প্রশ্নপত্র ফাঁস : টক অব দি কান্ট্রি by ড. গাজী মো: আহসানুল কবীর
এই
মুহূর্তে ‘টক অব দি কান্ট্রি’ হলো পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস। বিগত সারাটি
বছর যেন এ ভূত আমাদের তাড়া করে বেড়িয়েছে। বস্তুত গত কয়েক বছর ধরেই এ দেশে
প্রশ্নপত্র ফাঁসের এক ধরনের মহোৎসব চলছে। এসএসসি এবং এইচএসসির মতো পাবলিক
পরীক্ষা থেকে শুরু করে প্রাথমিক সমাপনী ও জেএসসি পরীক্ষা, স্কুল-কলেজের
বার্ষিক ও টার্মিনাল পরীক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা, পাবলিক
সার্ভিস কমিশনসহ বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষা এবং শেষ পর্যন্ত, স্থানীয় বিদ্যালয়ে
প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়ে গেছে। অর্থাৎ
এমন কোনো পরীক্ষা নেই, যার প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে না। ছোটবেলায় শুনতাম
কলেরা-বসন্তের মহামারী ছড়িয়েছে, পশু-পাখির বা ফসলের ক্ষেতে মড়ক লেগেছে।
আর
এখন দেখছি- প্রশ্নপত্র ফাঁসের অদ্ভুত এক মড়ক শুরু হয়েছে, মহামারী লেগেছে।
চলছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে। পাগলা ঘোড়ার লাগামের নিয়ন্ত্রণ কারো হাতে নেই। এ
যেন হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো আমাদের মোহাবিষ্ট করে নিয়ে চলেছে আত্মাহুতির
ক্ষেত্র, মহাসমুদ্রের ঠিকানায়। প্রথম যখন প্রশ্নপত্র ফাঁসের নানা অভিযোগ
গণমাধ্যমে প্রকাশিত হতো, তখন কর্তৃপক্ষ খুব উচ্চকণ্ঠে দৃঢ়ভাবে এ অভিযোগ
অস্বীকার করতেন। বরং কর্তৃপক্ষকে ‘হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য একটি মহল এসব
ভুয়া অভিযোগ তুলছে বলেও পাল্টা অভিযোগ করা হতো। তবে সুনির্দিষ্ট তথ্য
প্রমাণ দিয়ে তুলে ধরা হলে আস্তে আস্তে কর্তৃপক্ষের সুর নরম হতে থাকে। বলতে
থাকেন, এরকম প্রশ্ন ফাঁস আগে থেকেই হয়ে আসছে। তবে টেকনোলজির উন্নতির কারণে
এখন প্রচারণা ব্যাপক হচ্ছে, আর অতীতে জানাজানি কম হতো।’ আসলে কি তাই? মনে
হয় না। আমরা যারা দীর্ঘ শিক্ষা জীবন-কর্মজীবন শেষ করে জীবনসায়াহ্নে
পৌঁছেছি, তাদের অভিজ্ঞতা তা বলে না। বিচ্ছিন্ন দু-একটি ঘটনা কখনো ঘটতে
পারে, তাও নগণ্য পরিসরে, খুবই তাৎপর্যহীনভাবে। যেমন- আমার আজও মনে পড়ে,
১৯৫৭ সালে প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস থ্রিতে পড়ি। বার্ষিক পরীক্ষা চলছে।
স্কুলে এসে দেখি জটলা, ‘আজ পরীক্ষা হবে না।’ কী ব্যাপার? আমাদের সঙ্গেই
ক্লাস থ্রিতে পড়ত এক আদুভাই। চার-পাঁচ বছর ধরে একই ক্লাসে আছে, পাশ করতে
পারে না। সে নাকি আগের রাতে হেড স্যারের রুমের তালা ভেঙে আলমারি থেকে
প্রশ্ন চুরি করেছে। ধরাও পড়েছে। তার মাথা কামিয়ে গোবর মেখে সারা স্কুল
ঘোরাচ্ছে। রাস্তায় চলাচল করা লোকজনও বেশ জমে গেছে। প্রশ্ন ফাঁসের শাস্তি।
এর জন্য আইন ছিল ? না, ছিল নাতো।
হাতেনাতেই যদি অপরাধী ধরা যায় তবে
ব্যবস্থা নিতে অসুবিধা কোথায়? এখন প্রশ্ন ফাঁসের এত অভিযোগ! অভিযোগের চাপে
রীতিমতো শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। অভিযোগের প্রতিযোগিতায় সবার সঙ্গে ইদানীং যোগ
