বাংলাদেশি সাংবাদিকের দৃষ্টিতে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের চার দশক
মুজতাহিদ ফারুকী |
ইরানে ইসলামি বিপ্লবের ৪০তম বার্ষিকী ১১ ফেব্রুয়ারি।
আন্তর্জাতিক বিশ্বের সীমাহীন বৈরিতা এবং যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের দশকের
পর দশক ধরে চলমান অবরোধের মধ্যেও অভূতপূর্ব প্রাণশক্তিতে ভরপুর ইরানি জাতি
বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে দ্রুত ও দৃপ্ত গতিতে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে।
বৈশ্বিক মানব
উন্নয়ন প্রতিবেদনে তাদের অবস্থান এখন ১৮৯ দেশের মধ্যে ৬০ তম যা তুরস্ক, চীন
ও ভারতেরও ওপরে। ইরানের ভৌগোলিক সীমার মধ্যেই শুধু নয়, তেহরানের প্রভাবের
পরিধি বাড়ছে ইরাক-সিরিয়া-ইয়েমেন-লেবানন পর্যন্ত। দীর্ঘ চার দশক ধরে কঠিন
অবরোধের মধ্যে থেকেও ইরান যে শুধু টিকে আছে তাই নয়, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক,
সামরিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে পূর্ণ শক্তিমত্তারও পরিচয় দিচ্ছে যা
রীতিমত বিস্ময়কর।
বিপ্লবের আগে ইরানের
জনমানসে প্রধান বৈরি দেশ ছিল যুক্তরাজ্য। মূলত যুক্তরাজ্যকে ইরানের
তেলসম্পদ লুটে নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার প্রতিবাদেই শাহের বিরুদ্ধে ইরানি
জনগণ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। সেই ক্ষোভ থেকে জন্ম নেয় এক অপ্রতিরোধ্য জাতীয়তাবাদী
ও ইসলামি মূল্যবোধসঞ্জাত ধর্মীয় চেতনা। সেটাই পরে কোম শহরের ইসলামি
নেতৃত্বের নিরলস চেষ্টায় সমগ্র জাতির মধ্যে এক বিশাল জাগরণ সৃষ্টি করে এবং
সর্বব্যাপী বিপ্লব সংঘটনকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে।
ইমাম খোমেনী (রহ.)-এর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের সমাবেশ
বিপ্লব সফল হবার পর ১৯৭৯ থেকে ক্রমেই
ইরানের প্রধান বৈরী দেশ হয়ে ওঠে যুক্তরাষ্ট্র। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র
সম্পূর্ণ একতরফাভাবে ইরানের বিরুদ্ধে নতুন করে ইতিহাসের কঠোরতম অর্থনৈতিক
অবরোধ কার্যকর করেছে। তেল বিক্রি, সমুদ্র-বাণিজ্য, ব্যাংকব্যবস্থা- সবই
নিষেধাজ্ঞার আওতাধীন। ইরানকে নতজানু করার জন্য গত ৪০ বছর ধরেই ওয়াশিংটন একর
পর এক অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইরান সে সময় যুক্তরাষ্ট্রকে ‘সবচেয়ে বড়
শয়তান’ হিসাবে চিহ্ণিত করে। এখন ওই অভিধাটি ব্যবহার না করলেও দুই দেশের
বৈরিতার মাত্রায় তেমন কোনও হেরফের হয়নি। তবে ইউরোপের প্রধান কয়েকটি দেশ
জার্মানি, ব্রিটেন, রাশিয়া ও ফ্রান্স এখন ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করছে
এবং যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধে শরিক না হয়ে দেশটির সঙ্গে কিছু কিছু
অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক সম্পর্ক রক্ষা করছে। এভাবে ইরান কূটনীতিতে
যুক্তরাষ্ট্রকে কার্যত পেছনে ফেলে দিয়েছে।
ইরান তার ইসলামি
