সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার নিরাপত্তা! দায় কার! by অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
একই
দিনে পত্রিকায় দুটি খবর বেরিয়েছে। প্রথমটি দৈনিক ফেনীর সময়-এর সহসম্পাদক
রাশেদুল হাসানকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হাত-পা ভেঙে দিয়েছে ছাত্রলীগ-যুবলীগের
কর্মীরা। অপরটি দৈনিক জনকণ্ঠ ও বাসসের লালমনিরহাট জেলা প্রতিনিধি জাহাঙ্গীর
আলম শাহিনকে (৪০) গলাকেটে হত্যার চেষ্টা করেছে দুর্বৃত্তরা। দুটি ঘটনাই ৬
মার্চ তারিখের। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয় গণমাধ্যমকে।
দেশের প্রতিটি সরকারই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আর গণমাধ্যমকর্মীদের নিরাপত্তা
বিধানের ঢেকুর তোলে। কিন্তু বাস্তবতা অনেক নির্মম। প্রায় প্রতিদিনই
কর্মক্ষেত্রে নানাভাবে লাঞ্ছিত-নিগৃহীত হচ্ছেন গণমাধ্যমকর্মীরা। প্রতিটি
সরকারের সময়ে, সব ধরনের পরিস্থিতিতে। কখনো শারীরিকভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন,
কখনো শিকার হচ্ছেন হয়রানির। কখনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতে, কখনো রাষ্ট্রের
হাতে। স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলেই গণমাধ্যম ও গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর নেমে আসে
খড়্গ। হামলা, মামলা, আর হয়রানিতে দুর্বিষহ করে তোলা হয় জীবন। গণমাধ্যমের এ
আক্রান্ত অবস্থায় দেশের গণতন্ত্র যে রুগ্নতম সময় পার করছে তা অনুমেয়।
কেননা, গণমাধ্যম ও গণতন্ত্র অবস্থানের দিক থেকে একই সুতোয় গাঁথা। পারস্পরিক
সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করলেও পুলিশি নির্যাতনেরও শিকার হতে হয়
সংবাদকর্মীদের। যদিও উভয়ই ঝুঁকির মধ্যে কাজ করে। কিন্তু রাজপথে, বিপজ্জনক
মুহূর্তে মাঝেমধ্যে পুলিশই হয়ে পড়ে সাংবাদিকের প্রতিপক্ষ। পুলিশ সদস্যরা
পরিস্থিতির ঝাল মেটান সাংবাদিকদের ওপর। পরে ‘গরু মেরে জুতা দান’-এর মতো
মৌখিক দুঃখ প্রকাশও করেন। তবে এটুকুতেই প্রতিকারের সমাপ্তি।
একইভাবে রাজনীতিবিদ এবং সাংবাদিকের সম্পর্ককে আখ্যায়িত করা হয়- জল ও মাছের সম্পর্কে। কিন্তু যতই বস্তুনিষ্ঠ হোক, নিজের বা নিজ গ্রুপের বিপক্ষে গেলেই প্রতিপক্ষ হয়ে পড়েন রাজনীতিবিদরাও। তারাও হুমকি-ধমকি দেন, কর্মক্ষেত্রে প্রভাব খাটিয়ে সাংবাদিকদের ‘উপহার’ দেন বেকারত্ব। নিজস্ব সুবিধাবাদীদের দিয়ে মামলায় জড়িয়ে দেন রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। আমলারা করেন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নানা হয়রানি। কিন্তু সাংবাদিকতার নৈতিকতায় সাংবাদিকরা কারো স্থায়ী বন্ধু বা শত্রু হতে পারে না। অনিয়মের বিরুদ্ধে তাকে দাঁড়াতেই হয়। ফলে সাংবাদিকরা হয়ে পড়েন অপছন্দের পাত্র। তাদের গলা টিপে ধরতে সচেষ্ট হয়ে ওঠেন সবাই। অথচ অপছন্দের কথাগুলো তুলে ধরতে হয় দেশের বৃহত্তর স্বার্থেই।
