ভারত মহাসাগরে চীন-ভারতের আধিপত্যের লড়াই : কে কতটা এগিয়ে
ভারত
মহাসাগরে সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় নেমেছে চীন ও ভারত। আঞ্চলিক
ও আন্তর্জাতিক পরিসরে আধিপত্য বাড়াতে সেখানে শক্তিশালী উপস্থিতি নিশ্চিত
করার লড়াইয়ে নেমেছে দুই উদীয়মান পরাশক্তি। জিবুতিতে চীনের সামরিক ঘাঁটি
স্থাপনের পর এবার পাল্লা দিয়ে সিয়াচেলস, ওমান ও সিঙ্গাপুরে নিজের অবস্থান
তৈরির চেষ্টা করছে ভারত। চীন ও ভারত নিজেদের এসব উদ্যোগের নেপথ্যে
অর্থনৈতিক স্বার্থের কথা বললেও বিশ্লেষকেরা বলছেন, এইসব উদ্যোগ প্রকৃতপক্ষে
সামরিক উদ্দেশে ব্যবহৃত হবে। সিএনবিসির এক রিপোর্টে উঠে এসেছে ভারত-চীনের
আধিপত্য বিস্তার প্রচেষ্টার এই চিত্র। ২০১৬ সালে চীন জানিয়েছিল, জিবুতিতে
দেশটি তার প্রথম ‘বিদেশি ঘাঁটি’ স্থাপন করার কথা ভাবছে। তা ছাড়া চীনের
রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তানজানিয়ায় বন্দর নির্মাণের সিদ্ধান্ত
চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ প্রকল্পকে এগিয়ে নিয়েছে বেশ খানিকটা। পৃথিবীর
দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীন যে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছে
তাকে অনেক বিশ্লেষক ‘স্ট্রিং অব পার্ল’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এই
‘মুক্তার মালার’ কাজ হচ্ছে বিশাল এলাকাজুড়ে সারিবদ্ধ প্রতিরক্ষা ও
বাণিজ্যিক কেন্দ্র স্থাপন করা যা চীনের স্বার্থ রক্ষা করবে। চীনের সঙ্গে
পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ভারতও। গত মাসে ওমান সফরে গিয়ে ভারতের
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ওমানের নৌবাহিনীর স্থাপনা ব্যবহারের একটি
চুক্তি করেছেন। ওমানের নৌঘাঁটিটি হরমুজ প্রণালীর কাছে। প্রতিদিন সমুদ্রপথে
রফতানি হওয়া তেলের ৩০ শতাংশই হরমুজ প্রণালী দিয়ে যাওয়া আসা করে।
এ বছরের
শুরুতে একটি বিমান ঘাঁটি ও একটি নৌঘাঁটি নির্মাণের বিষয়ে সিয়াচেলসের সঙ্গে
ভারতের ২০ বছর মেয়াদি চুক্তি হয়েছে। আর গত বছরের নভেম্বরে, সিঙ্গাপুরের
সঙ্গে ভারত সরকার একটি চুক্তি করেছে যাতে ভারতে জন্য সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি
নৌঘাঁটি ব্যবহারের পথ সুগম হবে। সিএনবিসির রিপোর্টে বলা হয়েছে, চীনের
প্রভাব বিস্তারের চেষ্টায় শঙ্কিত ভারত। ভারত মহাসাগরের সীমান্তজুড়ে থাকা
আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার আওতায় রয়েছে সবচেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক সমুদ্রপথ। এই সমুদ্রপথ বিশ্ববাণিজ্যের জন্য
অপরিহার্য। সমুদ্র থেকে উত্তোলিত মোট তেলের ৪০ শতাংশই আসে ভারত মহাসাগর
থেকে। ভারত মহাসাগর একই সঙ্গে মৎস্য সম্পদ ও খনিজ সম্পদেও ভরপুর।
বিশ্লেষকদের বরাতে সিএনবিসি বলছে, কিন্তু প্রভাব বাড়ানোর এই চেষ্টা কেবল
অর্থনৈতিক নয়, আবার কেবল সামরিকও নয়। বরং অর্থনৈতিক প্রচেষ্টাগুলোর মধ্যেই
মিশে আছে সামরিক উদ্দেশ্য। অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সিনিয়ার
রিসার্চ ফেলো ডেভিড ব্রিউস্টার বলেছেন, ‘ভারত মহাসাগরে আমরা ঘাঁটি
নির্মাণের প্রতিযোগিতা দেখতে পাচ্ছি।’ গত জুলাই মাসে চীনের মার্চেন্টস
পোর্ট হোল্ডিংস ৯৯ বছরের জন্য শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটায় বন্দর ইজারা নেয়।
তখন থেকেই সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করে, চীনের নৌবাহিনী ওই বন্দর ব্যবহার
করতে পারে। এর কয়েক মাস পরেই রয়টার্স জানিয়েছিল, ভারত হাম্বানটোটার
বিমানবন্দর নিয়ে নিতে চাইছে। ভারতীয় বিশ্লেষক সংস্থা অবজারভার রিসার্চ
ফাউন্ডেশন তাদের অক্টোবর রিপোর্টে লিখেছে, ভারতীয় ও পশ্চিমা কূটনীতিবিদেরা
মোটামুটি নিশ্চিত, ‘জিবুতির মতো হাম্বান্টোটাও চীনের জন্য আর একটি সেনা ও
নৌঘাঁটি হয়ে উঠবে।’ মালদ্বীপ ও মিয়ানমার হচ্ছে এমন দু’টি দেশ, বিশাল
বিনিয়োগের কারণে চীন যেখানে সামরিক ঘাঁটি তৈরি করতে পারবে। বিপরীতে ইরানে
চাবাহার গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে ভারত। ‘ইন্ডিয়া পোর্টস গ্লোবাল’-এর
এই উদ্যোগকে পাকিস্তানে থাকা চীনের গাদার বন্দরের জবাব হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ব্রিউস্টার ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, আগামী দিনগুলোতে ভারত যে চাবাহার বন্দরকে
সামরিক কাজে ব্যবহার করবে না তা বলে যায় না। ৮৫ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নির্মিত
চাবাহার গভীর সমুদ্র বন্দর পাকিস্তানের গাদার বন্দর থেকে মাত্র ৩৫০
কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ভারত মহাসাগর যুদ্ধাস্ত্রের জন্যও বিশেষভাবে
চিহ্নিত হচ্ছে ইদানীংকালে। চীন সেখানে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধী ব্যবস্থা
চালু করতে চায়। অন্য দিকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভারত যে ড্রোন চেয়েছে তার
মূল উদ্দেশ্য ভারত মহাসাগরে চীনের কার্যকলাপে নজরদারি করা।
No comments