অভিজিৎকে কেন মরতে হলো by তসলিমা নাসরিন
অমর একুশে বইমেলা থেকে বের হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির কাছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসংলগ্ন ফুটপাতে খুন হন অভিজিৎ রায়। আহত হন তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ। ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে তোলা ছবি। |
---১.
দেশে যদি থাকতাম বা বেড়াতে যেতাম আমাকে ঠিক ওভাবে অনেক আগেই কুপিয়ে মেরে
ফেলতো ওরা, যেভাবে অভিজিৎকে মেরেছে। অনেকে বলছে, কেন অভিজিৎ গেল সে দেশে!
সম্ভবত ফেসবুকের হুমকিকে অতটা সিরিয়াসলি নেয়নি সে! আশি-নব্বই-এর দশকে বড় বড়
মুফতি, ইমাম, মাদ্রাসা-পড়া আর মসজিদে পড়ে থাকা মাতব্বর গোছের লোকেরা ফতোয়া
দিত, মানুষের মাথার দাম ঘোষণা করতো। লক্ষ লোক মিছিল করতো, লং মার্চ করতো।
আজকাল ফেসবুকে ইউনিভার্সিটির ছেলেরা মেরে ফেলার হুমকি দেয়। যাকে হুমকি দেয়,
তাকে ঠিক ঠিক একদিন পেছন থেকে অতর্কিতে আক্রমণ করে, ধারালো চাপাতি দিয়ে
কুপিয়ে মারে। বাংলাদেশের সম্ভবত গত ক'বছরে এই বদলটাই হয়েছে।
অভিজিতের নৃশংস হত্যাকাণ্ড দেখার পর দেশে ফেরার আমার যে দুর্দমনীয় এক ইচ্ছে ছিল, সেটি মরে পড়ে রয়েছে উপুড় হয়ে, যেভাবে অভিজিৎ পড়ে ছিল নিজের রক্তের ওপর। একুশ বছর আমি দেশে নেই, এ কারণে নিরন্তর বয়ে বেড়িয়েছি এক দুঃখের বোঝা। দুঃখগুলো এখন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। ভাগ্যিস আমাকে দেশে ঢুকতে দেয়নি বাংলাদেশের কোনও সরকারই। ঢুকতে দিলে আমি জানি আমি দেশে ফিরতাম, আগে না জানলেও এখন বেশ জানি যে দেশে ফেরার কিছুক্ষণের মধ্যে আমার নিজের রক্তের ওপর উপুড় হয়ে মরে থাকতে হতো আমাকে, কোপানো মস্তিষ্কের টুকরো ভেসে থাকতো রক্তে।
---২. ধর্মীয় সন্ত্রাসীরা একদিনে বাড়েনি বাংলাদেশে। ৬৯এর গণআন্দোলন দেখেছি, ৭১এর যুদ্ধ দেখেছি। আশির দশকে আমার যেসব কলাম ছাপা হয়েছে বাংলাদেশের জাতীয় পত্রিকায়, তা ছাপা হতে পারে বলে আজ কেউ এখন কল্পনাও করতে পারবে না। হ্যাঁ, সেসব কলামে ধর্ম নিয়ে আমার ভিন্নমত ছিল। আজ ভিন্নমতের কোনও স্থান বাংলাদেশের সমাজে নেই। মানুষ কী খাবে, কী পান করবে, কী গান শুনবে, কী ছবি অাঁকবে, কী ভাববে, কী পড়বে, কী লিখবে, কী বলবে, কোথায় যাবে, কোথায় যাবে না, কী পোশাক পরবে, কার সঙ্গে মিশবে, কার সঙ্গে শোবে- তা বলে দেওয়ার লোক বাড়ছে। মনস্টার বাড়ছে। তাদের আদেশ অমান্য করলে উপুড় হয়ে মরে পড়ে থাকতে হবে রাজপথে, নিজের রক্তের ওপর।
আমার মনে হয়, বাংলাদেশের প্রগতিশীল মানুষেরা যদি ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের শক্ত হাতে দমন করতো, তাহলে ওরা যে বাড়টা বেড়েছে এতদিনে, তা বাড়তে পারতো না। নব্বইয়ের প্রথম দিকে আমার মাথার মূল্য ধার্য করা হচ্ছে, আমার ফাঁসির জন্য সারা দেশজুড়ে মৌলবাদীরা তাণ্ডব করছে, ইসলামী ঐক্যজোট মরিয়া হয়ে উঠেছে আমাকে হত্যা করার জন্য, মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা