এ কেমন নিষ্ঠুরতা
প্রকাশ্যে ছিনতাইকারীরা গাড়ির চাকায় পিষে মারলো হেলেনাকে ক্ষতবিক্ষত শরীরে হাসপাতালে গিয়েও প্রাণে বাঁচলেন না ইব্রাহিম |
রাজধানীতে
হেলেনা নামের এক গৃহবধূকে গাড়ির চাকায় পিষে হত্যা করেছে ছিনতাইকারীরা।
অন্যদিকে ছিনতাইকারীদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে দৌড়ে
রক্তাক্ত অবস্থায় হাসপাতাল পর্যন্ত গেলেও প্রাণে বাঁচতে পারেননি আরেক
ব্যবসায়ী। নির্মম, নিষ্ঠুর, পৈশাচিক ঘটনা দু’টি ঘটেছে গতকাল ভোরে নগরীর
ধানমন্ডি ও সায়েদাবাদ এলাকায়। ছিনতাইকারীদের নির্মমতার শিকার হেলেনা বরিশাল
থেকে ঢাকায় ফিরে গ্রীন রোডের বাসায় যাচ্ছিলেন। ব্যবসায়ী ইব্রাহিম ব্যবসার
কাজ করে নারায়ণগঞ্জ থেকে বাসে করে সায়েদাবাদে নেমেছিলেন। নিহত হেলেনা
রাজধানীর গ্রিন লাইফ হাসপাতালে মিডওয়াইফ পদে চাকরি করতেন।
তার স্বামী মনিরুল ইসলাম মন্টু অন্য একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী। তারা গ্রিন রোডে ভাড়া বাসায় থাকতেন। চার সন্তানের জননী হেলেনার করুণ মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে স্বজনদের মাঝে। চোখের সামনে স্ত্রীর এমন করুণ মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না মনিরুল ইসলাম। নিহত ইব্রাহিম ব্যবসার কাজে খুলনা থেকে নারায়ণগঞ্জ গিয়েছিলেন। খুলনার শেখ পাড়ায় তার একটি নৌযান মেরামতের ওয়ার্কশপ রয়েছে।
এর আগে গত ১৮ই ডিসেম্বর রাজধানীর দয়াগঞ্জে ছিনতাইকারীদের টানে মায়ের কোল থেকে পড়ে সাত মাসের শিশু আরাফাতের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। ৮ই অক্টোবর টিকাটুলিতে ছিনতাইকারীদের কবল থেকে এক স্কুল শিক্ষিকাকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ দেন বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র খন্দকার আবু তালহা। এই দুই ঘটনার পর ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয় সারা দেশে। শিশু আরাফাতকে হত্যার ঘটনায় জড়িত ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করেছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। খন্দকার আবু তালহার খুনি ছিনতাইকারীদেরও ঘটনাস্থলের পাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজের সূত্র ধরে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গতকালের ঘটনার পর পুলিশ জানিয়েছে, আশপাশের এলাকার বাসাবাড়ির ভিডিও ফুটেজ দেখে ছিনতাইকারীদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে হেলেনার স্বামী মনিরুল ইসলাম বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্রের সর্বশেষ সংস্করণ ‘স্মার্টকার্ড’ আনতে কিছুদিন আগে আমরা বরিশালের গ্রামের বাড়ি যাই। সেখান থেকে গতকাল রাতে লঞ্চে করে সদরঘাট আসি। ভোর ৪টার দিকে আমরা সদরঘাটে পৌঁছাই। পরে একটু হেঁটে ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে থেকে গ্রিন রোডের বাসায় যাওয়ার জন্য গাবতলীগামী ৭ নম্বর বাসে উঠি। বাসটি ধানমন্ডি ৭ ও ৬ নম্বর সড়কের মাঝামাঝি এসে আমাদেরকে অনেকটা জোর করে নামিয়ে দেয়। তখন রাস্তাঘাট ফাঁকা ছিল। বাসার যাবার জন্য আমরা একটি রিকশা খুঁজছিলাম। তখন আমাদের বেশ পেছনে একটি সাদা রঙের কার দাঁড়ানো অবস্থায় দেখি। আমরা কিছু দূর যাবার পর ওই করলা ব্র্যান্ডের কারটি আমাদের পাশে এসে দাঁড়ায়। গাড়ির সামনে চালক ছাড়া আরো একজন লোক বসা ছিল। এছাড়া আর কেউ ছিল না। তখন ওই চালকই আমার স্ত্রী হেলেনার কাছে থাকা ভেনেটি ব্যাগে টান দেয়। তখন হেলেনা ব্যাগটি রক্ষায় জোর করে ধরে রেখেছিল। ছিনতাইকারীরা ব্যাগ ছাড়ছিল