চাপের মুখে অর্থনীতি
আগাম
ও মৌসুমি বন্যা, ঘাটতি মেটাতে ৫৭ লাখ টন চাল আমদানি এবং প্রায় সাত লাখ
রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ- এ তিন কারণে চাপের মুখে রয়েছে দেশের অর্থনীতি। গত ছয়
মাসে ঘটেছে এসব ঘটনা। এতে চলতি বছর অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে সরকারি
ব্যয়। আর এ ব্যয়ের হিসাবকে আসন্ন সংশোধিত বাজেটে সমন্বয় করতে সংশ্লিষ্ট
মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে বলেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে পরিস্থিতি সামাল দিতে
ইতিমধ্যে কোনো কোনো মন্ত্রণালয়কে দেয়া হয়েছে বেশকিছু জরুরি বরাদ্দ। সরকারি ও
বেসরকারি সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, আগাম ও মৌসুমি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত
হয়েছে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার বোরো। সেই সঙ্গে প্রত্যাশিত ২ হাজার
৭০০ কোটি টাকার আমন উৎপাদন করা সম্ভব হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে উৎপাদন ঘাটতি
মেটাতে গত ছয় মাসে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি করা হয়েছে ৫ হাজার ১১৮
কোটি টাকার চাল। অন্যদিকে বন্যার পানিতে নষ্ট হয়েছে ২ হাজার ১০০ কোটি টাকার
অবকাঠামো। এদিকে রোহিঙ্গা পুনর্বাসনে ২ হাজার ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ের
পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার।
এর মধ্যে নোয়াখালীর ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের
পুনর্বাসনের জন্য ২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এ
প্রকল্পের অর্থ চলতি বাজেট থেকেই ছাড় হচ্ছে। এ ছাড়া কক্সবাজারে রোহিঙ্গা
ক্যাম্প নির্মাণ, স্যানিটেশন ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন খাতে ইতিমধ্যে ব্যয় হয়েছে
৩০ কোটি টাকা। এ খাতে আরও ১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে স্থানীয় সরকার
মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে এ পর্যন্ত প্রায় ৭৪১ কোটি টাকা মূল্যের বনের কাঠ পুড়ে
নষ্ট করেছে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা। সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতির ওপর সৃষ্টি
হয়েছে বড় ধরনের চাপ। ভারপ্রাপ্ত অর্থ সচিব মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী
যুগান্তরকে বলেন, বন্যায় বেশকিছু মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ বরাদ্দ চেয়ে আবেদন
করেছে। ইতিমধ্যে অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দও দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট
মন্ত্রণালয়গুলোকে বাজেটের বরাদ্দ থেকে ব্যয় করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এগুলো
পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে সমন্বয় করা হবে। রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে তিনি
বলেন, এ খাতে এখন পর্যন্ত অস্বাভাবিক ব্যয় হয়নি। তবে দীর্ঘ মেয়াদের
প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়লে বড় ধরনের ব্যয়ের পরিকল্পনা করতে হবে। এ ব্যাপারে
প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যে অনেক পদক্ষেপ নিয়েছেন। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর ব্যয় নিয়ে একটি
হিসাব তৈরি করেছেন। সেখানে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ফেরত
পাঠাতে কমপক্ষে ৭ থেকে ১২ বছর সময় লাগবে। এতে সর্বনিন্ম ৩৬ হাজার থেকে
সর্বোচ্চ ৮৫ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যয় হবে। তবে ব্যয় কমবেশি নির্ভর
করবে পাঠানোর প্রক্রিয়ার ওপর। এই ব্যয়ভার দাতা সংস্থা বহন না করলে ভবিষ্যতে
