ওসমানী মেডিকেল কলেজ: দিদারের বিরুদ্ধে এন্তার অভিযোগ by ওয়েছ খছরু
সিলেট ওসমানী হাসপাতালে যেমনি দুর্নীতির শেকড় গেড়েছিলেন ব্রাদার সাদেক, তেমনি মেডিকেল কলেজে দুর্নীতিতে নাম এসেছে মাহমুদুর রশীদ দিদারের। তিনি হচ্ছেন পিএ টু প্রিন্সিপাল। পিএ হয়েও দাপটের সঙ্গে কলেজের ভারপ্রাপ্ত সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন। প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পর থেকে তার দুর্নীতির কথা কলেজ ও হাসপাতালের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মুখে মুখে রটছে। সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের সাবেক প্রিন্সিপাল ছিলেন মোর্শেদ আহমদ চৌধুরী। তিনি পরবর্তীতে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে সীমাহীন দুর্নীতির ঘটনায় দুদকের মামলার আসামি হয়েছেন। সেই মোর্শেদ আহমদ চৌধুরীর সময় ২০১৮ সালে নিয়ম বহির্ভূতভাবে ‘ব্লকপোস্ট’ ক্যাশিয়ার পদ থেকে পিএ টু প্রিন্সিপাল পদে পদোন্নতি নেন। কলেজের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দিদার যে পদে রয়েছে সেটি সরাসরি নিয়োগের মাধ্যমে নিতে হয়। কিন্তু তখনকার প্রিন্সিপাল নিয়ম লঙ্ঘন করে দিদারকে সে পদে পদায়ন করেন। অথচ এ পদের জন্য তারই সহকর্মী স্টেনোটাইপিস্ট অনুজের জন্য প্রাপ্য ছিল। কিন্তু অনুজকে ওই পদে নেয়া হয়নি। এ কারণে অনুজ ২০২৩ সালে ক্ষুব্ধ হয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি শিক্ষা বরাবর আবেদন করেছিলেন। তখন অনুজকে নানাভাবে হুমকি দেয়া হয়। বর্তমানেও চাপের মুখে রয়েছেন তিনি। বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিকদের এড়িয়ে যান তিনি। কোনো কথা বলতে রাজি হন না। তবে, অনুজের সেই অভিযোগটি শেষ মুহূর্তে ডিজি শিক্ষার কাছে তামাদি করে রাখা হয়েছে। এটি নিয়ে পরবর্তীতে কোনো কার্যক্রম চালানো হয়নি। কলেজের কয়েকজন কর্মচারী জানিয়েছেন, হাসপাতালে সীমাহীন দুর্নীতি হলেও ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছেন দিদার। দুই বছর আগে সচিবের দায়িত্ব পাওয়ার পর ‘ডাবল ক্ষমতার’ অধিকারী এখন তিনি। এ কারণে তার বিরুদ্ধে কলেজের ভেতরের কেউ টু শব্দও করেন না। দীর্ঘদিন ধরে চাকরির সুবাদে দিদার কলেজের সব শাখাতেই দাপট খাটাচ্ছেন। বিশেষ করে কলেজে বার্ষিক কেমিক্যাল ক্রয়, লাইব্রেরি নির্মাণ ও বই ক্রয়, নিয়মিত কলেজ ও ছাত্রবাস মেরামত, আসবাবপত্র ক্রয়, রি-এজেন্টের নামে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি করে যাচ্ছেন। এর বাইরেও তো নানা ধরনের টেন্ডার বাণিজ্য রয়েছে। কলেজের বিভিন্ন কাজে নামমাত্র ঠিকাদার নিয়োগ করা হলেও কাজ সম্পূর্ণটাই দিদারের তত্ত্বাবধানেই হয়ে থাকে। বর্তমানেও ছাত্রাবাসে সড়কের কাজ চলছে। এই কাজও তার নিয়ন্ত্রণেই হচ্ছে বলে জানান কর্মচারীরা। দু’বছর আগে কলেজের শিক্ষার্থীরা আবাস সমস্যা নিয়ে আন্দোলনে নেমেছিল। তখনো দুর্নীতির ঘটনায় উঠে এসেছিল দিদারের নাম। তারা জানিয়েছেন, হাসপাতালের পিএ ব্যক্তিগতভাবে কোনো গাড়ি ব্যবহার করতে পারেন না। কিন্তু ডক্টরদের ব্যবহৃত একটি গাড়ি নিয়মিতই ব্যবহার করেন। কয়েক মাস আগে কলেজে ৪০ জনের মতো তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ করা হয়েছে। এই নিয়োগে যথানিয়মে পরীক্ষা, ভাইবা সবকিছু হলেও টাকা ছাড়া কেউ নিয়োগ পাননি। এই নিয়োগের মাধ্যমে কয়েক