জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার
এ
বছরটা আমার জন্য খুব ভালো একটা সংবাদ দিয়ে শুরু হয়েছে। বছরের শুরুতেই
জানতে পেরেছি, এ বছর থেকে ছেলেমেয়েদের আলাদা আলাদা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে
আলাদা আলাদা ভর্তি পরীক্ষা দিতে হবে না। সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলে যেন সমন্বিত
ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারে তার ব্যবস্থা করা হবে। আমি মহামান্য রাষ্ট্রপতির
কাছে কী ভাষায় কৃতজ্ঞতা জানাব বুঝতে পারছি না, তিনি যদি এ ব্যাপারটি নিয়ে
আগ্রহ না দেখাতেন, এ দেশে সেটি কখনও ঘটত বলে মনে হয় না। আমি আমাদের
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার সঙ্গে একেবারে গোড়া থেকে জড়িত ছিলাম। কয়েক
বছর যাওয়ার পর যখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়তে লাগল তখন থেকেই আমি
টের পেতে শুরু করলাম যে এই ভর্তি পরীক্ষার চেয়ে অমানবিক বিষয় আর কিছু হতে
পারে না। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ছেলেমেয়েরা সারারাত বাসে
বসে অন্য আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসে, তাদের একটা
বাথরুমে পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ থাকে না। না ঘুমিয়ে, না খেয়ে, বিশ্রাম না
নিয়ে তারা কী ভর্তি পরীক্ষা দেয় আমি জানি না। এক বছর ভর্তি পরীক্ষা দিতে
এসে বাস থেকে নামার সময় অন্য একটি বাসচাপায় একটা ছেলে মারা গেল, আমার মনে
হচ্ছিল এই ছেলেটির মৃত্যুর জন্য কোনো না কোনোভাবে নিশ্চয়ই আমরাই দায়ী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা সিটের জন্য দেশের ছেলেমেয়েরা পাগলের মতো চেষ্টা করে।
যে ছেলে বা মেয়ে যত বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারে, কোনো
একটি পাবলিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ তার তত বেশি বেড়ে যায়। ভর্তি
পরীক্ষা দিতে অনেক টাকার দরকার। শুধু যে ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার জন্য টাকা
দিতে হয় তা নয়, পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময় অভিভাবকদের সঙ্গে যেতে হয়, গাড়ি
ভাড়া-ট্রেন ভাড়া দিতে হয়। হোটেল ভাড়া করে সেখানে থাকতে হয়, খেতে হয়। এতগুলো
টাকা খরচ করার ক্ষমতা সবার থাকে না। তাই ঘুরেফিরে বড়লোকের ছেলেমেয়েরা অনেক
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারে। গরিবের ছেলেমেয়েরা শুধু বাড়ির
কাছের একটি-দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে পারলেই নিজেদের ভাগ্যবান মনে
করে। তাই ভর্তি পরীক্ষা শেষে দেখা যেত বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে বড়লোকের
ছেলেমেয়েরা ভর্তি হয়েছে, এই কলুষিত সিস্টেমে গরিবের ছেলেমেয়েরা ছিটকে
পড়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে মেয়েদের।
বাবা-মা অনেক সময় ছেলেদের দেশের
নানা জায়গায় একা একা পরীক্ষা দিতে দিয়েছেন, মেয়েদের সেভাবে যেতে দিতে সাহস
পাননি। তাই মেয়েরা তুলনামূলকভাবে কম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছে,
তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগও পেয়েছে কম। শুধু যে পরীক্ষা দেয়ার
খরচ তা নয়, দেশে এখন ভর্তি কোচিং নামে বিশাল একটা বাণিজ্য শুরু হয়েছে। যদি
কেউ স্কুল-কলেজে লেখাপড়া না করে শুধু ভর্তি কোচিং করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি
হয়ে যেতে পারে তাহলে বুঝতে হবে আমাদের সিস্টেমে একটা বিশাল গলদ আছে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দায়িত্ব হচ্ছে ভালো ছেলেমেয়েদের বেছে নেয়া, যদি কোচিং
সেন্টারগুলো তাদের ছেলেমেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ে গছিয়ে দিতে পারে তাহলে
আমাদের দুশ্চিন্তার কারণ আছে। এই ভর্তি কোচিংয়ে যে সত্যি সত্যি কোনো লাভ হয়
তার কোনো প্রমাণ আমার কাছে নেই। আমার কাছে বরং উল্টো প্রমাণ আছে- যেখানে
একজন শুধু আমার মুখের কথাকে বিশ্বাস করে নিজে নিজে পড়াশোনা করে ভর্তি
পরীক্ষায় অসাধারণ ভালো করেছে। কিন্তু এ কথা ক’জন বিশ্বাস করবে? পথেঘাটে