স্বাধীন বাংলাদেশে প্রতিটি সরকারের সময়েই সাংবাদিকদের ওপর নেমে এসেছে নির্যাতনের খড়গ। বঙ্গবন্ধু সরকার চারটি বাদে বন্ধ করে সব পত্রিকা। বেকারত্বের পাশাপাশি নিগৃহীত হন বহু সাংবাদিক। জিয়া সরকারের সময়ে সংবাদপত্র প্রকাশের অনুমতি পেলেও নির্যাতন থেকে রেহাই মেলেনি সাংবাদিকদের। এরশাদ সরকারের সময়ে দেশ ছেড়েছেন অনেক সাংবাদিক, বন্ধ হয়েছে সংবাদপত্র। জিয়া ও এরশাদ সরকারের মার্শাল ল’ কোর্টে হয়রানির শিকার হয়েছেন বর্তমান বয়োজ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের অনেকেই। নব্বইয়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বড় ভূমিকা ছিল গণমাধ্যম ও গণমাধ্যমকর্মীদের। ফকরুদ্দিন-মঈনউদ্দিন সরকারের সময় আমাকেও সত্য বলার অপরাধে ৪৮ ঘন্টা জেলে থাকতে হয়েছিল।
কিন্তু বিএনপির নেতৃত্বে নির্বাচিত প্রথম সংসদীয় গণতান্ত্রিক সরকারের সময়ে পুলিশ ন্যক্কারজনকভাবে জাতীয় প্রেস ক্লাবে ঢুকে সাংবাদিকদের ওপর হামলা করেছিল। পরের বার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে সে পরিস্থিতি আরও করুণ রূপ ধারণ করে। দৈনিক বাংলা'সহ চারটি জনপ্রিয় পত্রিকা বন্ধ করে দেয় ওই সরকার। ফেনীর সাংবাদিক টিপু সুলতানের ওপর বর্বরতা মধ্যযুগকেও হার মানায়। চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ২০০৫ সালে চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে অস্ট্রেলিয়া জাতীয় ক্রিকেট দলের সামনে আচমকা পুলিশি রোষানলে পড়েন বেশ কয়েকজন ক্রীড়া ও ফটো সাংবাদিক। সেদিন বৃদ্ধ এক ফটোসাংবাদিকের মুখে জেলার শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তার ঘুষি মারার দৃশ্যটি বিশ্বব্যাপী সাংবাদিক নির্যাতনের প্রতীক হয়ে আছে।
বর্তমান সরকার ২য় বারের মত ক্ষমতায় আসার পর একটি টেলিভিশন চ্যানেল বন্ধ, একটি দৈনিক পত্রিকা সাময়িক বন্ধ করা হলে বহু সাংবাদিকের জীবন-জীবিকা অনিশ্চিত হয়েছে। জেল খেটে চলেছেন একজন সম্পাদক। স্বাধীনতার পরও বিভিন্ন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর রোষালনে পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন অনেক সাংবাদিক। পংগুত্ববরণ ও আহত হয়েছেন অসংখ্য। কখনো কখনো নির্যাতকের ভূমিকায় ছিল সরকারি বাহিনী। কিন্তু কোনোটিরই প্রতিকার হয়নি। সবকিছু ভুলে সাংবাদিকরা পেশাগত দায়িত্ব পালনে ছিলেন অবিচল। আর এজন্যই নির্যাতক গোষ্ঠী পিছু হটেছে বারবার।
স্বাধীন বাংলাদেশেও প্রতিটি সরকারের সময়কাল রঞ্জিত হয়েছে সাংবাদিকের রক্তে। অথচ শিল্প হিসেবে সংবাদমাধ্যমের বিকাশ ও সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় প্রতিটি সরকারই থাকেন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু কোনো সরকারের হাতেই প্রণীত হয়নি একটি সাংবাদিক সুরক্ষা আইন। এমনকি দেশে একের পর এক সাংবাদিক খুনের ঘটনা ঘটলেও কোনো খুনের বিচার প্রক্রিয়াই সুষ্ঠুভাবে এগোয়নি। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি একটিরও।
একইভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে দিনের পর দিন সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ফলে সাংবাদিকতা পেশা ক্রমাগতই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রতিটি ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে প্রথাগত দুঃখপ্রকাশ ও হামলাকারীদের শাস্তির আশ্বাস দিলেও কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। সাংবাদিকদের পেশায় এ চলমান ঝুঁকি কমাতে রাষ্ট্র কি কোনো উদ্যোগ নেবে? দূর ভবিষ্যতে কি কোনো উজ্জ্বল আলো অপেক্ষা করছে?
