সরকার কেন মুনাফা করবে? by মইনুল ইসলাম
২
ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে বিদ্যুতের দাম না কমিয়ে
উল্টো এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে ২৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ দাম
বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এবং বিতরণ
কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে এবং প্রস্তাবটি প্রক্রিয়াধীন। দেশের বিরোধী
রাজনীতি কোণঠাসা হয়ে যাওয়ায় ক্ষমতাসীনেরা যে তুঘলকি কাণ্ড-কারখানা শুরু
করার মওকা পেয়ে গেছে, তারই নজির হয়তো এই খবরটি। কিন্তু এর ফলে জনগণ যেমনি
জ্বালানি তেল এবং বিদ্যুতের দাম কমার উপকার ও সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন,
তেমনি উৎপাদকেরাও ব্যয় সাশ্রয়ের সুযোগ হারাচ্ছেন। জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার
বাড়ানোর একটা স্বর্ণ-সুযোগ থেকেও এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারকেরা
জাতিকে বঞ্চিত করছেন।
গত ১৬ জানুয়ারি প্রথম আলোতে প্রকাশিত কলামে আমি জ্বালানি তেলের দাম কমানোর জন্য নীতি-প্রণেতাদের অনুরোধ জানিয়েছিলাম। কারণ, দাম না কমানোর যুক্তিগুলো বহু আগেই খোঁড়া যুক্তিতে পর্যবসিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম দেড় বছর আগের পর্যায় থেকে ধাপে ধাপে কমে এক-পঞ্চমাংশেরও নিচে নেমে আসা সত্ত্বেও এই গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের দামের ধস নামার সুবিধা থেকে জনগণকে বঞ্চিত করা কোনো যুক্তিতে গ্রহণযোগ্য নয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, কর্তৃপক্ষ যেন পণ করেছে যে তারা কোনো যুক্তির তোয়াক্কা করবে না। (প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে নানা কৌশলে ক্ষমতাসীন জোট এত ব্যতিব্যস্ত রেখেছে যে এই ইস্যুতে জনমতকে সংগঠিত করে আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলার ক্ষমতাও তাদের তিরোহিত হয়ে গেছে। আর গৃহপালিত বিরোধী দল জাতীয় পার্টি যে এই ইস্যুতে সরকারকে বিব্রত করবে না, সরকার সেটা বোঝে।) কিন্তু জ্বালানি তেল এবং বিদ্যুৎ নিয়ে সরকারের মুনাফাবাজি অনৈতিক এবং ‘হাফ-বেকড অর্থনীতি’।
জ্বালানি তেল এবং বিদ্যুৎ বর্তমান যুগে একটি উন্নয়নগামী দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম মুখ্য চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। আমাদের দেশে জনগণের এক-তৃতীয়াংশের কাছে স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও আজও বিদ্যুৎ পৌঁছানো যায়নি। মহামতি লেনিনকে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার পর জিজ্ঞেস করা হয়েছিল বিপ্লব কী? লেনিন জবাব দিয়েছিলেন, বিপ্লব মানে হলো দেশকে বিদ্যুতায়িতকরণ (রেভল্যুশন ইজ ইলেকট্রিফিকেশন)। এই অগ্রাধিকারের ফলে ৮৭ লাখ বর্গমাইল আয়তনসম্পন্ন তদানীন্তন বিশ্বের এই সর্ববৃহৎ দেশটিকে ১৯১৭ সালের বিপ্লবের মাত্র ১৬ বছরের মধ্যেই ১৯৩৩ সালে বিদ্যুতায়নের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছিল। (বাংলাদেশের আয়তন মাত্র ৫৫ হাজার ৫৬১ বর্গমাইল।) গণচীনও ১৯৪৯ সালের বিপ্লবের দুই দশকের মধ্যে সারা দেশকে বিদ্যুতায়িত করেছিল। অথচ আমরা স্বাধীনতা