না। তারা ব্যাগটি নিয়ে নিতে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেয়। এতে হেলেনা পড়ে যান। ব্যাগসহ তার হাতটি তখনও গাড়ির কাচে আটকা। টেনে হিঁচড়ে বেশ কিছু দূর নেয়ার পর গাড়িটি মোড় নিতে চাইলে হেলেনার মাথা গাড়ির চাকার নিচে পড়ে যায়। এতে তার মাথা থেঁতলে যায়। স্ত্রীর মর্র্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনার বর্ণনা দিতে দিয়ে বার বার মূর্ছা যাচ্ছিলেন মনিরুল। তিনি বলেন, ‘ঘটনাস্থলেই ও শেষ হয়ে যায়। আমার চোখের সামনে ওকে ওরা একেবারে পিষে মেরে ফেলে’। মনিরুল বলেন, পরে আমি হেলেনার নিথর দেহ গ্রিন লাইফ হাসপাতালে নিয়ে আসি। সেখান থেকে পুলিশ এসে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে লাশ নিয়ে যায়। গতকাল ময়নাতদন্ত শেষে বরিশালের উদ্দেশে স্ত্রীর লাশ নিয়ে রওনা দেন মনিরুল।
তিনি জানান, হেলেনার আয়েই পরিবারের পুরো খরচ চলতো। তাদের তিন ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়েও গ্রিন লাইফ হাসপাতালে চাকরি করেন। তিন ছেলেকে পড়াশোনা করাতেই আমরা ঢাকায় কষ্ট করছিলাম। হেলেনা চলে যাওয়ায় আমি একা হয়ে গেলাম। স্ত্রী হেলেনার হত্যাকারী ছিনতাইকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন তিনি। এদিকে ঘটনাস্থল রাজধানীর ধানমন্ডির আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালের বিপরীতে ধানমন্ডির সাত নম্বর সড়কে গেলে ঘটনার কোনো প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যায়নি। পুলিশ জানিয়েছে গতকাল পর্যন্ত তারাও কোনো প্রত্যক্ষদর্শী পায়নি। ভোরবেলা হওয়ায় ওই এলাকার সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। তবে পাশের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সিসি ক্যামেরা সচল ছিল। পুলিশ গতকাল ওই প্রতিষ্ঠানের ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করেছে। এদিকে মরদেহের ময়নাতদন্ত করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সোহেল মাহমুদ মানবজিমনকে বলেন, গাড়ির চাকা মাথা ও মুখমণ্ডলের উপর দিয়ে চলে যাওয়াতে তার মুখমণ্ডল থেঁতলে যায়। মুখ ও মাথার সমস্ত হাড় ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। ধানমন্ডি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুল লতিফ মানবজমিনকে বলেন, ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে নারী নিহত হওয়ার ঘটনায় কাউকে আটক ও শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হচ্ছে। গতকাল থাকায় টেকনিশিয়ান না পাওয়াতে একটু দেরি হচ্ছে। তবে রাতেই ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করা হবে।
প্রাণ নিয়ে হাসপাতাল পর্যন্ত যেতে পেরেছিলেন ইব্রাহিম: রাজধানীর সায়েদাবাদ এলাকায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে রক্তাক্ত হন ব্যবসায়ী মো. ইব্রাহিম। তিনি খুলনার সোনাডাঙ্গা উপজেলার শেখপাড়ার মৃত বজলুর রহমানের ছেলে। ব্যবসার কাজে মঙ্গলবার খুলনা থেকে ঢাকায় আসেন। বৃহস্পতিবার রাতে নারায়ণগঞ্জ থেকে সায়েদাবাদ পৌঁছে কোথাও যাওয়ার সময় রাত সাড়ে তিনটার দিকে তিনি ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। এ সময় ছিনতাইকারীরা তার শরীরে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে। তার কাছে থাকা জিনিসপত্র নেয়ার জন্য টানাটানি শুরু হয়। একপর্যায়ে ছিনতাইকারীরা তাকে ছুরিকাঘাত করে। ছুরিকাঘাতে রক্তাক্ত অবস্থায় ইব্রাহিম নিজেকে রক্ষা করতে দৌড়াতে থাকেন। দৌড়ে তিনি সালাহউদ্দিন হাসপাতালে পৌঁছান। সেখানকার জরুরি বিভাগে তার কিছু চিকিৎসা দিয়ে ঢাকা মেডিকেলে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। সঙ্গে কেউ না থাকায় এবং যানবাহন না পাওয়ায় তিনি অনেক সময় ওই হাসপাতালেই অপেক্ষা করছিলেন। পরে পুলিশের টহল দল এসে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় থাকার পর তার মৃত্যু হয়।
