সাইবারযুদ্ধের দামামা by আবুল হাসনাত

হালকা, ছিপছিপে গড়নের দীর্ঘকায় মানুষটির মাথাভর্তি শ্বেত-শুভ্র চুল। দেখতে সুদর্শন, গলা খাদে নামিয়ে কথা বলেন। আপাতদৃষ্টিতে বেশ নিরীহ গোছের একটা মানুষ। চোখজোড়া থেকে বুদ্ধির দীপ্তি যেন ঠিকরে বেরুচ্ছে। কাঁধে ঝুলছে ব্যাকপ্যাক। এর ভেতরই ঘাপটি মেরে আছে মারাত্মক অস্ত্রটি—ল্যাপটপ। ছোট্ট ওই কম্পিউটার থেকে বেরিয়েছে সাম্প্রতিককালের ভয়ংকর বোমাটি।
যে তথ্যবোমার বিস্ফোরণে খসে পড়েছে মার্কিন তথা বিশ্ব কূটনীতির খোলস। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের আড়াই লাখ ডিজিটাল তথ্য ইন্টারনেটে ফাঁস করে বাঘা বাঘা রাষ্ট্রনায়কের ঘুম হারাম করে দিয়েছেন যে মানুষটি তিনি জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ। পশ্চিমা নেতাদের চোখে তিনি সাক্ষাৎ শয়তান, লাদেনের চেয়েও ভয়ংকর সন্ত্রাসী। আর মুক্তবুদ্ধির, মুক্তিকামী মানুষের কাছে তিনি সততা ও বাকস্বাধীনতার প্রতীক। কেউ তাঁকে বলেন, অকুতোভয় খ্যাপা সাংবাদিক। কেউ বলেন, গত শতকের সবচেয়ে প্রতিভাধর হ্যাকার। যাঁর উত্থান একবিংশ শতকে তথ্যযুদ্ধ তথা সাইবারযুদ্ধের সূচনা করে দিয়েছে। যে যুদ্ধের সম্মুখভাগে আছে সরকার ও বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। আর বিরোধী শিবিরে আছেন অ্যাসাঞ্জ এবং তাঁকে সমর্থনকারী কয়েক ডজন কম্পিউটার হ্যাকার।
৩৯ বছর বয়সী সাবেক এই হ্যাকার জন্মসূত্রে অস্ট্রেলীয়। চলতি বছরের এপ্রিলে ইন্টারনেটে স্পর্শকাতর তথ্য ফাঁস করে সবার নজর কাড়েন। প্রথমটি ছিল একটি ভিডিওচিত্র। মার্কিন হেলিকপ্টার থেকে ইরাকিদের গুলি করে হত্যার একটি দৃশ্য। দ্বিতীয়টি, আফগানিস্তান যুদ্ধের ওপর ৭৬ হাজার ৯০০ তথ্যের একটি সংকলন। যা সাধারণ লোকে আগে জানত না। গত নভেম্বরের শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের আড়াই লাখ কূটনৈতিক বার্তা ফাঁস করে দেন অ্যাসাঞ্জ। তাঁর প্রতিষ্ঠিত উইকিলিকস (www.wikileaks.org) নামের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয় সেসব তথ্য। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় সাইবার আক্রমণ। একসঙ্গে কয়েক লাখ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীকে ওয়েবসাইটটিতে ঢোকার নির্দেশ দেওয়া হয় (ড্যানিয়েল অব সার্ভিস বা ডস অ্যাটাক)। এতে ওয়েবসাইটটি হ্যাং হয়ে যায়। সাধারণ ব্যবহারকারীরা এত ঢুকতে পারে না। ধারণা করা হয়, এটি ছিল পেন্টাগনের একটি কূটচাল। যত চালই চালুন, অ্যাসাঞ্জ আগে থেকেই ছিলেন সতর্ক। সম্ভাব্য এমন হামলা হবে আঁচ করতে পেরেই তথ্যগুলো পেন ড্রাইভে করে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় পাঁচটি পত্রিকায়। গত ২৮ নভেম্বর সেগুলো একযোগে প্রকাশিত হয়।
উইকিলিকস কী
