পদ্মা-মেঘনা বহুমুখী সেতু হলে কমবে উন্নয়ন বৈষম্য by এম এ শাহেন শাহ
পদ্মা
সেতুর নির্মাণকাজ এগিয়ে চলেছে। এ সেতু উদ্বোধনের সঙ্গে সঙ্গেই
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার সঙ্গে রাজধানী ঢাকার সরাসরি যোগাযোগ
স্থাপিত হবে। এরপরও চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের ১৫টি জেলা থেকে বিচ্ছিন্ন
থাকবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলা। পরবর্তী সময়ে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া
দিয়ে দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা আছে। এ সেতু নির্মাণের আগেই
এর ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনা করা অপরিহার্য। গুলিস্তান থেকে মাওয়া অর্থাৎ
পদ্মা সেতুর উত্তর প্রান্তের দূরত্ব ৩৮ কিলোমিটার, অন্যদিকে গুলিস্তান থেকে
পাটুরিয়ার দূরত্ব ৯০ কিলোমিটার। একই সময়ে গুলিস্তান থেকে দুটি গাড়ি,
প্রথমটি মাওয়ার পথে এবং দ্বিতীয়টি পাটুরিয়ার পথে যাত্রা শুরু করলে
দ্বিতীয়টি পাটুরিয়া পৌঁছার আগেই প্রথমটি মাওয়া-জাজিরা পদ্মা সেতু দিয়ে
ফরিদপুর পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। দ্বিতীয় পদ্মা সেতুর প্রয়োজন আছে, কিন্তু
কোনোক্রমেই তা অগ্রাধিকার পেতে পারে না। পদ্মা সেতু চালু হলে ঢাকা-মাওয়ার
পথে চলাচলকারী যানবাহনের সঙ্গে যুক্ত হবে ঢাকা-পাটুরিয়ার পথে চলাচলরত
যানবাহন। এর সঙ্গে যখন বন্দরনগরী চট্টগ্রাম থেকে আগত ২১ জেলার যাত্রী ও
পণ্যবাহী যানবাহন পদ্মা সেতু দিয়ে চলাচল করবে তখন সেতুর ওপর পড়বে
অস্বাভাবিক চাপ। সেতুর উভয় প্রান্তেই সৃষ্টি হবে যানবাহনের অকল্পনীয় জট।
এ
অবস্থায় পদ্মা সেতুর স্থায়িত্বের ওপর পড়বে নেতিবাচক প্রভাব। কারণ গত শতকের
নব্বইয়ের দশকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে নির্মিত মেঘনা ও মেঘনা-গোমতী সেতু
দুটির প্রাথমিক মেয়াদ ধরা হয়েছিল ১০০ বছর। অতিরিক্ত যানবাহনের চাপে
উদ্বোধনের মাত্র ২৫ বছরের মধ্যেই সেতু দুটি নড়বড়ে হয়ে পড়ে। বর্তমানে সেতু
দুটির পাশে আরও দুটি সেতুর নির্মাণ কাজ চলছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল
দেশে একই স্থানে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে বারবার সেতু নির্মাণ অত্যন্ত
ব্যয়বহুল। এতে দেশের অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্পে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দে ঘাটতি
দেখা দেবে। বাংলাদেশ একটি ক্ষুদ্র আয়তনের জনবহুল রাষ্ট্র। দেশের
দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের আকাশ-পাতাল অর্থনৈতিক ও
অবকাঠামোগত বৈষম্য বিদ্যমান। শরীয়তপুর, মাদারীপুর, বাগেরহাট, খুলনা,
সাতক্ষীরা, পটুয়াখালীসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিশাল এলাকাজুড়ে এখনও বিরাজ
করছে ঊনবিংশ শতাব্দীর আমেজ। এ অসম ও বৈষম্যমূলক উন্নয়নকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত
পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্যের সঙ্গে তুলনা করা
যায়। চাঁদপুর, কুমিল্লা, ফেনী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এ ক্ষেত্রে ১৯৭১ সালের
পশ্চিম পাকিস্তান, অন্যদিকে শরীয়তপুর, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জসহ
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান।
স্বাধীনতা-পরবর্তী ৪৬ বছরে এ বৈষম্য হ্রাস পাওয়ার পরিবর্তে বরং আরও বৃদ্ধি
পেয়েছে। এটি বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির মূল চেতনারও পরিপন্থী। সড়ক-মহাসড়ক
উন্নয়ন বাজেটের সিংহভাগই ব্যয় হচ্ছে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে। স্থায়ী
বঞ্চনা দক্ষিণাঞ্চলকে ঘিরে রেখেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আইলা, সিডর,
নদীভাঙন, ফসলের জমিতে লবণাক্ততা ইত্যাদি। বিগত চার দশকে দেশের
যোগাযোগব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নয়ন হলেও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থা যে তিমিরে ছিল সে তিমিরেই আছে।
দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রাম থেকে দক্ষিণাঞ্চলে যেতে হয় ঢাকা হয়ে। চট্টগ্রাম
থেকে ঢাকা হয়ে দক্ষিণাঞ্চলে যাতায়াতের দূরত্ব, গমনকাল ও পরিবহন ব্যয়
চট্টগ্রাম থেকে চাঁদপুর হয়ে যাতায়াতের দূরত্ব, গমনকাল ও পরিবহন ব্যয়ের
দ্বিগুণ। তাছাড়া ঢাকা হয়ে যাতায়াতকারী প্রতিটি যানবাহনকে তিনটি সেতু ও একটি
ফেরিতে টোল দিতে হয়। অন্যদিকে চাঁদপুর হয়ে যাতায়াতের ক্ষেত্রে শুধু একটি
ফেরিতে টোল দিতে হয়। এ যাতায়াতব্যবস্থা সহজ করার লক্ষ্যে ২০০১ সালে
চট্টগ্রাম থেকে চাঁদপুর-শরীয়তপুর হয়ে চালু করা হয় চট্টগ্রাম-খুলনা মহাসড়ক। এ
মহাসড়কটি দেশের ৩৬টি জেলার মধ্যে যাতায়াতের হ্রস্বতম দূরত্বের পথ। দেশের
অন্য কোনো সড়ক-মহাসড়ক এত অধিকসংখ্যক জেলাকে যুক্ত করেনি। চাঁদপুর ও
শরীয়তপুরের মধ্যে সেতু না থাকায় এ মহাসড়কের কার্যকারিতা কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে
পৌঁছেনি। এ কারণে দেশের শীর্ষ পাঁচটি মহাসড়কের অন্যতম হওয়া সত্ত্বেও এ
সড়কপথে অদ্যাবধি কোনো মানসম্পন্ন বাস সার্ভিস চালু হয়নি। আঞ্চলিক বৈষম্য
লালনকারী অশুভ চক্র জ্বালানিসাশ্রয়ী জনপ্রিয় এ রুটকে অকার্যকর রাখতে এখনও
প্রবলভাবে সক্রিয়। বর্তমানে হরিণা ফেরিঘাটের পাশ দিয়ে বহমান পদ্মা-মেঘনার
মূল স্রোতধারা প্রায় ৩ কিলোমিটার প্রশস্ত। এর পশ্চিম দিকে ২ কিলোমিটার
বিস্তৃত বিশাল চর, চরের শেষ প্রান্তে ২০০ মিটার প্রস্থের একটি ক্ষীণধারা
প্রবাহিত। এর পরই শুরু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মূল ভূভাগ। অর্থাৎ প্রস্তাবিত
সেতুর দৈর্ঘ্য হবে অনধিক ৬ কিলোমিটার।
এর মধ্যে মূল নদীর ওপর থাকবে ৩
কিলোমিটার। একবিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের দিনে এ সেতু নির্মাণের
বাস্তবতা প্রশ্নাতীত। কারণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ২০-৩০
কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে অনেক সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। কয়েকটি সেতু আছে
নির্মাণাধীন। সেতুগুলোর কোনোটি আবার সাগর-উপসাগরের উপর অবস্থিত। সম্প্রতি
আসামে উদ্বোধন করা হয়েছে ৯.১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে ভূপেন হাজারিকা সেতু, যা
উপমহাদেশের দীর্ঘতম। পদ্মা-মেঘনা বহুমুখী সেতু নির্মাণ করা হলে নদীর উভয়
তীরে গড়ে উঠবে সিমেন্ট, সার, ইস্পাত কারখানা, গার্মেন্ট ভিলেজ, ইপিজেড,
বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প ও পর্যটন কেন্দ্র। খুলে যাবে নদীভাঙন কবলিত হাজার
মানুষের কর্মসংস্থানের দ্বার। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছাড়িয়ে যাবে কাঙ্ক্ষিত
লক্ষ্যমাত্রা। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে নির্মাণসামগ্রীর মূল্য হ্রাস পাবে, যা
অবকাঠামোগত উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে। যোগাযোগব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণে
পদ্মা সেতুর পরিপূরক হবে পদ্মা-মেঘনা বহুমুখী সেতু। রাষ্ট্রের
যোগাযোগব্যবস্থাও পূর্ণতা পাবে। সেতুটি নির্মাণের পক্ষে অর্থনৈতিক দিকও
বিবেচনায় নিতে হবে। বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ায় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির উদীয়মান
রাষ্ট্র। প্রতি বছরই বার্ষিক উন্নয়ন বাজেটের একটি অংশ অব্যহৃত থাকে।
তাছাড়া দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে লাখ লাখ কোটি টাকা অলস পড়ে আছে। এর
কিয়দংশ ব্যয়েই পদ্মা-মেঘনা সেতুর নির্মাণ সম্পন্ন হতে পারে। কল্পিত
দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করে হতাশ ও
অনুতপ্ত। পদ্মা-মেঘনা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংক অথবা নবগঠিত ব্রিকস ব্যাংক
যুক্ত হতে পারে। পদ্মা সেতু নির্মাণ শেষে বিদেশ থেকে আনা যন্ত্রপাতির
অনেকটাই ব্যবহার করা যাবে পদ্মা-মেঘনা বহুমুখী সেতু নির্মাণে। এম এ
শাহেনশাহ : সহযোগী অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, মহাসচিব, বাংলাদেশ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন
ফোরাম
No comments