ইউরোপের প্রবেশদ্বারে বাঙালি by মলয় ভৌমিক
শুধু বাংলাদেশি নয়, বহু দেশের নাগরিকের জন্যই ইতালি ইউরোপের প্রবেশদ্বার |
বাংলাদেশিদের
জন্য ইতালি হলো ইউরোপের প্রবেশসোপান। এ তথ্য আগে থেকেই জানা ছিল।
বাস্তবে গিয়ে দেখা গেল, সাদামাটা এই তথ্যের পেছনে রয়েছে গা হিম করা সব
কাহিনি; সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমার-থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়ার সীমান্তবর্তী
জঙ্গলে আবিষ্কৃত গণকবরের নির্মমতা থেকে যা কোনো অংশেই কম নয়। জীবন বাজি
রেখেই মানুষ পাড়ি জমিয়েছে ইতালিতে। কেউ পৌঁছেছে, কেউ পৌঁছাতে পারেনি।
জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে রোমে বাংলাদেশ দূতাবাসে গিয়ে দেখা গেল কর্মীরা রাত-দিন কাজ করছেন। ফার্স্ট সেক্রেটারি রুবাইয়াত-ই-আশিক জানালেন, আন্তর্জাতিক বিমান উড্ডয়ন সংস্থা এ বছরের ২৫ নভেম্বরের মধ্যে সবার জন্য মেশিন রিডেবল পাসপোর্টের আবশ্যিকতা জানিয়ে দিয়েছে। এত দিনের হাতে লেখা পাসপোর্টে আইনি জটিলতা এড়ানোর জন্য বাঙালিরা ইচ্ছাকৃতভাবে যেসব বিভ্রান্তিকর তথ্য ব্যবহার করেছে, তার একটা কিনারা এবার হতে যাচ্ছে। যাঁরা ইতালিতে নাগরিকত্ব পেয়েছেন বা বৈধভাবে কাজ করার অনুমতি পেয়েছেন, তাঁদের জন্য আগের পাসপোর্টে ব্যবহৃত ভুল তথ্য বিষফোড়া হয়ে আছে। রাষ্ট্রদূত মোহম্মদ শাহদৎ হোসেন বললেন, প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ আবেদন আসছে। আশা করা যায়, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ করা যাবে।
শুধু বাংলাদেশি নয়, এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বহু দেশের নাগরিকের জন্যই ইতালি ইউরোপের প্রবেশদ্বার। এর পেছনের কারণ যেমন মানবিক, তেমনি চমকপ্রদ। ভ্যাটিকানের পোপ জন পল একবার ভক্তদের উদ্দেশে দেওয়া বক্তৃতায় বলেছিলেন, ইতালি হলো ঈশ্বরের দেশ। সুতরাং ঈশ্বরের আশ্রয় থেকে কাউকে বিতাড়িত করা উচিত নয়। ভ্যাটিকানের পৃথক রাষ্ট্রের মর্যাদা থাকলেও তা ইতালি তথা রোম নগরের মধ্যে অবস্থিত। ফলে ইতালির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকার পোপের এই উক্তির প্রতি সম্মান দেখাতে শুরু করে। ধীরে ধীরে তা অলিখিত এক আবশ্যিক আইনে পরিণত হয়, যা এখনো কার্যকর। সরকার অবৈধ নাগরিকদের মাঝেমধ্যে গ্রেপ্তার করলেও দু-এক মাস পরেই আবার ছেড়ে দেয়। দেশ থেকে বিতাড়িত করে না। এই হলো দুর্গম পথে ইতালিতে পৌঁছানোর প্রতি আগ্রহের নেপথ্য কথা।