লেখক: অ্যাডভোকেট বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, সাংবাদিক ও আইনগ্রন্থ প্রণেতা।
ইমেইল: seraj.pramanik@gmail.com
একইভাবে রাজনীতিবিদ এবং সাংবাদিকের সম্পর্ককে আখ্যায়িত করা হয়- জল ও মাছের সম্পর্কে। কিন্তু যতই বস্তুনিষ্ঠ হোক, নিজের বা নিজ গ্রুপের বিপক্ষে গেলেই প্রতিপক্ষ হয়ে পড়েন রাজনীতিবিদরাও। তারাও হুমকি-ধমকি দেন, কর্মক্ষেত্রে প্রভাব খাটিয়ে সাংবাদিকদের ‘উপহার’ দেন বেকারত্ব। নিজস্ব সুবিধাবাদীদের দিয়ে মামলায় জড়িয়ে দেন রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। আমলারা করেন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নানা হয়রানি। কিন্তু সাংবাদিকতার নৈতিকতায় সাংবাদিকরা কারো স্থায়ী বন্ধু বা শত্রু হতে পারে না। অনিয়মের বিরুদ্ধে তাকে দাঁড়াতেই হয়। ফলে সাংবাদিকরা হয়ে পড়েন অপছন্দের পাত্র। তাদের গলা টিপে ধরতে সচেষ্ট হয়ে ওঠেন সবাই। অথচ অপছন্দের কথাগুলো তুলে ধরতে হয় দেশের বৃহত্তর স্বার্থেই।
স্বাধীন বাংলাদেশে প্রতিটি সরকারের সময়েই সাংবাদিকদের ওপর নেমে এসেছে নির্যাতনের খড়গ। বঙ্গবন্ধু সরকার চারটি বাদে বন্ধ করে সব পত্রিকা। বেকারত্বের পাশাপাশি নিগৃহীত হন বহু সাংবাদিক। জিয়া সরকারের সময়ে সংবাদপত্র প্রকাশের অনুমতি পেলেও নির্যাতন থেকে রেহাই মেলেনি সাংবাদিকদের। এরশাদ সরকারের সময়ে দেশ ছেড়েছেন অনেক সাংবাদিক, বন্ধ হয়েছে সংবাদপত্র। জিয়া ও এরশাদ সরকারের মার্শাল ল’ কোর্টে হয়রানির শিকার হয়েছেন বর্তমান বয়োজ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের অনেকেই। নব্বইয়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বড় ভূমিকা ছিল গণমাধ্যম ও গণমাধ্যমকর্মীদের। ফকরুদ্দিন-মঈনউদ্দিন সরকারের সময় আমাকেও সত্য বলার অপরাধে ৪৮ ঘন্টা জেলে থাকতে হয়েছিল।
কিন্তু বিএনপির নেতৃত্বে নির্বাচিত প্রথম সংসদীয় গণতান্ত্রিক সরকারের সময়ে পুলিশ ন্যক্কারজনকভাবে জাতীয় প্রেস ক্লাবে ঢুকে সাংবাদিকদের ওপর হামলা করেছিল। পরের বার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে সে পরিস্থিতি আরও করুণ রূপ ধারণ করে। দৈনিক বাংলা'সহ চারটি জনপ্রিয় পত্রিকা বন্ধ করে দেয় ওই সরকার। ফেনীর সাংবাদিক টিপু সুলতানের ওপর বর্বরতা মধ্যযুগকেও হার মানায়। চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ২০০৫ সালে চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে অস্ট্রেলিয়া জাতীয় ক্রিকেট দলের সামনে আচমকা পুলিশি রোষানলে পড়েন বেশ কয়েকজন ক্রীড়া ও ফটো সাংবাদিক। সেদিন বৃদ্ধ এক ফটোসাংবাদিকের মুখে জেলার শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তার ঘুষি মারার দৃশ্যটি বিশ্বব্যাপী সাংবাদিক নির্যাতনের প্রতীক হয়ে আছে।
বর্তমান সরকার ২য় বারের মত ক্ষমতায় আসার পর একটি টেলিভিশন চ্যানেল বন্ধ, একটি দৈনিক পত্রিকা সাময়িক বন্ধ করা হলে বহু সাংবাদিকের জীবন-জীবিকা অনিশ্চিত হয়েছে। জেল খেটে চলেছেন একজন সম্পাদক। স্বাধীনতার পরও বিভিন্ন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর রোষালনে পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন অনেক সাংবাদিক। পংগুত্ববরণ ও আহত হয়েছেন অসংখ্য। কখনো কখনো নির্যাতকের ভূমিকায় ছিল সরকারি বাহিনী। কিন্তু কোনোটিরই প্রতিকার হয়নি। সবকিছু ভুলে সাংবাদিকরা পেশাগত দায়িত্ব পালনে ছিলেন অবিচল। আর এজন্যই নির্যাতক গোষ্ঠী পিছু হটেছে বারবার।
স্বাধীন বাংলাদেশেও প্রতিটি সরকারের সময়কাল রঞ্জিত হয়েছে সাংবাদিকের রক্তে। অথচ শিল্প হিসেবে সংবাদমাধ্যমের বিকাশ ও সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় প্রতিটি সরকারই থাকেন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু কোনো সরকারের হাতেই প্রণীত হয়নি একটি সাংবাদিক সুরক্ষা আইন। এমনকি দেশে একের পর এক সাংবাদিক খুনের ঘটনা ঘটলেও কোনো খুনের বিচার প্রক্রিয়াই সুষ্ঠুভাবে এগোয়নি। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি একটিরও।
একইভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে দিনের পর দিন সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ফলে সাংবাদিকতা পেশা ক্রমাগতই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রতিটি ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে প্রথাগত দুঃখপ্রকাশ ও হামলাকারীদের শাস্তির আশ্বাস দিলেও কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। সাংবাদিকদের পেশায় এ চলমান ঝুঁকি কমাতে রাষ্ট্র কি কোনো উদ্যোগ নেবে? দূর ভবিষ্যতে কি কোনো উজ্জ্বল আলো অপেক্ষা করছে?
লেখক: অ্যাডভোকেট বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, সাংবাদিক ও আইনগ্রন্থ প্রণেতা।
ইমেইল: seraj.pramanik@gmail.com
No comments