দিয়েছেন স্বয়ং কর্তৃপক্ষও। তাও ভালো। প্রথমে যেখানে স্বীকারই করতেন না, সে
ক্ষেত্রে এখন স্বীকার করছেন যে, বড় বড় পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র আসলেই
ফাঁস হচ্ছে এবং তা হচ্ছে বেশ আগেভাগেই। তবে অবাক ব্যাপার হলো, সবার সঙ্গে
কর্তৃপক্ষ প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ তো করছেনই; তার চেয়ে বিস্ময়কর হলো- মাঝে
মাঝে নিজেদের অসহায়ত্বও প্রকাশ করছেন। সবাই প্রতিকারের জন্য কর্তৃপক্ষের
কাছে অভিযোগ করতে পারেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কার কাছে অভিযোগ করবেন? আর
অসহায়ইবা হবেন কেন? কারণ, কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা আছে, দাপট আছে, ব্যবস্থা
নেয়ার অধিকার ও উপকরণ, সবই আছে। সুতরাং কর্তৃপক্ষ সাথে সাথেই ব্যবস্থা নিতে
পারেন। দাপটকে পাশে রেখে, অসহায়ত্ব প্রকাশ কি ভনিতা? নাকি প্রশ্নপত্র
ফাঁসকারী দুর্বৃত্ত চক্র সত্যিই কর্তৃপক্ষের চেয়ে অনেক বেশি প্রতাপশালী,
ক্ষমতাধর? এসব প্রশ্ন সবার মনেই দানা বাঁধছে। অভিযোগ-অসহা য়ত্বের তো কোনো
যুক্তি নেই। কর্তৃপক্ষের হাতে মেকানিজম আছে। সুতরাং এত বছর ধরে প্রশ্নপত্র
ফাঁস হলেও কি দুর্বৃত্ত চিহ্নিত করা গেল না আজ পর্যন্ত? সুনির্দিষ্টভাবে
দুর্বৃত্ত চিহ্নিত করতে পারলেই ব্যবস্থা গ্রহণ। এর জন্য আইনের ধারা বা
শাস্তির ব্যবস্থা আটকাবে কেন ? শুধু আইনের দোহাই দেয়া হয়। শাস্তি দেয়ার
জন্য উপযুক্ত আইনের যদি অভাব থাকে তবে তা করতে এত দেরিই বা হবে কেন? জাতীয়
এমন সঙ্কটে এসব আইন তো খুব জরুরি ভিত্তিতেই করা উচিত।আমাদের আসল সমস্যা
অন্যত্র। আমরা সুনির্দিষ্টভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ক্ষেত্র এবং ফাঁসকারীই
চিহ্নিত করতে পারছি না। আইন প্রয়োগ করতে হলে, বিচারের আওতায় কাউকে আনতে হলে
অপরাধীকে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করতে হবে। সবাই যেমন বলছেন, তেমনি
কর্তৃপক্ষও বলছেন প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে শিক্ষকরা জড়িত। কারণ হিসেবে
যুক্তিসঙ্গতভাবেই বলা হচ্ছে, পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন প্রণেতা, মডারেটর,
প্রশ্ন মুদ্রণের সঙ্গে জড়িত বোর্ডের কর্তাব্যক্তি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের
পরীক্ষা পরিচালনা কমিটির সদস্য, পরীক্ষা হলের ইনভিজিলেটর- সবাই শিক্ষক।
অবশ্য এ ছাড়াও অভিযোগ উঠছে প্রশ্নপত্র সংরক্ষণ বা স্থানান্তরের সাথে জড়িত
কিছু প্রশাসনিক ব্যক্তির বিরুদ্ধেও। তবে এর চেয়ে গুরুতর অভিযোগ উঠছে
স্থানীয় স্কুল-কলেজের অত্যন্ত গুরুত্বহীন সাময়িক পরীক্ষার এমনকি প্রথম ও
দ্বিতীয় শ্রেণীর প্রশ্ন ফাঁস হওয়া নিয়ে। আর এসব অভিযোগ উঠছে সেসব শিক্ষকের
বিরুদ্ধে যারা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ান। কোথায়
নেমে গেছে মূল্যবোধ! এতসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের মনে প্রশ্ন
জাগছে- প্রশ্নপত্র ফাঁসের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের কি কোনো কার্যকর উদ্যোগ