পর্যন্ত পোস্টার লাগানো থাকে, যেখানে ভর্তি পরীক্ষায় ভালো ফল করা
ছেলেমেয়েদের ছবি দিয়ে কোচিং সেন্টার বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে।আজ থেকে ছয়-সাত বছর
আগে আরও একবার সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার একটা উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। তখন ডক্টর
প্রাণ গোপাল দত্ত ভাইস চ্যান্সেলরদের সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের সভাপতি
ছিলেন। মন্ত্রণালয় থেকে আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল এ দেশের সব
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরদের সামনে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা কীভাবে
নেয়া যায় তার ওপর একটি বক্তব্য দিতে। আমি নেহায়েত বোকাসোকা মানুষ বলে
সেখানে বক্তব্য দিতে রাজি হয়েছিলাম। বক্তব্য দেয়ার সময় দেশের বড় বড়
বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভাইস চ্যান্সেলররা অল্প সময়ের জন্য এসে
চেহারা দেখিয়ে চলে গেলেন এবং যাওয়ার আগে বলে গেলেন, তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের
ভর্তি পরীক্ষা যথেষ্ট ভালোভাবে চলছে, সেটা পরিবর্তন করার কোনো প্রয়োজন
কিংবা সুযোগ নেই! কিছু ভাইস চ্যান্সেলর বললেন, তাদের নিজেদের
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে পরীক্ষা নেয়া হলে তাদের মান নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।
আমি ভেবেছিলাম সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেয়া হলে শিক্ষকদের যে একটা বাড়তি
উপার্জন কমে যাবে সেই কথাটি হয়তো অন্তত ভদ্রতা করে কেউ মুখ ফুটে বলবে না।
কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর সেটা বলেই
ফেললেন! তিনি জানালেন, ভাইস চ্যান্সেলর হয়ে তিনি যদি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা
পদ্ধতিতে রাজি হয়ে নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যান, তাহলে তার
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাকে ক্যাম্পাসে ঢুকতে দেবেন না! অর্থলোভের এরকম
সহজ-সরল স্বীকারোক্তি আমি এর আগে আর কারও মুখে শুনিনি।
আমি তখনই বুঝেছিলাম,
এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কখনোই নিজের উৎসাহে সমন্বিত ভর্তি
পরীক্ষার জন্য এগিয়ে আসবেন না। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা শুরু করার একটিমাত্র
উপায়, সেটি হচ্ছে তাদের জোর করে রাজি করানো! বিশ্ববিদ্যালয়গুলো
স্বায়ত্তশাসিত, তাই তাদের জোর করে রাজি করানোর কাজটি সহজ নয়! সেটি করতে হবে
অনেক উপরের মহল থেকে চাপ দিয়ে। আমার ধারণাটি ভুল ছিল না, শুধু মহামান্য
রাষ্ট্রপতি বিষয়টি উত্থাপন করার পরই প্রথমবার সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার
বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। সত্যি কথা বলতে কী, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো
প্রথমবার মহামান্য রাষ্ট্রপতির ইচ্ছাটুকুর প্রতি সম্মান পর্যন্ত দেখায়নি। এ
বছর প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছে, আমি এখনও নিঃশ্বাস বন্ধ করে আছি, যতক্ষণ
পর্যন্ত সত্যি সত্যি বিষয়টি না ঘটবে, আমি নিশ্চিত হতে পারব না।আমার
আশঙ্কাটুকু মোটেও অমূলক নয়। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার আলোচনাটি শুরু হওয়ার পর
নানা ধরনের গুরুত্বপূর্ণ মানুষের কিছু কথা আমার কানে আসছে। বক্তব্যগুলো
এরকম : ‘সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা কি মুখের কথা? বললেই হল?’ কিংবা ‘এটা
কোনোদিন কাজ করবে না! নেভার।’ কিংবা, ‘মেডিকেল নিচ্ছে বলেই আমাদের নিতে হবে
কে বলেছে? মেডিকেল আর আমরা কি এক জিনিস?’ ইত্যাদি ইত্যাদি! আমি আশা ছাড়তে
রাজি নই। আমি জানি প্রক্রিয়াটাকে নানাভাবে বাধা দেয়া হবে- অর্থলোভ খুবই
ভয়ংকর। একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন খুব কম ছিল- মনে আছে একজন
লেকচারারের বেতন কত কম সেটা একবার একটা কলামে লিখে ফেলেছিলাম। পরদিন আমার
