মঞ্চের পালা, বয়াতির লড়াই by শামীমুল হক
ঈমান আলী মইরা গেছে/ সব বেঈমান আলীর
দল...। পালাগানে পালাকারদের প্রায়ই এ গানটি গাইতে শোনা যায়। পালায় জিততে
তাদের যে কসরত তা তন্ময় হয়ে শোনেন দর্শক।
গ্রামেগঞ্জে এখনও
শীতকাল এলে আয়োজন করা হয় পালাগানের। মঞ্চ বানিয়ে, আলোকসজ্জা করে অন্যভাবে
সাজানো হয় মাঠ। মঞ্চের দুই পাশে বসেন দুই বয়াতির দল। দুই বয়াতির গানের লড়াই
দেখতে দূর দূরান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসেন আসরে। সন্ধ্যা থেকে
শুরু হওয়া এ পালাগান চলে ভোর পর্যন্ত। সারা রাত দর্শক-শ্রোতা মন্ত্রমুগ্ধের
মতো বয়াতির লড়াই দেখেন। কখনও হাততালি দেন। কখনও উদ্বেগে সময় কাটান- বিপক্ষ
বয়াতির ছুড়ে দেয়া প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে কিনা অপর বয়াতি এ চিন্তায়।
না, গানে গানে প্রশ্নের উত্তর তো দিচ্ছেনই পাশাপাশি নিজেও ছুড়ে দিচ্ছেন
প্রশ্নের তীর। টান টান উত্তেজনা। এমন লড়াইয়ে লড়াইয়ে ভোর রাতে গিয়ে দুই
বয়াতি এক হয়ে এক সুরে গান ধরেন। দর্শকদের জানান দেন, রাতব্যাপী যে গানের
যুদ্ধ হয়েছে কিংবা পালাগানে দুই জনে দুই পক্ষে থাকলেও আসলে পৃথিবীতে সবই
এক। অর্থাৎ একজন ছাড়া অন্যজন চলতে পারেন না। চলতে গেলে সবকিছুরই প্রয়োজন
আছে। কাজেই দ্বন্দ্ব ফ্যাসাদ নয়, সবাই এক হয়েই কাজ করতে হবে। শেষ পর্যন্ত
পালাকাররা তাদের ভূমিকায় এটাই বুঝিয়ে দিয়ে যান। মঞ্চের পালাগানের রাজনীতিতে
দুই পক্ষ এক হলেও দেশের রাজনৈতিক মঞ্চে প্রধান দুই দল কখনও এক হতে দেখা
যায় না। কারণ, এখানে হচ্ছে স্বার্থের লড়াই। এ লড়াইয়ে দেশ গোল্লায় যাক তাতে
কি? নিজের লাভ হলেই হলো। দেশের মানুষ যারা তারা তো রাজনৈতিক এ মঞ্চের
দর্শক। কিন্তু এ দর্শকরা সবই বোঝেন। তারা সব অনুভব করেন। তাদের সামনে সব
ফকফকা। কিন্তু তারা যে দর্শক। তাদের তো মঞ্চে ওঠার সুযোগ নেই। কথা বলারও
সুযোগ নেই। পালাগানের মঞ্চে যেমন দেখে ও শুনেই সার; তেমনি রাজনৈতিক মঞ্চের
সব নাটকও দেখা ও শুনার অধিকার তাদের। মঞ্চে ওঠার সুযোগ নেই। দেশের
রাজনীতিতে এসব দর্শকের মূল্যায়ন কবে হবে? এ দর্শকরা কখন মঞ্চে ওঠার সুযোগ
পাবেন? তাদের কথার কখন মূল্যায়ন হবে? এসব প্রশ্নের উত্তর না জানা পর্যন্ত
রাজনৈতিক মঞ্চের কুশীলবরা পালাকারদের মতো শেষ মুহূর্তেও এক হবেন না। ততদিন
তারা তাদের মতোই চলবেন। তারা একবারও ভাবেন না দর্শক না থাকলে তাদের
মূল্যায়ন কোথায়? দর্শক না থাকলে তাদের ভাল কাজে হাততালি দেবে কারা? দর্শক
না থাকলে তাদের এগিয়ে যাওয়ার সাহস যোগাবে কারা? অবশ্য যদি ৫ই জানুয়ারির মতো
একটি নির্বাচন করতে পারা যায়- তাহলে তো দর্শকের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন নেই
দর্শকদের তোয়াজ করার। এমন বোবা দর্শক যদি থাকেন তাহলে তাদের জন্য লাভই হয়।
যতক্ষণ খুশি মঞ্চ দখল রাখা যায়। যেভাবে খুশি মঞ্চ পরিচালনা করা যায়। কেউ
বাধা দেয়ার থাকবে না। কেউ প্রতিবাদ করার থাকবে না। কারও কাছে জবাবদিহি
করারও প্রয়োজন নেই। এমন মঞ্চ কি আসলে আখেরে নিজেদের কাছে রাখা যায়। কারণ,
দর্শকের মন যোগাতে না পারলে তারা তো অডিয়েন্স ছেড়ে চলে যাবেন। তাদের কাছে
ভাল না লাগলে মুখ ফিরিয়ে নেবেন। তারপর দর্শকবিহীন মঞ্চে কতক্ষণ থাকতে
পারবেন পালাকাররা। মঞ্চে যারা থাকেন তারা এসব বিষয় কখনও ভাবেন না। কারণ,
তাদের সঙ্গে থাকেন যন্ত্রীরা। আর তারা চোখ বুজে চলেন বলে মনে করেন
বাদ্যযন্ত্রের সুরে দর্শক তো থাকবেই। মনে পড়ছে একটি গল্পের কথা- এক গ্রামে
করা হয়েছে গানের আয়োজন। রাগ সংগীতের আয়োজন। সারা দিন মাইকিং করে বিখ্যাত
গায়কের গানে আমন্ত্রণ জানানো হয় গ্রামবাসীকে। সন্ধ্যায় মাঠভর্তি মানুষ।
মঞ্চে উঠলেন গায়ক। তিনি দেখেন, সামনে এক লোক একটি নতুন গামছা নিয়ে বসে
আছেন। গায়ক তাকে ডাকলেন। তার কাছ থেকে গামছাটি চেয়ে নিলেন। গায়ক নতুন গামছা
বিছিয়ে বসলেন মঞ্চে। তারপর চোখ বুজে টান দিলেন রাগ সংগীতে। দীর্ঘ সময় পর
গান শেষ করে দেখলেন মাঠ ফাঁকা। শুধু বসে আছেন একজন। গায়ক খুশি হলেন। যাক
একজন অন্তত রাগ সংগীতের মর্ম বুঝলেন। ডাকলেন তাকে। বললেন, গান নিশ্চয়ই
তোমার ভাল লেগেছে। সবাই চলে গেলেও তুমি রয়ে গেলে। আমি খুব খুশি হয়েছি।
লোকটি বললেন, আমি আপনার গান শোনার জন্য বসে থাকিনি। আমি বসে আছি আমার
গামছার জন্য।
No comments