অর্জনের ৪৫ বছর পরও এই অবশ্যকরণীয় কাজটি করতে পারলাম না! আরও লজ্জাজনক হলো, ২০০১-০৬ সালে বিদ্যুৎ খাতে এ দেশের বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার অবিশ্বাস্য ব্যর্থতার ইতিহাস রচনা করেছিল। তাদের পাঁচ বছরের শাসনামলে টঙ্গীতে একটি ৮০ মেগাওয়াটের ‘পিকিং প্ল্যান্ট’ ছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্প্রসারণের আর কোনো ব্যবস্থা করা যায়নি, শুধু বিদ্যুতের খাম্বা স্থাপন করে শত শত কোটি টাকা লুটপাটের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ফলে ২০০১ সালের ৪ হাজার ২০০ মেগাওয়াট থেকে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন-সক্ষমতা ২০০৬ সালের শেষে ৩ হাজার ২০০ মেগাওয়াটে নেমে এসেছিল পুরোনো বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলোর উৎপাদন বন্ধ বা হ্রাস পাওয়ার কারণে। লোডশেডিং ওই সময়ে কী ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল, সেটা জনগণ নিশ্চয়ই ভুলে যায়নি। এই বিপর্যয় থেকে বর্তমান সরকার জনগণকে উদ্ধার করেছে বলা চলে। (এর জন্য ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারকেও কৃতিত্ব দিতে হবে।) গত সাত বছরে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বেড়ে ১৩ হাজার মেগাওয়াট অতিক্রম করেছে।
আমরা জানি যে সরকার স্বল্প মেয়াদে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি করার প্রয়োজনে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট স্থাপনের একটি ইমার্জেন্সি কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল, যে প্ল্যান্টগুলোর ঠিকাদারি বোধগম্যভাবেই ক্ষমতাসীন জোটের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী/শিল্পপতি এবং জোটের নেতা-কর্মীরাই বাগিয়ে নিয়েছেন। ওই ঠিকাদারিগুলো অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় সরকারি প্রকল্প অনুমোদনের প্রচলিত নিয়মকানুনগুলো অনুসরণ করা হয়নি সময় বাঁচানোর অজুহাতে এবং এ জন্য যেন দুর্নীতির মামলা-মোকদ্দমা করা না যায়, সে জন্য একটি ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ও জারি করা হয়। ওয়াকিবহাল মহলের জানার কথা যে কর্তৃপক্ষের কারও কারও যোগসাজশে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল প্ল্যান্টগুলো থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনার জন্য ব্যয়সাশ্রয়ী সরকারি খাতের প্ল্যান্টগুলোকে অনেক সময় অব্যবহৃত রাখা হচ্ছিল। স্বল্পমেয়াদি এই জরুরি ব্যবস্থার পাশাপাশি মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য আমদানি করা কয়লাভিত্তিক বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট স্থাপনের জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট স্থাপনের মাধ্যমে ২০২৪ সালে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রক্রিয়াও শুরু করা হয়েছে। বিদ্যুৎ খাতে বর্তমান সরকারের এসব পদক্ষেপ যে দেশকে একটা অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের শঙ্কা থেকে রক্ষা করেছে, সেটা এখন দেশে-বিদেশে প্রশংসিত।
