হাফিজুর, আমাদের ক্ষমা করো by সোহরাব হাসান
ফরিদপুরের
গরিব অটোরিকশাচালকের মেধাবী সন্তান হাফিজুর মোল্লা ঢাকায় এসেছিলেন
উচ্চশিক্ষা নিতে। সেই উদ্দেশ্যে তিনি ভর্তিও হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
মার্কেটিং বিভাগে। কিন্তু তাঁর সেখানে আর পড়া হলো না। ভর্তির এক মাস না
যেতেই সরকার-সমর্থক ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের ‘বড় ভাইয়ের’ খপ্পরে পড়ে
নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে জীবনটাই হারাতে হলো তাঁকে।
হাফিজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও এই শহরে তাঁর থাকার কোনো জায়গা ছিল না। শুরুতে হলে সিট পাওয়ার সুযোগও কম। তাই ছাত্রলীগের ‘বড় ভাইদের’ ধরে তিনি উঠেছিলেন সলিমুল্লাহ মুসলিম (এসএম) হলে। থাকতেন দোতলার দক্ষিণ পাশের বারান্দায়। হল প্রশাসন এখন আর ছাত্রদের সিট বরাদ্দ করে না। সিট বা বারান্দা যা-ই হোক বরাদ্দ দেন সরকার-সমর্থক ছাত্র সংগঠনটির নেতারা।
পত্রিকার খবর অনুযায়ী, হলে ওঠার বিনিময়ে হাফিজুরকে ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে তালিম নিতে যেতে হতো। কিন্তু শীতের রাতের ধকল সইতে পারেননি তিনি। ফলে আক্রান্ত হন নিউমোনিয়া ও টাইফয়েডে। চলে যান গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলার সদরপুর ইউনিয়নের পূর্ব শ্যামপুরে। শারীরিক অবস্থা বেশি খারাপ হলে ভালো চিকিৎসার জন্য রওনা দেন ঢাকায়। গত মঙ্গলবার রাতে পথেই তিনি মারা যান।
এই মৃত্যুর জবাব কী? এটি কি কেবলই শারীরিক অসুস্থতা, না এর পেছনে আমাদের অসুস্থ ছাত্ররাজনীতিও দায়ী? হাফিজুরের সহপাঠী ও পরিবারের অভিযোগ, শীতের মধ্যে বারান্দায় থাকা এবং রাতের বেলায় ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে যাওয়ার কারণে হাফিজ ঠান্ডায় আক্রান্ত হন। অসুস্থ অবস্থায় তীব্র শীতের মধ্যেও হাফিজকে গত ২৬ জানুয়ারি রাতে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা বাইরে থাকতে হয়। তাঁকে প্রায়ই অন্য কর্মীদের সঙ্গে হলের মাঠে ‘গেস্টরুম’ করতে হতো। গেস্টরুম হচ্ছে ছাত্রলীগের একটি দলীয় রীতি। একটি নির্দিষ্ট সময়ে ছাত্রলীগের কনিষ্ঠ কর্মীদের সঙ্গে জ্যেষ্ঠরা বসে আলাপ-আলোচনা করেন। এ সময় তাঁদের ছাত্রলীগ করতে বা হলে থাকতে হলে কী করতে হবে, সে সম্পর্কে নির্দেশনা দেওয়া হয়।
হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক দিদার মুহাম্মদ নিজামুল ইসলাম জোর করে হাফিজুরকে কর্মসূচিতে নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তাঁর দাবি, ‘আমি নিজে ওকে হলে তুলেছি। বলেছি, কোনো ধরনের সমস্যা হলে আমাকে বলতে। কিন্তু সে এ নিয়ে আমাকে কখনোই কিছু বলেনি।’ দিদার হলে তুললেও ছাত্রলীগের অন্য কেউ যে হাফিজুরকে গেস্টরুম কর্মসূচিতে পাঠাননি সে কথা হলফ করে বলা যাবে না। বিভিন্ন হলে ছাত্রলীগের নানা গ্রুপ থাকে। এক গ্রুপের কর্মীকে অন্য গ্রুপে নিতে জবরদস্তি করার ঘটনাও আছে। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, হাফিজ আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন। তাই যদি হয়, সেই অসুস্থ অবস্থায় কারা তাঁকে রাতের ডিউটিতে পাঠিয়েছে, সেটি তদন্ত করে দেখা দরকার।
