এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি by ডা. এবিএম আবদুল্লাহ
এন্টিবায়োটিক ওষুধ বিশ্বব্যাপী অত্যন্ত সমাদৃত এবং চিকিৎসাক্ষেত্রে যার অবদান অবিস্মরণীয়। ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে মানবজাতির জীবন রক্ষার প্রধান অস্ত্র হচ্ছে এন্টিবায়োটিক। দুঃখের বিষয় হলেও সত্য যে, বর্তমানে অতিরিক্ত অপ্রয়োজনীয় ও অযৌক্তিক এন্টিবায়োটিকের অপব্যবহারের কারণে ওষুধের ক্ষমতা কোনো কোনো জীবাণু ধ্বংসের ক্ষেত্রে অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে। এর যথেচ্ছ ব্যবহারে জীবন রক্ষাকারী এন্টিবায়োটিক জীবাণু প্রতিরোধী এন্টিবায়োটিক হয়ে উঠছে, জীবাণুগুলো ওষুধ প্রতিরোধী এবং ওষুধের বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকার সক্ষমতা অর্জন করছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এমন পরিস্থিতিকে বলা হয় এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স অর্থাৎ এন্টিবায়োটিক প্রতিবন্ধকতা, যা মানুষের জন্য প্রাণঘাতী। অনেক সময় দেখা যায় জীবাণুগুলো একাধিক এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করে, তাকে বলে মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স, অনেক সময় একে বলা হয় সুপারভাগ, যা আরও ভয়ঙ্কর।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশেও এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার কম নয়। মানুষ কোনো রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হলেই প্রাথমিকভাবে তার নিকটবর্তী দোকান থেকে ওষুধ কিনে খেতে পারে। ওষুধ কিনতে কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকায় এবং ডাক্তারের কোনো প্রেসক্রিপশন না লাগায় মানুষ সহজেই এ কাজটি করছে। এটি হচ্ছে জনসচেতনতার অভাবে। ফলে অপরিমিত ও মাত্রাহীন ওষুধ খাওয়ার ফলে এর জীবাণুনাশক ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এবং এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স তৈরি হচ্ছে যা স্বাস্থ্যব্যবস্থায় একটি অনাগত ঝুঁকি। এরপরও এন্টিবায়োটিকের অপব্যবহার হয়েই চলছে। একটা এন্টিবায়োটিক কাজ না করলে অন্য এন্টিবায়োটিক দিতে হচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় সেটিও কাজ করছে না। তখন অধিক কার্যকরী এবং অনেক দামি এন্টিবায়োটিক প্রয়োগ করতে হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে এন্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা হ্রাস পাচ্ছে। সাধারণ এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করে যে ফল পাওয়া সম্ভব ছিল, দেখা যায় অধিক কার্যক্ষমতাসম্পন্ন এন্টিবায়োটিক ব্যবহারেও সে ফল পাওয়া যাচ্ছে না। এভাবে অপব্যবহার আর যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে এন্টিবায়োটিক তার কার্যক্ষমতা হারাচ্ছে এবং রেজিস্ট্যান্স তৈরি হচ্ছে। জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রথাগত এন্টিবায়োটিক কাজে আসছে না। এটি মানুষ ও পশু স্বাস্থ্য এবং কৃষি সেক্টরের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সঠিক এন্টিবায়োটিক দিয়ে যে রোগ শুরুতেই ভালো করা যেত, ভুল ব্যবহারের কারণে তা আর সম্ভব হচ্ছে না, নতুন ওষুধ দরকার হচ্ছে, কখনো তাতেও কাজ হচ্ছে না।