বিপ্লব বিদেশে রপ্তানির কোনও চেষ্টা করেনি। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাব বাড়ানোর
নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। এই প্রচেষ্টারই প্রতিফলন ইরাকে, সিরিয়ায়,
লেবাননে এবং ইয়েমেনে ইরানি প্রভাবাধীন শক্তির একটি বলয় তৈরি হওয়া।
বর্তমান অন্যায্য
বিশ্ব ব্যবস্থায় অব্যাহত নিপীড়নের হাত থেকে সারা বিশ্বের মুসলমানদের রক্ষার
জন্য ইরান বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনী কিছু
গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নেন। তিনিই পবিত্র মাহে রমজানের শেষ শুক্রবার বা
জুমাতুল বিদার দিনটিকে 'বিশ্ব কুদস দিবস' ঘোষণা করেন। ১৯৭৯ সাল থেকে বিশেষ
করে মুসলিম দেশগুলোতে দিবসটি প্রতি বছর পালিত হয়ে আসছে। মুসলমানদের প্রথম
কিবলা বায়তুল মুকাদ্দাস বা আল-কুদস আল শরিফকে (জেরুজালেম) ইহুদিদের দখল
থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে তিনি এই ঘোষণা দেন। সেইসঙ্গে ফিলিস্তিনি জনগণের
সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে তাদের জন্য আল-কুদসকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন
ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর অংশীদার
ফিলিস্তিনিদের ওপর ইহুদি শাসকগোষ্ঠীর অব্যাহত জুলুম-নিপীড়নের চির অবসান
ঘটানোও ছিল তার লক্ষ্য।
ইমাম খোমেনীর আদর্শকে ধারণ করে ইরানি শিশুরা
ইমাম খোমেনী শুধু যে ফিলিস্তিনিদের কথা
মাথায় রেখে এই দিবস পালনের আহবান জানান এমন নয়। বরং বিশ্বের যেখানেই
মুসলমানরা এবং সাধারণ মানুষ ক্ষমতাধর সাম্রাজ্যবাদী ও জালিম শাসকদের হাতে
নিপীড়িত, নির্যাতিত ও অন্যায়-অবিচারের শিকার হচ্ছে সেখানেই প্রতিরোধের
আহবান জানান ইমাম খোমেনী। আল-কুদস দিবসের গুরুত্ব তুলে ধরতে গিয়ে তিনি
বলেছিলেন, “কুদস দিবস একটি বিশ্ব দিবস। দিবসটি কেবল কুদসের মাঝেই সীমাবদ্ধ
নয়। এই দিবস বলদর্পী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে শোষিত-বঞ্চিত-নিপীড়িত জনতার দিবস।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশের জুলুম অত্যাচারে যেসব দেশ পিষ্ট
হয়েছে তাদের রুখে দাঁড়ানোর দিবস। এই দিবস বলদর্পীদের বিরুদ্ধে নিগৃহীতদের
সুসজ্জিত হবার দিবস।”
তাই আল-কুদস দিবস হলো
শোষণ, বঞ্চনা, অন্যায়-অবিচার, নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবার এক
প্রতীকী দিবস, বিশ্ব মানবতার পক্ষে, সত্য, ন্যায় ও মানবাধিকারের পক্ষে এক
অনন্যসাধারণ মানবিক আহ্বান।
তবে তিনি
ফিলিস্তিনিদের স্বার্থরক্ষা ও অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে একটি সুনির্দিষ্ট
কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং আল-কুদস দিবস পালনের মধ্য দিয়ে বিশ্বের
মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধভাবে জেগে ওঠার একটি মঞ্চ তৈরি করে দেন যা অন্য কোনও
আরব বা ইসলামি বিশ্বের নেতা কখনও করেননি। এখানেই খোমেনীর কৃতীত্ব, তাঁর
শ্রেষ্ঠত্ব।
এসব কারণেই ফিলিস্তিন