উইকিলিকস অলাভজনক আন্তর্জাতিক একটি সংবাদ সংস্থা। ভক্তদের অনুদানে চলে এই ওয়েবসাইটটি। জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ নিজে এর প্রধান সম্পাদক। উইকি (wiki) যুক্ত করার কারণ, যে কেউ ওয়েবসাইটটিতে কোনো কিছু প্রকাশও সম্পাদনা করতে পারে। অনলাইন বিশ্বকোষউইকিপিডিয়ার সমগোত্রীয় ওয়েবসাইট বলা হয় উইকিলিকসকে। এটি একটি হুইসেল ব্লোয়িং (ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি, কেলেঙ্কারি ফাঁস করে দেন যিনি) ওয়েবসাইটও বটে।
বছর তিনেক আগে উইকিলিকসের আত্মপ্রকাশ। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি-সংক্রান্ত খবর বা দলিল-দস্তাবেজে বেজায় আগ্রহ উইকিলিকসের জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের। সেসব তথ্য জনসমক্ষে ফাঁস করে যারপরনাই আনন্দ পান তিনি। উইকিলিকসের কোনো অফিস নেই। তবে অ্যাসাঞ্জ ছাড়াও আছেন পাঁচজন নিয়মিত ও ৮০০ অনিয়মিত কর্মী। যাঁদের অধিকাংশ নানা পেশাজীবী শ্রেণীর মানুষ। তাঁরা সবাই ওয়েবসাইটটিকে নানাভাবে সহযোগিতা করেন। উইকিলিকসে তথ্য প্রকাশের কাজটি আগের মতো সহজ নেই আর। তবে যাঁরা তথ্য দিয়ে সহায়তা করেন, সোজা কথায় যাঁরা এই সংবাদমাধ্যমের তথ্যদাতা বা সোর্স তাঁদের গোপনীয়তা শতভাগ নিশ্চিত করার চেষ্টা করেন অ্যাসাঞ্জ।
তথ্য সংগ্রহে লেডি গাগার সিডি
শেষ পর্যন্ত সোর্সের পরিচয় গোপন থাকে না। যেমন থাকেনি মার্কিন সেনাসদস্য ব্র্যাডলি মানিংয়ের পরিচয়। মার্কিন সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা শাখায় কাজ করতেন। ইরাক ও আফগান যুদ্ধের নথি উইকিলিকসকে সরবরাহের অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। ধারণা করা হয়, আড়াই লাখ নথি পাচারের হোতাও এই মানিং। মার্কিন পপতারকা লেডি গাগার গানের একটি সিডিতে করে তথ্যগুলো কৌশলে কপি করে এনেছিলেন মানিং। পরে সেগুলো অ্যাসাঞ্জের হাতে তুলে দেন।
কে এই অ্যাসাঞ্জ
জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের জন্ম ১৯৭১ সালের ৩ জুলাই অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডের টাউনসভিলে। শৈশব থেকেই কোথাও থিতু হতে পারতেন না। ডজনখানেক স্কুল বদল করে পড়াশোনা করেন। গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানে ডিগ্রি নিয়েছেন। রাতের পর রাত জেগে, দুদিনে একবেলা খেয়ে অঙ্ক কষতেন অ্যাসাঞ্জ। অঙ্ক কষে কষে ঘরের দেয়াল এমনকি দরজা ভরে ফেলতেন। তরুণ বয়সে এমন খেপাটে স্বভাবের ছিলেন।
তেরো বছর বয়সে মা ক্রিস্টিন তাঁকে একটি কম্পিউটার কিনে দেন। মাত্র তিন বছরের মাথায় হ্যাকারদের খাতায় নাম লেখান। সমবয়সী আরও দুই হ্যাকারকে নিয়ে গড়ে তোলেন একটি দল। সেখানে তাঁর নাম ছিল ‘মেনড্যাক্স’। ওই হ্যাকিং দলের একটা নীতি ছিল, গোপনে কোনো নেটওয়ার্কে ঢুকে প্রয়োজনীয় কাজ সেরে ফিরে আসতে হবে। কিন্তু ওই সিস্টেমে তথ্যের ক্ষতি সাধন করা চলবে না।
কৈশোরের সেই নৈতিকতার আলোকচ্ছটা অ্যাসাঞ্জের জীবনজুড়েই দেখা যায়। সততা, নৈতিকতা ও আদর্শের বেলায় তিনি আপসহীন। হ্যাকিংয়ের দায়ে মাত্র ২০ বছর বয়সে পুলিশ গ্রেপ্তার করে তাঁকে। ১৯৯১ সালের কথা। তখন ২১ হাজার অস্ট্রেলীয় ডলার জরিমানা গুনে ছাড়া পেয়েছিলেন।
