কমিউনিটি ক্লিনিকে মিলছে উচ্চ রক্তচাপের বিনামূল্যে ওষুধ উপজেলায় যেতে অনীহা by ফরিদ উদ্দিন আহমেদ

কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে বিনামূল্যে ডায়াবেটিসের ওষুধ পেয়ে ভীষণ খুশি ৪৫ বছর বয়সী চানমুন খাতুন। সাত বছর ধরে তিনি এই রোগে ভুগছেন। দেহে আছে উচ্চ রক্তচাপও। রাজশাহীর পবা উপজেলার হুজুরিপাড়া ইউনিয়নের তেঁতুলিয়া কমিউনিটি ক্লিনিকে সরজমিন কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, বাড়ির কাজ ফেলে ছয়-সাত কিলোমিটার দূরের হাসপাতালে (উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স) যাওয়া আমাদের জন্য একটু কঠিন। অনেক সময় ওষুধ শেষ হলেও হাসপাতালে যাওয়া হয় না। পরে অসুস্থ হয়ে পড়ি। কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে সরাসরি এই ওষুধ দেয়ার ব্যবস্থা করলে আমার জন্য ভালো হয়।

৩রা অক্টোবর সকালে পবা উপজেলার কুমড়াপুকুর কমিউনিটি ক্লিনিক ও হুজুরিপাড়া ইউনিয়নের তেঁতুলিয়া কমিউনিটি ক্লিনিকে অন্তত ২০ জন উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের চিকিৎসা নিতে এসেছেন। দুই ক্লিনিকেই ডায়াবেটিসের ওষুধ দেয়া হলেও এক সপ্তাহের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ দেয়ার কথা জানান সংশ্লিষ্টরা। সেন্টারে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ পৌঁছালেও উপজেলার ব্যবস্থাপত্র ছাড়া রোগীদের দিচ্ছে না ক্লিনিকগুলো।

দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে সরকারিভাবে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পায় সাধারণ মানুষ। এসব ক্লিনিকে বিভিন্ন রোগের মোট ২২ ধরনের ওষুধ বিনামূল্যে সরবরাহ করে সরকার। এর মধ্যে রয়েছে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ। কিন্তু ওষুধ পেতে হলে যেতে হয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখান থেকে লিখে দিলেই মেলে ওষুধ। এতেই চরম অনীহা মানুষের।
পবা উপজেলার নওহাটা ইউনিয়নের কুমড়া পুকুর কমিউনিটি ক্লিনিকে গিয়ে দেখা যায়, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে এসেছেন আরিফা বেগম। বয়স ৩৭ বছর। ১৬ বছর ধরে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস আক্রান্ত তিনি। প্রতি মাসে ওষুধের পেছনেই ব্যয় হতো ছয় হাজার টাকা। কৃষক পরিবারের স্বল্প আয়ে সে ব্যয় মেটানো কষ্টকর হয়ে উঠেছিল। তবে সরকারি উদ্যোগে অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে বিনামূল্যে ওষুধ ও পরামর্শের পর তার কষ্ট কিছুটা লাঘব হয়েছে। এজন্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যেতে হলেও তার খরচ কমেছে দুই-তৃতীয়াংশ। জুরিপাড়া কমিউনিটি ক্লিনিকের কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) মফিজুল ইসলাম বলেন, ক্লিনিকটিতে প্রতিদিন অন্তত ৩০-৪০ জন মানুষ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, কৈশোরকালীন সেবা, নবজাতক ও গর্ভবতী নারীরা সেবা নিতে আসেন। এর বাইরে অসংক্রামক রোগাক্রান্ত (উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস) মানুষ ওষুধ ও পরামর্শের জন্য আসেন। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে রোগীদের লিখে দিলে আমরা তাদের দেই। াজশাহী জেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও কমিউনিটি ক্লিনিকে সেবা নেয়া ৫৬ ভাগ রোগীর উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আর এটি সম্ভব হয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালিত অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি (এনসিডিসি) এবং ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের একটি যৌথ উদ্যোগের ফলে। প্রকল্পের অংশ হিসেবে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের শনাক্ত করে তাদের চিকিৎসার আওতায় এনে দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন দিতে সহায়তা করা হচ্ছে। বাংলাদেশেও উচ্চ রক্তচাপের রোগী বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে। ডব্লিউএইচওর ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্তদের ৩০-৭৯ বছর বয়সী ৫৫ শতাংশ মানুষ জানে না তাদের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে চিকিৎসাসেবা গ্রহণের হার খুবই কম, মাত্র ৩৮ শতাংশ। নিয়মিত ওষুধ সেবনের মাধ্যমে রোগটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে মাত্র ১৫ শতাংশ; অর্থাৎ প্রতি ৭ জনে একজন।