মুক্তি সংগ্রামের অব্যাহত গতিধারায় একটি নতুন আশার আলো হিসাবে বিবেচনা করা
হয় ইরানের ইসলামি বিপ্লবকে। বর্তমান ফিলিস্তিনে আপোষকামিতাকে বুড়ো আঙুল
দেখিয়ে ফিলিস্তিনিদের সবচেয়ে জনপ্রিয় সংগঠন হামাসের নেতৃত্বের জেগে উঠেছে
ফিলিস্তিনের অযুত মানুষ। আর দক্ষিণ লেবাননে বিপুল শক্তি অর্জন করেছে
অকুতোভয় এক লড়াকু সংগঠন হিজবুল্লাহ। তাদের হাতে পর্যুদস্ত হয়ে ২০০৬ সালে
ইসরাইলী সেনাবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল।
বার্লিনে কুদস দিবসের সমাবেশ
অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইল ২০০৮ থেকে এ পর্যন্ত
হামাস শাসিত গাজা দখলের জন্য তিন তিনবার সর্বাত্মক যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়।
কিন্তু হামাস কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ফলে প্রতিবারই গাজার ব্যাপক মানবিক ও
অর্থনৈতিক ক্ষতি হলেও ইসরাইল গাজা দখল ও হামাসের পতন ঘটাতে পুরোপুরি
ব্যর্থ হয়। অন্যদিকে হিযবুল্লাহ্ অপরাজেয় হিসেবে পরিগণিত ইসরাইলের ওপর তিন
তিনবার শোচনীয় পরাজয়ের গ্লানি চাপিয়ে দেয়। হামাস ও হিযবুল্লাহর এসব
সাফল্যের পেছনে ইরানের সক্রিয় সহযোগিতা ও মদদ রয়েছে। ইরান যদি পাশ্চাত্য ও
তাদের তাবেদার আরব দেশগুলোর সব বৈরিতার মোকাবিলা করে নিজস্ব শক্তিমত্তা
নিয়ে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকার যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারে তাহলে
নির্যাতিত ইসলামি বিশ্বের জন্য সেটি হবে আল্লাহর প্রত্যক্ষ আশীর্বাদের
মতো।
ফরাসি দার্শনিক মিশেল
ফুকো ইরান বিপ্লবের অগ্নিগর্ভ দিনগুলিতে দু'বার তেহরান সফর করেন। ইরান
বিপ্লব ও সেই সময়কার ইরান নিয়ে তিনি বেশ কিছু নিবন্ধ লেখেন। তিনি
পাশ্চাত্যের বেশিরভাগ পণ্ডিতের মতো ইরান বিপ্লবকে ‘মৌলবাদ’ বা ‘ইসলামি’
অভিধায় চিহ্নিত না করে বরং এটিকে বহমান ইতিহাসের এক সমসাময়িক অভিব্যক্তি
হিসাবে হিসেবে দেখেছেন। বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমেনীর ‘আধ্যাত্মিকতার
রাজনীতি’র ভবিষ্যৎ নিয়ে ফুকো আশাবাদী ছিলেন। নতুন রাজনীতি ও সংস্কৃতির এই
নতুন জোয়ার মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন পটপরিবর্তনের সূচনা করবে
বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন ও লেবাননের বর্তমান
পরিস্থিতি সম্ভবত তাঁর অনুমানের অভ্রান্ততার সাক্ষ্য দেয়। ফুকো বিশ্বব্যাপী
পশ্চিমা আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে ইরান বিপ্লবকে প্রথম বড় ধরনের অভ্যুত্থান
হিসেবে অভিহিত করেন।
ইরান বিপ্লব কেবল
ইরানের সবচেয়ে বড় বিপ্লব এমন নয়, বরং এটি গোটা বিশ্বের ইতিহাসে সর্বকালের
সবচেয়ে বড় বিপ্লব। কারণ এর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে ছিল ইরানি জাতির মোট
জনসংখ্যার ১০ শতাংশ মানুষ। ভাবলে বিস্মিত হতে হয় যে, বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত ও
গৌরবময় বিপ্লবের উদাহরণ হিসাবে চিহ্ণিত করা হয় যে ফরাসী বিপ্লবকে তাতে
