পাকিস্তানকে বশ মানানোর বিজেপির অলীক কল্পনা ফুটে ওঠেছে ‘কাশ্মীরিস্তানে’ by অর্জুন আপ্পাদুরাই
সংবিধানের
অনুচ্ছেদ ৩৭০ বিলোপ ও জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্য মর্যাদা বাতিল করার বিষয়টি
সাম্প্রতিক সময়ে বহুল আলোচিত ঘটনা। অনেক ভাষ্যকার এসব ভীতিকর ঘটনাকে ভারতের
অন্যত্র ঘটতে যাওয়া ঘটনাপ্রবাহের মহড়া হিসেবে অভিহিত করছেন, আবার অনেকে
মনে করছেন ১৯৪৭ সাল থেকে ভারতের ক্ষমতাসীন দলগুলো কাশ্মীর ও অন্যান্য
স্থানে যে দমননীতি পরিচালনা করে আসছেন, এটি তারই ধারাবাহিকতা। সাধারণ
কাশ্মীরীদের ভাগ্য গুরুতর এবং গণতন্ত্রের ভারতের দাবিটি সবচেয়ে মারাত্মক
পরীক্ষার মুখে পড়েছে।
মোদি সরকার অতি সম্প্রতি কাশ্মীরে যা করেছে সেটাকে নিশ্চিতভাবেই বিদেশীভীতি, মুসলিমবিরোধী নীতি, রাজনৈতিক মঞ্চ ও হতাশাবাদী রাজনৈতিক পদক্ষেপের মিশ্রণ হিসেবে অভিহিত করা যায়। এই সময় ও কেন এমন বিধ্বংসী উপায়ে কাশ্মীরের মর্যাদা বাতিল করা হলো তা নিয়ে দুটি মন্তব্য এখানে করা হচ্ছে।
প্রথমত, হিন্দু ডানপন্থীদের মতে, নিয়ন্ত্রণ রেখার উভয় পাড়ে পুরো কাশ্মীর পাকিস্তানের পক্ষে রয়েছে। কাশ্মীর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার দীর্ঘ সংগ্রামে এটি সাধারণভাবেই দেখা গেছে। আর ভারত প্রমাণ করার চেষ্টা করছে যে কাশ্মীরীদের সব অসন্তোষের মূলে রয়েছে পাকিস্তান।
কিন্তু তা সত্ত্বেও অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিলের সময়টিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তান ও ভারত পুরো মাত্রায় যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে গিয়েও ফিরে এসেছিল। ভারতের জন্য এটি ছিল বিজেপির একটি লজ্জাজনক পরাজয়। তাদের সামরিক বাহিনী যে অযোগ্য, অদক্ষ তা প্রকটভাবে ফুটে ওঠেছিল। পাকিস্তানকে পায়ের তলায় ফেলে দিতে তারা পারেনি।
কিন্তু তা সত্ত্বেও মে মাসের নির্বাচনে মোদি দারুণ জয় পায়। সেটা হয় তার প্রবল প্রপাগান্ডা মেশিনের মাধ্যমে, হিন্দুত্ববাদী নির্বাচনী ঘাঁটি, পুঁজিবাদীদের সহায়তা। নির্বাচনের এই জয় তার ভোটারদের মধ্যে মুসলিমবিরোধী, পাকিস্তানবিরোধী প্রত্যাশা বাড়িয়ে দেয়। এটা উচ্চ পর্যায়ে ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব হয়নি।
সময়টার দিকে লক্ষ্য করা যেতে পারে: নভেম্বরে জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্য বিধান সভা ভেঙে দিয়ে বিজেপি বিপুল বিজয় লাভ করে। এরপর লজ্জাজনক কূটনীতির রেশ ধরে মার্চ ও এপ্রিলে পাকিস্তানের সাথে শান্তি স্থাপন করে। তারপর আগস্টে সামরিকভাবে নিরাপদ করে কেন্দ্রীয় ভূখণ্ড হিসেবে কাশ্মীরকে নিয়ন্ত্রণে নেয়া হয়।
অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিল আসলে ছিল একটি আইনগত অভ্যুত্থান। গত ফেব্রুয়ারিতে বালাকোটে পরাজয়ের পর বড় কিছু করার প্রয়োজন ছিল বিজেপির। এ কারণেই এই পদক্ষেপটি গ্রহণ করেছে তারা।
অর্থাৎ কাশ্মীর ছিল পাকিস্তানের জন্য একটি প্রক্সি। অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিলের জন্য কয়েক মাস, এমনকি হয়তো কয়েক বছর ধরেই প্রস্তুতি নিচ্ছিল বিজেপি। ফলে এটি ঘটা ছিল অনিবার্য। কিন্তু যেভাবে তা করা হয়েছে, সেটিই সবাইকে আতঙ্কিত করছে।