হাফিজুরের বাবা ইসহাক মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত সপ্তাহের বুধবার হাফিজ ঢাকা থেকে বাড়ি এসেছিল। প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে এসেছিল। কাঁদতে কাঁদতে বলছিল, “আমি আর বাঁচব না।” জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী হয়েছে। ও জানায়, শীতের মধ্যে বাইরে ‘‘ডিউটি’’ করতে হয়। ওই দিন নাকি সে ওদের বলেছে, তার শরীরটা ভালো না। ডিউটিতে যেতে পারবে না। কিন্তু তার পরও মাঠে নিয়ে গিয়ে রাত সাড়ে নয়টা থেকে একটা পর্যন্ত দাঁড় করিয়ে রেখেছে।’
একজন অসুস্থ তরুণকে রাত নয়টা থেকে একটা পর্যন্ত মাঠে দাঁড় করিয়ে রাখা কী ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি? এসব যাঁরা করেন, তাঁরা কীভাবে নিজেদের সুস্থ রাজনীতির বাহক বলে দাবি করেন। নবীনদের ছাত্র সংগঠনে আনার জন্য তাঁরা সভা-সমাবেশ করতে পারেন। দলীয় নীতি ও কর্মসূচি বোঝাতে পারেন। কিন্তু রাতের বেলায় চার ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখতে হবে কেন?
সন্তানকে হারিয়ে হাফিজুরের বাবা এখন দিশেহারা। মা পাগলপ্রায়। চার দিন ধরে বাড়িতে রান্না হয়নি। কিন্তু মা-বাবার আহাজারি আমাদের হৃদয়হীন সমাজকে এতটুকু নাড়া দিতে পেরেছে বলে মনে হয় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সলিমুল্লাহ হল কিংবা হাফিজুর যে বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন, সেই বিভাগের সবকিছুই স্বাভাবিকভাবে চলছে। কেউ তাঁর মৃত্যুতে শোক জানায়নি। বাবা-মার খোঁজ নেয়নি। এমনকি যে ছাত্র সংগঠনটির নেতারা হাফিজুরকে নিজেদের কর্মী বলে দাবি করেছেন, সেই সংগঠনটিও তাঁর শোকাহত বাবা-মাকে সামান্য সমবেদনা জানানোরও প্রয়োজন বোধ করেনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেছেন, ঘটনাটি গুরুতর কি না, তিনি পরখ করে দেখবেন। যে খবরটি দুদিন ধরে পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, সেটি পরখ করার কী আছে? হাফিজুর ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে ছাত্র সংঘাতের শিকার না হলেও গেস্টরুম কর্মসূচির নামে চালু হওয়া অপসংস্কৃতিরই বলি হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কি এই তথাকথিত গেস্টরুম সংস্কৃতি সম্পর্কে অবহিত? অবহিত হলে তারা এর বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছে? আর অবহিত না থাকলে হাফিজুরের মত্যুর দায় তাদেরও নিতে হবে। উচ্চশিক্ষার পাশাপাশি ক্যাম্পাসে অবস্থানরত সব শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষেরই।
এ ব্যাপারে সবচেয়ে নিষ্ঠুর মন্তব্য করেছেন সলিমুল্লাহ হলের প্রাধ্যক্ষ। তাঁর দাবি, বারান্দায় থাকলেও নিউমোনিয়া হতে পারে, না থাকলেও হতে পারে। আরও অনেকে বারান্দায় ছিলেন, তাঁদের নিউমোনিয়া হয়নি; কিন্তু হাফিজুরের হয়েছে। এ জন্য তাঁকেই দায়ী করেছেন এই প্রাধ্যক্ষ। হায় প্রাধ্যক্ষ! হায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়!