ইতালির বড় বড় শহর নেপলস, মিলান, ভেনিস, ফ্লোরেন্স, পিসা, কোমো, আনকোনা বা ভেরোনায় এমন অনেক বাঙালির সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, যাঁরা একাধিকবার গ্রেপ্তার হওয়ার পরও ইতালিতে থেকে গেছেন এবং পরে বৈধভাবে কাজ করার অনুমতি পেয়েছেন। সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া ও গ্রিসের বাঙালিদের সঙ্গে কথা বলেও জেনেছি, তাঁদের অনেকেই প্রথমে ইতালিতে বৈধতা পাওয়ার পর ওই সব দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। আবার যাঁরা ইতালি এড়িয়ে সরাসরি ওই সব দেশে গিয়েছেন, তাঁরা বিপদে পড়লেই চলে এসেছেন ইতালিতে ‘নিরাপদ’ আশ্রয়ে। ইউরোপীয় জোনের দেশগুলোয় এ ধরনের যাওয়া-আসা চলতে থাকায় ইতালিতে বাঙালির সংখ্যা দ্রুত হ্রাসবৃদ্ধি ঘটে। আজ তিন লাখ তো চার মাস পর দুই লাখ।
ইতালিতে বাঙালিরা আসেন কীভাবে—এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে রোমে কথা হয় বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী কাজী মোহম্মদ জাকারিয়া ও চারুশিল্পী ইফতেখারুল আলমের সঙ্গে। তাঁরা জানান, যাঁরা আসেন, তাঁদের ৯৫ শতাংশই দালালের মাধ্যমে অবৈধভাবে ইতালিতে প্রবেশ করেন। আনকোনার বাঙালি সমিতির নেতা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মোহাম্মদ দুলাল, চারুশিল্পী শহিদুর রহমান, পারভেজ হোসেনও একই কথা জানান।
লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলা থেকে হারুনুর রশীদ ইতালিতে পাড়ি জমান ১৯৮৭ সালে। তিনি অবশ্য বৈধভাবেই সে দেশে প্রবেশ করেন। সেই থেকে এখনো বাংলাদেশ দূতাবাসে গাড়িচালকের কাজ করছেন। দীর্ঘদিন ইতালিতে অবস্থানের কারণে বাঙালিরা তাঁকে এক নামে চেনেন। তাঁর সহযোগিতায় অনেক বাঙালি ইতালিসহ ইউরোপের নানা দেশে আজ প্রতিষ্ঠিত। হারুনুর রশীদ মনে করেন, মেশিন রিডেবল পাসপোর্টের ব্যবস্থা হওয়ায় দেশের বদনাম ঘুচবে, মানব পাচার কমে আসবে।
বিভিন্নজনের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, স্বাধীনতার পর গত শতাব্দীর আশির দশকের শেষে ইতালিতে মানব পাচার শুরু হয়। সে সময় পাচারপথ ছিল প্রথমে যুগোস্লাভিয়ায় প্রবেশ এবং সেখান থেকে নৌপথে ইতালির ভেনিস নগরে চলে আসা। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে অনেকে ইতালিতে প্রবেশ করতে শুরু করেন রাশিয়া-ইউক্রেন হয়ে পায়ে হেঁটে। উভয় ক্ষেত্রেই মাধ্যম ছিল দালাল। বর্তমানে এ দুটি পথ বন্ধ। নব্বইয়ের দশকে ইতালিতে থেকে যাওয়ার আরেকটি উপায় ছিল, বৈধভাবে ইতালির ভ্রমণ-ভিসা নিয়ে সেখানে যাওয়ার পর পাসপোর্ট ফেলে দিয়ে সাধারণে মিশে যাওয়া। ইউরোপ ছাড়া আমেরিকা-কানাডার মতো দেশে ব্রাহ্মণ-শূদ্রনির্বিশেষে অনেকে আজও এই পন্থা অবলম্বন করে চলেছেন।
এসব কারণে ভ্রমণ-ভিসার ব্যাপারে ইউরোপ, বিশেষ করে ইতালি সরকার এখন অনেক সতর্ক। ইউরোপজুড়ে জল ও স্থলসীমান্তের নজরদারিও এখন কড়া। কিন্তু এসব কড়াকড়ি ইউরোপের প্রতি মোহগ্রস্তদের ঠেকাতে পারেনি। বরফ-পাহাড়-মরুভূমি মাসের পর মাস হেঁটে অতিক্রম করে বহু মানুষ দালালের মাধ্যমে পৌঁছে যাচ্ছেন তঁাদের স্বপ্নের প্রবেশদ্বারে।
