রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ চেষ্টা, ৬০ জনকে ফেরত

মিয়ানমারে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের নতুন করে শুরু হওয়া দাঙ্গায় এ পর্যন্ত কমপক্ষে ৮২ জন মারা গেছে। এছাড়া অগ্নিসংযোগে অন্তত ২০ হাজার রোহিঙ্গা গৃহহীন হয়ে পড়েছে। সহিংসতায় উপকূলীয় চাওপিউ শহরের রোহিঙ্গা মুসলিম-অধ্যুষিত একটি এলাকার পুরোটাই ধ্বংস হয়ে গেছে।

দাঙ্গা শুরুর পর থেকেই ট্রলার ও নৌকায় করে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে দুর্ভাগ্যতবলিত রোহিঙ্গারা। গত দুই দিনে টেকনাফ ও উখিয়া থেকে ৬০ জনকে আটক করে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
দেশ টিভির টেকনাফ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, শনিবার গভীর রাতে বঙ্গোপসাগরে প্রায় ৩ হাজার রোহিঙ্গা ৪০টি ট্রলারে করে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি ও কোস্টগার্ডের বাধায় পরে তারা ফিরে যায়।
গত দুই দিনে টেকনাফের বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে কমপক্ষে ৬০ জনকে আটক করা হয়েছে। এর পর তাদের ফেরত পাঠানো হয়।

মিয়ানমারে পশ্চিমাঞ্চলে রাখাইন ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে সহিংসতায় হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছেন। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি, নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড সদস্যরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. রুহুল আমিন বলেন, মিয়ানমারে নতুন করে জাতিগত দাঙ্গা শুরু হলেও কোনো রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ অনুপ্রবেশের সুযোগ দেয়া হচ্ছে না। সরকারের শীর্ষ মহলের নির্দেশে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ সাগরে নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, টেকনাফ ও উখিয়া সীমান্তে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও পুলিশকে সতর্ক প্রহরায় রয়েছে।

প্রসঙ্গত, বর্তমানে টেকনাফের নয়াপাড়া ও উখিয়ার কুতুপালং পাহাড়ে প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বাস করছে। এছাড়া সরকারি পাহাড় দখল করে বসবাস করছে আরো দুই লাখের বেশি রোহিঙ্গা। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন তাদের বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে সববাসের সুযোগ করে দিতে সরকারকে চাপ দিয়ে আসছে।
গত মে মাসে একজন বৌদ্ধ নারীকে কয়েকজন মুসলমান ধর্ষণ করেছে বলে অভিযোগ ওঠে। এরপর বৌদ্ধ ও রোহিঙ্গা মুসলমানদের মধ্যে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। সহিংসতায় প্রায় ৮০ জন নিহত এবং হাজার হাজার মানুষ তাদের বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালিয়েছিল।

সে সময় পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলেও সেখানে এক ধরনের চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছিল। এরই ধারাবাহিকতায় গত সপ্তাহে রোববার থেকে দেশটিতে আবারো জাতিগত সহিংসতা শুরু হয়।সূত্র: বিবিসি ও দেশ টিভি।


রোহিঙ্গাদের জরুরি ত্রাণ প্রয়োজনঃ জাতিসংঘ

মিয়ানমারে বৌদ্ধ ও রোহিঙ্গা মুসলিমদের মধ্যে নতুন করে দাঙ্গা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘ বলছে, এই সহিংসতায় বাস্তচ্যুত হাজার হাজার মানুষের জন্য জরুরি ত্রাণসাহায্য দরকার।
মিয়ানমার সরকারের হিসাবেই জুন মাসে দাঙ্গা শুরুর পর থেকে ২০ হাজারের মতো লোক গৃহহীন হয়েছে। তবে জাতিসংঘের হিসাবে গৃহহীনের সংখ্যা অন্ত লাখখানেক, যাদের সিংহভাগই রোহিঙ্গা মুসলিম।

পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যে সর্বশেষ এই সহিংসতায় আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সাড়ে চার হাজারেরও বেশি বাড়িঘর। শরণার্থীদের বেশির ভাগই আশ্রয় নিয়েছে অস্থায়ী ক্যাম্প, নৌকা, বিভিন্ন দ্বীপ ও পাহাড়ের চূড়ায়।

সরকারি প্রতিনিধি দলের সাথে শনিবার এসব এলাকা সফরে গিয়ে জাতিসংঘের কর্মকর্তারা বলছেন যে, তাদের এখন জরুরি  ত্রাণসাহায্য প্রয়োজন।


মিয়ানমারে জাতিসংঘের মানবিক ত্রাণবিষয়ক প্রধান আশোক নিগম বলছেন, প্রকৃত শরণার্থীর সংখ্যা সরকারি হিসাবের চেয়েও বেশি হতে পারে।


কোনো কোনো খবরে বলা হচ্ছে, এদের কেউ কেউ সাগরে ডুবে মারা গেছেন, আবার কেউ কেউ নিখোঁজ।


