ডেঙ্গু বিস্তারে নির্মাণাধীন ভবন, উন্নয়ন প্রকল্প দায়ী কতটা? by সানজানা চৌধুরী
বাংলাদেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষ থেকে শুরু থেকেই বলা হচ্ছে নাগরিক সচেতনতার কথা।
কিন্তু
ঢাকার বেশ কিছু নির্মাণাধীন ভবন এবং যে উন্নয়ন প্রকল্প এলাকাগুলো ঘুরে
দেখা গেছে সেখানে জায়গায় জায়গায় পানি জমে আছে। যেখানে কিনা এডিস মশা
জন্মানোর আশঙ্কা থাকে।
এখন প্রশ্ন উঠেছে এই নির্মাণাধীন ভবন বা
প্রকল্পগুলো তদারকির দায়িত্ব কাদের? এ নিয়ে কী সরকার আসলেও কিছু ভাবছে?
ঘাটতিগুলো কোথায় রয়ে গেছে?
কারণ খতিয়ে দেখতে ঢাকার মিরপুর ১০ নম্বর এলাকায় মেট্রোরেল সংলগ্ন একটি বাড়ির বাসিন্দা সাবিহা সুলতানার সঙ্গে কথা হয়।
তীব্র গরমের মধ্যেও তিনি তার বাড়ির সব দরজা জানালা বন্ধ রাখেন। কারণ একটাই, "মশা"।
নিজ পরিবারকে এডিস মশার কামড় থেকে বাঁচাতে তিনি সব দিকে সতর্ক হলেও মশার উপদ্রব ঠেকাতে পারছেন না।
কারণ বাড়ির পাশেই চলছে নির্মাণাধীন ভবন আর মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ।
বিবিসি
বাংলাকে তিনি বলেন, "আমি তো ডেঙ্গুর অবস্থা দেখে টবের গাছগুলো আর রাখিনি।
কোথাও পানি জমতে দিচ্ছিনা। যতোটা পরিষ্কার থাকা যায়। আমার বাড়িওয়ালাও
লোক দিয়ে বাসার আশপাশ পরিষ্কার করিয়েছে।"
"কিন্তু এই যে
মেট্রোরেলের গর্তগুলোয় পানি জমেছে, পাশের যে নির্মাণাধীন ভবনগুলোয় জমা
পানি আছে। এগুলো কারা পরিষ্কার করবে। এটা তো আর আমার দ্বারা সম্ভব না।
কিন্তু ঘুরেফিরে ওই আমাদেরকেই সাফার (ভুগতে) করতে হচ্ছে।"
মশার উৎপত্তিস্থল একেকটি নির্মাণাধীন এলাকা
মিসেস সুলতানার বাসার কাছেই দুটি নির্মাণাধীন ভবনে গিয়ে দেখা যায় ভবনের ছাদে এবং বেজমেন্টে জায়গায় পানি জমে রয়েছে।
এছাড়া মিরপুর সংলগ্ন মেট্রোরেলের পাশ ঘেঁষে যাওয়ার সময় চোখে পড়ে বেশ কয়েকটি জায়গায় জমে আছে বৃষ্টির স্বচ্ছ পানি।
এই স্থানগুলোতে এডিস মশার লার্ভা নির্বিঘ্নে আবাস গড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন কীটতত্ত্ববিদ ড. চন্দ্রিমা ইমতিয়া।
"যে
কোন কনস্ট্রাকশন এরিয়ায় পানি জমবেই। আর ওই পানিতে এই এডিস মশা ডিম দিতে
পারে। আর তার মাত্র কয়েকদিনের মাথায় ডিম থেকে লার্ভা বেরিয়ে আসে। এভাবেই
কিন্তু মশাগুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম টিকে যাচ্ছে আর দিন দিন আরও
শক্তিশালী হচ্ছে।"
এখনই কোন ব্যবস্থা নেয়া না হলে পরবর্তী বর্ষার মৌসুমে মশার উপদ্রব আরও ভয়াবহ আকারে পৌঁছাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন মিজ ইমতিয়া।
একে
ভবিষ্যতের জন্য বিপদজনক উল্লেখ করে তিনি বলেন, "এই কনস্ট্রাকশন কখনোই
পরিকল্পিত হবেনা। এভাবেই পানি জমতে থাকবে আর মশাও জন্মাতেই থাকবে। এখন যদি
দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া না হয় তাহলে এডিস মশার বংশবৃদ্ধি রোধ করা যাবেনা।"
সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে সমন্বয় আনা যায়নি কেন?