বর্তমানে ইতালিতে পৌঁছার রুট বেশ কয়েকটি। বাংলাদেশ থেকে প্রথমে মাল্টা। সেখান থেকে জাহাজে ইতালি। একইভাবে লিবিয়া হয়েও জাহাজে ইতালিতে পৌঁছানো যায়। সব থেকে কষ্টকর পথটি হলো বাংলাদেশ থেকে ভারত-পাকিস্তান-ইরান-তুরস্ক-স্পেন হয়ে বেশির ভাগ রাস্তা হেঁটে, কখনো-বা বছরব্যাপী ঘুরে ঘুরে ইতালিতে পৌঁছানো। ভয়ংকর পথটি হলো তুরস্ক সীমানার পথ। সেখানে নির্বিচারে গুলি চালানো হয়। অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের পেছনে লেলিয়ে দেওয়া হয় হিংস্র কুকুর। গুলি বা কুকুরের কামড়ে জীবন যায় অনেকেরই। এমনও হয়, যাত্রা শুরু করেছিল ২০ জনের একটি দল, কিন্তু গন্তব্যে গিয়ে পৌঁছাতে পেরেছেন পাঁচ বা ছয়জন। ইতালি দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি রুবাইয়াত-ই-আশিক জানালেন, কুকুরের কামড়ে গুরুতর আহত অনেকেই তাঁর কাছে এসে সাহায্য চেয়েছেন। সীমান্ত এলাকায় বরফের ফাটলে স্বামীর পা আটকে গেছে, প্রহরীরা ধেয়ে আসছেন। এ অবস্থায় স্ত্রী স্বামীকে ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। পরে আর স্বামীর খোঁজ মেলেনি। দুর্গম এসব পথে পাড়ি জমাতে গিয়ে প্রতিবছর শত শত বাঙালির মৃত্যু হচ্ছে। কিন্তু আইনি জটিলতা এড়াতে এসব বিয়োগযন্ত্রণার নির্মম চিত্র চাপা পড়ছে আড়ালে।
অপরিণত (মাইনর) বা ১৮ বছরের নিচে যাদের বয়স, তাদের কদর আবার ইতালিতে বেশি। বেশ কিছু কথিত মানবাধিকার সংগঠন দাঁড়িয়ে গেছে তাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য। উদ্বাস্তু মাইনরদের দেখভালের খরচ মেটাতে সরকার বা বড় বড় দাতা প্রতিষ্ঠান মাসে জনপ্রতি ৭০০ ইউরো পর্যন্ত দিয়ে থাকে। ৩০০ ইউরো জনপ্রতি ব্যয় করে বাকিটা স্বচ্ছন্দে নিজ পকেটে ঢোকানো যায়। এই ‘ব্যবসার’ সঙ্গে যুক্ত একটি গোষ্ঠী বাংলাদেশি মাইনরদের ইতালিতে যেতে উৎসাহ জুগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও ইতালিতে প্রবেশের পথ ওই একই।
মাঝেমধ্যেই ইতালি সরকার কৃষিতে কাজ করানোর জন্য স্থানীয় কৃষি-মালিকদের চাহিদা অনুযায়ী লোক নেয়। শ্রীলঙ্কা, ভারতসহ বাংলাদেশের অনেক কৃষিশ্রমিক ইতালিতে তাঁদের আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে এই প্রক্রিয়ায় বৈধভাবে ইতালিতে প্রবেশ করেন। এ ক্ষেত্রে চুক্তি হলো, নয় মাস পরে কৃষিশ্রমিককে দেশে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু অধিকাংশ বাঙালি দেশে না ফিরে স্থানীয় উকিলের মাধ্যমে পাসপোর্টে তাঁর নিজের ও বাবার নাম-ঠিকানা পাল্টে ফেলেন। এমনও দেখ গেছে, নেত্রকোনার গুরুপদ এই প্রক্রিয়ায় উকিলের সহায়তায় বনে গেছেন শ্রীলঙ্কার গুরুসিংহে। বাংলাদেশিদের এই আচরণের কারণে দুই বছর হলো ইতালি সরকার কৃষিতে বাঙালি শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ রেখেছে।