সহকর্মী লেকচারার মাথায় থাবা দিতে দিতে আমার সঙ্গে দেখা করে বলেছিল, ‘স্যার
আপনি করেছেন কী? আমার বিয়ের কথা হচ্ছিল, বিয়েটা ভেঙে গেছে!’ যা হোক,
সেগুলো অতীতের কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন এখন অনেক বেড়েছে, শুধু
টাকার লোভের জন্য এখন এ দেশের ছেলেমেয়েদের প্রতি নিষ্ঠুরতা করে যাবে আমি
সেটি বিশ্বাস করি না! আমি আশা করে আছি, এরপরের ভর্তি পরীক্ষাটি হবে একটি
সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা! বাংলাদেশের ছেলেমেয়েদের আর কখনও অতীতের নিষ্ঠুর
অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হবে না।
২.সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে যখনই আলোচনা হয় তখন আমি ‘গুচ্ছপদ্ধতি’ নিয়ে একটা কথা শুনি এবং যখনই এই কথাটি শুনতে পাই তখনই আমি একটা ধাক্কা খাই। আমার মনে হয়, যে ‘গুচ্ছপদ্ধতি’ শব্দটি ব্যবহার করে সে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার বিষয়টি ধরতে পারিনি। ‘গুচ্ছ’ শব্দটির অর্থ একধরনের অনেক বিষয়ের সমাহার। ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার সময় সব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটি গুচ্ছ, সব প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটি গুচ্ছ, সব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় মিলে আরেকটি গুচ্ছ- এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বেশ কয়েকটি গুচ্ছে ভাগ করা যেতে পারে। তারপর একেকটা গুচ্ছের জন্য একেকটা ভর্তি পরীক্ষা নেয়া হবে এবং সেটা হচ্ছে গুচ্ছপদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষা। কিন্তু যে বিষয়টা আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না সেটা হচ্ছে, যে ছেলেমেয়েগুলো ভর্তি পরীক্ষা দিচ্ছে তারা কেউ কৃষিবিদ হয়ে যায়নি কিংবা প্রকৌশলী হয়ে যায়নি, কাজেই এখনও তারা নির্দিষ্ট কোনো গুচ্ছের অংশ হয়ে যায়নি! আমরা যদি তাদের একটা পরীক্ষা নিতে চাই তাহলে মোটেও তাদের কোনো ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ের পরীক্ষা নিই না। কিংবা কৃষিবিষয়ক পরীক্ষা নিই না! তারা সেই বিষয়গুলো এখনও জানে না, এখনও সেগুলো পড়েনি, আমরা তার পরীক্ষা নেব কেমন করে? তারা এইচএসসিতে যে বিষয়গুলো নিয়ে লেখাপড়া করেছে, আমরা শুধু সেই বিষয়গুলোরই পরীক্ষা নিতে পারি! সত্যি কথা বলতে কী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা আসলে একটা মিনি এইচএসসি পরীক্ষা ছাড়া আর কিছু নয়! সত্যিকারের এইচএসসি পরীক্ষার সঙ্গে এর সবচেয়ে বড় পার্থক্য হচ্ছে, এই পরীক্ষার প্রশ্নগুলো করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। এইচএসসি পরীক্ষায় ছেলেমেয়েদের যে বুদ্ধিমত্তাকে যাচাই করা সম্ভব হয় না, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় চেষ্টা করা হয় সেই বুদ্ধিমত্তাকে যাচাই করার! কাজেই আমি মনে করি, যখন সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেয়া হবে তখন যেন ছেলেমেয়েদের আগেই গুচ্ছ গুচ্ছ হিসেবে ভাগ করে নেয়ার চেষ্টা করা না হয়। ভর্তি পরীক্ষা নেয়া হবে তার এইচএসসির বিষয়গুলোর ওপর। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের যে গুচ্ছ বিষয়ের নম্বর বিবেচনা করতে চায়, তারা সেই নম্বরগুলো বিবেচনা করতে পারবে। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেয়া হলে এ দেশের একটা অনেক বড় অভিশাপকে চিরদিনের মতো দূর করে দেয়া সম্ভব হবে। সেই অভিশাপটি হচ্ছে ভর্তি কোচিং। আমি আশা করে আছি, যারা সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার দায়িত্ব নেবেন, তারা যেন সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষাটি নেন এইচএসসি পরীক্ষা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। তখন ছেলেমেয়েরা ভর্তি পরীক্ষাটি সবচেয়ে ভালোভাবে দিতে পারবে। সদ্য এইচএসসি পরীক্ষা দেয়ার কারণে বিষয়বস্তুটা তাদের খুব ভালোভাবে মনে থাকবে, ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার প্রস্তুতি নেয়ার জন্য তাদের কোনো কোচিং সেন্টারে টাকা ঢালতে হবে না। যখন আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিতে রাজি হবে না তখন যশোর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, দুটি বিশ্ববিদ্যালয় মিলেই একটা সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেয়া হোক। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় রাজি হয়েছিল এবং দুটি বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটি ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছিল। বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো সিলেটে এই অতি চমৎকার উদ্যোগটির বিরোধিতা করে আন্দোলন শুরু করে দিল এবং শেষ পর্যন্ত উদ্যোগটি আর সফল হতে পারল না। তবে আমরা যেহেতু সেই সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার খুঁটিনাটি বিবেচনা করে কাজ শুরু করেছিলাম, তাই অনেক বিষয় আমরা তখনই সমাধান করেছিলাম, যেগুলো জানা থাকলে ভালো।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো এরকম :
ক. ছাত্রছাত্রীরা ভর্তির জন্য আবেদন করার সময়েই জানিয়ে দিত তারা যশোর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নাকি শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নাকি দুটো বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যই বিবেচিত হতে চায়। কয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আবেদন করছে তার ওপর নির্ভর করে ফি নির্ধারণ করা হতো (আমি আগেই এটা বলছি, কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যেন খানিকটা আশ্বস্ত হয় যে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা হলেও তাদের অর্থ উপার্জনের রাস্তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে না!)।
খ. প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির নিজস্ব নিয়মকানুন থাকে। পাবলিক পরীক্ষার নম্বর কত শতাংশ নেয়া হবে, কোন বিভাগে ভর্তি করার জন্য কোন কোন বিষয়ের নম্বর বিবেচনা করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। সোজা কথায় বলা যায়, সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা হলেও প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির নিয়মে তাদের স্বকীয়তা বজায় রাখতে পারবে। তারা শুধু সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার নম্বরটি নেবেন, বাকি সব আগের মতোই থাকবে।
গ. রেজিস্ট্রেশন করার সময় পরীক্ষার্থী ছেলেমেয়েরা জানিয়ে দিত তারা কোন সেন্টারে পরীক্ষা দিতে চায়। আমাদের বেলায় উত্তরবঙ্গের ছেলেমেয়েরা যশোর সেন্টারে পরীক্ষা দিতে আগ্রহী ছিল, অন্যেরা সিলেটে। যদি বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার পরিকল্পনা করে, তাহলে সারা দেশে ত্রিশটির থেকেও বেশি সেন্টার থাকবে এবং কোনো সেন্টারেই বাড়াবাড়ি পরীক্ষার্থী থাকবে না, পরীক্ষা নেয়ার কাজটি অনেক সহজ হয়ে যাবে। ছাত্রছাত্রীরাও নিজের বাড়ির কাছে একটি সেন্টারে পরীক্ষা দিতে পারবে। কষ্ট করে দূরে কোথাও যেতে হবে না।প্রথম যখন ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার ঘোষণা দেয়া হয়েছিল তখন বিষয়টা সবাই ভালো করে বুঝতে পার েনি। অনেকেই ধরে নিয়েছিল এটি শুধু একটি মুখের কথা। কিন্তু বিগত বছরগুলোয় তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে অনেক কাজ হয়েছে। একসময় যেটি কল্পনাও করা যেত না এখন সেটি শুধু যে কল্পনা করা যাচ্ছে তা নয়, সেটি বাস্তবায়ন পর্যন্ত করা যাচ্ছে। কাজেই যারা ভবিষ্যতের সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার দায়িত্ব নিচ্ছেন, তারা যদি সময়মতো পরিকল্পনা করে তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্য নেন, তাহলে শুধু যে চমৎকারভাবে একটা পরীক্ষা নিতে পারবেন তা নয়, পরীক্ষার পর দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি করানো থেকে শুরু করে ভর্তি-পরবর্তী কাজগুলোও করে দিতে পারবেন। আমি এখন নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করে আছি দেখার জন্য- সত্যি সত্যি আমরা আমাদের ছেলেমেয়ের হাতে তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহারটি তুলে দিতে পারি কিনা!