এন্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা হারানোর আরও কিছু কারণ:
(১) প্রায় সময়েই দেখা যায় এন্টিবায়োটিক খাওয়া দরকার ৭ থেকে ১০ দিন। অনেক রোগীও কয়েকটা এন্টিবায়োটিক খেয়ে সুস্থতাবোধ করলে মাঝপথে ওষুধ বন্ধ করে দেয়। মনে করে, ‘আমি তো ভালোই হয়ে গেলাম, ওষুধ খাবার আর দরকার কী’? এটি খুবই ক্ষতিকর। এভাবে ওষুধের মেয়াদ পূরণ না করায় এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ছে এবং রোগীর বিপদও বাড়ছে। এন্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলেই এমন ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে এবং দিন দিন তা বেড়েই চলছে।
(২) আমাদের দেশে জীবাণুগুলো ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে ওঠার অন্যতম কারণগুলোর একটি হলো ওষুধের দোকানগুলোতে কোনো ধরনের ব্যবস্থাপত্র বা প্রেসক্রিপশন ছাড়াই এন্টিবায়োটিক ওষুধ বিক্রি করা হয়। যে কেউ চাইলেই ফার্মেসিতে গিয়ে ইচ্ছামতো এন্টিবায়োটিক কিনতে পারে, ডোজ মানছে না, নিয়ম মানছে না, যেমন ইচ্ছা হলো খাচ্ছে, যখন ইচ্ছা খাচ্ছে, বন্ধ করছে, যেগুলো আরও ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে।
(৩) অনেক রোগীই আর্থিক অসঙ্গতির কারণে ডাক্তারের পরামর্শ না নিয়ে নিজেই ওষুধ বিক্রেতার কাছ থেকে এন্টিবায়োটিক চেয়ে নিচ্ছে। কিছু কিছু ওষুধ বিক্রেতাও মুনাফার স্বার্থে প্রেসক্রিপশন ছাড়াই ওষুধ বিক্রি করছে। এমনকি অনেক সময় রোগী ও তাদের লোকজনও চিকিৎসকদের প্রেসক্রিপশন গ্রহণ ও সে অনুযায়ী ওষুধ কেনার প্রয়োজন অনুভব করেন না। এর সঙ্গে ওষুধ প্রতিরোধী বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থা খুব ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে।
(৪) আবার আমাদের দেশে পাস করা রেজিস্টার্ড ডাক্তার ছাড়াও অনেকেই প্রতিনিয়ত রোগীর চিকিৎসা করেন, এমনকি মাঝে মাঝে ভুয়া ডাক্তারের কথাও শোনা যায়। যাদের চিকিৎসা বিজ্ঞানে পড়াশোনা কম, তারা উপযুক্ত মাত্রা এবং মেয়াদ সম্পর্কে না জেনেই রোগীকে এন্টিবায়োটিক দিচ্ছে, এটাও একটা খারাপ দিক।
(৫) এ ছাড়াও আমাদের দেশে প্রায়ই দেখা যায় অধিকাংশ ফার্মেসি ডিগ্রিধারী বা উপযুক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ফার্মাসিস্ট দিয়ে চালানো হয় না। মোটামুটি লেখাপড়া জানা অনেকেই ওষুধের দোকানে বিক্রেতা হিসেবে কিছুদিন কাজ করেই নিজেরা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই ফার্মাসিস্ট হিসেবে কাজ করছে। প্রায়ই প্রত্যন্ত অঞ্চলে ডাক্তার না থাকায় এ ধরনের বিক্রেতারাই রোগীকে ব্যবস্থাপত্র এবং এন্টিবায়োটিক দিচ্ছে। এক্ষেত্রে দেখা যায় রোগীর বয়স ও ওজন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় মাত্রায় এন্টিবায়োটিক দেয়া হয় না। এমনকি খাবারের আগে-পরে বা কতোদিন খেতে হবে তারও নির্দেশনা থাকে না বা রোগীকে ভালোভাবে বুঝিয়ে বলা হয় না। ফলশ্রুতিতে রোগীর শারীরিক এবং আর্থিক উভয় দিক থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।
প্রতিরোধে করণীয়: আমাদের হাতে কার্যকর এন্টিবায়োটিকের সংখ্যা দিন দিন কমে আসছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোয় সংক্রামক রোগ বেশি, এন্টিবায়োটিকের প্রয়োজনও বেশি। তাই এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স প্রতিরোধে অবশ্যই সচেতনতা দরকার এবং এন্টিবায়োটিকের অকার্যকারিতা রোধে এখনই ব্যবস্থা নেয়া দরকার।
