উগেৎসু : যন্ত্রণাদগ্ধ মানুষের মহাকাব্য by জাহিদ সোহাগ
শুরুতে,
ষোলো শতকের জাপানের একটি গ্রামের দৃশ্যাবলীর সঙ্গে প্রবেশ করি, জীর্ণ
কুটিরের ছাদ দেখে, জেনজুরো-তোবেই দুই ভাই ও তাদের পরিবারের কাছে। যারা একই
সঙ্গে কৃষক ও কুমাড়। রওনা হয়েছে ঠেলাগাড়িতে তাদের বানানো তৈজসপত্র শহরে
বিক্রির উদ্দেশ্যে। বাতাসে যুদ্ধের বার্তা, বোমার শব্দ। স্ত্রীর নিষেধ
থোড়াই করে দুই ভাই চলেতে থাকে। তোবেই যুদ্ধে যেতে চায়। যুদ্ধ অবসম্ভাবি
পরিবর্তন আনবে। পটারি বিক্রি শেষে সে সৈন্যদলে যোগ দিতে গেলে তাকে
আস্তাকুরের ভিখিরি বলে প্রত্যাখান করা হয়। কারণ তার নিজের বর্ম নেই, অস্ত্র
নেই। নাছোড় তোবেই তবু আশা ছাড়ে না। অপর ভাই জেনজুরো স্ত্রীর জন্য পোশাক
কিনে বাড়ি ফেরে।
‘উগেতসু’র শুরুতেই জানতে পেরেছি ১৬ শতকের সিভিল ওয়ারের কাল এটা। যুদ্ধ মানুষকে যা দেয়—ধর্ষণ, খুন, অনিশ্চয়তা, ভীতি, বীরত্ব-ভীরুতা এবং অন্তঃসারশূন্যতার সবগুলো দিক।
১৯৫৩ সালে নির্মিত কেনজি মিজোগুচি’র এই ছবিটি বাস্তব জগতের সঙ্গে রূপকথা ও ফ্যান্টাসির মিশ্রণ ঘটিয়ে নিরেট বাস্তবতাকে, যা আসলেই বাস্তব, তাকে, কল্পদৃশ্যের মধ্যে নিপতিত করেছে। যে কারণে দর্শক কোথাও না কোথায় নিজেকে কল্পনায় স্থাপিত করে নিতে পারে।
উগেতসুর প্রায় সব চরিত্রই, অন্তত যাদের ব্যাপ্তি আছে, তাদের পাপেটের মতো চলাফেরা করতে দেখি। তারা কোমর সোজা না করে ছোটাছুটি করে। নেপথ্য সংগীত বা বাদ্য তাদের হাড়ে-রক্তে বাজে, বা নিংড়ে নেয় সবটুকুই।
গ্রামে সৈন্য ঢুকে পড়ে। চলে লুঠতরাজ। নারী অপহরণ। নির্যাতন। গ্রামের মানুষ পালাচ্ছে যে যার মতোন। জেনজুরো-টোবেই পরিবার তাদের সঙ্গে জঙ্গলে লুকায়। যুদ্ধের গতিবিধি বুঝতে চেষ্টা করে।
কিন্তু তাদের আছে বেঁচে থাকার স্বপ্ন। তারা তৈজসপত্র নৌকায় বোঝাই করে রওনা হয়, লেক পাড়ি দিয়ে পৌঁছুবে শহরে, মাঝপথে কুয়াশার মধ্য দিয়ে আরেকটি নিরুদ্দেশ নৌকা ভেসে এলে দেখে আহত এক মাঝি, পানি চায়, পান শেষে মৃত্যু হলে ওই কুয়াশার ওপারে কী আছে তা বুঝতে বাকি থাকে না। আবার ফিরে আসে গ্রামে। গ্রাম শহর দুটোই অনিরাপদ।
টোবেই’র স্বপ্ন সে সামুরাই (প্রাক-শিল্প যুগের জাপানী যোদ্ধা) হতে চায়। তৈজসপত্র বিক্রির পয়সা দিয়ে বর্ম কেনে, যুদ্ধাস্ত্র কেনে। তবে তাকে সঙ্ঘবদ্ধ কোনো দলের সঙ্গে দেখা যায় না। ফাঁকতালে সে এক সৈন্যকে হত্যা করে তার কাছ থেকে প্রতিপক্ষ এক শীর্ষ ব্যক্তির কাটামুণ্ডু ছিনিয়ে নিয়ে বিজয়ী নেতৃত্বের কাছে অর্পন করে। মুহূর্তেই সে সেনানায়কে পরিণত হয়। ঘোড়া ও আরো সরাঞ্জম পেয়ে, সৈন্য সমেতে বের হয় শহরের পথে। যেভাবে জুলিয়াস সিজার শহরে প্রবেশ করলে মানুষের আনন্দধ্বনি চারপাশ গোলজার করে।