মুহম্মদ জাফর ইকবাল : অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়; লেখক
২.সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে যখনই আলোচনা হয় তখন আমি ‘গুচ্ছপদ্ধতি’ নিয়ে একটা কথা শুনি এবং যখনই এই কথাটি শুনতে পাই তখনই আমি একটা ধাক্কা খাই। আমার মনে হয়, যে ‘গুচ্ছপদ্ধতি’ শব্দটি ব্যবহার করে সে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার বিষয়টি ধরতে পারিনি। ‘গুচ্ছ’ শব্দটির অর্থ একধরনের অনেক বিষয়ের সমাহার। ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার সময় সব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটি গুচ্ছ, সব প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটি গুচ্ছ, সব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় মিলে আরেকটি গুচ্ছ- এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বেশ কয়েকটি গুচ্ছে ভাগ করা যেতে পারে। তারপর একেকটা গুচ্ছের জন্য একেকটা ভর্তি পরীক্ষা নেয়া হবে এবং সেটা হচ্ছে গুচ্ছপদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষা। কিন্তু যে বিষয়টা আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না সেটা হচ্ছে, যে ছেলেমেয়েগুলো ভর্তি পরীক্ষা দিচ্ছে তারা কেউ কৃষিবিদ হয়ে যায়নি কিংবা প্রকৌশলী হয়ে যায়নি, কাজেই এখনও তারা নির্দিষ্ট কোনো গুচ্ছের অংশ হয়ে যায়নি! আমরা যদি তাদের একটা পরীক্ষা নিতে চাই তাহলে মোটেও তাদের কোনো ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ের পরীক্ষা নিই না। কিংবা কৃষিবিষয়ক পরীক্ষা নিই না! তারা সেই বিষয়গুলো এখনও জানে না, এখনও সেগুলো পড়েনি, আমরা তার পরীক্ষা নেব কেমন করে? তারা এইচএসসিতে যে বিষয়গুলো নিয়ে লেখাপড়া করেছে, আমরা শুধু সেই বিষয়গুলোরই পরীক্ষা নিতে পারি! সত্যি কথা বলতে কী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা আসলে একটা মিনি এইচএসসি পরীক্ষা ছাড়া আর কিছু নয়! সত্যিকারের এইচএসসি পরীক্ষার সঙ্গে এর সবচেয়ে বড় পার্থক্য হচ্ছে, এই পরীক্ষার প্রশ্নগুলো করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। এইচএসসি পরীক্ষায় ছেলেমেয়েদের যে বুদ্ধিমত্তাকে যাচাই করা সম্ভব হয় না, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় চেষ্টা করা হয় সেই বুদ্ধিমত্তাকে যাচাই করার! কাজেই আমি মনে করি, যখন সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেয়া হবে তখন যেন ছেলেমেয়েদের আগেই গুচ্ছ গুচ্ছ হিসেবে ভাগ করে নেয়ার চেষ্টা করা না হয়। ভর্তি পরীক্ষা নেয়া হবে তার এইচএসসির বিষয়গুলোর ওপর। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের যে গুচ্ছ বিষয়ের নম্বর বিবেচনা করতে চায়, তারা সেই নম্বরগুলো বিবেচনা করতে পারবে। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেয়া হলে এ দেশের একটা অনেক বড় অভিশাপকে চিরদিনের মতো দূর করে দেয়া সম্ভব হবে। সেই অভিশাপটি হচ্ছে ভর্তি কোচিং। আমি আশা করে আছি, যারা সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার দায়িত্ব নেবেন, তারা যেন সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষাটি নেন এইচএসসি পরীক্ষা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। তখন ছেলেমেয়েরা ভর্তি পরীক্ষাটি সবচেয়ে ভালোভাবে দিতে পারবে। সদ্য এইচএসসি পরীক্ষা দেয়ার কারণে বিষয়বস্তুটা তাদের খুব ভালোভাবে মনে থাকবে, ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার প্রস্তুতি নেয়ার জন্য তাদের কোনো কোচিং সেন্টারে টাকা ঢালতে হবে না। যখন আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিতে রাজি হবে না তখন যশোর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, দুটি বিশ্ববিদ্যালয় মিলেই একটা সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেয়া হোক। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় রাজি হয়েছিল এবং দুটি বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটি ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছিল। বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো সিলেটে এই অতি চমৎকার উদ্যোগটির বিরোধিতা করে আন্দোলন শুরু করে দিল এবং শেষ পর্যন্ত উদ্যোগটি আর সফল হতে পারল না। তবে আমরা যেহেতু সেই সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার খুঁটিনাটি বিবেচনা করে কাজ শুরু করেছিলাম, তাই অনেক বিষয় আমরা তখনই সমাধান করেছিলাম, যেগুলো জানা থাকলে ভালো।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো এরকম :
ক. ছাত্রছাত্রীরা ভর্তির জন্য আবেদন করার সময়েই জানিয়ে দিত তারা যশোর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নাকি শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নাকি দুটো বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যই বিবেচিত হতে চায়। কয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আবেদন করছে তার ওপর নির্ভর করে ফি নির্ধারণ করা হতো (আমি আগেই এটা বলছি, কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যেন খানিকটা আশ্বস্ত হয় যে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা হলেও তাদের অর্থ উপার্জনের রাস্তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে না!)।
খ. প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির নিজস্ব নিয়মকানুন থাকে। পাবলিক পরীক্ষার নম্বর কত শতাংশ নেয়া হবে, কোন বিভাগে ভর্তি করার জন্য কোন কোন বিষয়ের নম্বর বিবেচনা করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। সোজা কথায় বলা যায়, সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা হলেও প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির নিয়মে তাদের স্বকীয়তা বজায় রাখতে পারবে। তারা শুধু সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার নম্বরটি নেবেন, বাকি সব আগের মতোই থাকবে।
গ. রেজিস্ট্রেশন করার সময় পরীক্ষার্থী ছেলেমেয়েরা জানিয়ে দিত তারা কোন সেন্টারে পরীক্ষা দিতে চায়। আমাদের বেলায় উত্তরবঙ্গের ছেলেমেয়েরা যশোর সেন্টারে পরীক্ষা দিতে আগ্রহী ছিল, অন্যেরা সিলেটে। যদি বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার পরিকল্পনা করে, তাহলে সারা দেশে ত্রিশটির থেকেও বেশি সেন্টার থাকবে এবং কোনো সেন্টারেই বাড়াবাড়ি পরীক্ষার্থী থাকবে না, পরীক্ষা নেয়ার কাজটি অনেক সহজ হয়ে যাবে। ছাত্রছাত্রীরাও নিজের বাড়ির কাছে একটি সেন্টারে পরীক্ষা দিতে পারবে। কষ্ট করে দূরে কোথাও যেতে হবে না।প্রথম যখন ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার ঘোষণা দেয়া হয়েছিল তখন বিষয়টা সবাই ভালো করে বুঝতে পার েনি। অনেকেই ধরে নিয়েছিল এটি শুধু একটি মুখের কথা। কিন্তু বিগত বছরগুলোয় তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে অনেক কাজ হয়েছে। একসময় যেটি কল্পনাও করা যেত না এখন সেটি শুধু যে কল্পনা করা যাচ্ছে তা নয়, সেটি বাস্তবায়ন পর্যন্ত করা যাচ্ছে। কাজেই যারা ভবিষ্যতের সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার দায়িত্ব নিচ্ছেন, তারা যদি সময়মতো পরিকল্পনা করে তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্য নেন, তাহলে শুধু যে চমৎকারভাবে একটা পরীক্ষা নিতে পারবেন তা নয়, পরীক্ষার পর দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি করানো থেকে শুরু করে ভর্তি-পরবর্তী কাজগুলোও করে দিতে পারবেন। আমি এখন নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করে আছি দেখার জন্য- সত্যি সত্যি আমরা আমাদের ছেলেমেয়ের হাতে তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহারটি তুলে দিতে পারি কিনা!
মুহম্মদ জাফর ইকবাল : অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়; লেখক
No comments