জীবনের তোয়াক্কা না করে ইউরো-ডলারের মোহে যাঁরা ইউরোপে পাড়ি জমান, ঘাটে ঘাটে পয়সা গুনে তাঁদের জনপ্রতি ১০ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় হয়। এ টাকার জোগান হয় ভিটেবাড়ি বিক্রির বিনিময়ে। এত পয়সা খরচ করে যাঁরা যান, তাঁরা কেমন আয় করেন? রোমের কলসিও, রোমান ফোরাম, ভ্যাটিকানের আশপাশ, বিসুভিয়াসের ছাইচাপা ঐতিহাসিক নগর পম্পাই বা ভেনিসের রাস্তায় অসংখ্য বাঙালি চোখে পড়েছে। তাঁরা ফেরি করে সেলফিস্ট্যান্ড, পানির বোতল বা শুকনা খাবার বিক্রি করছেন। কথা বলে জেনেছি, তাঁদের মাসিক গড় আয় ৭০০ থেকে ৮০০ ইউরো। নিজের জন্য চলে যায় ৫০০ ইউরো। বাকিটা দেশে পাঠান তাঁরা। এই ইউরোতে বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার ভাঁড়ার হয়তো বাড়ে, কিন্তু ভিটেবাড়ি বিক্রির আসল উঠতে যুগ পার হয়ে যায়।
মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট ইউরোপে পাড়ি জমানো বাঙালিদের আসল পরিচয় নিশ্চিত করবে। এতে হয়তো মানব পাচারও কিছুটা কমানো যাবে। তবে এ উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। ইতালি, গ্রিস, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্সসহ অনেক দেশেই কাজের লোক, বিশেষ করে কৃষি-শ্রমিকের চাহিদা আছে। সরকার চেষ্টা করলে বৈধ প্রক্রিয়ায় ইউরোপে এখনো বহু বাঙালির কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে বলে অনেকে মনে করেন। তা করা গেলে সেটাই হবে ইউরোপে বাঙালির প্রকৃত ঠিকানা।
মলয় ভৌমিক: অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; নাট্যকার৷
জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে রোমে বাংলাদেশ দূতাবাসে গিয়ে দেখা গেল কর্মীরা রাত-দিন কাজ করছেন। ফার্স্ট সেক্রেটারি রুবাইয়াত-ই-আশিক জানালেন, আন্তর্জাতিক বিমান উড্ডয়ন সংস্থা এ বছরের ২৫ নভেম্বরের মধ্যে সবার জন্য মেশিন রিডেবল পাসপোর্টের আবশ্যিকতা জানিয়ে দিয়েছে। এত দিনের হাতে লেখা পাসপোর্টে আইনি জটিলতা এড়ানোর জন্য বাঙালিরা ইচ্ছাকৃতভাবে যেসব বিভ্রান্তিকর তথ্য ব্যবহার করেছে, তার একটা কিনারা এবার হতে যাচ্ছে। যাঁরা ইতালিতে নাগরিকত্ব পেয়েছেন বা বৈধভাবে কাজ করার অনুমতি পেয়েছেন, তাঁদের জন্য আগের পাসপোর্টে ব্যবহৃত ভুল তথ্য বিষফোড়া হয়ে আছে। রাষ্ট্রদূত মোহম্মদ শাহদৎ হোসেন বললেন, প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ আবেদন আসছে। আশা করা যায়, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ করা যাবে।
