এটা অন্যায়, এটা অবিচার by আসিফ নজরুল

শারমিন নামটি ছদ্মনাম। কিন্তু এই ছদ্মনামের মেয়েটির জীবনযুদ্ধের ঘটনাটি পুরোপুরি সত্যি। সে বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে অনেক দূরের এক গ্রামের বাসিন্দা। প্রথমে প্রায় এক ঘণ্টা হেঁটে তাকে বুড়িগঙ্গার পাড়ে আসতে হয়। তারপর নৌকায় চড়ে ঢাকায়। সেখানে থেকে বাসে করে ধানমন্ডির শংকর। তারপর একটু হেঁটে ২৭ নম্বর রোড সাতমসজিদ রোডের সংযোগস্থলের স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশে। সেখানে সে আইন বিভাগের ছাত্রী, আর আমি সেই বিভাগের ‘অ্যাডভাইজর’ ও পার্টটাইম শিক্ষক।
শারমিন এসএসসি আর এইচএসসি মিলিয়ে ভালো রেজাল্ট করেছে। এ জন্য তাকে স্টেট ইউনিভার্সিটির পক্ষ থেকে পড়ার খরচের ৮০ শতাংশ ছাড় (ওয়েভের) দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তবু তার মুখ থাকে শুকনো। একদিন আমার টেবিলে এসে সে তার জীবনের করুণ গল্প বলে। শুধু ইউনিভার্সিটিতে যেতে-আসতে তার প্রায় পাঁচ ঘণ্টা সময় লেগে যায়। কিন্তু মূল সমস্যা এটি নয়। মূল সমস্যা হচ্ছে এই আসা-যাওয়ার খরচ তার কোনোভাবেই জোগাড় হচ্ছে না। স্টেট ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ ভালো ছাত্র বিবেচনায় তার থেকে মাত্র ২০ শতাংশ কোর্স ফি গ্রহণ করে। সেই টাকা দেওয়ার পর তার আর নৌকাভাড়া আর বাসভাড়া দেওয়ার মতো টাকা থাকে না। আমি কি পারি তাকে কোনো পার্টটাইম চাকরি জোগাড় করে দিতে?
এর কিছুদিন পর এম এম শামীমের সঙ্গে স্টিমারে বরিশাল যাচ্ছি। তিনি ল্যাবএইড গ্রুপের মালিক, স্টেট ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের প্রেসিডেন্ট। স্টিমারের ডেকের সামনে বিশাল চাঁদ, এমন চাঁদের আলোয় জীবনের বহু করুণ গল্প হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে যায়। আমি একজন কোটিপতি মানুষের কাছে একটি হতদরিদ্র মেয়ের গল্প বলি। এই গল্প তাঁকে স্পর্শ করে। ঢাকায় ফিরে হঠাৎ ফোন পাই তাঁর। শারমিনকে যেন পাঠিয়ে দিই তাঁর অফিসে। মাসে পাঁচ হাজার টাকা দেওয়া হবে তাকে পড়াশোনা চালানোর জন্য।
শারমিনের সমস্যা কিছুটা দূর হয়েছে। কিন্তু শারমিনের মতো এমন আরও অনেক ছাত্র আছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে। কেউ কেউ কয়েক হাজার টাকা শোধ করতে পারে না বলে সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষায় বসার অনুমতি পায় না প্রথমে। আমি তাদের হয়ে নানা দেনদরবার করি। যতটা পারা যায় তাদের অনুমতি দিয়ে দেওয়া হয়। তবু অনেকের অভাব যায় না। কারও চাকরি দরকার, কারও টিউশনি, কারও করুণ আকুতি আরও ওয়েভারের। অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে একই অবস্থা। লাখ লাখ টাকা খরচ করে পড়ার সামর্থ্য নেই অনেকের। কিন্তু তাই বলে মাঝপথে ছেড়ে দেবে তারা পড়াশোনা! ছাত্রছাত্রীদের দুরবস্থা দেখে মাঝে মাঝে ভাবি, কেন তাদের সাহায্য করার মতো অনেক টাকা হলো না আমার!
...২...