সরকারের ওপরেই বর্তাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে সিপিডি। সংশ্লিষ্ট
সূত্রগুলো জানায়, বন্যায় ক্ষতি এবং মোকাবেলায় চাল আমদানিতে সরকারের বেশি
ব্যয় হচ্ছে। চাল আমদানি ব্যয় প্রসঙ্গে সিপিডির গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান
বলেন, সরকারের মজুদ পরিস্থিতি সন্তোষজনক নয়। ফলে সার্বিকভাবে সরকার আমদানি
নির্ভরতা হয়ে উঠেছে।
খাদ্য আমদানির জন্য চলতি বাজেটে নির্ধারিত বরাদ্দের
চেয়ে বেশি ব্যয় হচ্ছে। এই অতিরিক্ত ব্যয়ের পরিমাণ ৭০০ থেকে ১১০০ কোটি টাকা
হতে পারে। আরও জানা গেছে, আগাম ও মৌসুমি বন্যার কারণে ধানের ব্যাপক ক্ষতি
হয়। সব মিলিয়ে প্রায় ১৫ লাখ টন বোরো ক্ষতি হয়। সিপিডির গবেষণায় এর আর্থিক
মূল্য ৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। মৌসুমি বন্যার কারণে আমনের ক্ষতি হয় প্রায় ২
হাজার ৭০০ কোটি টাকার। এতে খাদ্য ঘাটতির সৃষ্টি হয়। তা মোকাবেলায় চলতি
অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৫৭ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানি
করা হয়। খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিট সূত্রমতে, সরকারিভাবে খাদ্য
আমদানি হয় প্রায় ৮ লাখ টন। যার প্রায় ৫ লাখ টন চাল এবং পৌনে তিন লাখ টন গম।
এ ছাড়া বেসরকারি খাতে ৪৯ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে চালের
পরিমাণ সাড়ে ১৭ লাখ টন এবং গম ৩২ লাখ টন। এই চাল আমদানি করতে গত ছয় মাসে ৫
হাজার ১১৮ কোটি টাকা এলসি খাতে ব্যয় হয়েছে। যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল
৫৬ কোটি টাকা। এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ধানের
ক্ষতি ছাড়াও বন্যায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, উত্তরাঞ্চল
ও পশ্চিমাঞ্চলসহ অন্যান্য অঞ্চলে ৫৭ লাখের বেশি মানুষসহ রাস্তাঘাট,
বেড়িবাঁধ, ব্রিজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যার আর্থিক মূল্য ২ হাজার ১০০ কোটি টাকার
বেশি। ক্ষতিগ্রস্ত অবকাঠামো মেরামত ও নির্মাণের জন্য এই টাকা অর্থ
মন্ত্রণালয়ের কাছে চাওয়া হয়েছে। এই আর্থিক ক্ষতি প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে আরও
বলা হয়, ৮৬৯টি স্থানে প্রায় ৭৯৩ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে
নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের পরিমাণ ৪৮৭ কিলোমিটার ও নদীর পাড়ের পরিমাণ ৩০৫
কিলোমিটার। যার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে ১২০৫ কোটি টাকা। বন্যায় গৃহহীন হয়েছে
১৮ হাজার ৭৫৩ পরিবার।
এদের পুনর্বাসন ব্যয় ধরা হয়েছে ১৯৮ কোটি টাকা।
বন্যাকালীন এসব স্থানে দ্রুত এবং জরুরি সংস্কার ও মেরামতের জন্য ব্যয়ের
হিসাব করা হয় ১৭৩ কোটি টাকা। সেচ, হাওর ও অন্যান্য প্রকল্পের আওতায়
পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনা করতে ব্যয় ধরা হয় ১৪৩ কোটি টাকা। এ ছাড়া
ক্যারিডওভার কাজের চাহিদা খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮৪ কোটি টাকা। যদিও একই কাজ
বাবদ গত জুন পর্যন্ত সম্পাদিত কাজের বিপরীতে বকেয়া আছে ২০২ কোটি টাকা। এ
ছাড়া অর্থনীতির ওপর অপ্রত্যাশিত চাপ সৃষ্টি করেছে রোহিঙ্গা সংকট। গত ২৫
আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত ৬ লাখ ৭২ হাজার ৯৫০ জন রোহিঙ্গা দেশে প্রবেশ করেছে।
অপ্রত্যাশিতভাবে রোহিঙ্গা প্রবেশ করার কারণে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশের
ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়েছে। বন বিভাগের হিসাবে প্রতিদিন ৮শ’ টন কাঠ
জ্বালানো হচ্ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয়। রান্নাবান্নার কাজে জ্বালানি হিসেবে
এগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত ৪শ’ কোটি টাকার বনের কাঠ পোড়ানো হয়েছে
উল্লেখ করে বন বিভাগের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এ পর্যন্ত ৪ হাজার ১৪০ একর
বনভূমি নষ্ট হয়েছে। তবে বেসরকারি সংস্থা সিপিডির গবেষণায় বলা হয়েছে এ
পর্যন্ত ৭৪১ কোটি টাকার বনের কাঠ পোড়ানো হয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি
সংস্থার (এফএও) এক হিসাবে বলা হয়েছে, এভাবে কাঠ পোড়ানো অব্যাহত থাকলে এক
বছরে ৩ লাখ টন বনের কাঠ উজাড় হয়ে যাবে। এ ছাড়া রোহিঙ্গা সংকটে স্থানীয়ভাবে
(কক্সবাজার) শ্রম মজুরির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সেন্টার ফর পলিসি
ডায়ালগের (সিপিডি) এ সংক্রান্ত গবেষণায় দেখা গেছে, কক্সবাজারের কুতুপালং,
উখিয়াসহ স্থানীয় অঞ্চলে শ্রমজীবীদের দিনব্যাপী কাজের বিনিময়ে মজুরি ছিল
দৈনিক ৪০০-৫০০ টাকা। কিন্তু এ মুহূর্তে সেটি নেমে এসেছে ১৫০-২০০ টাকায়।
রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে মিয়ানমারের সঙ্গে একটি চুক্তি হয়েছে। রোহিঙ্গা
ফেরত নিয়ে সিপিডি একটি গবেষণা করেছে। সেখানে দেখানো হয়, চুক্তি অনুযায়ী
প্রতিদিন ৩০০ জন রোহিঙ্গা ফেরত দেয়া হলে এ কার্যক্রম শেষ হতে কমপক্ষে ৭ বছর
লাগবে। এতে ব্যয় হবে ৩৬ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। কিন্তু এই সাত বছরে রোহিঙ্গা
জনগোষ্ঠী বাড়বে এবং মূল্যস্ফীতি হবে। এতে আর্থিক ব্যয় আরও বাড়বে। জনসংখ্যা
ও মূল্যস্ফীতির হিসাব ধরে এ ব্যয় দাঁড়াবে ৪৮ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা। সিপিডির
গবেষণায় আরও বলা হয়, যদি দিনে ২০০ জন রোহিঙ্গা ফেরত পাঠানো হয়, সে
ক্ষেত্রে ব্যয় দাঁড়াবে ৮৫ হাজার ৭৩৯ কোটি টাকা এবং সময়ের প্রয়োজন হবে ১২
বছর। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী গত ২৩ নভেম্বর থেকে ২৩ জানুয়ারির মধ্যে
রোহিঙ্গা ফেরত পাঠানো শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু অদ্যাবধি শুরু হয়নি এ
কার্যক্রম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং বিআইডিএসের
সাবেক মহাপরিচালক এমকে মুজেরী যুগান্তরকে বলেন, বন্যায় দেশব্যাপী অবকাঠামো
ভালোই ক্ষতি হয়েছে। এর প্রভাব এখনও কাটেনি। কৃষি খাতে বিরূপ প্রভাব পড়েছে,
ফসলের বেশ ক্ষতি হয়েছে। বড় ক্ষতির কারণে চালের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে।
এত চাল আমদানির পরও এখনও মূল্য নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। অর্থনীতিতে কিছুটা
হলেও বিরূপ প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে সামষ্টিক অর্থনীতির অন্যান্য সূচকে এর
নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তিনি বলেন, আমদানি বেড়ে যাওয়ায় বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে
গেছে। এতে চলতি হিসাবের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে সামষ্টিক
অর্থনীতিতে আরও চাপ বাড়বে। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে নির্বাচন নিয়ে এক ধরনের
অনিশ্চয়তা। তিনি আরও বলেন, সাত লাখ রোহিঙ্গা অর্থনীতির ওপর একটি চাপ সৃষ্টি
করেছে। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা, সামাজিক ও পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। যে
সংখ্যক রোহিঙ্গা নেবে, কত বছরের শেষ হবে, তা বলা যাচ্ছে না। ফলে বন্যার
আঘাত, বিপুল পরিমাণ চাল আমদানি এবং রোহিঙ্গা সংকট- সবকিছুই অর্থনীতির সঙ্গে
সম্পৃক্ত। তাই এমন পরিস্থিতিতে আগামীতে অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ার
আশঙ্কা বেশি। এ ক্ষেত্রে সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে। পরিস্থিতি মোকাবেলায়
প্রস্তুতি নিতে হবে সরকারকে।
No comments