প্রাইভেট, কোচিং ও টিচিং by প্রফেসর মো: আবু নসর
প্রাইভেট
ও কোচিং ব্যবসার সূচনা হয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণ সূচিত হওয়ার অনেক
আগে। প্রাচীনকালে মানুষ গুরুর কাছে গিয়ে জ্ঞানপিপাসা মেটানোর প্রয়াস
পেয়েছে। এ সংস্কৃতিকে আমরা ‘গুরুগৃহ সংস্কৃতি’ বলতে পারি। আর এ গুরুগৃহ
সংস্কৃতি বিবর্তিত হয়েই আজকের দিনে হয়তো ‘গৃহশিক্ষক সংস্কৃতি’র রূপ লাভ
করেছে। প্রাচীনকালের গুরুগৃহের কার্যক্রমকে এক ধরনের প্রাইভেট বা কোচিং নাম
দেয়া যায়। তবে এ দুই যুগের কোচিংয়ের মধ্যে লক্ষ্য ও পদ্ধতিগত ক্ষেত্রে
গরমিল পরিলক্ষিত হয়। প্রাচীন গ্রিক সংস্কৃতিতে জ্ঞানচর্চার স্বর্ণযুগ সূচিত
হয় দার্শনিক মহামতি সক্রেটিসের সময় থেকে। অথচ সক্রেটিস কোনো
প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক শিক্ষক ছিলেন না। প্রাইভেট পড়ানো এবং কোচিং সেন্টার
খুলে ‘শিক্ষাবাণিজ্য’ করা এক কথা নয়। শিক্ষকেরা বিদ্যালয় শুরু হওয়ার আগে বা
ছুটির পর তাদের বাসায় বা শ্রেণিকক্ষে নিজ প্রতিষ্ঠানের সীমিতসংখ্যক
শিক্ষার্থীর সমন্বয়ে তাদের মধ্যে গ্রুপ করে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় যে পাঠদান ও
শিক্ষাদান করেন, সেটাকে প্রাইভেট পড়ানো বলা হয়। প্রাইভেট পড়ানোর প্রচলন
যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। আর বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের
ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে ভাড়াবাড়িতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিষয়ওয়ারি ক্রমাগত
পাঠদানের জন্য যে সেন্টার বা কেন্দ্র খোলা হয়, সেটি হলো কোচিং সেন্টার।
বর্তমানে এর অর্থ কোচিং বাণিজ্য। ‘কোচিং’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো
পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য কোনো ছাত্রছাত্রীকে পড়ানো। কোচিং শব্দটি ব্রিটিশ
পদ্ধতি অনুসরণকারী। আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষাব্যবস্থা
একটি বিশেষ অর্থে ব্রিটিশ শাসনের সূচনা থেকেই প্রচলিত। এসএসসি ও এইচএসসি
পরীক্ষায় অংশগ্রহণের যোগ্যতা যাচাইয়ের পরীক্ষা তথা টেস্ট বা নির্বাচনী
পরীক্ষার পর চূড়ান্ত বা পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের আগ পর্যন্ত বিদ্যালয় ও
কলেজগুলো কর্তৃক বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষক দিয়ে পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষার
প্রস্তুতির জন্য শ্রেণিকক্ষে পড়ানোর যে ব্যবস্থা করা হয়, তা কোচিং হিসেবে
পরিচিত ছিল। এ পদ্ধতি বিদ্যালয় বা কলেজ কর্তৃক আয়োজিত একটি আনুষ্ঠানিক
ব্যবস্থা।
এটাকে শিক্ষাব্যবস্থার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ বলা যেতে পারে।
কিন্তু পেশাদার শিক্ষকেরা নিজ বাসগৃহে কিংবা ভাড়াবাড়িতে পরীক্ষার
প্রস্তুতির জন্য বা ভর্তির লক্ষ্যে অর্থের বিনিময়ে পড়ানোর যে ব্যবস্থা
করেন, সেটাই হলো বর্তমান সময়ের কোচিং। কোচিং শব্দের আর এক অর্থ হলো
শিক্ষাদান বা উপদেশ। কিন্তু বর্তমানে কোচিংয়ের অপপ্রয়োগের ফলে কুফলই
পরিলক্ষিত হচ্ছে। ‘টিচিং’-এর আভিধানিক অর্থ হলো শ্রেণিকক্ষে কোনো বিষয়ে
সম্পূর্ণ জ্ঞানদান করা, যা অনেক ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী। বর্তমানে কোচিং