আছে? কারণ, দেখা যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ
বেশ কিছু ক্ষেত্রে কোনো কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যম তাদের গোয়েন্দা টিমের
তৎপরতায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সহায়তা
নিয়ে বেশ কিছু দুর্বৃত্তকে তথ্যপ্রমাণসহ হাতেনাতে ধরে ফেলেছে। এমনকি ছোট্ট
কক্ষে ছাপাখানা স্থাপনের মতো দুঃসাহসী ঘটনাও ততোধিক দুঃসাহসী সাংবাদিকরা
উদঘাটন করেছেন। এটি যেভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে, অন্য ক্ষেত্রে তা
হয়নি।
যেমন প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে শিক্ষকদের জড়িত থাকার অভিযোগ বিভিন্ন মহল
থেকে করা হলেও সুনির্দিষ্টভাবে কোনো শিক্ষককে চিহ্নিত করা হয়েছে, এমন কোনো
খবর দেখলাম না। গোষ্ঠী হিসেবে শিক্ষকদের অভিযুক্ত করায় শিক্ষক সমাজ বেশ
লজ্জায় পড়ছেন। ভালো ও সৎ শিক্ষকেরা অপমান বোধ করছেন। জানি না, ভুলবশত কোনো
সুনির্দিষ্ট নজির মিস করেছি কি না। যদি নির্দিষ্ট করে কোনো শিক্ষকের নাম
আসত তবে তিনি তো আর শিক্ষক হিসেবে মোটেও বিবেচনায় আসবেন না। তার বিচার
যথানিয়মে অভিযুক্ত অপরাধী হিসেবেই হওয়া উচিত। একজন শিক্ষক যদি সত্যিই এ
ধরনের জঘন্য অপরাধের সাথে জড়িত থাকেন, সে ক্ষেত্রে বিচারের বিবেচনার পরিধি
আরো বিস্তৃত হওয়া বাঞ্ছনীয়। কারণ তার ক্ষেত্রে এটি শুধুই সামাজিক অপরাধই
নয়, নৈতিক স্খলনের চরম উদাহরণও। অভিযুক্ত হলে তার পক্ষে জীবনের অবশিষ্ট সময়
আর শিক্ষকতা পেশায় কাজ করা নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। কারণ তিনি এ কাজে নিয়োজিত
থাকার সব নৈতিক অধিকার হারিয়ে ফেলেছেন। স্বগোত্রীয় শিক্ষকের বিরুদ্ধে এমন
নৈতিকতাবর্জিত কাজে সংশ্লিষ্টতার গুরুতর অভিযোগ শুনে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে
যায়। শিক্ষকেরা প্রশ্ন প্রণয়ন, মডারেশন, পরীক্ষা পরিচালনা, হল পরিদর্শন
প্রভৃতি নানা কাজে জড়িত থাকতেই পারেন। ভাবতেও তো পারি না, এমন বড়
দায়িত্বশীল কাজে সংশ্লিষ্ট কোনো শিক্ষক ন্যায়নীতি থেকে সামান্যতম বিচ্যুত
হতে পারেন। ৪৫ বছরের শিক্ষকতা জীবনে তো আমরা এসব কাজই করেছি, বলতে গেলে
পুরো জীবনই। কিন্তু কই, আমাদের সময় তো কোথাও কখনো প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা
শুনিনি! প্রশ্ন প্রণয়ন, মডারেশন বা পরীক্ষাসংক্রান্ত অন্যান্য গোপনীয় কাজই
শুধু নয়, সারাজীবন আমাদের কলেজকেন্দ্রগুলোতে নানা ধরনের পরীক্ষা পরিচালনা
করেছি এবং দেখেছি, কী নিখুঁত স্বচ্ছতা ও দায়িত্ববোধের সাথে এ কাজগুলো হতো।
দায়িত্বে সামান্যতম বিচ্যুতির প্রশ্নও উঠত না। প্রশ্ন ফাঁস? সে তো কল্পনারও
অতীত। আজ হয়তো সেই নৈতিকতার দিক তত শানিত নয়। এ কারণেই শাস্তির জন্য আইন
খুঁজতে হচ্ছে। একদিন আইনও হবে, ব্যবস্থাও হবে। ততদিনে হয়তো নৈতিক স্খলনের
ব্যাপক সংক্রমণ ঘটবে। সব সময় সর্বত্রই চুরি হয়ে থাকে। এত থানা পুলিশ, এত
ধরপাকড়, আইন-আদালত, জেল ও শাস্তি হচ্ছে। কিন্তু চুরি কি কখনো বন্ধ হয়েছে?