অ্যাসাঞ্জ পাকড়াও, যুদ্ধের শুরু
পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় তথ্য কেলেঙ্কারির এই ঘটনায় নড়েচড়ে বসে মার্কিন কর্তৃপক্ষ। খোঁজ পড়ে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের। খবর মেলে তিনি ব্রিটেনে। কিন্তু তাঁকে ধরার নির্ভরযোগ্য কোনো সূত্র পাওয়া যাচ্ছিল না। শেষে সুইডেনে দুই নারীকে ধর্ষণের অভিযোগে ইন্টারপোল তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। মার্কিন সরকারের হুকুমে বন্ধ করে দেওয়া হয় তাঁর অর্থ লেনদেনের সব পথ। অনলাইনে অর্থ লেনদেনের মাধ্যম পেপ্যাল ও মাস্টারকার্ড অ্যাসাঞ্জের অ্যাকাউন্ট জব্দ করে।
যুক্তরাষ্ট্রের অনলাইন দোকান অ্যামাজন সার্ভার উইকিলিকসের যাবতীয় তথ্য বহনে অস্বীকৃতি জানায়। বন্ধ করে দেওয়া হয় wikileaks.org ওয়েবসাইটটি। অবশ্য কয়েক ঘণ্টার মাথায় সুইজারল্যান্ডের ডোমেইন ব্যবহার করে উইকিলিকসের ঠিকানা হয় www.wikileaks.ch-এ। ৭ ডিসেম্বর ব্রিটেন পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন অ্যাসাঞ্জ।
সাবেক এই হ্যাকারকে একে একে এভাবে কোণঠাসা করতে দেখে চুপচাপ বসে থাকেনি হ্যাকাররা। ইউরোপীয় হ্যাকাররা উইকিলিকসের জন্য আরও ২১টি ডোমেইন জোগাড় করে দেয়। অ্যানোনিমাস নামে হ্যাকরদের একটি দল ১২ ডিসেম্বর রাতে অনলাইনে কেনাকাটার ওয়েবসাইট অ্যামাজনের ওপর আক্রমণ চালায়। আধ ঘণ্টার জন্য ওয়েবসাইটটি বিকল করে দেয় তারা। তার তিন-চার দিন আগে তারা হামলা চালায় মাস্টারকার্ডের ওয়েবসাইটে। এভাবে অ্যাসাঞ্জের পক্ষে-বিপক্ষে একের পর এক সাইবার আক্রমণ চলছেই।
নথিগুলো আছে কোথায়!
মার্কিন কূটনীতির স্পর্শকাতর আড়াই লাখ নথির মধ্যে কিছু সবে প্রকাশ করা হয়েছে। এখন অনেকের মনে প্রশ্ন জেগেছে, অ্যাসাঞ্জহীন উইকিলিকস কী পারবে বাকি নথিগুলো ঠিকঠাক প্রকাশ করতে! জবাবে সাবেক এই হ্যাকারের সমর্থকেরা বলছেন, পারবে। কারণ আত্মসমর্পণের আগে অ্যাসাঞ্জ তথ্যগুলো এমন গোপন জায়গায় রেখে গেছেন যেখানে পরমাণু বোমা ফেলেও ধ্বংস করা যাবে না। যে দেশের ধর্ষণ মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন অ্যাসাঞ্জ, সেই সুইডেনের একটি সার্ভারে রাখা হয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নথিগুলো। দেশটিতে বাকস্বাধীনতা ও তথ্য সংরক্ষণ আইন বেশ কঠোর। সে জন্য অ্যাসাঞ্জ সুইডেনের ‘পিওনেন ডেটা সেন্টার’-এর নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়েছেন। সে দেশের সার্ভার সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান বানাফর কাছ থেকে ডিজিটাল তথ্য রাখার জন্য জায়গা ভাড়া নেন অ্যাসাঞ্জ। স্নায়ুযুদ্ধকালে ব্যবহার হতো এমন একটি বাংকারকে বেছে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। সেখানে মাটির ১০০ ফুট নিচে গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল তথ্যভান্ডার (ডেটাবেইস সার্ভার)। মাটির ১০০ ফুট নিচ পর্যন্ত গ্রানাইটের ঢালাই দেওয়া হয়েছে। যা পরমাণু বোমার হামলা ঠেকাতে সক্ষম। বানাফ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে তাঁর সার্ভার ভাড়া দেয়। বিনিময়ে যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখে গোপন সে তথ্য।
