত ইসলামি ভারতবিরোধী অবস্থানের জন্য পরিচিত।
কিন্তু যাই হোক না কেন, আগামী জানুয়ারিতে ঢাকায় যে সরকারই আসুক না কেন, তার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে ভারতকে প্রস্তুত থাকতে হবে। দুই দশক আগে বাংলাদেশ যেখানে ছিল সেখানে বাংলাদেশ নেই। এবং বিশ্বে ভারতের অবস্থানেরও পরিবর্তন ঘটেছে। এই বাস্তবতা উপলব্ধিতে নিতে বিএনপি একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। ২০১২ সালে বেগম খালেদা জিয়া তার দিল্লি সফরের সময় ঘোষণা করেছিলেন যে, যদি তার দল আবার ক্ষমতায় আসে তাহলে বাংলাদেশ ভূখণ্ডকে ভারতবিরোধী তৎপরতার জন্য আর কখনও ব্যবহার করতে দেয়া হবে না।
ভারতকে এখন শুধু তার ভালো উদ্দেশ্য ঘোষণা করলেই হবে না, ভারতকে এটা অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে যে, তারই ঘরের কাছে চীনের সঙ্গে তার স্ট্রেটেজিক প্রতিযোগিতা বিকাশমান পর্যায়ে রয়েছে। এই সন্ধিক্ষণে, বাংলাদেশে তার বিকল্পগুলো (রাজনৈতিক দল) বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে তার পক্ষে কোনো সংকীর্ণ নীতির অনুসরণ করাটা কোনো অর্থ বহন করে না। কারণ ভারত কোনো ভুল পদক্ষেপ নিলেই তা থেকে ফায়দা নিতে উদগ্রীব থাকবে বেইজিং। বাংলাদেশে একটি রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ঘনায়মান বলেই মনে হচ্ছে। তাই এই অবস্থায় বাংলাদেশ রাজনীতির কোনো খেলোয়াড়ের দিকেই ভারতের পক্ষে ঝুঁকে পড়া অবশ্যই কোনোমতে ঠিক হবে না। নেপাল, শ্রীলংকা ও মালদ্বীপ যেই পথে গেছে, সেই পথে বাংলাদেশকেও ঠেলে দেয়া ভারতের স্বার্থের অনুকূল হতে পারে না।
(লেখক ভারতভিত্তিক একজন সাংবাদিক, গতকাল বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডে প্রকাশিত তার নিবন্ধের অবিকল তর্জমা ছাপা হলো)
No comments