শুধু বাংলাদেশি নয়, এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বহু দেশের নাগরিকের জন্যই ইতালি ইউরোপের প্রবেশদ্বার। এর পেছনের কারণ যেমন মানবিক, তেমনি চমকপ্রদ। ভ্যাটিকানের পোপ জন পল একবার ভক্তদের উদ্দেশে দেওয়া বক্তৃতায় বলেছিলেন, ইতালি হলো ঈশ্বরের দেশ। সুতরাং ঈশ্বরের আশ্রয় থেকে কাউকে বিতাড়িত করা উচিত নয়। ভ্যাটিকানের পৃথক রাষ্ট্রের মর্যাদা থাকলেও তা ইতালি তথা রোম নগরের মধ্যে অবস্থিত। ফলে ইতালির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকার পোপের এই উক্তির প্রতি সম্মান দেখাতে শুরু করে। ধীরে ধীরে তা অলিখিত এক আবশ্যিক আইনে পরিণত হয়, যা এখনো কার্যকর। সরকার অবৈধ নাগরিকদের মাঝেমধ্যে গ্রেপ্তার করলেও দু-এক মাস পরেই আবার ছেড়ে দেয়। দেশ থেকে বিতাড়িত করে না। এই হলো দুর্গম পথে ইতালিতে পৌঁছানোর প্রতি আগ্রহের নেপথ্য কথা।
ইতালির বড় বড় শহর নেপলস, মিলান, ভেনিস, ফ্লোরেন্স, পিসা, কোমো, আনকোনা বা ভেরোনায় এমন অনেক বাঙালির সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, যাঁরা একাধিকবার গ্রেপ্তার হওয়ার পরও ইতালিতে থেকে গেছেন এবং পরে বৈধভাবে কাজ করার অনুমতি পেয়েছেন। সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া ও গ্রিসের বাঙালিদের সঙ্গে কথা বলেও জেনেছি, তাঁদের অনেকেই প্রথমে ইতালিতে বৈধতা পাওয়ার পর ওই সব দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। আবার যাঁরা ইতালি এড়িয়ে সরাসরি ওই সব দেশে গিয়েছেন, তাঁরা বিপদে পড়লেই চলে এসেছেন ইতালিতে ‘নিরাপদ’ আশ্রয়ে। ইউরোপীয় জোনের দেশগুলোয় এ ধরনের যাওয়া-আসা চলতে থাকায় ইতালিতে বাঙালির সংখ্যা দ্রুত হ্রাসবৃদ্ধি ঘটে। আজ তিন লাখ তো চার মাস পর দুই লাখ।
ইতালিতে বাঙালিরা আসেন কীভাবে—এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে রোমে কথা হয় বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী কাজী মোহম্মদ জাকারিয়া ও চারুশিল্পী ইফতেখারুল আলমের সঙ্গে। তাঁরা জানান, যাঁরা আসেন, তাঁদের ৯৫ শতাংশই দালালের মাধ্যমে অবৈধভাবে ইতালিতে প্রবেশ করেন। আনকোনার বাঙালি সমিতির নেতা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মোহাম্মদ দুলাল, চারুশিল্পী শহিদুর রহমান, পারভেজ হোসেনও একই কথা জানান।
লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলা থেকে হারুনুর রশীদ ইতালিতে পাড়ি জমান ১৯৮৭ সালে। তিনি অবশ্য বৈধভাবেই সে দেশে প্রবেশ করেন। সেই থেকে এখনো বাংলাদেশ দূতাবাসে গাড়িচালকের কাজ করছেন। দীর্ঘদিন ইতালিতে অবস্থানের কারণে বাঙালিরা তাঁকে এক নামে চেনেন। তাঁর সহযোগিতায় অনেক বাঙালি ইতালিসহ ইউরোপের নানা দেশে আজ প্রতিষ্ঠিত। হারুনুর রশীদ মনে করেন, মেশিন রিডেবল পাসপোর্টের ব্যবস্থা হওয়ায় দেশের বদনাম ঘুচবে, মানব পাচার কমে আসবে।