ইব্রাহিমের দুলাভাই আবদুল হক মানবজমিনকে বলেন, জাহাজের ওয়ার্কশপের কাজেই ইব্রাহিম ঢাকায় আসেন। মঙ্গলবার রাতে ঢাকায় এসে একটি আবাসিক হোটেলে থেকে বুধবার ব্যবসায়িক কাজ কর্ম সেরেছেন। কিন্তু মঙ্গলবার কোনো কাজে হয়তো তিনি নারায়ণগঞ্জ গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফিরতে গভীর রাত হয়ে যায়। রাতে গাড়ি থেকে সায়েদাবাদ এলাকায় নেমে কোথাও যাচ্ছিলেন। ঠিক তখনই তাকে কয়েকজন ছিনতাইকারী আক্রমণ করে। তার কাছে জিনিসপত্র নেয়ার জন্য টানাটানি শুরু হয়। একপর্যায়ে ছিনতাইকারীরা তাকে ছুরিকাঘাত করে। পর পর তাকে সাতটি ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। ফলে সে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। কিন্তু মনোবল না হারিয়ে ইব্রাহিম একাই পার্শ্ববর্তী সালাউদ্দিন হাসপাতালে গিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা নেয়। অবস্থার বেগতিক দেখে হাসপাতাল থেকেই তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। কিন্তু তখন কোনো সিএনজি বা গাড়ি হাসপাতালে যেতে রাজি হয়নি। পরে খবর পেয়ে ওই হাসপাতালে এসে টহল পুলিশ তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে কিছুক্ষন চিকিৎসা নেয়ার পর সে মারা যায়। তার কাছে থাকা মোবাইল থেকে আমাদের নম্বর নিয়ে ফোন করে পুলিশ। তারপর এসে আমরা ঘটনার বিস্তারিত জানতে পারি। নিহত ইব্রাহিমের আত্মীয় মো. বাদল মানবজমিনকে বলেন, বাস থেকে সায়েদাবাদ নেমে রেল লাইনের পাশের গলি দিয়ে তিনি হাঁটছিলেন। এ সময় তিনি ছিনতাকারীর কবলে পড়েন। পরে তারা ছুরিকাঘাত করলে তিনি দৌড়ে গিয়ে সালাউদ্দিন হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। পরে সেখান থেকে আবার ঢামেকে নিলে খবর পেয়ে আমরা সেখানে পৌঁছাই। কিন্তু আমরা যাওয়ার পর পরই তিনি মারা যান। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপ-কমিশনার ফরিদ উদ্দিন আহমদ মানবজমিনকে বলেন, এ ঘটনায় গেণ্ডারিয়া থানায় মামলা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কাউকে আটক করা বা এ ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।
এর আগে গত ১৮ই ডিসেম্বর রাজধানীর দয়াগঞ্জ এলাকায় ছিনতাইয়ের সময় মায়ের কোল থেকে ছিটকে পড়ে শিশু আরাফাতের মৃত্যু হয়। বড় ছেলের চিকিৎসার জন্য ছোট সন্তান আরাফাতকে সঙ্গে ঢাকায় এসেছিলেন শাহ আলম গাজী ও আকলিমা দম্পতি। সেদিন ভোরে তারা সদরঘাটে নামেন। পরে শাহ আলম গাজী তার স্ত্রী আকলিমা ও দুই সন্তানসহ রিকশায় করে শনির আখড়ায় যাচ্ছিলেন। রিকশাটি দয়াগঞ্জ মোড় এলাকায় পৌঁছালে ছিনতাইকারীরা চলন্ত অবস্থায় আকলিমার কাছ থেকে ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। এ সময় তার কোলে থাকা শিশু আরাফাত নিচে পড়ে যায়। শিশু আরাফাতকে গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