না নিয়ে সরকার আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে, মামলা করছে, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হচ্ছে- কোনও লেখকের জন্য এর আগে দেশজুড়ে অত ভয়ংকর দুর্যোগ কখনও আসেনি। প্রগতিশীলরা তখন বেশির ভাগই মুখ বন্ধ করে ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল বেরিয়েছে মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে, কিন্তু কেউ আমার উচ্চারণ করেনি। করবে কেন? 'নাস্তিক নারীবাদী'র বিরুদ্ধে শুধু যে মৌলবাদীরাই নয়, মৌলবাদীবিরোধীরাও। 'পুরুষতন্ত্রবিরোধী নাস্তিক নারীবাদীদের' মত প্রকাশের অধিকারে বাংলাদেশের মৌলবাদী গোষ্ঠী এবং মৌলবাদবিরোধী ধার্মিক গোষ্ঠী- কোনও গোষ্ঠীই বিশ্বাস করে না। দেশসুদ্ধ লোকের সামনে আমাকে আমার দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হল, এবং একুশ বছর দেশে পা রাখতে দেওয়া হয়নি। এর কোনও প্রতিবাদ সত্যিকার অর্থে হয়নি। মৌলবাদীদের সঙ্গে কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে দেশের প্রগতিশীলরা আমার বিরুদ্ধে গত একুশ বছর মিথ্যে অপবাদ রটিয়েছে পত্র-পত্রিকায়। প্রগতিশীল নামে খ্যাত সুবিধেবাদীগুলো মৌলবাদীদের মনে অথবা মানুষের ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগবে এই কারণ দেখিয়ে সরকার যে একের পর এক আমার বই নিষিদ্ধ করেছে- চুপচাপ দেখে গেছে। কোনও কোনও সময় তো নিজেরাই এগিয়ে এসে বই নিষিদ্ধ করেছে। নারীবাদী সমিতির নির্বোধ নারীরা আমাকে দোষ দিয়েছে আমি নাকি মৌলবাদীদের উত্থানের কারণ। তাদের এটুকু বোঝার ক্ষমতা হয়নি যে আমার লেখার কারণে মৌলবাদের উত্থান হয়নি, তাদের মৌনতা এবং তাদের আপোসই দেশে মৌলবাদের উত্থান ঘটিয়েছে। মৌলবাদীরা আমাকে চায়নি, সুতরাং মৌলবাদীদের খুশি করার জন্য, মৌলবাদীদের জিতিয়ে দেওয়ার জন্য সরকার আমাকে তাড়িয়েছে। জনগণ তা বিনাবাক্যে মাথা পেতে মেনে নিয়েছে। এই তো ছিল ঘটনা। তারপর থেকে কি মৌলবাদীরা হাত গুটিয়ে গুহায় বসে থাকবে! তারা যা ইচ্ছে তাই করার গ্রিন লাইসেন্স পেয়ে গেছে। তাই মহা উদ্যমে নেমে পড়লো একের পর এক বাক-স্বাধীনতা হরণে। একের পর এক শিল্পী সাহিত্যিক আর মুক্তচিন্তার মানুষের ওপর নেমে এলো মৃত্যুর হুমকি, বীভৎস শারীরিক আক্রমণ, খুনের চেষ্টা, খুন।
সেদিন যদি আমার ওপর মৌলবাদী আর সরকারের নির্যাতনকে রোধ করা হতো, তবে মৌলবাদীদের পেশিতে এত শক্তি আসতো না, তাদের আত্দবিশ্বাস এত ভয়ংকরভাবে বাড়তো না। যদি আমার নির্বাসনকে সেদিন রোধ করা হতো, তবে মৌলবাদী অপশক্তিকে অন্তত বুঝিয়ে দেওয়া যেতো, তাদের জয় অনিবার্য নয়।