নারীদের আহ্বানে পথে এক বেশ্যালয়ে ঢুকে পড়ে তোবেই তার সৈন্যসমেতে। সে এখন মর্যাদাবান ব্যক্তি। কিন্তু পানাহারের মধ্যে স্ত্রীকে আবিষ্কার করে পয়সা না দিয়ে পালানো খদ্দের পাকরাও করা অবস্থায়। স্ত্রীর কুয়োয় ঝাঁপ দিতে উদ্যত হলে তারা পরস্পরের ভালোবাসার উত্তাপ স্পর্শ করলে বুঝতে পারে, যুদ্ধই এসবের কার্যকারণ। তারা সানন্দে গ্রামের পথে পা বাড়ায়। নদীতে ছুড়ে ফেলে সাধের বর্ম ও অস্ত্র। আবার নতুন করে বাঁচার আশা।
অপরদিকে, জেনজুরো, তোবেই যখন যায় বর্ম কিনতে তখন সে পতিত হয় এক কল্পরাজ্যে। তৈজস বিক্রির সময় এক সম্ভ্রান্ত নারী তার পরিচারিকা সহ শহরের বাজারে এসে তার প্রণয়মুগ্ধ হয়। যদিও জেনজুরো শুরুতে তা বুঝতে পারে না। তৈজস হাতে সে তাদের অনুসরণ করে গৃহে এসে বোঝে এক ফ্যান্টাসির জগতে সে হতে যাচ্ছে রতিরাজা। নিজে বেমালুম ভুলেও যায়, গোপনও রাখে স্ত্রী-সন্তানের কথা, যে স্ত্রীকে বুদ্ধ-মন্দিরে ফেলে সৈন্যরা ধর্ষণ করে শেষে কয়টি পয়সা ফেলে যায়।
অডিসিয়াস ট্রয়ের যুদ্ধ শেষে ইথাকায় ফেরার পথে সদলবলে এক কামুক দেবী ও তার লাস্যময়ীদের দ্বারা ছলনার শিকার হয়ে রতিরসে ভুলে যায়। যখন সম্বিত ফেরে তখন অনেকগুলো বছর পেরিয়ে যায়। ওদিকে ইথাকায় তার স্ত্রীকে অধিকার করতে সম্ভ্রান্তরা প্রতিযোগীতার লিপ্ত।
জেনজুরো যুদ্ধের এই অনিশ্চয়তার সময় অডিসিয়াসের মতো পরিবারের কথা ভুলে সুরা ও সঙ্গে বিভোর। কিন্তু একদিন সে ধরা পরে, স্বীকার করে স্ত্রী-সন্তানের কথা। আবার লেডি ওয়াকাসার স্বামী যে কিনা, মারা গেছে বলে সংবাদ পেয়েছে, সেও শেষে ফিরে আসে।
জেনজুরো বাড়ি ফিরে দেখে স্ত্রী উনুনের কাছে, সন্তান ঘুমাচ্ছে। স্বাভাবিক আলাপ ও পানাহার শেষে সন্তানের পাশে ঘুমিয়ে পড়ে সে। যেনো যুদ্ধ তার স্ত্রী-সন্তানের গায়ে ফুলের টোকাটিও দেয়নি। কিন্তু তার ভ্রম কাটে যখন সকালে জানতে পারে তার স্ত্রী নিহত হয়েছে অনেক আগেই। গতরাতে স্ত্রী যেখানে বসে ছিল সেখানে সে হাত বাড়িয়ে বুঝতে চেষ্টাও করে আসলেই তার স্ত্রী আছে কিনা। তখন তার কবরের কাছে গিয়ে কাঁদা ছাড়া পথ থাকে না।
তোবেই যুদ্ধে অংশ নিয়ে স্ত্রীর কথা ভুলে গেছে। জেনজুরো সেই যুদ্ধের মধ্যেই স্ত্রী-সন্তানের কথা ভুলে এক অভিজাত নারীর অঙ্কশয্যায় বিভোর। কারো উদ্বেগ যেনো নেই। তাদের অন্তঃসারশূন্য মনোভূমি দেখতে পাই, বিশেষত জেনজুরোর।