গত ৮ই অক্টোবর আরেক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে টিকাটুলি এলাকায়। ওই দিন ভোরে বারিধারার একটি স্কুলের শিক্ষিকা সিফাত সাদিয়া ও তার ভাই একটি রিকশা করে যাচ্ছিলেন। পথে তারা ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। এ সময় খন্দকার আবু তালহা একটি ছিনতাইকারীকে ঝাপটে ধরেন। এ সময় পিছন থেকে দুই ছিনতাইকারী এসে তাকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়। তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হলে তার মৃত্যু হয়। ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের এ শিক্ষার্থী ক্লাসে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হয়ে ছিনতাইকারীদের হাতে লাশ হয়ে ফিরেন।
তার স্বামী মনিরুল ইসলাম মন্টু অন্য একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী। তারা গ্রিন রোডে ভাড়া বাসায় থাকতেন। চার সন্তানের জননী হেলেনার করুণ মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে স্বজনদের মাঝে। চোখের সামনে স্ত্রীর এমন করুণ মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না মনিরুল ইসলাম। নিহত ইব্রাহিম ব্যবসার কাজে খুলনা থেকে নারায়ণগঞ্জ গিয়েছিলেন। খুলনার শেখ পাড়ায় তার একটি নৌযান মেরামতের ওয়ার্কশপ রয়েছে।
এর আগে গত ১৮ই ডিসেম্বর রাজধানীর দয়াগঞ্জে ছিনতাইকারীদের টানে মায়ের কোল থেকে পড়ে সাত মাসের শিশু আরাফাতের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। ৮ই অক্টোবর টিকাটুলিতে ছিনতাইকারীদের কবল থেকে এক স্কুল শিক্ষিকাকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ দেন বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র খন্দকার আবু তালহা। এই দুই ঘটনার পর ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয় সারা দেশে। শিশু আরাফাতকে হত্যার ঘটনায় জড়িত ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করেছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। খন্দকার আবু তালহার খুনি ছিনতাইকারীদেরও ঘটনাস্থলের পাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজের সূত্র ধরে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গতকালের ঘটনার পর পুলিশ জানিয়েছে, আশপাশের এলাকার বাসাবাড়ির ভিডিও ফুটেজ দেখে ছিনতাইকারীদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে হেলেনার স্বামী মনিরুল ইসলাম বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্রের সর্বশেষ সংস্করণ ‘স্মার্টকার্ড’ আনতে কিছুদিন আগে আমরা বরিশালের গ্রামের বাড়ি যাই। সেখান থেকে গতকাল রাতে লঞ্চে করে সদরঘাট আসি। ভোর ৪টার দিকে আমরা সদরঘাটে পৌঁছাই। পরে একটু হেঁটে ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে থেকে গ্রিন রোডের বাসায় যাওয়ার জন্য গাবতলীগামী ৭ নম্বর বাসে উঠি। বাসটি ধানমন্ডি ৭ ও ৬ নম্বর সড়কের মাঝামাঝি এসে আমাদেরকে অনেকটা জোর করে নামিয়ে দেয়। তখন রাস্তাঘাট ফাঁকা ছিল। বাসার যাবার জন্য আমরা একটি রিকশা খুঁজছিলাম। তখন আমাদের বেশ পেছনে একটি সাদা রঙের কার দাঁড়ানো অবস্থায় দেখি। আমরা কিছু দূর যাবার পর ওই করলা ব্র্যান্ডের কারটি আমাদের পাশে এসে দাঁড়ায়। গাড়ির সামনে চালক ছাড়া আরো একজন লোক বসা ছিল। এছাড়া আর কেউ ছিল না। তখন ওই চালকই আমার স্ত্রী হেলেনার কাছে থাকা ভেনেটি ব্যাগে টান দেয়। তখন হেলেনা ব্যাগটি রক্ষায় জোর করে ধরে রেখেছিল। ছিনতাইকারীরা ব্যাগ ছাড়ছিল না। তারা ব্যাগটি নিয়ে নিতে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেয়। এতে হেলেনা পড়ে যান। ব্যাগসহ তার হাতটি তখনও গাড়ির কাচে আটকা। টেনে হিঁচড়ে বেশ কিছু দূর নেয়ার পর গাড়িটি মোড় নিতে চাইলে হেলেনার মাথা গাড়ির চাকার নিচে পড়ে যায়। এতে তার মাথা থেঁতলে যায়। স্ত্রীর মর্র্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনার বর্ণনা দিতে দিয়ে বার বার মূর্ছা যাচ্ছিলেন মনিরুল। তিনি বলেন, ‘ঘটনাস্থলেই ও শেষ হয়ে যায়। আমার চোখের সামনে ওকে ওরা একেবারে পিষে মেরে ফেলে’। মনিরুল বলেন, পরে আমি হেলেনার নিথর দেহ গ্রিন লাইফ হাসপাতালে নিয়ে আসি। সেখান থেকে পুলিশ এসে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে লাশ নিয়ে যায়। গতকাল ময়নাতদন্ত শেষে বরিশালের উদ্দেশে স্ত্রীর লাশ নিয়ে রওনা দেন মনিরুল।