কোটি টাকা দুর্নীতি করা হয়েছে। এই দুর্নীতির তীরও দিদারের দিকে বেশি। কলেজের কর্মকর্তা-কর্মচারী কোয়ার্টারে দিদার পরিবার নিয়ে থাকেন না। তবে তার এক ভাই পরিবার পরিজন নিয়ে এ কোয়ার্টারে থাকেন। সম্প্রতি বিষয়টি নজরে এসেছে কলেজ কর্তৃপক্ষেরও। এ কারণে তার ভাইকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ২০১৭ সালে মেডিকেল কলেজের লাইব্রেরি নির্মাণের সময় দুর্নীতি করা হয়। ওই লাইব্রেরি ১৪ কোটি টাকায় নির্মাণ করা হলেও বেশির ভাগ টাকা দুর্নীতির মাধ্যমে পকেটস্থ করা হয়েছে। দিদার এই লাইব্রেরি নির্মাণে কোটি টাকার মতো হাতিয়ে নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। কলেজের ভেতরে আধিপত্য বিস্তার করে দুর্নীতির সাম্রাজ্য গড়া দিদার বিশাল সম্পদের মালিক। তবে, এসব সম্পদের বেশির ভাগই হচ্ছে বেনামী। তার আত্মীয়স্বজনদের নামে। কয়েক বছর আগে দিদার ও মধুশহীদ এলাকার সাদ্দামকে নিয়ে একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার খুলেছিলেন। কয়েক বছর ব্যবসা করার পরে ডাক্তারদের কাছে ওই ডায়াগনস্টিক সেন্টার বিক্রি দেন। প্রায় দু’বছর আগে তিনি নগরের শেখঘাটের শুভেচ্ছা আবাসিক এলাকায় একটি তিনতলা বাসা ক্রয় করেন। ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকায় কেনা ওই বাসা দিদারের টাকায় ক্রয় করা হয়েছে বলে কলেজের সবাই জানেন। সম্প্রতি সময়ে নগরের ঘাষিটুলা এলাকায় আরেকটি তিনতলা বাসা নির্মাণাধীন রয়েছে। এই বাসাও তার টাকায় হচ্ছে। তবে দুটি বাসা তার নামে নয়। ভাইদের নামে বাসা ক্রয় করা হয়েছে। শেখঘাটের বাসায় দিদার পরিবার পরিজন নিয়ে নিজেও বসবাস করেন। সাদ্দাম নামে একজনের সঙ্গে পার্টনার হয়ে মেডিকেল এলাকার রজনীগন্ধ্যা আবাসিক হোটেল চালাচ্ছেন তারা। এ হোটেল নিয়ে এলাকার মানুষের অভিযোগের অন্ত নেই। এর বাইরে শেখঘাট এলাকায় তার ফার্মেসি ব্যবসা রয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। এ ছাড়া নগরের জিন্দাবাজার এলাকায় লাইব্রেরি সহ স্টেশনারি ব্যবসায় তার শেয়ার রয়েছে। ভাতালিয়া এলাকায় জমি রয়েছে তার। মেডিকেল কলেজের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা জানিয়েছেন, দিদার ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে কয়েক বছর আগে দুদকে একটি অভিযোগ দেয়া হয়েছিল। পরে দিদার লবিং করে ওই অভিযোগ গায়েব করে ফেলেন। সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল ডা. শিশির চক্রবর্তী জানিয়েছেন, দিদার পিএ’র দায়িত্ব থাকায় তাকে পরে সচিবের ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তার জন্য এটি অস্থায়ী পদ। যেকোনো সময় তাকে বাদ দেয়া যেতে পারে। আর তার নিয়োগের বিষয়টি তিনি প্রিন্সিপাল হওয়ার আগে হয়েছে। সুতরাং এ ব্যাপারে তিনি অবগত নন। দখলে রাখা বাসা ছেড়ে দেয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, কোয়ার্টারের বাসা ছেড়ে দিতে দিদারের লোকজনকে বলে দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে পিএ মাহমুদুর রশীদ দিদার জানিয়েছেন, তিনি বৈধভাবেই পিএ পদে এসেছেন। কোনো অনিয়ম হয়নি। নগরের শেখঘাট ও ঘাষিটুলা এলাকার দুটি বাসা সম্পর্কে তিনি বলেন, তারা ভাইরা দুটি বাসা ক্রয় করেছেন। তিনি দেখভাল করছেন। তার তো টাকা নেই। বিদেশ থেকে ভাইরা টাকা দেয়ায় তিনি বাসা ক্রয় করেছেন বলে জানান।
No comments