অনেক বেশি ব্যয়বহুল বিদ্যুৎ উৎপাদন সত্ত্বেও যে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল প্ল্যান্টগুলোকে চরম সংকট মোকাবিলার জন্য স্থাপন করা হয়েছে, সেগুলোকে কয়েক বছর আগেই ধাপে ধাপে বিদায় করার কথা ছিল। কিন্তু ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে রহস্যজনকভাবে কালক্ষেপণ লক্ষ করা যাচ্ছে। ক্ষমতাকেন্দ্রের সঙ্গে দহরম-মহরম রক্ষাকারী এসব প্ল্যান্টগুলোর মালিকেরা জোর-তদবির চালিয়ে তাঁদের ভাড়ায় বিদ্যুৎ বিক্রয়ের ঠিকাদারির মেয়াদ বারবার নবায়ন করিয়ে নিচ্ছেন এবং এর পেছনে নগদ নারায়ণের ভূমিকা থাকার অভিযোগ উঠেছে। এই স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নও ইচ্ছাকৃতভাবে বিলম্বিত করা হচ্ছে বলে কয়েকজন বিশ্লেষক অভিযোগ তুলেছেন। আরও গুরুতর ব্যাপার হলো, এখন যখন আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৩০ ডলারের নিচে নেমে এসেছে, তখন ওপরের হিসাবনিকাশগুলো সব ওলটপালট হয়ে গেছে। জ্বালানি তেলের উচ্চ দামের সময় ওই রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলোতে ডিজেল এবং ফার্নেস অয়েল ব্যবহার করে যেহেতু বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছিল, তাই ওগুলোতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ পড়ছিল ১৫ থেকে ২০ টাকা। (ওগুলো থেকে বিদ্যুৎ না কিনলেও মিনিমাম চার্জ পরিশোধ করার নিয়ম রয়েছে।) আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম হু হু করে বাড়তে বাড়তে যখন ব্যারেলপ্রতি প্রায় ১৫০ ডলারের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল, তখন তার সঙ্গে সঙ্গে জ্বালানি ও বিদ্যুতের দামকে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে এ দেশে বাড়ানো হয়নি অর্থনীতিতে ওই দাম বৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাবের বিবেচনায়। ফলে সরকারকে প্রচুর ভর্তুকি দিতে হয়েছে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল প্যান্টগুলো থেকে বিদ্যুৎ কিনে ওই বিদ্যুৎ প্রতি ইউনিট গড়ে ছয় টাকায় বা তারও কমে গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করতে হওয়ায়। ওই ভর্তুকির বোঝা বহন করতে হয়েছে একদিকে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে এবং অন্যদিকে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে। তাই এই দুটো সংস্থাকে বাজেট-সহায়তা ও ঋণসহায়তা দিতে হয়েছে সরকারকে। (সরকারের বাজেট ঘাটতিকে সামাল দেওয়ার জন্য কিছুদিন আগেও বিদ্যুতের সক্ষমতা অব্যবহৃত রেখে ঘন ঘন লোডশেডিং করতে হতো, এটা এখন অনেকে হয়তো ভুলে গেছেন!) কিন্তু তেলের আন্তর্জাতিক দাম গত দেড় বছরে ক্রমাগত কমে ৩০ ডলারের নিচে চলে আসায় বর্তমানে নিচে উল্লিখিত মুনাফাবাজির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে:
১) বর্তমানে প্রতি লিটার অকটেন উৎপাদন খরচ কমে দাঁড়িয়েছে ৫০ টাকারও কম আর পেট্রলের উৎপাদন খরচ পড়ছে ৪০ টাকার মতো। অথচ দেশে এক লিটার অকটেনের বর্তমান দাম ৯৯ টাকা এবং পেট্রলের দাম ৯০ টাকা। তার মানে, এই দুটো পণ্যে ১০০ শতাংশের বেশি মুনাফা করছে পেট্রোলিয়াম করপোরেশন।
২) এ দেশে সবচেয়ে বেশি বিক্রীত জ্বালানি তেল ডিজেলের লিটারপ্রতি আমদানি খরচ পড়ছে ৪০ টাকার কম। অথচ এক লিটার ডিজেল বিক্রি করা হচ্ছে ৬৮ টাকায়। এ ক্ষেত্রে মুনাফার হার ৭০ শতাংশ।