---৩. ধর্মান্ধ বর্বরদের সঙ্গে বছরের পর বছর আপোস করতে থাকলে শেষ অবধি এই দাঁড়ায়। একসময় সমাজটা পচে গলে নষ্ট হয়ে যায়। আমার মনে হয়, বাংলাদেশের অবস্থা আজ তেমনই। আশির দশকের মাঝামাঝি প্রেসিডেন্ট এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম নিয়ে এলো। যদিও কেউ তাকে রাষ্ট্রধর্ম আনার জন্য অনুরোধ বা আবদার করেনি। সেই থেকে ইসলামের জয়জয়কার শুরু হয়ে গেল সমাজে। ইসলামী ব্যাংক, ইসলামী ইস্কুল, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী নার্সিং হোম, ইসলামী হাসপাতাল... সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে গেল ইসলাম, প্রবেশ করে গেল ভিনদেশি পোশাক এবং আচার আচরণ। নানা ধর্মের লোক যেখানে বাস করে, সেখানে তুমি কোনও একটা ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম বানাতে পারো না। বানালে সেই ধর্মটি অন্য ধর্মের চেয়ে প্রধান হয়ে ওঠে। এবং সেই ধর্মের মানুষেরা অন্য ধর্মের মানুষদের চেয়ে বেশি প্রাধান্য পায়, গণতন্ত্র বলে কিছু আর অবশিষ্ট থাকে না। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম আসার পর থেকে অমুসলিম সংখ্যা কমতে কমতে, মুসলিম সংখ্যাকে আট থেকে নয়ের ঘরেও পৌঁছে দিয়েছে। এভাবে চললে ১০০ ভাগ মুসলিমের দেশ হয়ে উঠতে খুব বেশি সময় নেবে না বাংলাদেশ। সৌদি আরব যেমন ১০০ ভাগ মুসলিমের দেশ। আভাসটা এরকমই দেখতে পাচ্ছি। অমুসলিমরা বিদেয় হলে কি মুসলিমরা সুখে শান্তিতে বসবাস করবে? আমার কিন্তু তা মনে হয় না। সুন্নিরা শিয়া মারছে, নাস্তিক মারছে, আহমদিয়া মারছে; শিয়ারা সুন্নি মারছে, কাফের মারছে। শুধু তরবারির ঝনঝনানি। আইসিস দেখিয়ে দিচ্ছে, খাঁটি মুসলমানের দেশ বলতে কী বোঝায়।
---৪. 'ধর্মনিরপেক্ষ' টার্মটায় আমি বিশ্বাস করি না। কারণ আমি মনে করি না সব ধর্ম সমান। ইসলাম আর বৌদ্ধ ধর্মকে আমি সমান বলে মনে করি না। ইহুদি আর জৈন ধমর্কেও নয়। বর্বরতাগুলো একেক ধর্মে একেক রকম। তবে নিরপেক্ষ কী করে হবে মানুষ? যদি দুই বর্বরের মধ্যে এক বর্বরের পাশে আমাকে দাঁড়াতে হয়, তবে তুলনায় কম বর্বরের পাশেই দাঁড়াবো। তাই নয় কি? যেহেতু ধর্মগুলো বর্বরতার দিক দিয়ে বা উদারতার দিক দিয়ে সমান নয়, তাই সকল ধর্মের প্রতি সবারই সমান শ্রদ্ধাশীল হওয়া এবং সকল ধর্মের প্রতি নিরপেক্ষ থাকাও সম্ভব নয়। বরং সকল মানুষকে, সে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মুসলমান, ইহুদি, জৈন, শিখ, নাস্তিক যা-ই হোক- সমান চোখে দেখাটা সম্ভব হতে পারে। আমি মনে করি মানুষ হিসেবে প্রত্যেকের অধিকার সমান হওয়া উচিত। সে ক্ষেত্রে 'ধর্মনিরপেক্ষতা'র বদলে 'বিশ্বাসীনিরপেক্ষতা' অথবা এরকম একটি শব্দ আমাদের ব্যবহার করা উচিত।
---৫. কে মেরেছে অভিজিৎকে? ফারাবী? খুনিরা কি ফেসবুকে বলে বেড়ায় 'আমি খুন করব'? আইসিসএর রাজ্যে বলে। কিন্তু এখনো তো বাংলাদেশ পুরোপুরি আইসিস রাজ্য হয়ে ওঠেনি। আমার মনে হয় ফারাবীর চেয়েও ভয়ংকর জিহাদী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অভিজিৎকে হত্যা করেছে। যেই করুক, খুনি ধরা পড়ুক চাই। খুনির শাস্তি হোক চাই। আমি বরাবরই মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে। কিন্তু আজকাল মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, আইসিসরা, বোকো হারামরা, আল শাবাবরা, আর বাংলাদেশে রাজিব হায়দার, হুমায়ুন আজাদ আর অভিজিৎ রায়ের খুনিদের মৃত্যুদণ্ড হলে আমি অখুশি হবো না।