কাশ্মীরে আরেক ধরনের দীর্ঘ মেয়াদি প্রক্সি চলছে। ২০০২ সালে গুজরাটে মুসলিমদের বিরুদ্ধে সেটা পরীক্ষা করা হয়েছিল। গোধরা ট্রেনে হামলার রেশ ধরে ওই সময়ের গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, ও বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ মুসলিমদের টার্গেট করেন। তাদের বিরুদ্ধে দাঙ্গাবাজদের লেলিয়ে দেন। এরপর শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে গুজরাটে মুসলিমদের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ঘিরে রাখা হয়।
গুজরাটে ওই সময় যেসব সহিংস পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল তাতে আমলাতন্ত্র ও সশস্ত্র বাহিনী সহায়তা করেছিল। কাশ্মীরে কাশ্মীরীদের সন্ত্রস্ত্র করার জন্য সেনাবাহিনী ও আধা সামরিক বাহিনীর কোনো দাঙ্গাবাজের দরকার পড়েনি। তারা নিজেরাই ওই কাজটি করছে।
গুজরাট ছিল মোদির রাজনৈতিক গবেষণাগার। এখান থেকেই তিনি জাতীয় ক্ষমতায় ওঠেছিলেন। সেখানকার গবেষণাই কাশ্মীরে প্রয়োগ করা হচ্ছে।
এখন পাকিস্তানকে ধীরে ধীরে কাশ্মীরিস্তানে পরিণত করার চেষ্টা চলছে। এটা এখন একদিকে অলীক কল্পনা, অন্যদিকে গবেষণাগার। অলীক কল্পনায় কাশ্মীর পরিণত হয়েছে বশ্যতা স্বীকার করা পাকিস্তান এবং ভারতবর্ষ ভাগ আংশিকভাবে বিলুপ্ত করা হয়েছে। অধিকন্তু এই অলীক কল্পনায় কাশ্মীর হলো বলিউড সিনেমার ভালোবাসার জায়গা। এখানকার লেক আর পাহাড়গুলো হলো পাকিস্তানের নারীকৃত সংস্করণ, এখানকার সুন্দরী নারীরা লুফে নেয়ার জন্য তৈরি।
কাশ্মীরিস্তানে গবেষণা চালানো হবে ভারতের সংবিধানকে ধীরে ধীরে নির্বাহী শক্তি ও সামরিক শক্তির কেন্দ্র হিসেবে পরিণত করা।
এই পরীক্ষায় ব্রাজিল, যুক্তরাষ্ট্র, ফিলিপাইন, তুরস্ক ও অন্যান্য উদীয়মান স্বৈরতন্ত্রের সাথে প্রতিযোগিতা করবে ভারত। এতে গণতান্ত্রিক আইনের স্থলাভিষিক্ত হবে বিদেশীভীতি। পেশীবহুল কেন্দ্র ও নারীতে পরিণত রাজ্যগুলোর যুগে স্বাগতম। কাশ্মীরিস্তান আমাদের। আমরা সবাই এখন বিজেপির ভারতের জন্য অপেক্ষা করছি।
>>>লেখক: শিক্ষক, নিউ ইয়র্ক ও বার্লিন, বিশ্বায়ন ও দক্ষিণ এশিয়ার ওপর নিয়মিত লেখালেখি করেন।
মোদি সরকার অতি সম্প্রতি কাশ্মীরে যা করেছে সেটাকে নিশ্চিতভাবেই বিদেশীভীতি, মুসলিমবিরোধী নীতি, রাজনৈতিক মঞ্চ ও হতাশাবাদী রাজনৈতিক পদক্ষেপের মিশ্রণ হিসেবে অভিহিত করা যায়। এই সময় ও কেন এমন বিধ্বংসী উপায়ে কাশ্মীরের মর্যাদা বাতিল করা হলো তা নিয়ে দুটি মন্তব্য এখানে করা হচ্ছে।
প্রথমত, হিন্দু ডানপন্থীদের মতে, নিয়ন্ত্রণ রেখার উভয় পাড়ে পুরো কাশ্মীর পাকিস্তানের পক্ষে রয়েছে। কাশ্মীর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার দীর্ঘ সংগ্রামে এটি সাধারণভাবেই দেখা গেছে। আর ভারত প্রমাণ করার চেষ্টা করছে যে কাশ্মীরীদের সব অসন্তোষের মূলে রয়েছে পাকিস্তান।
কিন্তু তা সত্ত্বেও অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিলের সময়টিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তান ও ভারত পুরো মাত্রায় যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে গিয়েও ফিরে এসেছিল। ভারতের জন্য এটি ছিল বিজেপির একটি লজ্জাজনক পরাজয়। তাদের সামরিক বাহিনী যে অযোগ্য, অদক্ষ তা প্রকটভাবে ফুটে ওঠেছিল। পাকিস্তানকে পায়ের তলায় ফেলে দিতে তারা পারেনি।