বিভিন্নজনের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, স্বাধীনতার পর গত শতাব্দীর আশির দশকের শেষে ইতালিতে মানব পাচার শুরু হয়। সে সময় পাচারপথ ছিল প্রথমে যুগোস্লাভিয়ায় প্রবেশ এবং সেখান থেকে নৌপথে ইতালির ভেনিস নগরে চলে আসা। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে অনেকে ইতালিতে প্রবেশ করতে শুরু করেন রাশিয়া-ইউক্রেন হয়ে পায়ে হেঁটে। উভয় ক্ষেত্রেই মাধ্যম ছিল দালাল। বর্তমানে এ দুটি পথ বন্ধ। নব্বইয়ের দশকে ইতালিতে থেকে যাওয়ার আরেকটি উপায় ছিল, বৈধভাবে ইতালির ভ্রমণ-ভিসা নিয়ে সেখানে যাওয়ার পর পাসপোর্ট ফেলে দিয়ে সাধারণে মিশে যাওয়া। ইউরোপ ছাড়া আমেরিকা-কানাডার মতো দেশে ব্রাহ্মণ-শূদ্রনির্বিশেষে অনেকে আজও এই পন্থা অবলম্বন করে চলেছেন।
এসব কারণে ভ্রমণ-ভিসার ব্যাপারে ইউরোপ, বিশেষ করে ইতালি সরকার এখন অনেক সতর্ক। ইউরোপজুড়ে জল ও স্থলসীমান্তের নজরদারিও এখন কড়া। কিন্তু এসব কড়াকড়ি ইউরোপের প্রতি মোহগ্রস্তদের ঠেকাতে পারেনি। বরফ-পাহাড়-মরুভূমি মাসের পর মাস হেঁটে অতিক্রম করে বহু মানুষ দালালের মাধ্যমে পৌঁছে যাচ্ছেন তঁাদের স্বপ্নের প্রবেশদ্বারে।
বর্তমানে ইতালিতে পৌঁছার রুট বেশ কয়েকটি। বাংলাদেশ থেকে প্রথমে মাল্টা। সেখান থেকে জাহাজে ইতালি। একইভাবে লিবিয়া হয়েও জাহাজে ইতালিতে পৌঁছানো যায়। সব থেকে কষ্টকর পথটি হলো বাংলাদেশ থেকে ভারত-পাকিস্তান-ইরান-তুরস্ক-স্পেন হয়ে বেশির ভাগ রাস্তা হেঁটে, কখনো-বা বছরব্যাপী ঘুরে ঘুরে ইতালিতে পৌঁছানো। ভয়ংকর পথটি হলো তুরস্ক সীমানার পথ। সেখানে নির্বিচারে গুলি চালানো হয়। অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের পেছনে লেলিয়ে দেওয়া হয় হিংস্র কুকুর। গুলি বা কুকুরের কামড়ে জীবন যায় অনেকেরই। এমনও হয়, যাত্রা শুরু করেছিল ২০ জনের একটি দল, কিন্তু গন্তব্যে গিয়ে পৌঁছাতে পেরেছেন পাঁচ বা ছয়জন। ইতালি দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি রুবাইয়াত-ই-আশিক জানালেন, কুকুরের কামড়ে গুরুতর আহত অনেকেই তাঁর কাছে এসে সাহায্য চেয়েছেন। সীমান্ত এলাকায় বরফের ফাটলে স্বামীর পা আটকে গেছে, প্রহরীরা ধেয়ে আসছেন। এ অবস্থায় স্ত্রী স্বামীকে ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। পরে আর স্বামীর খোঁজ মেলেনি। দুর্গম এসব পথে পাড়ি জমাতে গিয়ে প্রতিবছর শত শত বাঙালির মৃত্যু হচ্ছে। কিন্তু আইনি জটিলতা এড়াতে এসব বিয়োগযন্ত্রণার নির্মম চিত্র চাপা পড়ছে আড়ালে।
অপরিণত (মাইনর) বা ১৮ বছরের নিচে যাদের বয়স, তাদের কদর আবার ইতালিতে বেশি। বেশ কিছু কথিত মানবাধিকার সংগঠন দাঁড়িয়ে গেছে তাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য। উদ্বাস্তু মাইনরদের দেখভালের খরচ মেটাতে সরকার বা বড় বড় দাতা প্রতিষ্ঠান মাসে জনপ্রতি ৭০০ ইউরো পর্যন্ত দিয়ে থাকে। ৩০০ ইউরো জনপ্রতি ব্যয় করে বাকিটা স্বচ্ছন্দে নিজ পকেটে ঢোকানো যায়। এই ‘ব্যবসার’ সঙ্গে যুক্ত একটি গোষ্ঠী বাংলাদেশি মাইনরদের ইতালিতে যেতে উৎসাহ জুগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও ইতালিতে প্রবেশের পথ ওই একই।