(১) ডাক্তারদের অবশ্যই রোগীকে এন্টিবায়োটিক লেখার সময় উপযুক্ত মাত্রা এবং মেয়াদের ব্যাপারে রোগীকে ভালো করে বুঝিয়ে দিতে হবে।
(২) রোগীদেরও সচেতন হতে হবে, তারা যেন যখন তখন নিজে থেকেই বা ফার্মেসি থেকে প্রেসক্রিপশন ছাড়া কোনো ওষুধ কিনে না খান। কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলে ওষুধ বন্ধ বা পরিবর্তনের আগে ডাক্তারকে অবহিত করতে হবে। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খেতে হবে এবং অবশ্যই উপযুক্ত মাত্রা এবং মেয়াদ অনুযায়ী। বিশেষ করে শিশু, গর্ভবতী মা এবং বয়স্কদের ব্যাপারে আরও বেশি সতর্ক থাকতে হবে। তাই এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
(৩) ওষুধ বিক্রেতার কর্তব্য: ওষুধ বিক্রেতাকে অবশ্যই কিছু দায়িত্ব ভালোভাবে পালন করতে হবে। প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ বিক্রি করা উচিত। শুধু ব্যবসায়িক স্বার্থে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া সব ওষুধ বিক্রি করা উচিত নয়। তবে ‘ওভার দ্য কাউন্টার’ বিক্রির জন্য, যা আইনগতভাবে বৈধ, শুধু সেগুলোই বিক্রি করা যাবে। সুন্দরভাবে প্যাকেটের ওপর প্রয়োজনীয় মাত্রা, কতোবার, কীভাবে সেবন করতে হবে, খাওয়ার আগে বা পরে, তা ভালোভাবে লিখে দেয়া উচিত। তা না হলে রোগীকে বা রোগীর লোকজনকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে।
(৪) সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব: ওষুধ যেহেতু একটি অতি প্রয়োজনীয় জীবনরক্ষাকারী পণ্য, তাই যথাযথ কর্তৃপক্ষের দায়িত্বও অনেক বেশি। দোকানে ওষুধ বিক্রির ক্ষেত্রে নিয়ম মানা হচ্ছে কিনা, তা পর্যবেক্ষণ করা ও সার্বিক তত্ত্বাবধান করা উচিত। শিক্ষিত বা ট্রেনিংপ্রাপ্ত ফার্মাসিস্ট ছাড়া অন্য কেউ যেন ওষুধ বিক্রি না করে, তার যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। অননুমোদিত ওষুধপত্র বিক্রি বন্ধ করা উচিত। মাঝেমধ্যে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় রেখে পরিদর্শন টিম থাকা ভালো, যাদের কাজ হবে মাঝে মাঝে বিভিন্ন ওষুধের দোকানে নিয়মিত চেকআপ এবং ওষুধের ব্যবহার নিশ্চিত করা। সরকারি হাসপাতালে প্রয়োজনীয় ওষুধের সময়মতো সরবরাহ নিশ্চিত করাও জরুরি। দেশে বিভিন্ন ধরনের অপচিকিৎসা, কুচিকিৎসা, তাবিজ-কবজ বা ঝাড়ফুঁক ইত্যাদি অবৈজ্ঞানিক পন্থায় যেসব কুচিকিৎসা চলে, তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া জরুরি।
মোট কথা, আমাদের ভালোভাবে বেঁচে থাকতে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন সুস্থভাবে সুস্বাস্থ্য নিয়ে গড়ে ওঠে, তার জন্য এন্টিবায়োটিক সহ অন্যান্য ওষুধের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি ওষুধের অপব্যবহার, বিশেষ করে এন্টিবায়োটিকের রেজিস্ট্যান্স থেকে নিজেদের এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচাতে এখনই পদক্ষেপ নেয়া দরকার। মনে রাখতে হবে চিকিৎসার অভাবে মানুষের যেমন মৃত্যু হতে পারে, ভবিষ্যতে হাতের কাছে অসংখ্য ওষুধ থাকলেও যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে সবই অকার্যকর হওয়ায় মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়তে পারে।
No comments