তৎকালীন ফরাসী জনগোষ্ঠীর মাত্র দুই শতাংশের সরাসরি সম্পৃক্ততা ছিল।
ইরান বিপ্লব নিয়ে দেশে
দেশে প্রচারমাধ্যমে নেতিবাচক প্রচারণা এই ৪০ বছরেও কিছুমাত্র কমেনি। এখনও
পাশ্চাত্যের এবং আমাদের মতো দেশগুলোর পাশ্চাত্যপন্থি লেখক বুদ্ধিজীবীরা
ইরান বিপ্লবকে নিছক মোল্লাতন্ত্রের উত্থান এবং একটি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র
হিসাবে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। মার্কিন অবরোধের কারণে ইরান কতটা
ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং কীভাবে দেশটির শাসকগোষ্ঠীর সম্ভাব্য পতন ঘটতে পারে তা
নিয়েও গবেষণার শেষ নেই। ইরানে নারী অধিকার, সংখ্যালঘু সুন্নী মুসলমানদের
অধিকার এবং মানবাধিকার কতভাবে খর্ব করা হয়েছে কিংবা কোমভিত্তিক ইসলামি
নেতৃত্বের সঙ্গে রাজধানীকেন্দ্রিক শিক্ষিত তরুণ সমাজের মানসিক দ্বন্দ্ব
কীভাবে দেশটিতে সম্ভাব্য বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে তা নিয়েও কৌতুহলোদ্দীপক
বিচার-বিশ্লেষণ হামেশা চলছে। কিন্তু তারা কোনও তল খুঁজে পাচ্ছে না।
পাশ্চাত্যের লেখক
বুদ্ধিজীবীদের এই ব্যর্থতার পেছনের কারণ হলো তাদের সংস্কৃতি ও শিক্ষার
মধ্যে বিশ্বাসের ঘাটতি। ইমাম খোমেনী তাঁর অনুসারীদের কাছে ইসলামি জাগরণের
ভবিষ্যৎ সম্পর্কে পরিষ্কার একটি ধারণা দিতে সক্ষম হয়েছিলেন যা তাদের মনে
বিশ্বাসের সুদৃঢ় শেকড় গেড়েছিল। সেই বিশ্বাসের অবসান হয়েছে এমন মনে করার
কোনও কারণ নেই।
বিপ্লবের মূল মর্মবাণী
ছিল, স্বাধীনতা, মুক্তি, ইসলামি প্রজাতন্ত্র। আয়াতুল্লাহ ইমাম খোমেনী
দেখিয়ে গেছেন সেই সত্যের পথে যে বাধা বিপত্তি আছে তার সাথে লড়াই করে কিভাবে
অটল অবিচল থাকতে হয়। ইতিহাস, বর্তমান ও ভবিষ্যতের বিবেচনায় ইসলামি জ্ঞান
থেকে ইরানের ইসলামি বিপ্লব রসদ সংগ্রহের অন্যতম কৌশল শিখিয়েছে। তাই তাকে
প্রকৃতি ও চারপাশ সম্পর্কে গভীর অনুধ্যান করতে এবং এর নিরিখে ইসলামের
মর্মবাণী কী তা নিরূপণ করতে হয়।
ইসলাম একজন বিপ্লবীর
জীবনের যেসব বাস্তব ও ব্যক্তিগত দিক রয়েছে তাকে উদ্ভাসিত করে তোলে। একজন
অনুসারী তার ধর্মীয় নেতা বা ইসলামি শাসকের কাছ থেকে জীবন সংগ্রামের যেসব
রসদ পায় তা তাকে এতটাই সমৃদ্ধ করে তোলে যে, কোনো আগ্রাসী শক্তিকেই সে ভয়
পায় না। তার উপলব্ধি অটুট থাকে। কারণ, সে তার লক্ষ্যমাত্রা ও অর্জনের
পথগুলো সম্পর্কে পরিষ্কার জ্ঞান অর্জন করে। এভাবেই এক ধরনের দৃঢ় আস্থা নিয়ে
ইসলামি বিপ্লবের অনুসারীরা একের পর এক বাধা অতিক্রম করতে পেরেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া ইরাকের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, পরাশক্তিগুলোর
অবরোধ কিংবা বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইরানের মানুষ যে কঠিন মনোবল
নিয়ে বছরের পর বছর লক্ষ্য অর্জনে ধাবিত হতে পেরেছে তার রহস্য নিহিত রয়েছে
ওই বিশ্বাস ও আত্মিক সম্পর্কের মধ্যে।
ইরানে সম্পদের সামাজিক
বণ্টনের একটি সুপ্রাচীন ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর
মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মধ্যে সম্পদের যোগান দেওয়ার এই ব্যবস্থা এখনও
অব্যাহত আছে এবং তা আরও জোরালো হয়েছে। বিপ্লবের নেতারা ক্ষমতাকে নিজেদের
সম্পদ অর্জনের বা ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার হাতিয়ার হিসাবে গ্রহণ
করেননি। বরং নজীরবিহীন সততা ও নিষ্ঠার দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছেন রাষ্ট্র
পরিচালনার প্রতিটি ক্ষেত্রে। সমাজের স্বাভাবিক বিকাশ ও অগ্রগতির নিয়ামকগুলো
তারা ধর্মের নামে রুদ্ধ করেননি যেমনটা করেছিল আফগানিস্তানের তালেবানি
শাসকরা। বাইরের প্রচারণা সত্ত্বেও ইরানি সমাজে নারীর ভূমিকা অতীতের চেয়ে
সংকুচিত তো নয়ই বরং আরও বিস্তৃত হয়েছে। দেশটির সাহিত্য, সংস্কৃতি,
চলচ্চিত্র, ক্রীড়া, ব্যবসা-বাণিজ্য এমনকি রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের দিকে
তাকালেই সেটি স্পষ্ট হয়।
সাফির রকেটের মাধ্যমে চতুর্থ কৃত্রিম উপগ্রহ মহাকাশে পাঠায় ইরান
ইরান বিপ্লবের পর ১৯৯০ থেকে ২০১৭ সালের
মধ্যে ইরানিদের গড় আয় বেড়েছিল ৬৮ শতাংশ। গড় আয়ু ৫৪ থেকে বেড়ে হয়েছে ৭৫ বছর।
কঠোরতর অবরোধে পড়ে এসব অগ্রগতি হয়তো কিছুটা বাধাগ্রস্ত হবে। কিন্তু থমকে
থেমে যাবে না। মনে রাখতে হবে মধ্যপ্রাচ্যের ইরানই হচ্ছে
জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে সবচেয়ে অগ্রসর মুসলিম দেশ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে
অনেক পশ্চিমা দেশকেও ইরান এখন চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। কিছু পরিসংখ্যান তুলে
ধরলে বিষয়টা বোঝা সহজ হবে।
ইরানি কেন্দ্রীয়
ব্যাংকের দেওয়া ২০১৬-১৭ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ওই বছর দেশটির
রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ১২ শতাংশ। তেল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞার পরও
প্রধানত পেট্রোকেমিক্যাল পণ্য ও অন্যান্য সমগ্রী রপ্তানি থেকে এই প্রবৃদ্ধি
অর্জন করে দেশটি।
বৈজ্ঞানিক গবেষণায়
ইরান সম্প্রতি বিশ্বের শীর্ষস্থানটি দখল করে। ২০১৭ সালের হিসাবে এই
ক্ষেত্রে শীর্ষে ছিল ইরান, দ্বিতীয় অবস্থানে রাশিয়া এবং তৃতীয় স্থানে ছিল
চীন। শীর্ষ ২৫টি দেশের মধ্যে প্রতিযোগিতায় ইরানের প্রবৃদ্ধি হয় ১৪ শতাংশ।
দেশটির প্রযুক্তিভিত্তিক পণ্যের রপ্তানিও বেড়েছে বিপুল পরিমাণে। ২০১৫ সালে
ইরান ৫০ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের বিজ্ঞানভিত্তিক পণ্যসামগ্রী রপ্তানি করে।
বিখ্যাত তেহরান টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বে ন্যানো প্রযুক্তিতে
দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানি, জাপান ও ফ্রান্সের মতো দেশকে টপকে ৪র্থ
শীর্ষস্থান দখল করেছে ইরান। এই খাতে ৮ হাজার ৭৯১টি আর্টিকেল প্রকাশ করে
দেশটি এই অবস্থান অর্জন করে। এই তালিকায় চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত ছিল