তিনি জানান, হেলেনার আয়েই পরিবারের পুরো খরচ চলতো। তাদের তিন ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়েও গ্রিন লাইফ হাসপাতালে চাকরি করেন। তিন ছেলেকে পড়াশোনা করাতেই আমরা ঢাকায় কষ্ট করছিলাম। হেলেনা চলে যাওয়ায় আমি একা হয়ে গেলাম। স্ত্রী হেলেনার হত্যাকারী ছিনতাইকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন তিনি। এদিকে ঘটনাস্থল রাজধানীর ধানমন্ডির আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালের বিপরীতে ধানমন্ডির সাত নম্বর সড়কে গেলে ঘটনার কোনো প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যায়নি। পুলিশ জানিয়েছে গতকাল পর্যন্ত তারাও কোনো প্রত্যক্ষদর্শী পায়নি। ভোরবেলা হওয়ায় ওই এলাকার সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। তবে পাশের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সিসি ক্যামেরা সচল ছিল। পুলিশ গতকাল ওই প্রতিষ্ঠানের ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করেছে। এদিকে মরদেহের ময়নাতদন্ত করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সোহেল মাহমুদ মানবজিমনকে বলেন, গাড়ির চাকা মাথা ও মুখমণ্ডলের উপর দিয়ে চলে যাওয়াতে তার মুখমণ্ডল থেঁতলে যায়। মুখ ও মাথার সমস্ত হাড় ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। ধানমন্ডি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুল লতিফ মানবজমিনকে বলেন, ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে নারী নিহত হওয়ার ঘটনায় কাউকে আটক ও শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হচ্ছে। গতকাল থাকায় টেকনিশিয়ান না পাওয়াতে একটু দেরি হচ্ছে। তবে রাতেই ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করা হবে।
প্রাণ নিয়ে হাসপাতাল পর্যন্ত যেতে পেরেছিলেন ইব্রাহিম: রাজধানীর সায়েদাবাদ এলাকায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে রক্তাক্ত হন ব্যবসায়ী মো. ইব্রাহিম। তিনি খুলনার সোনাডাঙ্গা উপজেলার শেখপাড়ার মৃত বজলুর রহমানের ছেলে। ব্যবসার কাজে মঙ্গলবার খুলনা থেকে ঢাকায় আসেন। বৃহস্পতিবার রাতে নারায়ণগঞ্জ থেকে সায়েদাবাদ পৌঁছে কোথাও যাওয়ার সময় রাত সাড়ে তিনটার দিকে তিনি ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। এ সময় ছিনতাইকারীরা তার শরীরে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে। তার কাছে থাকা জিনিসপত্র নেয়ার জন্য টানাটানি শুরু হয়। একপর্যায়ে ছিনতাইকারীরা তাকে ছুরিকাঘাত করে। ছুরিকাঘাতে রক্তাক্ত অবস্থায় ইব্রাহিম নিজেকে রক্ষা করতে দৌড়াতে থাকেন। দৌড়ে তিনি সালাহউদ্দিন হাসপাতালে পৌঁছান। সেখানকার জরুরি বিভাগে তার কিছু চিকিৎসা দিয়ে ঢাকা মেডিকেলে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। সঙ্গে কেউ না থাকায় এবং যানবাহন না পাওয়ায় তিনি অনেক সময় ওই হাসপাতালেই অপেক্ষা করছিলেন। পরে পুলিশের টহল দল এসে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় থাকার পর তার মৃত্যু হয়।