তার পরও আমরা আশা করব, হাফিজুরের মৃত্যু তাঁদের বিবেক জাগ্রত করতে না পারলেও কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙাবে। ক্যাম্পাসে গেস্টরুম সংস্কৃতির অবসান ঘটাবে। কয়েক বছর আগে শহীদুল্লাহ হলে ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে না যাওয়ার কারণে বেশ কিছু ছাত্রকে সারা রাত হলের বাইরে থাকতে বাধ্য করা হয়েছিল। সেবারে কর্তৃপক্ষ অন্যায়ের বিচার করলে হয়তো হাফিজুরকে শীতের রাতে নিউমোনিয়ায় ভুগে এভাবে মরতে হতো না।
হাফিজুরের বাবা জানেন, তিনি কখনো সন্তানকে ফিরে পাবেন না। তাই আকুতি জানিয়েছেন, যেন ভবিষ্যতে আর কারও সন্তান হাফিজুরের ভাগ্য না বরণ করেন। নিজের সন্তানের বিনিময়ে অন্যদের সন্তানকে নিরাপদ দেখতে চেয়েছেন এই মহান বাবা।
কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কি সন্তানহারা বাবার এই আকুতি শুনতে পাবে? তারা কি ক্যম্পাসে ছাত্ররাজনীতির নামে চলা অপসংস্কৃতি ও জবরদস্তি বন্ধ করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে? না প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনহীন ক্যাম্পাসে সরকার-সমর্থক ছাত্রলীগের সব অপকর্ম প্রশ্রয় দিতে থাকবে?
সদরপুরের দায়িত্বরত ভাঙ্গা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আলমগীর হোসেন তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে আমি লজ্জিত।’ কিন্তু এ লজ্জা তো তাঁর একার নয়। আমাদের সবার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে সেই লজ্জা স্পর্শ করবে কি না, তা ভবিষ্যৎই বলে দেবে।
‘হাফিজুর, আমরা তোমাকে বাঁচাতে পারিনি। এমনকি তোমার শোকাহত বাবা-মার কান্না মুছে দিতে আমাদের হাতও বাড়াতে পারিনি। আমাদের এই অক্ষমতা ও কাপুরুষতা ক্ষমা করো।’
হাফিজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও এই শহরে তাঁর থাকার কোনো জায়গা ছিল না। শুরুতে হলে সিট পাওয়ার সুযোগও কম। তাই ছাত্রলীগের ‘বড় ভাইদের’ ধরে তিনি উঠেছিলেন সলিমুল্লাহ মুসলিম (এসএম) হলে। থাকতেন দোতলার দক্ষিণ পাশের বারান্দায়। হল প্রশাসন এখন আর ছাত্রদের সিট বরাদ্দ করে না। সিট বা বারান্দা যা-ই হোক বরাদ্দ দেন সরকার-সমর্থক ছাত্র সংগঠনটির নেতারা।
পত্রিকার খবর অনুযায়ী, হলে ওঠার বিনিময়ে হাফিজুরকে ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে তালিম নিতে যেতে হতো। কিন্তু শীতের রাতের ধকল সইতে পারেননি তিনি। ফলে আক্রান্ত হন নিউমোনিয়া ও টাইফয়েডে। চলে যান গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলার সদরপুর ইউনিয়নের পূর্ব শ্যামপুরে। শারীরিক অবস্থা বেশি খারাপ হলে ভালো চিকিৎসার জন্য রওনা দেন ঢাকায়। গত মঙ্গলবার রাতে পথেই তিনি মারা যান।