অভিজিতের নৃশংস হত্যাকাণ্ড দেখার পর দেশে ফেরার আমার যে দুর্দমনীয় এক ইচ্ছে ছিল, সেটি মরে পড়ে রয়েছে উপুড় হয়ে, যেভাবে অভিজিৎ পড়ে ছিল নিজের রক্তের ওপর। একুশ বছর আমি দেশে নেই, এ কারণে নিরন্তর বয়ে বেড়িয়েছি এক দুঃখের বোঝা। দুঃখগুলো এখন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। ভাগ্যিস আমাকে দেশে ঢুকতে দেয়নি বাংলাদেশের কোনও সরকারই। ঢুকতে দিলে আমি জানি আমি দেশে ফিরতাম, আগে না জানলেও এখন বেশ জানি যে দেশে ফেরার কিছুক্ষণের মধ্যে আমার নিজের রক্তের ওপর উপুড় হয়ে মরে থাকতে হতো আমাকে, কোপানো মস্তিষ্কের টুকরো ভেসে থাকতো রক্তে।
---২. ধর্মীয় সন্ত্রাসীরা একদিনে বাড়েনি বাংলাদেশে। ৬৯এর গণআন্দোলন দেখেছি, ৭১এর যুদ্ধ দেখেছি। আশির দশকে আমার যেসব কলাম ছাপা হয়েছে বাংলাদেশের জাতীয় পত্রিকায়, তা ছাপা হতে পারে বলে আজ কেউ এখন কল্পনাও করতে পারবে না। হ্যাঁ, সেসব কলামে ধর্ম নিয়ে আমার ভিন্নমত ছিল। আজ ভিন্নমতের কোনও স্থান বাংলাদেশের সমাজে নেই। মানুষ কী খাবে, কী পান করবে, কী গান শুনবে, কী ছবি অাঁকবে, কী ভাববে, কী পড়বে, কী লিখবে, কী বলবে, কোথায় যাবে, কোথায় যাবে না, কী পোশাক পরবে, কার সঙ্গে মিশবে, কার সঙ্গে শোবে- তা বলে দেওয়ার লোক বাড়ছে। মনস্টার বাড়ছে। তাদের আদেশ অমান্য করলে উপুড় হয়ে মরে পড়ে থাকতে হবে রাজপথে, নিজের রক্তের ওপর।
আমার মনে হয়, বাংলাদেশের প্রগতিশীল মানুষেরা যদি ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের শক্ত হাতে দমন করতো, তাহলে ওরা যে বাড়টা বেড়েছে এতদিনে, তা বাড়তে পারতো না। নব্বইয়ের প্রথম দিকে আমার মাথার মূল্য ধার্য করা হচ্ছে, আমার ফাঁসির জন্য সারা দেশজুড়ে মৌলবাদীরা তাণ্ডব করছে, ইসলামী ঐক্যজোট মরিয়া হয়ে উঠেছে আমাকে হত্যা করার জন্য, মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা না নিয়ে সরকার আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে, মামলা করছে, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হচ্ছে- কোনও লেখকের জন্য এর আগে দেশজুড়ে অত ভয়ংকর দুর্যোগ কখনও আসেনি। প্রগতিশীলরা তখন বেশির ভাগই মুখ বন্ধ করে ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল বেরিয়েছে মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে, কিন্তু কেউ আমার উচ্চারণ করেনি। করবে কেন? 'নাস্তিক নারীবাদী'র বিরুদ্ধে শুধু যে মৌলবাদীরাই নয়, মৌলবাদীবিরোধীরাও। 'পুরুষতন্ত্রবিরোধী নাস্তিক নারীবাদীদের' মত প্রকাশের অধিকারে বাংলাদেশের মৌলবাদী গোষ্ঠী এবং মৌলবাদবিরোধী ধার্মিক গোষ্ঠী- কোনও গোষ্ঠীই বিশ্বাস করে না। দেশসুদ্ধ লোকের সামনে আমাকে আমার দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হল, এবং একুশ বছর দেশে পা রাখতে দেওয়া হয়নি। এর কোনও প্রতিবাদ সত্যিকার অর্থে হয়নি। মৌলবাদীদের সঙ্গে কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে দেশের প্রগতিশীলরা আমার বিরুদ্ধে গত একুশ বছর মিথ্যে অপবাদ রটিয়েছে পত্র-পত্রিকায়। প্রগতিশীল নামে খ্যাত সুবিধেবাদীগুলো মৌলবাদীদের মনে অথবা মানুষের ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগবে এই কারণ দেখিয়ে সরকার যে একের পর এক আমার বই নিষিদ্ধ করেছে- চুপচাপ দেখে গেছে। কোনও কোনও সময় তো নিজেরাই এগিয়ে এসে বই নিষিদ্ধ করেছে। নারীবাদী সমিতির নির্বোধ নারীরা আমাকে দোষ দিয়েছে আমি নাকি মৌলবাদীদের উত্থানের কারণ। তাদের এটুকু বোঝার ক্ষমতা হয়নি যে আমার লেখার কারণে মৌলবাদের উত্থান হয়নি, তাদের মৌনতা এবং তাদের আপোসই দেশে মৌলবাদের উত্থান ঘটিয়েছে। মৌলবাদীরা আমাকে চায়নি, সুতরাং মৌলবাদীদের খুশি করার জন্য, মৌলবাদীদের জিতিয়ে দেওয়ার জন্য সরকার আমাকে তাড়িয়েছে। জনগণ তা বিনাবাক্যে মাথা পেতে মেনে নিয়েছে। এই তো ছিল ঘটনা। তারপর থেকে কি মৌলবাদীরা হাত গুটিয়ে গুহায় বসে থাকবে! তারা যা ইচ্ছে তাই করার গ্রিন লাইসেন্স পেয়ে গেছে। তাই মহা উদ্যমে নেমে পড়লো একের পর এক বাক-স্বাধীনতা হরণে। একের পর এক শিল্পী সাহিত্যিক আর মুক্তচিন্তার মানুষের ওপর নেমে এলো মৃত্যুর হুমকি, বীভৎস শারীরিক আক্রমণ, খুনের চেষ্টা, খুন।
সেদিন যদি আমার ওপর মৌলবাদী আর সরকারের নির্যাতনকে রোধ করা হতো, তবে মৌলবাদীদের পেশিতে এত শক্তি আসতো না, তাদের আত্দবিশ্বাস এত ভয়ংকরভাবে বাড়তো না। যদি আমার নির্বাসনকে সেদিন রোধ করা হতো, তবে মৌলবাদী অপশক্তিকে অন্তত বুঝিয়ে দেওয়া যেতো, তাদের জয় অনিবার্য নয়।
---৩. ধর্মান্ধ বর্বরদের সঙ্গে বছরের পর বছর আপোস করতে থাকলে শেষ অবধি এই দাঁড়ায়। একসময় সমাজটা পচে গলে নষ্ট হয়ে যায়। আমার মনে হয়, বাংলাদেশের অবস্থা আজ তেমনই। আশির দশকের মাঝামাঝি প্রেসিডেন্ট এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম নিয়ে এলো। যদিও কেউ তাকে রাষ্ট্রধর্ম আনার জন্য অনুরোধ বা আবদার করেনি। সেই থেকে ইসলামের জয়জয়কার শুরু হয়ে গেল সমাজে। ইসলামী ব্যাংক, ইসলামী ইস্কুল, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী নার্সিং হোম, ইসলামী হাসপাতাল... সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে গেল ইসলাম, প্রবেশ করে গেল ভিনদেশি পোশাক এবং আচার আচরণ। নানা ধর্মের লোক যেখানে বাস করে, সেখানে তুমি কোনও একটা ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম বানাতে পারো না। বানালে সেই ধর্মটি অন্য ধর্মের চেয়ে প্রধান হয়ে ওঠে। এবং সেই ধর্মের মানুষেরা অন্য ধর্মের মানুষদের চেয়ে বেশি প্রাধান্য পায়, গণতন্ত্র বলে কিছু আর অবশিষ্ট থাকে না। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম আসার পর থেকে অমুসলিম সংখ্যা কমতে কমতে, মুসলিম সংখ্যাকে আট থেকে নয়ের ঘরেও পৌঁছে দিয়েছে। এভাবে চললে ১০০ ভাগ মুসলিমের দেশ হয়ে উঠতে খুব বেশি সময় নেবে না বাংলাদেশ। সৌদি আরব যেমন ১০০ ভাগ মুসলিমের দেশ। আভাসটা এরকমই দেখতে পাচ্ছি। অমুসলিমরা বিদেয় হলে কি মুসলিমরা সুখে শান্তিতে বসবাস করবে? আমার কিন্তু তা মনে হয় না। সুন্নিরা শিয়া মারছে, নাস্তিক মারছে, আহমদিয়া মারছে; শিয়ারা সুন্নি মারছে, কাফের মারছে। শুধু তরবারির ঝনঝনানি। আইসিস দেখিয়ে দিচ্ছে, খাঁটি মুসলমানের দেশ বলতে কী বোঝায়।
---৪. 'ধর্মনিরপেক্ষ' টার্মটায় আমি বিশ্বাস করি না। কারণ আমি মনে করি না সব ধর্ম সমান। ইসলাম আর বৌদ্ধ ধর্মকে আমি সমান বলে মনে করি না। ইহুদি আর জৈন ধমর্কেও নয়। বর্বরতাগুলো একেক ধর্মে একেক রকম। তবে নিরপেক্ষ কী করে হবে মানুষ? যদি দুই বর্বরের মধ্যে এক বর্বরের পাশে আমাকে দাঁড়াতে হয়, তবে তুলনায় কম বর্বরের পাশেই দাঁড়াবো। তাই নয় কি? যেহেতু ধর্মগুলো বর্বরতার দিক দিয়ে বা উদারতার দিক দিয়ে সমান নয়, তাই সকল ধর্মের প্রতি সবারই সমান শ্রদ্ধাশীল হওয়া এবং সকল ধর্মের প্রতি নিরপেক্ষ থাকাও সম্ভব নয়। বরং সকল মানুষকে, সে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মুসলমান, ইহুদি, জৈন, শিখ, নাস্তিক যা-ই হোক- সমান চোখে দেখাটা সম্ভব হতে পারে। আমি মনে করি মানুষ হিসেবে প্রত্যেকের অধিকার সমান হওয়া উচিত। সে ক্ষেত্রে 'ধর্মনিরপেক্ষতা'র বদলে 'বিশ্বাসীনিরপেক্ষতা' অথবা এরকম একটি শব্দ আমাদের ব্যবহার করা উচিত।
---৫. কে মেরেছে অভিজিৎকে? ফারাবী? খুনিরা কি ফেসবুকে বলে বেড়ায় 'আমি খুন করব'? আইসিসএর রাজ্যে বলে। কিন্তু এখনো তো বাংলাদেশ পুরোপুরি আইসিস রাজ্য হয়ে ওঠেনি। আমার মনে হয় ফারাবীর চেয়েও ভয়ংকর জিহাদী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অভিজিৎকে হত্যা করেছে। যেই করুক, খুনি ধরা পড়ুক চাই। খুনির শাস্তি হোক চাই। আমি বরাবরই মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে। কিন্তু আজকাল মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, আইসিসরা, বোকো হারামরা, আল শাবাবরা, আর বাংলাদেশে রাজিব হায়দার, হুমায়ুন আজাদ আর অভিজিৎ রায়ের খুনিদের মৃত্যুদণ্ড হলে আমি অখুশি হবো না।
তসলিমা নাসরিন |
---৬.
খুনিদের যে শাস্তিই হোক, অভিজিৎ আর ফিরে আসবে না। বাঙালিকে মানুষ বানাবার
স্বপ্ন আর সে দেখবে না। একজন প্রতিভাবান বাঙালিকে, যে দেশ আর দশের জন্য খুব
জরুরি কাজ করছিল, বাঙালিরাই মেরে ফেললো। টিএসসির সামনে যে ফুটপাতে
অভিজিৎকে খুন করা হয়েছে, তার রক্তের ওপর মস্তিষ্কের কাটা টুকরো আর তার
চশমাটা ভাসছিল ঠিক যে জায়গাটায়, সে জায়গায় একটা মনুমেন্ট গড়া হোক। মুক্তমনা
মনুমেন্ট। মানুষ সাধারণত অতীতকে ভুলে যায়। মনুমেন্টটা থাকলে মানুষ ভুলতে
চাইলেও ভুলতে পারবে না একটি রক্তাক্ত ইতিহাস। মনুমেন্টটাই এ দেশের মানুষকে
প্রতিদিন মনে করিয়ে দেবে যে ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ, কুসংস্কার, নারীবিদ্বেষ,
বৈষম্য ইত্যাদিকে পরাজিত করে মুক্তচিন্তা, বিজ্ঞানমনস্কতা, সমতা,
বাক-স্বাধীনতা যদি সামনে না এগোয়, তবে অচিরেই জাতি হিসেবে বাঙালির মুখ
থুবড়ে মৃত্যু ঘটবে।
লেখক : নির্বাসিত লেখিকা
লেখক : নির্বাসিত লেখিকা
No comments