মিয়ানমার সীমান্ত পরিস্থিতি
বাংলাদেশ-মিয়ানমার
সীমান্তে সৃষ্ট উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতির অবসানে বাংলাদেশকে বহির্বিশ্বে
তার বহুমুখী কূটনীতি আরও বাড়াতে হবে। সীমান্তে নতুন সেনাসমাবেশ, দৃশ্যত
উসকানিমূলক গুলিবর্ষণের ঘটনার সঙ্গে প্রাথমিকভাবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন
প্রক্রিয়াকে অকার্যকর করা এবং মিয়ানমার থেকে অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের
দেশত্যাগে বাধ্য করার কৌশলের যোগসূত্র নাকচ করা যাবে না।
উপরন্তু, তারা
শুধু রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করাই নয়, এ ঘটনা কার্যত
জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীকে চ্যালেঞ্জ করার শামিল। তমব্রুর
আশ্রয়শিবিরে থাকা ৬ হাজার ২২ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশেই থাকতে বাধ্য করার
প্রকাশ্য নীতি ইঙ্গিত করছে যে দেশটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হুঁশিয়ারি ও
সীমিত নিষেধাজ্ঞাকে এখন পর্যন্ত অগ্রাহ্য করে চলতেই সংকল্পবদ্ধ। দ্বিপক্ষীয়
পর্যায়ে স্বাভাবিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানে তাদের
কোনো আগ্রহ নেই। বরং তারা যেন শক্তি প্রদর্শন করেই ‘রোহিঙ্গারা তাদের
নাগরিক নয়, তারা বাংলাদেশের বাঙালি’—এ ধরনের কৌশল বাস্তবায়নেই বদ্ধপরিকর।
আমরা কিছুটা বিস্মিত যে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে গা ছাড়া মনোভাব দেখিয়ে
চলা সু চি সরকারের সামরিক শক্তির নবতর মহড়া দেখানোর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক
সম্প্রদায় যথাযথ সংবেদনশীলতায় উদ্বেগ প্রকাশ করা থেকে বিরত রয়েছে। এ
পর্যন্ত শুধু ওয়াশিংটনে এক সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের
মুখপাত্র বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র সতর্কতার সঙ্গে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।
বাংলাদেশের উদ্বেগের বিষয়টি তারা বিবেচনায় নিয়েছে।’ অথচ ভারত, চীন ও
রাশিয়ার মতো ঘনিষ্ঠ বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর কাছ থেকেও দ্রুত যথাযথ
প্রতিক্রিয়া প্রত্যাশিত। সীমান্তে ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও সেনা মোতায়েনের
সপক্ষে দুই দেশের পতাকা বৈঠকে যে যুক্তি দেখিয়ে মিয়ানমার আশ্বস্ত করার একটা
চেষ্টা করেছে, তার সঙ্গে বাংলাদেশের দিকে অস্ত্র তাক করা বা গুলিবর্ষণের
মতো ঘটনাবলির সংগতি নেই। মিয়ানমার সরকারের মুখপাত্র জ তে বার্তা সংস্থা
এএফপির কাছে যে যুক্তি হাজির করেছেন, তাতে সত্যের লেশমাত্র আছে বলে মনে হয়
না। জতে যুক্তি দিয়েছেন, ‘সন্ত্রাসবাদ, বিশেষ করে আরসার তৎপরতার ব্যাপারে
এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
এটি বাংলাদেশের সঙ্গে বিরোধের উদ্দেশ্যে করা
হয়নি।’ প্রশ্ন হলো, অতীতে বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে যৌথ সাঁড়াশি অভিযান
চালিয়ে আরসাসহ জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সফল অভিযান চালিয়েছে। সুতরাং সন্ত্রাস বা
জঙ্গি দমনই যদি উদ্দেশ্য হয়, তাহলে বাংলাদেশকে না জানিয়ে সীমান্তে
উদ্বেগজনকভাবে সেনাসমাবেশ ঘটানোর কথা নয়। সীমান্ত চুক্তি এবং আন্তর্জাতিক
রীতিনীতি অনুযায়ী প্রতিবেশীকে এ বিষয়ে কখনো আগাম জানিয়ে এ ধরনের বিশেষ
পদক্ষেপ নেওয়ার যুক্তি থাকতে পারে। রোহিঙ্গাদের কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনকে
দমন বা তার ভূখণ্ডগত জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে বাংলাদেশের বন্ধুভাবাপন্ন
সরকার ও জনগণকে আস্থায় নিতে ব্যর্থ হলে মিয়ানমারের বিদেশনীতি আত্মঘাতী বলেই
বিবেচিত হবে। আমরা মনে করি, বাংলাদেশকে অবিলম্বে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের
অভিন্ন বন্ধুদের কাছে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিশেষ দূত প্রেরণ করতে হবে। স্মরণ
করতে পারি, মূলত শরণার্থী সংকটের আশু সমাধানের যুক্তি দেখিয়ে ১৯৭১ সালে
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক মিত্রদের
কাছে গিয়েছিলেন। বর্তমান পরিস্থিতি সেই মাপের ঘটনা না হলেও বাংলাদেশ যে
ধরনের কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে আসছে, তাতে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ
গুরুত্বারোপের বিষয়টির প্রতিফলন ঘটছে না বলে প্রতীয়মান হয়। বাংলাদেশ
অবশ্যই শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানে বিশ্বাসী। কিন্তু আত্মরক্ষার স্বাভাবিক
তাগিদে তাকে অবশ্যই প্রস্তুত থাকতে হবে। এ কারণে জাতিসংঘসহ তার বন্ধু
দেশগুলোর কাছে বর্তমান নতুন পরিস্থিতির বিষয় অবহিত করে চিঠি দেওয়া
প্রয়োজন কি না, তা বিবেচনাযোগ্য।
No comments