এই মৃত্যুর জবাব কী? এটি কি কেবলই শারীরিক অসুস্থতা, না এর পেছনে আমাদের অসুস্থ ছাত্ররাজনীতিও দায়ী? হাফিজুরের সহপাঠী ও পরিবারের অভিযোগ, শীতের মধ্যে বারান্দায় থাকা এবং রাতের বেলায় ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে যাওয়ার কারণে হাফিজ ঠান্ডায় আক্রান্ত হন। অসুস্থ অবস্থায় তীব্র শীতের মধ্যেও হাফিজকে গত ২৬ জানুয়ারি রাতে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা বাইরে থাকতে হয়। তাঁকে প্রায়ই অন্য কর্মীদের সঙ্গে হলের মাঠে ‘গেস্টরুম’ করতে হতো। গেস্টরুম হচ্ছে ছাত্রলীগের একটি দলীয় রীতি। একটি নির্দিষ্ট সময়ে ছাত্রলীগের কনিষ্ঠ কর্মীদের সঙ্গে জ্যেষ্ঠরা বসে আলাপ-আলোচনা করেন। এ সময় তাঁদের ছাত্রলীগ করতে বা হলে থাকতে হলে কী করতে হবে, সে সম্পর্কে নির্দেশনা দেওয়া হয়।
হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক দিদার মুহাম্মদ নিজামুল ইসলাম জোর করে হাফিজুরকে কর্মসূচিতে নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তাঁর দাবি, ‘আমি নিজে ওকে হলে তুলেছি। বলেছি, কোনো ধরনের সমস্যা হলে আমাকে বলতে। কিন্তু সে এ নিয়ে আমাকে কখনোই কিছু বলেনি।’ দিদার হলে তুললেও ছাত্রলীগের অন্য কেউ যে হাফিজুরকে গেস্টরুম কর্মসূচিতে পাঠাননি সে কথা হলফ করে বলা যাবে না। বিভিন্ন হলে ছাত্রলীগের নানা গ্রুপ থাকে। এক গ্রুপের কর্মীকে অন্য গ্রুপে নিতে জবরদস্তি করার ঘটনাও আছে। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, হাফিজ আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন। তাই যদি হয়, সেই অসুস্থ অবস্থায় কারা তাঁকে রাতের ডিউটিতে পাঠিয়েছে, সেটি তদন্ত করে দেখা দরকার।
হাফিজুরের বাবা ইসহাক মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত সপ্তাহের বুধবার হাফিজ ঢাকা থেকে বাড়ি এসেছিল। প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে এসেছিল। কাঁদতে কাঁদতে বলছিল, “আমি আর বাঁচব না।” জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী হয়েছে। ও জানায়, শীতের মধ্যে বাইরে ‘‘ডিউটি’’ করতে হয়। ওই দিন নাকি সে ওদের বলেছে, তার শরীরটা ভালো না। ডিউটিতে যেতে পারবে না। কিন্তু তার পরও মাঠে নিয়ে গিয়ে রাত সাড়ে নয়টা থেকে একটা পর্যন্ত দাঁড় করিয়ে রেখেছে।’
একজন অসুস্থ তরুণকে রাত নয়টা থেকে একটা পর্যন্ত মাঠে দাঁড় করিয়ে রাখা কী ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি? এসব যাঁরা করেন, তাঁরা কীভাবে নিজেদের সুস্থ রাজনীতির বাহক বলে দাবি করেন। নবীনদের ছাত্র সংগঠনে আনার জন্য তাঁরা সভা-সমাবেশ করতে পারেন। দলীয় নীতি ও কর্মসূচি বোঝাতে পারেন। কিন্তু রাতের বেলায় চার ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখতে হবে কেন?