হয়নি। কারণ ঘরে মূল্যবান দ্রব্য থাকলে তার লোভে ফাঁকফোকর খুঁজে চোর তো
ঢুকবেই। চুরি করে সটকে পড়বে সে। সারাক্ষণ তো প্রতিটি ঘরের দোরগোড়ায় পুলিশ
দাঁড় করিয়ে রাখা সম্ভব নয়। তাই চুরি বন্ধের সর্বোৎকৃষ্ট পন্থাই হবে চোরকে এ
কাজে প্রাকৃতিকভাবে নিরুৎসাহিত করা, নিবৃত্ত করা। অর্থাৎ ঘরে মূল্যবান
জিনিস রাখব না। চোরকে চুরির সুযোগই দেবো না। আপনি বলবেন, এটি কেমন কথা?
চোরের ভয়ে জিনিস ব্যবহার করব না? হ্যাঁ, প্রয়োজন হলে কখনো কখনো এটাই করতে
হয়। আসলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রশ্ন ফাঁসের দানবটি যেভাবে ঢুকে পড়েছে,
তার ‘উপাদেয় খাদ্য’ বন্ধ করে দেয়া ছাড়া উপায় নেই।
বলছিলাম, আমাদের
শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে। এটি এখন হয়ে পড়েছে সম্পূর্ণরূপে পরীক্ষানির্ভর।
মনে হয়, যেন শিক্ষাজীবনে পরীক্ষা ছাড়া আর কিছুই নেই। ‘জ্ঞানার্জন’ মানেই
পরীক্ষা। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এখন শিক্ষার্থী বা জ্ঞানার্থী নেই। আছে
শুধুই পরীক্ষার্থী। শিক্ষাজীবন শুরু করবে, তাও ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে। যার
হাতেখড়ি হবে ভর্তির পর সে কাজটিও শুরু করতে হবে শিক্ষা দিয়ে নয়, পরীক্ষা
দিয়েই। আর ভর্তির পর শুরু হয়ে যায় প্রতি ক্লাসে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়
সাময়িক পরীক্ষা, ক্লাস টেস্ট, স্পট টেস্ট, কুইজ পরীক্ষা। প্রতিটি ক্লাস
পরীক্ষাময়। ছিল ১০ বছর পর এসএসসি পরীক্ষা, এর দু’বছর পর এইচএসসি পরীক্ষা।
তাতে কর্তৃপক্ষের তৃপ্তি হয়নি। নতুন করে কিশোর বয়সেই চাপিয়ে দেয়া হলো
প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা এবং তারপর অষ্টম শ্রেণীতে জেএসসি। এর মধ্যে আবার
স্কুল পরিবর্তনে কোথাও প্রথম শ্রেণী, কোথাও তৃতীয় শ্রেণী, কোথাও পঞ্চম,
কোথাও ষষ্ঠ বা অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি পরীক্ষা। আর এসএসসি পাসের পর কলেজে এবং
এইচএসসি পাসের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য জমকালো ভর্তিযুদ্ধ তো আছেই।
এত পরীক্ষার চাপে আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রীতিমতো হাঁফিয়ে তুলেছি, ক্লান্ত
পরিশ্রান্ত করে তুলেছি ভবিষ্যৎ দায়িত্ব নেয়ার কাজটি ওরা শুরু করার আগেই।
আসলে পরীক্ষার নামে আমরা যা করছি তা হলো, কে কতটুকু তথ্য মুখস্থ করতে পারল
তা দেখা। শিক্ষার উদ্দেশ্য কিন্তু তা নয়। এর উদ্দেশ্য হলো সৃজনশীলতার বিকাশ
ঘটানো, একজন পরিপূর্ণ মানুষ (total man) তৈরি করা। এটি করতে হলে
জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি ব্যক্তিগত আচার-আচরণ, নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধ, মনন ও
মানবীয় সব বৈশিষ্ট্যসমৃদ্ধ হতে হয়। এসব বৈশিষ্ট্য কিছু প্রক্রিয়াগত
পদ্ধতিতে অর্জিত হয়।
সেটি হয় শিক্ষক, পরিবার ও সমাজের সাহচর্যে। একজন
শিক্ষার্থীর এসব বৈশিষ্ট্য কতটুকু অর্জিত হলো তা বোঝার জন্য পরীক্ষাই