মাঝেমধ্যেই ইতালি সরকার কৃষিতে কাজ করানোর জন্য স্থানীয় কৃষি-মালিকদের চাহিদা অনুযায়ী লোক নেয়। শ্রীলঙ্কা, ভারতসহ বাংলাদেশের অনেক কৃষিশ্রমিক ইতালিতে তাঁদের আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে এই প্রক্রিয়ায় বৈধভাবে ইতালিতে প্রবেশ করেন। এ ক্ষেত্রে চুক্তি হলো, নয় মাস পরে কৃষিশ্রমিককে দেশে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু অধিকাংশ বাঙালি দেশে না ফিরে স্থানীয় উকিলের মাধ্যমে পাসপোর্টে তাঁর নিজের ও বাবার নাম-ঠিকানা পাল্টে ফেলেন। এমনও দেখ গেছে, নেত্রকোনার গুরুপদ এই প্রক্রিয়ায় উকিলের সহায়তায় বনে গেছেন শ্রীলঙ্কার গুরুসিংহে। বাংলাদেশিদের এই আচরণের কারণে দুই বছর হলো ইতালি সরকার কৃষিতে বাঙালি শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ রেখেছে।
জীবনের তোয়াক্কা না করে ইউরো-ডলারের মোহে যাঁরা ইউরোপে পাড়ি জমান, ঘাটে ঘাটে পয়সা গুনে তাঁদের জনপ্রতি ১০ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় হয়। এ টাকার জোগান হয় ভিটেবাড়ি বিক্রির বিনিময়ে। এত পয়সা খরচ করে যাঁরা যান, তাঁরা কেমন আয় করেন? রোমের কলসিও, রোমান ফোরাম, ভ্যাটিকানের আশপাশ, বিসুভিয়াসের ছাইচাপা ঐতিহাসিক নগর পম্পাই বা ভেনিসের রাস্তায় অসংখ্য বাঙালি চোখে পড়েছে। তাঁরা ফেরি করে সেলফিস্ট্যান্ড, পানির বোতল বা শুকনা খাবার বিক্রি করছেন। কথা বলে জেনেছি, তাঁদের মাসিক গড় আয় ৭০০ থেকে ৮০০ ইউরো। নিজের জন্য চলে যায় ৫০০ ইউরো। বাকিটা দেশে পাঠান তাঁরা। এই ইউরোতে বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার ভাঁড়ার হয়তো বাড়ে, কিন্তু ভিটেবাড়ি বিক্রির আসল উঠতে যুগ পার হয়ে যায়।
মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট ইউরোপে পাড়ি জমানো বাঙালিদের আসল পরিচয় নিশ্চিত করবে। এতে হয়তো মানব পাচারও কিছুটা কমানো যাবে। তবে এ উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। ইতালি, গ্রিস, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্সসহ অনেক দেশেই কাজের লোক, বিশেষ করে কৃষি-শ্রমিকের চাহিদা আছে। সরকার চেষ্টা করলে বৈধ প্রক্রিয়ায় ইউরোপে এখনো বহু বাঙালির কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে বলে অনেকে মনে করেন। তা করা গেলে সেটাই হবে ইউরোপে বাঙালির প্রকৃত ঠিকানা।
মলয় ভৌমিক: অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; নাট্যকার৷
No comments