পৃথিবীর যব যুদ্ধই নারীর উপর দিয়ে একই পরিণতি বয়ে আনে।
মিজোগুচি উগেতসুতে এমন সব মানুষের সাক্ষাৎ ঘটিয়েছে, তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ পায়ের উপর যন্ত্রণাদগ্ধ। শান্তি নেই। উপশম নেই কিছুতেই। সৈন্যদেরও দেখি শেষে খাবার ছিনিয়ে খেতে। অনাহারে শরীর সামলাতে না পেরে বারবার আছড়ে পড়তে। বিশেষত নারীর উপর যা যা প্রবাহিত হতে পারে, বিভীষিকাময়, সবিই দেখি।
এমনই, শেষ দৃশ্যে পুত্র জেনিসি ধোয়া ওঠা এক বাটি স্যুপ তার মা মিয়াগির কবরে রাখে। যেন সে বেঁচে আছে, বেঁচে থাকাদের মতো করে—ঋত্বিক ঘটকের তিতাস একটি নদীর নাম-এ অনন্ত যেমন নদীর পাড়ে ভাত ছিটায় কাকরূপে মা এসে খাবে বলে। সেই সান্ত্বনাটুকু কোথায়, মিয়াগির!
‘উগেতসু’র শুরুতেই জানতে পেরেছি ১৬ শতকের সিভিল ওয়ারের কাল এটা। যুদ্ধ মানুষকে যা দেয়—ধর্ষণ, খুন, অনিশ্চয়তা, ভীতি, বীরত্ব-ভীরুতা এবং অন্তঃসারশূন্যতার সবগুলো দিক।
১৯৫৩ সালে নির্মিত কেনজি মিজোগুচি’র এই ছবিটি বাস্তব জগতের সঙ্গে রূপকথা ও ফ্যান্টাসির মিশ্রণ ঘটিয়ে নিরেট বাস্তবতাকে, যা আসলেই বাস্তব, তাকে, কল্পদৃশ্যের মধ্যে নিপতিত করেছে। যে কারণে দর্শক কোথাও না কোথায় নিজেকে কল্পনায় স্থাপিত করে নিতে পারে।
উগেতসুর প্রায় সব চরিত্রই, অন্তত যাদের ব্যাপ্তি আছে, তাদের পাপেটের মতো চলাফেরা করতে দেখি। তারা কোমর সোজা না করে ছোটাছুটি করে। নেপথ্য সংগীত বা বাদ্য তাদের হাড়ে-রক্তে বাজে, বা নিংড়ে নেয় সবটুকুই।
গ্রামে সৈন্য ঢুকে পড়ে। চলে লুঠতরাজ। নারী অপহরণ। নির্যাতন। গ্রামের মানুষ পালাচ্ছে যে যার মতোন। জেনজুরো-টোবেই পরিবার তাদের সঙ্গে জঙ্গলে লুকায়। যুদ্ধের গতিবিধি বুঝতে চেষ্টা করে।
কিন্তু তাদের আছে বেঁচে থাকার স্বপ্ন। তারা তৈজসপত্র নৌকায় বোঝাই করে রওনা হয়, লেক পাড়ি দিয়ে পৌঁছুবে শহরে, মাঝপথে কুয়াশার মধ্য দিয়ে আরেকটি নিরুদ্দেশ নৌকা ভেসে এলে দেখে আহত এক মাঝি, পানি চায়, পান শেষে মৃত্যু হলে ওই কুয়াশার ওপারে কী আছে তা বুঝতে বাকি থাকে না। আবার ফিরে আসে গ্রামে। গ্রাম শহর দুটোই অনিরাপদ।