সন্তানকে হারিয়ে হাফিজুরের বাবা এখন দিশেহারা। মা পাগলপ্রায়। চার দিন ধরে বাড়িতে রান্না হয়নি। কিন্তু মা-বাবার আহাজারি আমাদের হৃদয়হীন সমাজকে এতটুকু নাড়া দিতে পেরেছে বলে মনে হয় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সলিমুল্লাহ হল কিংবা হাফিজুর যে বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন, সেই বিভাগের সবকিছুই স্বাভাবিকভাবে চলছে। কেউ তাঁর মৃত্যুতে শোক জানায়নি। বাবা-মার খোঁজ নেয়নি। এমনকি যে ছাত্র সংগঠনটির নেতারা হাফিজুরকে নিজেদের কর্মী বলে দাবি করেছেন, সেই সংগঠনটিও তাঁর শোকাহত বাবা-মাকে সামান্য সমবেদনা জানানোরও প্রয়োজন বোধ করেনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেছেন, ঘটনাটি গুরুতর কি না, তিনি পরখ করে দেখবেন। যে খবরটি দুদিন ধরে পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, সেটি পরখ করার কী আছে? হাফিজুর ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে ছাত্র সংঘাতের শিকার না হলেও গেস্টরুম কর্মসূচির নামে চালু হওয়া অপসংস্কৃতিরই বলি হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কি এই তথাকথিত গেস্টরুম সংস্কৃতি সম্পর্কে অবহিত? অবহিত হলে তারা এর বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছে? আর অবহিত না থাকলে হাফিজুরের মত্যুর দায় তাদেরও নিতে হবে। উচ্চশিক্ষার পাশাপাশি ক্যাম্পাসে অবস্থানরত সব শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষেরই।
এ ব্যাপারে সবচেয়ে নিষ্ঠুর মন্তব্য করেছেন সলিমুল্লাহ হলের প্রাধ্যক্ষ। তাঁর দাবি, বারান্দায় থাকলেও নিউমোনিয়া হতে পারে, না থাকলেও হতে পারে। আরও অনেকে বারান্দায় ছিলেন, তাঁদের নিউমোনিয়া হয়নি; কিন্তু হাফিজুরের হয়েছে। এ জন্য তাঁকেই দায়ী করেছেন এই প্রাধ্যক্ষ। হায় প্রাধ্যক্ষ! হায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়!
তার পরও আমরা আশা করব, হাফিজুরের মৃত্যু তাঁদের বিবেক জাগ্রত করতে না পারলেও কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙাবে। ক্যাম্পাসে গেস্টরুম সংস্কৃতির অবসান ঘটাবে। কয়েক বছর আগে শহীদুল্লাহ হলে ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে না যাওয়ার কারণে বেশ কিছু ছাত্রকে সারা রাত হলের বাইরে থাকতে বাধ্য করা হয়েছিল। সেবারে কর্তৃপক্ষ অন্যায়ের বিচার করলে হয়তো হাফিজুরকে শীতের রাতে নিউমোনিয়ায় ভুগে এভাবে মরতে হতো না।
হাফিজুরের বাবা জানেন, তিনি কখনো সন্তানকে ফিরে পাবেন না। তাই আকুতি জানিয়েছেন, যেন ভবিষ্যতে আর কারও সন্তান হাফিজুরের ভাগ্য না বরণ করেন। নিজের সন্তানের বিনিময়ে অন্যদের সন্তানকে নিরাপদ দেখতে চেয়েছেন এই মহান বাবা।
কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কি সন্তানহারা বাবার এই আকুতি শুনতে পাবে? তারা কি ক্যম্পাসে ছাত্ররাজনীতির নামে চলা অপসংস্কৃতি ও জবরদস্তি বন্ধ করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে? না প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনহীন ক্যাম্পাসে সরকার-সমর্থক ছাত্রলীগের সব অপকর্ম প্রশ্রয় দিতে থাকবে?
সদরপুরের দায়িত্বরত ভাঙ্গা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আলমগীর হোসেন তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে আমি লজ্জিত।’ কিন্তু এ লজ্জা তো তাঁর একার নয়। আমাদের সবার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে সেই লজ্জা স্পর্শ করবে কি না, তা ভবিষ্যৎই বলে দেবে।
‘হাফিজুর, আমরা তোমাকে বাঁচাতে পারিনি। এমনকি তোমার শোকাহত বাবা-মার কান্না মুছে দিতে আমাদের হাতও বাড়াতে পারিনি। আমাদের এই অক্ষমতা ও কাপুরুষতা ক্ষমা করো।’
No comments