একমাত্র এবং জরুরি পন্থা নয়। এ জন্য বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত পন্থা হলো
শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন অর্থাৎ assessment যাকে পদ্ধতিগত ভাষায় বিভিন্ন দেশে
বিদ্যালয় ভিত্তিক মূল্যায়ন (School Based Assessment, SBA) অথবা
শ্রেণীভিত্তিক মূল্যায়ন (Class Based Assessment, CBA) বলা হয়ে থাকে।
পরীক্ষা হলো এ মূল্যায়ন পদ্ধতির একটি মাত্র টুল (tool)। যেসব শিক্ষকের
সাহচর্যে শিক্ষার্থীরা জ্ঞানার্জনের জন্য সারাটি দিন বিদ্যালয়ে কাটায় তাদের
প্রতিটি ক্ষণে, প্রতিটি কাজ-আচরণ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে মূল্যায়ন করবেন
১০-১৫ জন শিক্ষক। এভাবে সারাটি বছরের সব শিক্ষকের মূল্যায়নের গড়ই হলো SBA
বা CBA। এর সঙ্গে যোগ হয় বছরান্তের একটি লিখিত পরীক্ষার প্রাপ্তি। আমাদের
দেশে শিক্ষার্থীর মূল্যায়নের সবটুকু শুধু পরীক্ষার মাধ্যমেই করা হয়ে থাকে।
এর ফলাফলের ওপরই নির্ভর করে একজন শিক্ষার্থীর career, সারাটি জীবন। তাই এ
জন্য যত cock-fight। তাতে যত মূল্যই দিতে হোক আর যত রকমের অনৈতিক পন্থাই
অনুসরণ করতে হোক না কেন, এতে কারো কোনো আপত্তি থাকে না। এ জন্যই সন্তানের
ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে অভিভাবকেরাও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। কেমন বেপরোয়া? ফাঁস
হওয়া প্রশ্ন যে পরীক্ষার আগেই হাতে পেয়েছে, আজকাল এ কথা বেশ হাসিমুখেই
শিক্ষার্থী বা তার অভিভাবক স্বীকার করছেন। এতটুকু লজ্জা শরম ও অনুশোচনা
নেই। আরো সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার হলো, প্রশ্ন ফাঁসের খবর পেয়েই শিক্ষার্থী মাকে
বলে, মা প্রশ্ন এনে দাও। অথবা সন্তান বলার আগেই করিৎকর্মা অভিভাবকেরা
প্রশ্নটি এনে শিক্ষার্থীর হাতে তুলে দিচ্ছেন। কোথায় গিয়ে ঠেকেছে
নীতি-নৈতিকতা? এ সন্তানকে কি আর জীবনে কখনো মূল্যবোধের কথা বলার মতো নৈতিক
অধিকার বাবা-মায়ের থাকে? এই যেখানে অবস্থা, সেখানে এ দুর্বলতার সুযোগই নেয়
দুর্বৃত্ত চক্র। এর সহজ পথ, প্রশ্ন ফাঁস করা। এ কাজের তো অনেক point আছে।
কোনো না কোনো point-এ কেউ না কেউ- শিক্ষক হোক বা অন্য কোনো সুযোগসন্ধানী
ব্যক্তিও হতে পারেন, তিনি চেইনে ঢুকে পড়েন এবং কাজটি সারিয়ে দেন চোরের
চুরির কায়দায়। উন্নত টেকনোলজির জমানায় এটি আরো সহজ হয়ে গেছে। কে কোথায়
কিভাবে পাহারা দেবে এসব চুরি? তাও আবার আমাদের সেই বিশাল পাবলিক পরীক্ষা
এসএসসি বা এইচএসসি যেখানে ১৩-১৪ লাখ পরীক্ষার্থী একসঙ্গে পরীক্ষা দেয়। তাই
চুরি বন্ধ করার একটিই পথ থাকতে পারে। তা হলো, মূল্যায়ন পদ্ধতি পরিবর্তন
করা, প্রচলিত পরীক্ষার গুরুত্ব কমিয়ে দেয়া। শুধু চার দিকে সমালোচনার ঝড় না
তুলে এ কাজটি যেভাবে যত তাড়াতাড়ি করা যায়, জাতির জন্য বোধ হয় ততই মঙ্গল।
কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখবেন কি?
লেখক : প্রফেসর, রসায়ন ও সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড
লেখক : প্রফেসর, রসায়ন ও সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড
No comments