৩) ফার্নেস অয়েলের ক্রয়মূল্য পড়ছে ২৫ টাকা। বিক্রয়মূল্য নির্ধারিত রয়েছে ৬২ টাকা। অতএব, এ ক্ষেত্রে মুনাফা করা হচ্ছে ১৪৮ শতাংশ।
৪) ১১টি রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কোম্পানিকে এখন সরাসরি জ্বালানি তেল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। অতএব, তাদের প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ এখন ছয় টাকার নিচে নেমে এসেছে। অথচ পিডিবি বিদ্যুতের গড় বিক্রয়মূল্য পাচ্ছে ছয় টাকার বেশি। তাহলে তাদের লোকসান হচ্ছে কীভাবে? আর সরকারি ভর্তুকি লাগছে কোথায়? এমতাবস্থায় দাম বাড়ানোর আবদারের কী যুক্তি? সামিট পাওয়ারের জনৈক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও ব্যাপারটা স্বীকার করেছেন। (যেসব রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট এ সুবিধা পায়নি, তারা সরকারি দাম ৬২ টাকায় এক লিটার ফার্নেস অয়েল কিনছে অথবা ৬৮ টাকায় ডিজেল কিনছে এবং তাদের খরচ পড়ছে ইউনিটপ্রতি ১৫ থেকে ২০ টাকা। ওই দামে সরকার বিদ্যুৎ কিনছে তাদের কাছ থেকে, ভর্তুকি দিতে হচ্ছে ইউনিটপ্রতি ৯ থেকে ১৪ টাকা। পিডিবিকে লোকসানের অজুহাতে ভর্তুকি প্রদানের এই তেলেসমাতি কার স্বার্থে?)
ওপরের হিসাবগুলোর আলোকে বলতে চাই, দেশবাসী জ্বালানি তেল এবং বিদ্যুৎ নিয়ে সরকারের মুনাফাবাজি থেকে রেহাই পেতে চায়। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন তাদের টার্মস অব রেফারেন্স অনুযায়ী সরকারের আজ্ঞাবহ না হয়ে জ্বালানি তেলের বর্তমান আন্তর্জাতিক দামের ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করে জ্বালানি তেল এবং বিদ্যুতের অভ্যন্তরীণ দাম সমন্বয়ের সাহস দেখাতে পারলে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো দূরে থাক, কমানোই এখন যৌক্তিক। এই পরিপ্রেক্ষিতে অনতিবিলম্বে কমিশন কর্তৃক ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি ৪০ টাকা, ফার্নেস অয়েলের দাম ২৫ টাকা, কেরোসিনের দাম ২০ টাকা, পেট্রলের দাম ৬০ টাকা এবং অকটেনের দাম ৭০ টাকায় পুনর্নির্ধারণের দাবি সময়োপযোগী মনে করি।
মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
গত ১৬ জানুয়ারি প্রথম আলোতে প্রকাশিত কলামে আমি জ্বালানি তেলের দাম কমানোর জন্য নীতি-প্রণেতাদের অনুরোধ জানিয়েছিলাম। কারণ, দাম না কমানোর যুক্তিগুলো বহু আগেই খোঁড়া যুক্তিতে পর্যবসিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম দেড় বছর আগের পর্যায় থেকে ধাপে ধাপে কমে এক-পঞ্চমাংশেরও নিচে নেমে আসা সত্ত্বেও এই গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের দামের ধস নামার সুবিধা থেকে জনগণকে বঞ্চিত করা কোনো যুক্তিতে গ্রহণযোগ্য নয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, কর্তৃপক্ষ যেন পণ করেছে যে তারা কোনো যুক্তির তোয়াক্কা করবে না। (প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে নানা কৌশলে ক্ষমতাসীন জোট এত ব্যতিব্যস্ত রেখেছে যে এই ইস্যুতে জনমতকে সংগঠিত করে আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলার ক্ষমতাও তাদের তিরোহিত হয়ে গেছে। আর গৃহপালিত বিরোধী দল জাতীয় পার্টি যে এই ইস্যুতে সরকারকে বিব্রত করবে না, সরকার সেটা বোঝে।) কিন্তু জ্বালানি তেল এবং বিদ্যুৎ নিয়ে সরকারের মুনাফাবাজি অনৈতিক এবং ‘হাফ-বেকড অর্থনীতি’।