এমন পরিস্থিতিতে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ২০১৮ সালে এই প্রকল্প নেয় সরকার। এটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে রাজশাহীর ১১টি উপজেলার ২৩৬ কমিউনিটি ক্লিনিক এবং দেশের ১৮২টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে। রাজশাহীতে এই প্রকল্প শুরু হয়েছে ২০২৩ সালে। দেশব্যাপী এই কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে দিতে আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের (জিএইচআই) সহায়তায় গবেষণা এবং অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা’র (প্রগতির জন্য জ্ঞান) মাধ্যমে মিডিয়া অ্যাডভোকেসির কাজ চলছে। এর উদ্দেশ্য, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস শনাক্ত করা, বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ প্রদান এবং ফলোআপ করা। গত প্রায় দুই বছরে রাজশাহীতে ২২ হাজার ৫০৩ জন মানুষকে সেবা দেয়া হয়েছে। তারা নিয়মিত ওষুধ ও স্বাস্থ্যবিষয়ক নানা পরামর্শ পাচ্ছেন। এর মধ্যে শুধু উচ্চ রক্তচাপের রোগীর সংখ্যা ১২ হাজার ৮০০ জন এবং উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস উভয় রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৯ হাজার ৭০৩ জন। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ জেলায় উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের হার ছিল শতকরা ৫৬ ভাগ। তবে উচ্চ রক্তচাপ রোগীদের মধ্যে ৪৫ ভাগ রোগী নিয়মিত চিকিৎসাসেবা নিতে আসেন না। তাদের সচেতন করতে নেয়া হয়েছে বিভিন্ন কর্মসূচি।

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির বিভাগীয় প্রোগ্রাম অফিসার এহসানুল আমিন ইমন মানবজমিনকে বলেন, কমিউনিটি পর্যায়ে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের ওষুধ বিনামূল্যে দিচ্ছে সরকার। তবে দূরত্ব, সময় ও পরিবহন ব্যয়ের কারণে ৫ হাজারের অধিক উচ্চ রক্তচাপের রোগী ফলোআপে প্রতি মাসে নিয়মিত আসেন না। বিশেষ করে পুরুষ রোগীদের মধ্যে অনীহা বেশি। কারণ তাদের মধ্যে অনেক রোগী আছেন যারা ফসলের ক্ষেত্রে মৌসুমি কাজ করেন। তিনি জানান, অনিয়মিত রোগী বাড়ানোর জন্য কাউন্সেলিং হচ্ছে। সেবাকে কমিউনিটি পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ চলছে। কমিউনিটিতে নানা গ্রুপকে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০১৮ সাল থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি (এনসিডিসি) ও ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ দেশের ২৩ জেলার ১৮২টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং চারটি সদর হাসপাতালের এনসিডি কর্নারে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। যার উদ্দেশ্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে উচ্চ রক্তচাপ শনাক্ত করা, চিকিৎসা ও ফলোআপ কার্যক্রম শক্তিশালী করা। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে তৃণমূল পর্যায়ে প্রকল্পটি আরও সফল করতে পরীক্ষামূলকভাবে সিলেট জেলার চারটি উপজেলার (গোলাপগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, বিশ্বনাথ ও বিয়ানীবাজার) ৮৬টি কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে সরকারিভাবে বিনামূল্যে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ দেয়া শুরু হয়। গত বছর ১৪ই মে ওই সভায় কমিউনিটি ক্লিনিকের ওষুধ তালিকায় উচ্চ রক্তচাপের জন্য অ্যামলোডিপিন ৫ মিলি গ্রাম ও ডায়াবেটিসের জন্য মেটফরমিন ৫০০ মিলি গ্রাম সরবরাহ করার সিদ্ধান্ত নেয়। এরই মধ্যে দেশের দুই-তৃতীয়াংশ উপজেলার কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলে দেশে অকাল মৃত্যুও কমে আসবে। কারণ মৃত্যুর প্রধান তিন কারণের অন্যতম উচ্চ রক্তচাপ। যদি অকাল মৃত্যু কমাতে হয় তাহলে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে হবে।

তিনি বলেন, সরকারের তো একটা টার্গেট আছে অকাল মৃত্যু এক-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনা। এজন্য ওষুধের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। প্রান্তিক পর্যায়ে ওষুধ কিনে খেতে না পারলে ওষুধ সরবরাহ করা সরকারের দায়িত্ব। কিছু রোগী অনিয়মিত হয়ে যাচ্ছে তাদের বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে জানতে চাইলে ডা. সোহেল রেজা বলেন, এটা একটা চ্যালেঞ্জ। তবে ওষুধ শেষ হলে এখন তাদেরকে মোবাইলে মেজেস দেয়া হচ্ছে। এতে বেশ সাড়াও পাওয়া যাচ্ছে।

mzamin


No comments

Powered by Blogger.