এর মধ্যে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো একটি খবর পেলাম কিছুদিন আগে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের নাকি পড়াশোনার খরচের ওপর বাড়তি সাড়ে ৭ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে এখন থেকে। ভ্যাট মানে ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স। আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে বুঝি শিক্ষা কোনো পণ্য নয়, শিক্ষা গ্রহণের ওপর কোনো ভ্যাট তাই হতে পারে না। কোনো আলোচনা, কোনো মতামত গ্রহণ, কোনো কিছু আগাম না জানিয়ে হঠাৎ এই ভ্যাট আরোপ কেন তাহলে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও স্টেট ইউনিভার্সিটি দুই জায়গাতেই আমার কলিগ রোবায়েত ফেরদৌস। বঞ্চিত আর অবিচারের শিকার মানুষের জন্য বহুবার সে রাস্তায় দাঁড়িয়েছে। এবারও দাঁড়ায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে। রোবায়েত জানায়, একজন আইনজীবীর সঙ্গে তারা কথা বলেছে জনস্বার্থে মামলা করার জন্য। কিন্তু তিনি জানিয়েছেন ভ্যাট নাকি দিতে হবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে, ছাত্রছাত্রীদের নয়। আমি হতবুদ্ধ হয়ে ভাবি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়-সংক্রান্ত আইনে বলা আছে, বিশ্ববিদ্যালয় হবে অলাভজনক। অলাভজনক প্রতিষ্ঠান তাহলে ভ্যাট দেবে কেন? এই ভ্যাট তারা যদি উল্টো ছাত্রছাত্রীদের থেকে আদায় করে নেয়?
আমি কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খবর নিয়ে জানলাম, তা-ই হতে যাচ্ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদালয়ের ছাত্রছাত্রীদের থেকেই আদায় করা হবে অতিরিক্ত সাড়ে ৭ শতাংশ টাকা। আগোরা কিংবা পিৎজা হাট ভ্যালু অ্যাড করে পণ্য বিক্রয় করে বলে ভ্যাট দেয়, কিন্তু ক্রেতাদের কাছে থেকেই আদায় করা হয় এই ভ্যাট। এখন শিক্ষার ক্রেতা হিসেবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের থেকে আদায় হবে ভ্যাট! হয়তো এ জন্য ভ্যাট নিয়ে অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মাথাব্যথা নেই তেমন। মাথায় যাদের দুষ্টবুদ্ধি আছে, তারা বরং কম ভ্যাট জমা দিয়ে কিছু লাভ করতে পারে ছাত্রছাত্রীদের দুর্দশা থেকে। লাভ হতে পারে ঘুষখোর ভ্যাটের লোকদেরও। কিন্তু শারমিন বা তার মতো হাজারো দরিদ্র ছাত্রছাত্রীর কী হবে? এমনিতেই টাকা জোগাড় করতে জীবন যায় তাদের। এই অতিরিক্ত টাকা তারা কীভাবে জোগাড় করবে?
...৩...
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সম্পর্কে সমাজে ঢালাও কিছু নেতিবাচক ধারণা আছে বলে আমরা তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হই না তেমন। আমাদের প্রচলিত বিশ্বাস, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা সুযোগ পায় না, তারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। এটি অনেক ক্ষেত্রে ঠিক, কিছু ক্ষেত্রে নয়। কেউ কেউ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশ, সেশনজট বা পছন্দের বিভাগ না পাওয়ার জন্য সেখানে পড়ে না, কষ্ট করে হলেও পড়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমাদের অনেকের ধারণা, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা হয় না, সহশিক্ষা কার্যক্রমও খুব কম। এটি অনেক ক্ষেত্রে পুরোপুরি ভুল। অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বরং পড়াশোনা হয় বেশি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চরম ফাঁকিবাজ শিক্ষকও সেখানে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন অনেক ক্ষেত্রে।