জ্বালানি তেল এবং বিদ্যুৎ বর্তমান যুগে একটি উন্নয়নগামী দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম মুখ্য চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। আমাদের দেশে জনগণের এক-তৃতীয়াংশের কাছে স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও আজও বিদ্যুৎ পৌঁছানো যায়নি। মহামতি লেনিনকে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার পর জিজ্ঞেস করা হয়েছিল বিপ্লব কী? লেনিন জবাব দিয়েছিলেন, বিপ্লব মানে হলো দেশকে বিদ্যুতায়িতকরণ (রেভল্যুশন ইজ ইলেকট্রিফিকেশন)। এই অগ্রাধিকারের ফলে ৮৭ লাখ বর্গমাইল আয়তনসম্পন্ন তদানীন্তন বিশ্বের এই সর্ববৃহৎ দেশটিকে ১৯১৭ সালের বিপ্লবের মাত্র ১৬ বছরের মধ্যেই ১৯৩৩ সালে বিদ্যুতায়নের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছিল। (বাংলাদেশের আয়তন মাত্র ৫৫ হাজার ৫৬১ বর্গমাইল।) গণচীনও ১৯৪৯ সালের বিপ্লবের দুই দশকের মধ্যে সারা দেশকে বিদ্যুতায়িত করেছিল। অথচ আমরা স্বাধীনতা অর্জনের ৪৫ বছর পরও এই অবশ্যকরণীয় কাজটি করতে পারলাম না! আরও লজ্জাজনক হলো, ২০০১-০৬ সালে বিদ্যুৎ খাতে এ দেশের বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার অবিশ্বাস্য ব্যর্থতার ইতিহাস রচনা করেছিল। তাদের পাঁচ বছরের শাসনামলে টঙ্গীতে একটি ৮০ মেগাওয়াটের ‘পিকিং প্ল্যান্ট’ ছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্প্রসারণের আর কোনো ব্যবস্থা করা যায়নি, শুধু বিদ্যুতের খাম্বা স্থাপন করে শত শত কোটি টাকা লুটপাটের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ফলে ২০০১ সালের ৪ হাজার ২০০ মেগাওয়াট থেকে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন-সক্ষমতা ২০০৬ সালের শেষে ৩ হাজার ২০০ মেগাওয়াটে নেমে এসেছিল পুরোনো বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলোর উৎপাদন বন্ধ বা হ্রাস পাওয়ার কারণে। লোডশেডিং ওই সময়ে কী ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল, সেটা জনগণ নিশ্চয়ই ভুলে যায়নি। এই বিপর্যয় থেকে বর্তমান সরকার জনগণকে উদ্ধার করেছে বলা চলে। (এর জন্য ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারকেও কৃতিত্ব দিতে হবে।) গত সাত বছরে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বেড়ে ১৩ হাজার মেগাওয়াট অতিক্রম করেছে।
আমরা জানি যে সরকার স্বল্প মেয়াদে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি করার প্রয়োজনে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট স্থাপনের একটি ইমার্জেন্সি কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল, যে প্ল্যান্টগুলোর ঠিকাদারি বোধগম্যভাবেই ক্ষমতাসীন জোটের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী/শিল্পপতি এবং জোটের নেতা-কর্মীরাই বাগিয়ে নিয়েছেন। ওই ঠিকাদারিগুলো অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় সরকারি প্রকল্প অনুমোদনের প্রচলিত নিয়মকানুনগুলো অনুসরণ করা হয়নি সময় বাঁচানোর অজুহাতে এবং এ জন্য যেন দুর্নীতির মামলা-মোকদ্দমা করা না যায়, সে জন্য একটি ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ও জারি