ইন্টারনেট তথা সাইবার দুনিয়া থেকে উইকিলিকসকে চিরতরে মুছে ফেলার পাঁয়তারা চলছে। অশুভ এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে এককাট্টা হচ্ছেন বিশ্বের নানা প্রান্তের বুদ্ধিজীবী ও মুক্তচিন্তার মানুষ। এখন অ্যাসাঞ্জের সমর্থকেরাই তৈরি করছেন একের পর এক মিরর-ওয়েবসাইট। মূল ওয়েবসাইটটি মুছে ফেললেও মিরর সাইটগুলো উইকিলিকসকে জিইয়ে রাখবে যুগ যুগ।
একাধিক ওয়েবসাইট অবলম্বনে
=======================
সরলতার খোঁজে  সেই আমি এই আমি  আমেরিকান অর্থনীতি ডলারের চ্যালেঞ্জ  বাংলাদেশ-ভারত যৌথ ইশতেহার- আশানুরূপ সুফল নেই এক বছরেও  ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও রাজনীতি  মাস্টারদা সূর্যসেন ও যুব বিদ্রোহ সাতাত্তর  রসভা নির্বাচন ২০১১: একটি পর্যালোচনা  ড. ইউনূস অর্থ আত্মসাৎ করেননি  প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ৩৯ বছর  স্বাধীনতাযুদ্ধের 'বিস্মৃত' কূটনৈতিক মুক্তিযোদ্ধারা  আতঙ্কে শেয়ারবাজার বন্ধঃ বিক্ষোভ  আতঙ্কের রাজত্ব কায়েম হয়েছে  মানবকল্যাণ আমাদের মন্ত্র  ট্রানজিট নিয়ে সবে গবেষণা শুরু  ভারতের একতরফা সেচ প্রকল্পঃ বাংলাদেশের আপত্তিতে বিশ্বব্যাংকের সাড়া  আমলাদের যাচ্ছেতাই বিদেশ সফর  সরকারের ব্যর্থতায় হতাশাঃ বিরোধী দলের ব্যর্থতায় বিকল্পের অনুপস্থিতি  ক্ষমতা ও গণতন্ত্র  পানি সংকট পানি বাণিজ্য  ২০১০ সালের অর্থনীতি কেমন গেল  গণতান্ত্রিক বিকাশের পথে বাধা অনেক  কপাটে তালা দিয়ে কেন এই মৃতু্যর আয়োজন  বিজয়ের অর্থনীতি ও সম্ভাবনা  মুক্তিযুদ্ধের বিজয়লক্ষ্মীর মুখোমুখি  একেই কি বলে আমলাতন্ত্র?  আত্মসমর্পণের সেই বিকেল  আমরা তাঁদের ভুলতে পারি না  সংবিধানের অনেক বক্তব্য পারস্পরিক সংঘাতমূলক  পরাশক্তির বিরুদ্ধে এক ‘ভবঘুরের’ স্পর্ধা  আবু সাঈদ চৌধুরীর ভাষণ দেওয়া হলো না  শুভ নববর্ষ ২০১১- দিনে দিনে বর্ষ হলো গত  এরশাদের বিচারে দুই দলেরই আগ্রহ কম  কিশোরদের সাদামাটা ফল  জিপিএ-৫ পেয়েছে আট হাজার ৫২ জন  এরশাদের বিচার হওয়া উচিত  ছোটদের বড় সাফল্য  প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষাঃ পাস ৯২%, প্রথম বিভাগ বেশি  বাংলাদেশের বন্ধুঃ জুলিয়ান ফ্রান্সিস  নিষ্ফল উদ্ধার অভিযানঃ দখলচক্রে ২৭ খাল  জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ বনাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র


দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ আবুল হাসনাত


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.