বাণিজ্যের ব্যাপকতার কাছে টিচিংয়ের ত্রাহি অবস্থা। শ্রেণিকক্ষে টিচিংয়ের
ভাগ্যাকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকদের পাঠদানে
অমনোযোগিতার জন্য টিচিংয়ের এ দুর্দশা। প্রাইভেট ও কোচিং প্রাতিষ্ঠানিক বা
একাডেমিক শিক্ষার পরিপূরক হিসেবে কাজ করছে না। কোচিংয়ে নিয়োজিত শিক্ষকদের
উদ্দেশ্য ব্যবসায়িক। তারা অনেকেই ‘জ্ঞান ব্যবসা’ করেন। এ ব্যবসার জন্ম
প্রাতিষ্ঠানিক বা একাডেমিক শিক্ষার আগে। প্রাচীন গ্রিসে সোফিস্ট নামক একদল
পেশাদার জ্ঞান ব্যবসায়ীর আবির্ভাব ঘটেছিল। তারা বড় অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে
জ্ঞানপিপাসু তরুণ যুবসমাজকে তাদের চাহিদা অনুযায়ী এমন জ্ঞান প্রদান করতেন,
যা বহুলাংশে সার্বজনীন নৈতিকতার পরিপন্থী। গ্রিক ভাষায় ‘সোফিস্ট’ কথাটির
আভিধানিক অর্থ জ্ঞান হলেও জ্ঞানচর্চার ইতিহাসে একদল পেশাদার জ্ঞান
ব্যবসায়ীকে চিহ্নিত করা হয়। এর ধারাবাহিকতায় বর্তমানে দেশে ভয়াবহভাবে
প্রাইভেট ও কোচিং সেন্টার বেড়ে চলেছে। প্রাইভেট ও কোচিংয়ের অশুভ ছোবল কেবল
স্কুলপর্যায়ে প্রসারিত নয়, উচ্চ মাধ্যমিক স্তর থেকে শুরু করে
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সম্প্রসারিত। প্রাইভেট ও কোচিং সেন্টার এখন
‘শিক্ষা বাণিজ্যকেন্দ্র’। আর কিছুসংখ্যক শিক্ষক জ্ঞানসাধক না হয়ে
জ্ঞানব্যবসায়ী হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছেন। অর্থাৎ প্রাইভেট ও কোচিং সেন্টারে
শিক্ষকেরা জ্ঞানসাধনার পরিবর্তে জ্ঞান ব্যবসায়ে নিয়োজিত থাকছেন বলে
বিজ্ঞজনদের অভিমত। শিক্ষায় কোচিং ভাইরাস শিক্ষার গুণগতমানের অন্তরায়।
ইদানীং শিক্ষকেরা নিজ বিদ্যালয়ে ও মহাবিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে যথাযথ ও
নিয়মিত পাঠদান না করে অন্যত্র প্রাইভেট, টিউশনি ও কোচিং করানোর জন্য বেশি
আগ্রহী। প্রকৃত টিচিং বলতে যেটা বোঝায়, সেটা আজ বিরল। আজ শ্রেণিকক্ষে
শিক্ষকদের প্রকৃত, মানসম্মত ও সঠিক পাঠদানের বা শিক্ষাদানের (টিচিং)
ব্যবস্থা ও কার্যক্রম অনুপস্থিত। টিচিংয়ের জায়গা এখন প্রাইভেট ও কোচিং
সেন্টারগুলোর দখলে। এটা শিক্ষার্থীদের মধ্যে অল্প বয়সেই ব্যবসায়িক
মনোবৃত্তির জন্ম দেয় এবং শিক্ষকদের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা সৃষ্টির পথে বাধা
হয়ে দাঁড়ায়। এ অবস্থায় সততা, নৈতিকতা, দেশপ্রেম ও মানবিকতাসহ মূল্যবোধহীন
যান্ত্রিক মানুষ হয়ে গড়ে উঠছে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম। প্রাইভেট ও কোচিংকে
বাদ দিয়ে টিচিংয়ে নিবেদিতপ্রাণ, এমন প্রকৃত শিক্ষকদের অভাব। শিক্ষক হবেন
শিক্ষা ও সভ্যতার অধিকতর অগ্রগণ্য অভিভাবক। প্রাচীন ভারতবর্ষ, চীন, মিসর
প্রভৃতি দেশে সাধারণত ধর্মযাজকেরা শিক্ষকতা করতেন এবং তারা সামাজিক মর্যাদা
ও সুবিধা ভোগ করতেন।
ইহুদি সমাজে শিক্ষককে মা-বাবার চেয়েও বড় মনে করা হতো।
শিল্পকলা, রাজনীতি ও দর্শন পড়ানোর মাধ্যমে প্রাচীন গ্রিসে শিক্ষকতা শুরু
হয়েছিল। পাঁচ থেকে পনেরো শতক পর্যন্ত ইউরোপে রোমান ক্যাথলিক চার্চগুলোতে
পাঠদান করা হতো এবং এগুলো ছিল শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু। প্রাচীনকালে মহান ও
আদর্শ শিক্ষকদের মধ্যে গ্রিসের অ্যারিস্টটল, ইটালির গ্যালিলিও, চীনের