সম্প্রতি
ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের ভ্রাম্যমাণ আদালত নির্মাণাধীন ভবনগুলোয়
অভিযান চালিয়ে অর্ধশতাধিক ভবনে এডিস মশার লার্ভা সনাক্ত করে।
এক দিনে বেশ কয়েকটি ভবনের মালিক ও ডেভেলপারকে জরিমানাও করা হয়।
সেই
সঙ্গে ঢাকা জুড়ে মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো যে মেগা
প্রকল্পের কাজ চলছে সেখানকার কৃত্রিম জলাধার বা গর্তে এডিস মশা বিস্তারের
আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এই ধরণের স্থানগুলো তদারকি ও মশার বিস্তার ঠেকানোর দায়িত্বে সংশ্লিষ্ট রয়েছে সিটি কর্পোরেশনসহ একাধিক পক্ষ।
তাদের মধ্যে আজও সমন্বয় আনা যায়নি কেন?
এ বিষয়ে জানতে কথা বলেছিলাম গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের সঙ্গে।
"এটার
মূল দায়িত্ব মূলত সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভার। তার সঙ্গে কিছু উন্নয়নমূলক
সংস্থারও দায়িত্ব আছে। যেমন পিডব্লিউডি, ন্যাশনাল হাউজিং অথরিটি, ঠিকাদার,
প্রকৌশলী, বাড়ির মালিক বা প্রাইভেট ডেভেলপার সবারই আসলে এখানে ভূমিকা
আছে। এখন এতোগুলো সংস্থা এই একটা বিষয়ের সাথে জড়িত, এজন্য
আন্ত:মন্ত্রণালয় বা আন্ত:দপ্তরের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে একটা সমন্বয় আনা
দরকার। যেখানে প্রত্যেকের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া হবে।"
এ নিয়ে
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকে এই সমন্বয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত
নেয়া হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন মিস্টার মনিরুজ্জামান।
তার মতে, ধীর গতিতে হলেও কাজ হচ্ছে।
"বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্য ইস্যুটি সবচেয়ে উপেক্ষিত"
তবে তার সঙ্গে একমত হতে পারেননি নগর পরিকল্পনাবিদ ড. মোহাম্মদ মুসলেহ উদ্দিন হাসান।
তিনি মনে করেন বাংলাদেশের বেশিরভাগ ভবন নির্মাণ বা উন্নয়ন প্রকল্পে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে কোন ধরণের সমন্বয় দেখা যায়না।
মিস্টার
হাসান বলেন, "কনস্ট্রাকশন ম্যানেজমেন্টের এক্সপার্টিজ ও তদারকিতে এখনও
আমাদের অনেক ঘাটতি আছে। এখন পাবলিক হেলথের ইস্যুটা যখন এটার সাথে যোগ হল,
তখন ঘাটতিটা আরও স্পষ্ট হয়েছে।"
বাংলাদেশে যেকোনো ধরণের নির্মাণের
ক্ষেত্রে সেটা হোক ভবন বা সড়ক অথবা যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়ার
ক্ষেত্রে অনেক বিষয় নজরে আনা হয়না, তার মধ্যে জনস্বাস্থ্য ইস্যুটি
সবচেয়ে উপেক্ষিত বলে তিনি উল্লেখ করেন।
"যেকোনো নির্মাণের ক্ষেত্রে
জনস্বাস্থ্য ইস্যুটি যে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত সেটা আমরা ভুলে যাই। এই যে
মেগা প্রজেক্টগুলো হচ্ছে এগুলোর সাথে অনেক বিদেশি সংস্থা জড়িত। আপনি ওই
দেশগুলোতে গিয়ে দেখবেন তারা যখন এ ধরণের প্রকল্প হাতে নেয় তখন পাবলিক
হেলথ ইস্যুটা তদারকি করে। ধুলাবালি, শব্দ দূষণ থেকে শুরু মশার উপদ্রব
ঠেকানো সবকিছু নিয়ে তারা ভাবে। কিন্তু এখানে এটা ওই বিদেশিরাও ভাবেনা।
আমাদের সরকারের লোকজনও ভাবেনা।"
বর্তমানে ডেঙ্গু পরিস্থিতি যে রূপ
নিয়েছে সেটা থেকে শিক্ষা নিয়ে সরকারের সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি সমন্বয়
বাড়ানো জরুরি বলে মনে করেন ড. মোহাম্মদ মুসলেহ উদ্দিন হাসান।
No comments