আশোক নিগম বলেছেন, পরিস্থিতি খুবই গুরুতর এবং তাদের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার কাজটাই এখন সবচে বড় চ্যালেঞ্জ।

ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো পরিদর্শন করার পর মিয়ানমারে  জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার প্রতিনিধি হান্স টেড ফেল্ড বিবিসিকে বলছেন, “জরুরি ভিত্তিতে যা করা দরকার সেটা হচ্ছে তাদের জন্যে খাবার-দাবার ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা। তাদের কাছে অন্যান্য সামগ্রীও পৌঁছাতে হবে। কারণ আগুনে তারা সবকিছু হারিয়ে ফেলেছে।”

এদিকে, মিয়ানমারে রাখাইন রাজ্য সরকারের মুখপাত্র দাবি করছেন পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে।
তবে রাজধানী সিতওয়েতে নতুন করে কোনো শরণার্থীকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না।

এর আগে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের পক্ষ থেকে বলা হয়, সবশেষ এই সহিংসতায় উপকূলীয় চাওপিউ শহরের রোহিঙ্গা মুসলিম-অধ্যুষিত একটি এলাকার পুরোটাই ধ্বংস হয়ে গেছে। সংস্থাটি স্যাটেলাইট থেকে তোলা ওই এলাকার ছবিও প্রকাশ করেছে।

মিয়ানমারে প্রেসিডেন্টের একজন মুখপাত্র বিবিসির কাছে ওই ছবির সত্যতা স্বীকার করেছেন।

গত জুন মাস থেকে এই সহিংসতা শুরু হয় যাতে এ পর্যন্ত এক লাখের মতো মানুষ উদ্ধাস্ত হয়েছে। এদের প্রায় সকলেই রোহিঙ্গা মুসলিম।
সরকারও স্বীকার করেছে যে সহিংসতায় ৮০ জনের মতো নিহত হয়েছে।

টেকনাফ-উখিয়া সীমান্তে বিজিবির টহল জোরদার

গোলাম আজম খান কক্সবাজার থেকেঃ

মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে নতুন করে শুরু হওয়া জাতিগত দাঙ্গার সূত্র ধরে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ার সীমান্ত এলাকায় বিজিবির টহল জোরদার করা হয়েছে। বিশেষত টেকনাফের নাফ নদী থেকে সেন্টমার্টিন সমুদ্র উপকূল পর্যন্ত বিজিবির পাশাপাশি  কোস্টগার্ডের নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।

মিয়ানমারে জাতিগত সহিংসতার কারণে আরাকানের রোহিঙ্গারা যাতে সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ করতে না পারে সেজন্য বিজিবি এবং কোস্টগার্ডকে সতর্ক অবস্থানে রাখা হয়েছে।

গত সপ্তাহের রোববার থেকে আরাকানের চকপো, পাত্তরখিল্যা, ম্রো, মিনবাউসহ কয়েক টাউনশিপে নতুন করে জাতিগত দাঙ্গা শুরু হয়। এ সময় রোহিঙ্গাদের শত শত বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ হামলা ও লুটপাট করা হয়। এসব হামলায় বাস্তুচ্যুত হয়ে শত শত রোহিঙ্গা ছোট বড় ইঞ্জিন নৌকা করে বাংলাদেশের দিকে পালিয়ে আসার চেষ্টা করে।

এসব রোহিঙ্গারা যাতে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য কক্সবাজারের জেলা প্রশাসন, পুলিশ-বিজিবি এবং কোস্টগার্ড সীমান্ত এলাকায় সর্বোচ্চ নজরদারির ব্যবস্থা করেছে।

বিজিবি টেকনাফের ৪২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল জাহিদ হাসান রোববার সকালে টেকনাফের নাফনদীর শাহপরীর দ্বীপ পয়েন্ট থেকে সেন্টমার্টিন উপকূল পর্যন্ত নিজেই বিজিবির টহল পরিচালনা করেন।

সন্ধ্যায় তিনি জানান, সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত নাফনদীল মোহনা থেকে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের নিয়ে কোনো নৌযানকে সাগরে ভাসমান অবস্থায় দেখা যায়নি।

তিনি আরো জানান, সাগরপথে কোনোভাবেই যাতে রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করতে না পারে সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতায় রয়েছে বিজিবি এবং কোস্টগার্ড। এ ব্যাপারে টেকনাফে বিজিবির জনবলও বাড়ানো হয়েছে।

অপরদিকে উখিয়ার বালুখালী, ঘুমধুম এবং নাইক্ষ্যংছড়ির তমব্রু সীমান্ত দিয়ে গতকাল ১০ জন এবং আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত ২০ জন রোহিঙ্গাকে অনুপ্রবেশকালে আটক করে মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছে বিজিবি।

কক্সবাজারের বিজিবি ১৭ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল খালেকুজ্জামান জানান, অনুপ্রবেশের এ চেষ্টাটি স্বাভাবিক ঘটনা। আরাকানে নতুন করে সহিংসতার পর উখিয়া এবং নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত এলাকা শান্ত থাকলেও বিজিবির টহলদলকে জোরদার রাখা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.