কনফুসিয়াস, গ্রিসের পিথাগোরাসের বিভিন্ন সেক্টরে শিক্ষাদানের ও শিক্ষকতার
কৌশল, রকমফের বিশ্ববাসীর কাছে প্রণিধানযোগ্য। শিক্ষক হবেন কখনো বন্ধু, কখনো
মা-বাবা, অভিভাবক, কখনো আদর্শ মহৎ ব্যক্তি, কখনো সাহায্যকারী এবং কখনো
অভিজ্ঞ উপদেষ্টা। শ্রেণিকক্ষে একমাত্র টিচিংয়ের মাধ্যমেই শিক্ষক-ছাত্রের
সুপ্ত প্রতিভাকে বিকশিত করতে পারেন। একজন শিক্ষক মানুষ গড়ার কারিগর আর
শিক্ষাই জীবনের আলো। শিক্ষাই যদি জীবনের আলো হয় তো একজন শিক্ষক দিয়াশলাই। এ
দিয়াশলাই ছাত্র নামক মোমবাতিকে আগুনে জ্বালিয়ে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে
তোলে। আজ সেই শিক্ষকেরই প্রয়োজন। এ সত্ত্বেও শিক্ষকসমাজের একাংশের
নৈতিকতাবোধের অভাবে দেশে ব্যাপকভাবে প্রাইভেট ও টিউশনের ব্যবস্থা এবং কোচিং
সেন্টার চালু হচ্ছে। অবশ্য সরকার জাতীয় শিক্ষানীতিতে এর যথোপযুক্ত
প্রতিকারের উদ্দেশ্যে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মেধা বিকাশের সব পথ উন্মুক্ত
রেখে ক্ষতিকর প্রাইভেট ও কোচিং বাণিজ্যকে নিয়ন্ত্রণ ও নিরুৎসাহিত করতে
যত্নবান হয়েছে। তবুও শিক্ষকদের প্রাইভেট ও কোচিং বাণিজ্য থেমে নেই। ২০১২
সালে ২০ জুন প্রাইভেট বা টিউশনি বন্ধ করতে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে শিক্ষা
মন্ত্রণালয়।
সেখানে বলা হয়- সরকারি এবং এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষকেরা
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বা নিজের বাড়িতে বা অন্যত্র কোচিং করাতে বা প্রাইভেট
পড়াতে পারবেন না। বাস্তবতা হচ্ছে, ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই কয়েক
কিলোমিটার দূরের কোচিং সেন্টারে পড়তে যেতে হয় শিক্ষার্থীদের। শিক্ষা
মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি
স্কুল-কলেজের শিক্ষকেরা চালিয়ে যাচ্ছেন কোচিং বাণিজ্য। বেশির ভাগ শিক্ষক
নিজের বা ভাড়া করা বাড়িতে গড়ে তুলেছেন ‘বিকল্প’ বাণিজ্যিক স্কুল ও প্রাইভেট
সেন্টার। এতে শিক্ষার্থীদের সময় ও শ্রমের অপচয়ের পাশাপাশি অভিভাবকদের ব্যয়
হচ্ছে বড় অঙ্কের টাকা। তাই শিক্ষা এখন উচ্চমূল্যের পণ্য ও বাণিজ্যনির্ভর।
বস্তুত কোচিং ব্যবস্থাটি অনৈতিক। এটি মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থাকে একপ্রকার
প্রতিবন্ধী করে ফেলেছে। শিক্ষকেরা বুদ্ধি ও কৌশল পরিবর্তন করে, সরকারি
নির্দেশকে উপেক্ষা করে কোচিং বাণিজ্য চালু রেখেছেন। এতে মেধার বিকাশ
বিঘ্নিত এবং শিক্ষার গুণগতমান বিপন্ন হচ্ছে। মেধার অপচয় সবচেয়ে বড়
ট্র্যাজেডি। মেধাই হলো জাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ। নৈতিকতাসম্পন্ন শিক্ষক দিয়েই
শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশ ঘটানো বা মেধাবী শিক্ষার্থী সৃষ্টিসহ দেশ ও
জাতির উন্নয়ন সম্ভব। উল্লেখ্য, একাডেমিক পর্যায়ে শিক্ষাকার্যক্রম সুন্দর,
সঠিক ও বিধিসম্মতভাবে পরিচালিত হলেই প্রাইভেট ও কোচিং-নির্ভরতা কমে আসবে।
তাই কোচিং সেন্টার নয়, শ্রেণিকক্ষই হতে হবে শিক্ষাদানের প্রাণকেন্দ্র।
লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ, সরকারি কলেজ, কলারোয়া, সাতক্ষীরা
লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ, সরকারি কলেজ, কলারোয়া, সাতক্ষীরা
No comments