সহশিক্ষা কার্যক্রমের একটি উদাহরণ দিই। আমাদের স্টেট ইউনিভার্সিটিতে মুট-কোর্ট করার সুযোগ খুবই সীমিত। সেখান থেকে প্রথমবারের মতো গত বছর আন্তবিশ্ববিদ্যালয় মুট-কোর্ট কম্পিটিশনে অংশ নিয়েছিল আমাদের তিনজন ছাত্রছাত্রী। হাইকোর্টের জাঁদরেল জাজ আর আইনের দুঁদে অধ্যাপকের সামনে তাদের ইংরেজি যুক্তিতর্ক শুনে আমিই হতবাক হয়ে যাই। ব্যক্তিগত র্যা ঙ্কিংয়ে দেখা গেল অনেকগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের চেয়ে ভালো পারফর্ম করেছে স্টেট ইউনিভার্সিটির মুটাররা। আর মুট-কোর্টে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের পারফরম্যান্স বরাবরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাদে অন্য সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে ভালো।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্য হয়, মানবাধিকার দিবস পালন হয়, ড. ইউনূস, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বা আইনজীবী রফিক–উল হকদের বক্তৃতা হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা ব্লাড ব্যাংক খুলেছে, রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পর ছুটে গেছে, প্রতিবছর নিজেরা চাঁদা দিয়ে ঈদের আগে গরিব-দুখীদের মধ্যে নতুন কাপড় বিতরণ করছে।
উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্য শুধু মানবসম্পদ সৃষ্টি নয়, উদ্দেশ্য জ্ঞান সৃষ্টি করাও। উন্নত বিশ্বের অগ্রসর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন আরেক ধাপ এগিয়ে নিজেদের সৃষ্ট জ্ঞান ব্যবহার করার মতো সামর্থ্যও অর্জন করছে। বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনেকগুলোই নিষ্ঠার সঙ্গে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে। কোনো কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশিত কিছু গবেষণার চেয়ে অবশ্যই মানসম্পন্ন। আমি বিশ্বাস করি, কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের সৃষ্ট জ্ঞানের ব্যবহারের সামর্থ্যও অর্জন করবে অচিরেই।
তাই বলে সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এক রকম নয়। কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিতই হয়েছে শিক্ষার নামে সার্টিফিকেট ব্যবসা করার জন্য। কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকেরা নানা কৌশলে এখান থেকেও হাতিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা। কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার মান খুব খারাপ। সেসব সমস্যা দূর করার জন্য ইউজিসির পক্ষ থেকে সার্বক্ষণিক তদারকি ও মূল্যায়ন, পারফরম্যান্স মানদণ্ড নির্ধারণ, বাধ্যতামূলকভাবে ছাত্রদের কর্তৃক ইভ্যালুয়েশন, ন্যূনতম অবকাঠামো, মানবসম্পদ এবং শিক্ষা উপকরণ নিশ্চিতকরণের পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু এখানে ব্যবসা হচ্ছে ঢালাওভাবে—এমন ধারণা থেকে উচ্চশিক্ষার সুযোগ আরও সীমিত ও কষ্টসাধ্য করে তোলার কোনো যুক্তি নেই।
...৪...
আমাদের কারও কারও ধারণা, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ধনী লোকের সন্তানেরা পড়াশোনা করে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ পরিবারের। হাতে গোনা কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী অবস্থাপন্ন ঘরের সন্তান এটি সত্যি। কিন্তু অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্রছাত্রী নিম্ন মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। অন্যদিকে আমার নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অন্তত এক-তৃতীয়াংশ ছাত্রছাত্রী খুবই সচ্ছল পরিবারের সন্তান। এই এক-তৃতীয়াংশ পরিবারের সন্তানেরাও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় বিনা পয়সায় পড়াশোনা করছে। এতেও হয়তো আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে দিনে দিনে পড়াশোনার খরচ বাড়বে, সরকারও আবার তাদের ওপর নতুন করে ভ্যাটের বোঝা চাপাবে, এতটা বৈষম্য করা ঠিক নয়।
উন্নত বিশ্বের ছাত্রছাত্রীদের পার্টটাইম চাকরি করার এবং শিক্ষাঋণ নেওয়ার বহু সুযোগ থাকে। আমাদের দেশে তা নেই বললেই চলে। এখন ভ্যাট আদায়ের মাধ্যমে সরকার যদি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের ওপরও চেপে বসে, তাহলে তারা কোথায় যাবে?
আমাদের প্রধানমন্ত্রী গরিববান্ধব হিসেবে পরিচিত, আমাদের শিক্ষামন্ত্রী শ্রেণিহীন সমাজের রাজনীতি করতেন বহু বছর। আপনারা অনুগ্রহ করে বিষয়টি ভেবে দেখবেন কি? শারমিনের মতো বহু ছেলেমেয়ের অসহায়ত্ব আপনারা উপলব্ধি করবেন কি?
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.