ইব্রাহিমের দুলাভাই আবদুল হক মানবজমিনকে বলেন, জাহাজের ওয়ার্কশপের কাজেই ইব্রাহিম ঢাকায় আসেন। মঙ্গলবার রাতে ঢাকায় এসে একটি আবাসিক হোটেলে থেকে বুধবার ব্যবসায়িক কাজ কর্ম সেরেছেন। কিন্তু মঙ্গলবার কোনো কাজে হয়তো তিনি নারায়ণগঞ্জ গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফিরতে গভীর রাত হয়ে যায়। রাতে গাড়ি থেকে সায়েদাবাদ এলাকায় নেমে কোথাও যাচ্ছিলেন। ঠিক তখনই তাকে কয়েকজন ছিনতাইকারী আক্রমণ করে। তার কাছে জিনিসপত্র নেয়ার জন্য টানাটানি শুরু হয়। একপর্যায়ে ছিনতাইকারীরা তাকে ছুরিকাঘাত করে। পর পর তাকে সাতটি ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। ফলে সে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। কিন্তু মনোবল না হারিয়ে ইব্রাহিম একাই পার্শ্ববর্তী সালাউদ্দিন হাসপাতালে গিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা নেয়। অবস্থার বেগতিক দেখে হাসপাতাল থেকেই তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। কিন্তু তখন কোনো সিএনজি বা গাড়ি হাসপাতালে যেতে রাজি হয়নি। পরে খবর পেয়ে ওই হাসপাতালে এসে টহল পুলিশ তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে কিছুক্ষন চিকিৎসা নেয়ার পর সে মারা যায়। তার কাছে থাকা মোবাইল থেকে আমাদের নম্বর নিয়ে ফোন করে পুলিশ। তারপর এসে আমরা ঘটনার বিস্তারিত জানতে পারি। নিহত ইব্রাহিমের আত্মীয় মো. বাদল মানবজমিনকে বলেন, বাস থেকে সায়েদাবাদ নেমে রেল লাইনের পাশের গলি দিয়ে তিনি হাঁটছিলেন। এ সময় তিনি ছিনতাকারীর কবলে পড়েন। পরে তারা ছুরিকাঘাত করলে তিনি দৌড়ে গিয়ে সালাউদ্দিন হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। পরে সেখান থেকে আবার ঢামেকে নিলে খবর পেয়ে আমরা সেখানে পৌঁছাই। কিন্তু আমরা যাওয়ার পর পরই তিনি মারা যান। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপ-কমিশনার ফরিদ উদ্দিন আহমদ মানবজমিনকে বলেন, এ ঘটনায় গেণ্ডারিয়া থানায় মামলা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কাউকে আটক করা বা এ ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।
এর আগে গত ১৮ই ডিসেম্বর রাজধানীর দয়াগঞ্জ এলাকায় ছিনতাইয়ের সময় মায়ের কোল থেকে ছিটকে পড়ে শিশু আরাফাতের মৃত্যু হয়। বড় ছেলের চিকিৎসার জন্য ছোট সন্তান আরাফাতকে সঙ্গে ঢাকায় এসেছিলেন শাহ আলম গাজী ও আকলিমা দম্পতি। সেদিন ভোরে তারা সদরঘাটে নামেন। পরে শাহ আলম গাজী তার স্ত্রী আকলিমা ও দুই সন্তানসহ রিকশায় করে শনির আখড়ায় যাচ্ছিলেন। রিকশাটি দয়াগঞ্জ মোড় এলাকায় পৌঁছালে ছিনতাইকারীরা চলন্ত অবস্থায় আকলিমার কাছ থেকে ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। এ সময় তার কোলে থাকা শিশু আরাফাত নিচে পড়ে যায়। শিশু আরাফাতকে গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
গত ৮ই অক্টোবর আরেক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে টিকাটুলি এলাকায়। ওই দিন ভোরে বারিধারার একটি স্কুলের শিক্ষিকা সিফাত সাদিয়া ও তার ভাই একটি রিকশা করে যাচ্ছিলেন। পথে তারা ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। এ সময় খন্দকার আবু তালহা একটি ছিনতাইকারীকে ঝাপটে ধরেন। এ সময় পিছন থেকে দুই ছিনতাইকারী এসে তাকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়। তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হলে তার মৃত্যু হয়। ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের এ শিক্ষার্থী ক্লাসে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হয়ে ছিনতাইকারীদের হাতে লাশ হয়ে ফিরেন।
No comments