যথাক্রমে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে।
বৈজ্ঞানিক উৎপাদনেও সম্প্রতি বিস্ময়কর অগ্রগতি অর্জন করেছে দেশটি। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে ইরানের অবস্থান এখন ১৬তম।
এতক্ষণ যেসব বিষয়ে বলা
হলো তাতে মনে হতে পারে যে, অর্থনীতি সামাল দিতে হিমশিম খাওয়া ইরানের
মোল্লাতান্ত্রিক(!) শাসকরা সম্ভবত সব ধরণের মননশীলতার চর্চা বন্ধ করে দিয়ে
কেবল বৈষয়িক উন্নয়নের দিকেই মনোযোগী হয়েছে। কিন্তু বিশ্বের চলমান ঘটনাবলীর
সামান্য খবরাখবরও যারা রাখেন তাদের অজানা নয় যে, সৃজনশীল সংস্কৃতির চর্চা
সেখানে বন্ধ তো হয়ইনি বরং তা বিশ্বমানে উন্নীত হয়েছে। মাত্র আট কোটি
মানুষের এই দেশটিতে এখনও বছরে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হয় প্রায়
২০০টি। প্রতিবছর জাতীয় চলচ্চিত্র উৎসব পালিত হয় এবং বিশ্বের সর্বত্র এ
ধরণের উৎসবে অংশ নিয়ে পুরস্কার ছিনিয়ে আনেন ইরানি চলচ্চিত্র জগতের গুণী
ব্যক্তিরা।
'দ্য সেলসম্যান' চলচ্চিত্রের পোস্টার
ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে বিগত বছরগুলোতে
ইরানের চলচ্চিত্র শিল্প বিশ্বের দর্শক ও বোদ্ধাদের কাছে একটি নতুন মাত্রা
যোগ করেছে। বিশ্বের বেশিরভাগ চলচ্চিত্র নির্মাতা যখন বাণিজ্যিক উপাদানকে
হাতিয়ার করে অতি সহজে দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন তখন ইরানের
চলচ্চিত্র নির্মাতারা বেছে নিয়েছেন পেশাগত দক্ষতা ও শিল্পের নান্দনিক
প্রকাশের দিকটি। তারা কাজে লাগাচ্ছেন সামাজিক, চারিত্রিক ও মানবিক
মূল্যবোধগুলো যা দর্শকের কাছে ভিন্নতর মাত্রা যোগ করেছে। এ কারণেই
বিশ্বব্যাপী আজ ইরানি চলচ্চিত্রের এমন জয়জয়কার। সেইসঙ্গে শক্তিশালী
চিত্রনাট্য, অনন্য অভিনয় শৈলী, কলাকুশলির মনকাড়া আবেদন এবং বিশ্বমানের
কারিগরি কৌশলের কারণে বিশ্বের সর্বত্র আজ ইরানি সিনেমা ব্যাপকভাবে দর্শক
সমাদৃত।
আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র
অঙ্গনে সবচেয়ে আলোচিত ও সম্মানজনক পুরস্কার অস্কার থেকে শুরু করে অনেক
গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার ঘরে তুলে নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশটি। দুই দু'বার
সেরা পরিচালক হিসাবে অস্কার জিতেছেন ‘অ্যা সেপারেশন’ ও ‘দ্য সেলসম্যান’
ছবির পরিচালক আসগর ফারহাদি। এছাড়াও ইরানে অনেক মেধাবি চলচ্চিত্রকারের জন্ম
হয়েছে যাদের হাত ধরে দেশটি ভবিষ্যতেও অস্কার জিতবে বলে বোদ্ধাদের ধারণা।
এভাবে
আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রতিটি ক্ষেত্রে ইরান যে অগ্রগতি
অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে তা মূলত ইসলামি বিপ্লবেরই সুফল। সম্পূর্ণ প্রতিকূল
বিশ্ব-পরিস্থিতির মোকাবেলা করে এই অর্জন সত্যিই অভূতপূর্ব, অনন্য।
বাংলাদেশের বর্তমান উন্নয়নের কাণ্ডারিদের জন্য এ থেকে অনেক কিছু শেখার
আছে।
লেখক: মুজতাহিদ ফারুকী, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, বাংলাদেশ।
No comments