করা হয়। ওয়াকিবহাল মহলের জানার কথা যে কর্তৃপক্ষের কারও কারও যোগসাজশে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল প্ল্যান্টগুলো থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনার জন্য ব্যয়সাশ্রয়ী সরকারি খাতের প্ল্যান্টগুলোকে অনেক সময় অব্যবহৃত রাখা হচ্ছিল। স্বল্পমেয়াদি এই জরুরি ব্যবস্থার পাশাপাশি মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য আমদানি করা কয়লাভিত্তিক বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট স্থাপনের জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট স্থাপনের মাধ্যমে ২০২৪ সালে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রক্রিয়াও শুরু করা হয়েছে। বিদ্যুৎ খাতে বর্তমান সরকারের এসব পদক্ষেপ যে দেশকে একটা অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের শঙ্কা থেকে রক্ষা করেছে, সেটা এখন দেশে-বিদেশে প্রশংসিত।
অনেক বেশি ব্যয়বহুল বিদ্যুৎ উৎপাদন সত্ত্বেও যে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল প্ল্যান্টগুলোকে চরম সংকট মোকাবিলার জন্য স্থাপন করা হয়েছে, সেগুলোকে কয়েক বছর আগেই ধাপে ধাপে বিদায় করার কথা ছিল। কিন্তু ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে রহস্যজনকভাবে কালক্ষেপণ লক্ষ করা যাচ্ছে। ক্ষমতাকেন্দ্রের সঙ্গে দহরম-মহরম রক্ষাকারী এসব প্ল্যান্টগুলোর মালিকেরা জোর-তদবির চালিয়ে তাঁদের ভাড়ায় বিদ্যুৎ বিক্রয়ের ঠিকাদারির মেয়াদ বারবার নবায়ন করিয়ে নিচ্ছেন এবং এর পেছনে নগদ নারায়ণের ভূমিকা থাকার অভিযোগ উঠেছে। এই স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নও ইচ্ছাকৃতভাবে বিলম্বিত করা হচ্ছে বলে কয়েকজন বিশ্লেষক অভিযোগ তুলেছেন। আরও গুরুতর ব্যাপার হলো, এখন যখন আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৩০ ডলারের নিচে নেমে এসেছে, তখন ওপরের হিসাবনিকাশগুলো সব ওলটপালট হয়ে গেছে। জ্বালানি তেলের উচ্চ দামের সময় ওই রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলোতে ডিজেল এবং ফার্নেস অয়েল ব্যবহার করে যেহেতু বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছিল, তাই ওগুলোতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ পড়ছিল ১৫ থেকে ২০ টাকা। (ওগুলো থেকে বিদ্যুৎ না কিনলেও মিনিমাম চার্জ পরিশোধ করার নিয়ম রয়েছে।) আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম হু হু করে বাড়তে বাড়তে যখন ব্যারেলপ্রতি প্রায় ১৫০ ডলারের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল, তখন তার সঙ্গে সঙ্গে জ্বালানি ও বিদ্যুতের দামকে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে এ দেশে বাড়ানো হয়নি অর্থনীতিতে ওই দাম বৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাবের বিবেচনায়। ফলে সরকারকে প্রচুর ভর্তুকি দিতে হয়েছে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল প্যান্টগুলো থেকে বিদ্যুৎ কিনে ওই বিদ্যুৎ প্রতি ইউনিট গড়ে ছয় টাকায় বা তারও কমে গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করতে হওয়ায়। ওই ভর্তুকির বোঝা বহন করতে হয়েছে একদিকে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে এবং অন্যদিকে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে। তাই এই দুটো সংস্থাকে বাজেট-সহায়তা ও ঋণসহায়তা দিতে হয়েছে সরকারকে। (সরকারের বাজেট ঘাটতিকে সামাল দেওয়ার জন্য কিছুদিন আগেও বিদ্যুতের সক্ষমতা অব্যবহৃত রেখে ঘন ঘন লোডশেডিং করতে হতো, এটা এখন অনেকে হয়তো ভুলে গেছেন!) কিন্তু তেলের আন্তর্জাতিক দাম গত দেড় বছরে ক্রমাগত কমে ৩০ ডলারের নিচে চলে আসায় বর্তমানে নিচে উল্লিখিত মুনাফাবাজির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে:
১) বর্তমানে প্রতি লিটার অকটেন উৎপাদন খরচ কমে দাঁড়িয়েছে ৫০ টাকারও কম আর পেট্রলের উৎপাদন খরচ পড়ছে ৪০ টাকার মতো। অথচ দেশে এক লিটার অকটেনের বর্তমান দাম ৯৯ টাকা এবং পেট্রলের দাম ৯০ টাকা। তার মানে, এই দুটো পণ্যে ১০০ শতাংশের বেশি মুনাফা করছে পেট্রোলিয়াম করপোরেশন।
২) এ দেশে সবচেয়ে বেশি বিক্রীত জ্বালানি তেল ডিজেলের লিটারপ্রতি আমদানি খরচ পড়ছে ৪০ টাকার কম। অথচ এক লিটার ডিজেল বিক্রি করা হচ্ছে ৬৮ টাকায়। এ ক্ষেত্রে মুনাফার হার ৭০ শতাংশ।
৩) ফার্নেস অয়েলের ক্রয়মূল্য পড়ছে ২৫ টাকা। বিক্রয়মূল্য নির্ধারিত রয়েছে ৬২ টাকা। অতএব, এ ক্ষেত্রে মুনাফা করা হচ্ছে ১৪৮ শতাংশ।
৪) ১১টি রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কোম্পানিকে এখন সরাসরি জ্বালানি তেল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। অতএব, তাদের প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ এখন ছয় টাকার নিচে নেমে এসেছে। অথচ পিডিবি বিদ্যুতের গড় বিক্রয়মূল্য পাচ্ছে ছয় টাকার বেশি। তাহলে তাদের লোকসান হচ্ছে কীভাবে? আর সরকারি ভর্তুকি লাগছে কোথায়? এমতাবস্থায় দাম বাড়ানোর আবদারের কী যুক্তি? সামিট পাওয়ারের জনৈক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও ব্যাপারটা স্বীকার করেছেন। (যেসব রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট এ সুবিধা পায়নি, তারা সরকারি দাম ৬২ টাকায় এক লিটার ফার্নেস অয়েল কিনছে অথবা ৬৮ টাকায় ডিজেল কিনছে এবং তাদের খরচ পড়ছে ইউনিটপ্রতি ১৫ থেকে ২০ টাকা। ওই দামে সরকার বিদ্যুৎ কিনছে তাদের কাছ থেকে, ভর্তুকি দিতে হচ্ছে ইউনিটপ্রতি ৯ থেকে ১৪ টাকা। পিডিবিকে লোকসানের অজুহাতে ভর্তুকি প্রদানের এই তেলেসমাতি কার স্বার্থে?)
ওপরের হিসাবগুলোর আলোকে বলতে চাই, দেশবাসী জ্বালানি তেল এবং বিদ্যুৎ নিয়ে সরকারের মুনাফাবাজি থেকে রেহাই পেতে চায়। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন তাদের টার্মস অব রেফারেন্স অনুযায়ী সরকারের আজ্ঞাবহ না হয়ে জ্বালানি তেলের বর্তমান আন্তর্জাতিক দামের ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করে জ্বালানি তেল এবং বিদ্যুতের অভ্যন্তরীণ দাম সমন্বয়ের সাহস দেখাতে পারলে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো দূরে থাক, কমানোই এখন যৌক্তিক। এই পরিপ্রেক্ষিতে অনতিবিলম্বে কমিশন কর্তৃক ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি ৪০ টাকা, ফার্নেস অয়েলের দাম ২৫ টাকা, কেরোসিনের দাম ২০ টাকা, পেট্রলের দাম ৬০ টাকা এবং অকটেনের দাম ৭০ টাকায় পুনর্নির্ধারণের দাবি সময়োপযোগী মনে করি।
মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments