মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় ভারতের সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায় by পরিতোষ পাল
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মন্তব্যের জন্য কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না।
ভারতের
সুপ্রিম কোর্ট একটি ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন। তথ্য অধিকার আইনের ৬৬ (এ)
ধারাকে অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে ভারতের দণ্ডবিধি
থেকে এ ধারাটি মুছে ফেলারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এর ফলে তথ্য অধিকার আইন
থেকে বাতিল হয়ে গেল এ ধারাটি। আদালতের মতে, এ ধারাটির অপব্যবহার করে পুলিশ
যাকে খুশি তাকে আটক করে। এতে সংবিধান প্রতিটি মানুষকে সামাজিক ও রাজনৈতিক
মত প্রকাশের যে স্বাধীনতা দিয়েছে তা লঙ্ঘিত হচ্ছে। এ রায় দিয়ে আদালত
বলেছেন, আইনের এ ধারাটি একই সঙ্গে স্বাধীনতা ও অবাধ মত প্রকাশের যে মৌলিক
অধিকার তাতে আঘাত করা হয়েছে। গণতন্ত্রের মূল ভিত্তিই এ দুটি বিষয়। আদালতের
এমন রায়ের পর এখন সামাজিক মিডিয়ায় মত প্রকাশের জন্য আর কাউকে গ্রেপ্তার করা
যাবে না। মঙ্গলবার ভারতের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট এই ঐতিহাসিক রায়
দেয়। ফলে এই আইনের বলে যেভাবে খেয়াল-খুশিমতো গ্রেপ্তার করা হচ্ছিল এতদিন তা
আর করা যাবে না। আদালত জানিয়েছে, সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটে নিজের মতামত
প্রকাশ করার জন্য এই আইনটিকে ব্যবহার করে সারা দেশে এর আগে বহুক্ষেত্রে
নিরপরাধ মানুষকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। নিজের মত ব্যাখ্যা করে ইচ্ছামত এই
আইনটির অপপ্রয়োগ করেছে রাজ্য সরকারগুলোও। আদালত জানিয়েছে, এই আইনটি
বাক-স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থি, তাই সার্বিকভাবেই এই আইন
গণতন্ত্রবিরোধী। সংবিধান অনুযায়ী সাধারণ মানুষের মত প্রকাশের অধিকারবিরোধী
এই আইনটিকে ভারতীয় দণ্ডবিধি থেকে বাদ দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে সর্বোচ্চ
আদালত। অবশ্য সর্বোচ্চ আদালত জানিয়েছে, কোন ওয়েবসাইট যদি সামপ্রদায়িক
সমপ্রীতি নষ্ট করে, হিংসা ছড়ায় বা ভারতের সঙ্গে অন্যান্য দেশের স্বাভাবিক
সম্পর্ক নষ্ট করে, সেই ওয়েবসাইটগুলো ভারত সরকার চাইলে ব্লক করতে পারবে। এর
আগে বহুবার অভিযোগ উঠেছে তথ্যপ্রযুক্তি সংক্রান্ত ভারতীয় দণ্ডবিধির ৬৬ (এ)
ধারার অপপ্রয়োগ করছে পুলিশ প্রশাসন। অভিযোগ উঠেছে, এই ধারা প্রয়োগ করে কেড়ে
নেয়া হচ্ছে মত প্রকাশের স্বাধীনতা। এই বিতর্কিত ৬৬ (এ) ধারার সাংবিধানিক
যৌক্তিকতা নিয়েই রায় দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। ৬৬-এ ধারা অনুযায়ী, ‘অত্যন্ত
অশোভন বা আপত্তিজনক কোন বক্তব্য বিভিন্ন যোগাযোগের মাধ্যম, টেক্সট মেসেজ বা
ভিডিওর মাধ্যমে পাঠিয়ে তা প্রচার করলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য
করা হতো। সরকারের দাবি ছিল, শুধু কিছু ‘অপব্যবহার’-এর অভিযোগে
তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রের ৬৬ (এ) ধারাটি অবলুপ্ত করা অনুচিত। এই বিষয়ে
সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য গত ২৬শে ফেব্রুয়ারি বিচারপতি জে চেলামেশ্বর ও
বিচারপতি আর এফ নরিমানের একটি ডিভিশন বেঞ্চ গঠিত হয়। ওই মামলার শুনানির সময়
আদালত জানায় ‘অত্যন্ত আপত্তিকর’, ‘সমস্যাজনক’ এই শব্দগুলো ভীষণভাবেই
আপেক্ষিক। এই আইনে স্পষ্ট করে কোনটাকে সমস্যাজনক ক্যাটিগরিতে ফেলা হবে,
কোনটাকে নয়, এবং কেন, সেই বিষয়ে স্পষ্ট বা নির্দিষ্ট করে কিছুই বলা নেই।
ভারত সরকার জানিয়েছিল, সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধে এই আইনের প্রয়োজনীয়তা
অনস্বীকার্য। এই আইনের বিরোধিতা করে একাধিক পিটিশন সর্বোচ্চ আদালতে জমা
পড়ে। প্রত্যেক পিটিশনেই অভিযোগ, এই আইনের অপব্যবহার করে বাক-স্বাধীনতা ও মত
প্রকাশের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে রাষ্ট্রযন্ত্র।
মুম্বইতে বাল ঠাকুরের বিরুদ্ধে ফেসবুকে ‘আপত্তিকর মন্তব্য’ করার ‘অপরাধে’
পুলিশ দুই কিশোরীকে গ্রেপ্তার করার পর এই আইনের বিরুদ্ধে প্রথম পিটিশনটি
দায়ের করা হয়। পিটিশনটি দিয়েছেন শ্রেয়া সিঙ্ঘল নামের এক আইনপড়ুয়া। এই আইনেই
গ্রেপ্তার হতে হয়েছে কার্টুনিস্ট অসীম ত্রিবেদীকে, গ্রেপ্তার হয়েছেন এয়ার
ইন্ডিয়ার দুই কেবিন ক্রু। সোশাল মিডিয়াতে যথাক্রমে সাংসদ ও প্রধানমন্ত্রীর
বিরুদ্ধে ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য করার ‘অপরাধে’ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন এরা।
আদালত তার রায়ে ৬৯-বি ধারাটি বহাল রেখেছে। সুপ্রিম কোর্ট তার রায়ে যেসব কথা
বলেছে এখানে তার চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো- সংবিধানের ১৯(১)(এ) ধারায় বাক ও
মত প্রকাশের যে স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে তথ্য অধিকার আইনের ৬৬-এ ধারাটি
সেই অধিকারকে লঙ্ঘন করেছে। চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে অপরিহার্য বলে
মন্তব্য করেন আদালত। জনগণের তথ্য জানার যে অধিকার তা তথ্য প্রযুক্তি আইনের
৬৬-এ ধারায় সরাসরি বাধাগ্রস্ত হয়। তা সত্ত্বেও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি
করতে পারে, সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে অথবা অন্য দেশের সঙ্গে
ভারতের সম্পর্কে প্রভাব ফেলতে পারে- এমন কোন ওয়েবসাইট ব্লক করতে পারবে
সরকার। এ আইনে ৬৬ (এ) ধারাটি কেন ব্যবহার করা হয়েছে তা স্পষ্ট নয়।
No comments