কিন্তু তা সত্ত্বেও মে মাসের নির্বাচনে মোদি দারুণ জয় পায়। সেটা হয় তার প্রবল প্রপাগান্ডা মেশিনের মাধ্যমে, হিন্দুত্ববাদী নির্বাচনী ঘাঁটি, পুঁজিবাদীদের সহায়তা। নির্বাচনের এই জয় তার ভোটারদের মধ্যে মুসলিমবিরোধী, পাকিস্তানবিরোধী প্রত্যাশা বাড়িয়ে দেয়। এটা উচ্চ পর্যায়ে ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব হয়নি।
সময়টার দিকে লক্ষ্য করা যেতে পারে: নভেম্বরে জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্য বিধান সভা ভেঙে দিয়ে বিজেপি বিপুল বিজয় লাভ করে। এরপর লজ্জাজনক কূটনীতির রেশ ধরে মার্চ ও এপ্রিলে পাকিস্তানের সাথে শান্তি স্থাপন করে। তারপর আগস্টে সামরিকভাবে নিরাপদ করে কেন্দ্রীয় ভূখণ্ড হিসেবে কাশ্মীরকে নিয়ন্ত্রণে নেয়া হয়।
অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিল আসলে ছিল একটি আইনগত অভ্যুত্থান। গত ফেব্রুয়ারিতে বালাকোটে পরাজয়ের পর বড় কিছু করার প্রয়োজন ছিল বিজেপির। এ কারণেই এই পদক্ষেপটি গ্রহণ করেছে তারা।
অর্থাৎ কাশ্মীর ছিল পাকিস্তানের জন্য একটি প্রক্সি। অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিলের জন্য কয়েক মাস, এমনকি হয়তো কয়েক বছর ধরেই প্রস্তুতি নিচ্ছিল বিজেপি। ফলে এটি ঘটা ছিল অনিবার্য। কিন্তু যেভাবে তা করা হয়েছে, সেটিই সবাইকে আতঙ্কিত করছে।
কাশ্মীরে আরেক ধরনের দীর্ঘ মেয়াদি প্রক্সি চলছে। ২০০২ সালে গুজরাটে মুসলিমদের বিরুদ্ধে সেটা পরীক্ষা করা হয়েছিল। গোধরা ট্রেনে হামলার রেশ ধরে ওই সময়ের গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, ও বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ মুসলিমদের টার্গেট করেন। তাদের বিরুদ্ধে দাঙ্গাবাজদের লেলিয়ে দেন। এরপর শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে গুজরাটে মুসলিমদের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ঘিরে রাখা হয়।
গুজরাটে ওই সময় যেসব সহিংস পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল তাতে আমলাতন্ত্র ও সশস্ত্র বাহিনী সহায়তা করেছিল। কাশ্মীরে কাশ্মীরীদের সন্ত্রস্ত্র করার জন্য সেনাবাহিনী ও আধা সামরিক বাহিনীর কোনো দাঙ্গাবাজের দরকার পড়েনি। তারা নিজেরাই ওই কাজটি করছে।
গুজরাট ছিল মোদির রাজনৈতিক গবেষণাগার। এখান থেকেই তিনি জাতীয় ক্ষমতায় ওঠেছিলেন। সেখানকার গবেষণাই কাশ্মীরে প্রয়োগ করা হচ্ছে।
এখন পাকিস্তানকে ধীরে ধীরে কাশ্মীরিস্তানে পরিণত করার চেষ্টা চলছে। এটা এখন একদিকে অলীক কল্পনা, অন্যদিকে গবেষণাগার। অলীক কল্পনায় কাশ্মীর পরিণত হয়েছে বশ্যতা স্বীকার করা পাকিস্তান এবং ভারতবর্ষ ভাগ আংশিকভাবে বিলুপ্ত করা হয়েছে। অধিকন্তু এই অলীক কল্পনায় কাশ্মীর হলো বলিউড সিনেমার ভালোবাসার জায়গা। এখানকার লেক আর পাহাড়গুলো হলো পাকিস্তানের নারীকৃত সংস্করণ, এখানকার সুন্দরী নারীরা লুফে নেয়ার জন্য তৈরি।
কাশ্মীরিস্তানে গবেষণা চালানো হবে ভারতের সংবিধানকে ধীরে ধীরে নির্বাহী শক্তি ও সামরিক শক্তির কেন্দ্র হিসেবে পরিণত করা।
এই পরীক্ষায় ব্রাজিল, যুক্তরাষ্ট্র, ফিলিপাইন, তুরস্ক ও অন্যান্য উদীয়মান স্বৈরতন্ত্রের সাথে প্রতিযোগিতা করবে ভারত। এতে গণতান্ত্রিক আইনের স্থলাভিষিক্ত হবে বিদেশীভীতি। পেশীবহুল কেন্দ্র ও নারীতে পরিণত রাজ্যগুলোর যুগে স্বাগতম। কাশ্মীরিস্তান আমাদের। আমরা সবাই এখন বিজেপির ভারতের জন্য অপেক্ষা করছি।
>>>লেখক: শিক্ষক, নিউ ইয়র্ক ও বার্লিন, বিশ্বায়ন ও দক্ষিণ এশিয়ার ওপর নিয়মিত লেখালেখি করেন।
No comments