টোবেই’র স্বপ্ন সে সামুরাই (প্রাক-শিল্প যুগের জাপানী যোদ্ধা) হতে চায়। তৈজসপত্র বিক্রির পয়সা দিয়ে বর্ম কেনে, যুদ্ধাস্ত্র কেনে। তবে তাকে সঙ্ঘবদ্ধ কোনো দলের সঙ্গে দেখা যায় না। ফাঁকতালে সে এক সৈন্যকে হত্যা করে তার কাছ থেকে প্রতিপক্ষ এক শীর্ষ ব্যক্তির কাটামুণ্ডু ছিনিয়ে নিয়ে বিজয়ী নেতৃত্বের কাছে অর্পন করে। মুহূর্তেই সে সেনানায়কে পরিণত হয়। ঘোড়া ও আরো সরাঞ্জম পেয়ে, সৈন্য সমেতে বের হয় শহরের পথে। যেভাবে জুলিয়াস সিজার শহরে প্রবেশ করলে মানুষের আনন্দধ্বনি চারপাশ গোলজার করে।
নারীদের আহ্বানে পথে এক বেশ্যালয়ে ঢুকে পড়ে তোবেই তার সৈন্যসমেতে। সে এখন মর্যাদাবান ব্যক্তি। কিন্তু পানাহারের মধ্যে স্ত্রীকে আবিষ্কার করে পয়সা না দিয়ে পালানো খদ্দের পাকরাও করা অবস্থায়। স্ত্রীর কুয়োয় ঝাঁপ দিতে উদ্যত হলে তারা পরস্পরের ভালোবাসার উত্তাপ স্পর্শ করলে বুঝতে পারে, যুদ্ধই এসবের কার্যকারণ। তারা সানন্দে গ্রামের পথে পা বাড়ায়। নদীতে ছুড়ে ফেলে সাধের বর্ম ও অস্ত্র। আবার নতুন করে বাঁচার আশা।
অপরদিকে, জেনজুরো, তোবেই যখন যায় বর্ম কিনতে তখন সে পতিত হয় এক কল্পরাজ্যে। তৈজস বিক্রির সময় এক সম্ভ্রান্ত নারী তার পরিচারিকা সহ শহরের বাজারে এসে তার প্রণয়মুগ্ধ হয়। যদিও জেনজুরো শুরুতে তা বুঝতে পারে না। তৈজস হাতে সে তাদের অনুসরণ করে গৃহে এসে বোঝে এক ফ্যান্টাসির জগতে সে হতে যাচ্ছে রতিরাজা। নিজে বেমালুম ভুলেও যায়, গোপনও রাখে স্ত্রী-সন্তানের কথা, যে স্ত্রীকে বুদ্ধ-মন্দিরে ফেলে সৈন্যরা ধর্ষণ করে শেষে কয়টি পয়সা ফেলে যায়।
অডিসিয়াস ট্রয়ের যুদ্ধ শেষে ইথাকায় ফেরার পথে সদলবলে এক কামুক দেবী ও তার লাস্যময়ীদের দ্বারা ছলনার শিকার হয়ে রতিরসে ভুলে যায়। যখন সম্বিত ফেরে তখন অনেকগুলো বছর পেরিয়ে যায়। ওদিকে ইথাকায় তার স্ত্রীকে অধিকার করতে সম্ভ্রান্তরা প্রতিযোগীতার লিপ্ত।
জেনজুরো যুদ্ধের এই অনিশ্চয়তার সময় অডিসিয়াসের মতো পরিবারের কথা ভুলে সুরা ও সঙ্গে বিভোর। কিন্তু একদিন সে ধরা পরে, স্বীকার করে স্ত্রী-সন্তানের কথা। আবার লেডি ওয়াকাসার স্বামী যে কিনা, মারা গেছে বলে সংবাদ পেয়েছে, সেও শেষে ফিরে আসে।
জেনজুরো বাড়ি ফিরে দেখে স্ত্রী উনুনের কাছে, সন্তান ঘুমাচ্ছে। স্বাভাবিক আলাপ ও পানাহার শেষে সন্তানের পাশে ঘুমিয়ে পড়ে সে। যেনো যুদ্ধ তার স্ত্রী-সন্তানের গায়ে ফুলের টোকাটিও দেয়নি। কিন্তু তার ভ্রম কাটে যখন সকালে জানতে পারে তার স্ত্রী নিহত হয়েছে অনেক আগেই। গতরাতে স্ত্রী যেখানে বসে ছিল সেখানে সে হাত বাড়িয়ে বুঝতে চেষ্টাও করে আসলেই তার স্ত্রী আছে কিনা। তখন তার কবরের কাছে গিয়ে কাঁদা ছাড়া পথ থাকে না।
তোবেই যুদ্ধে অংশ নিয়ে স্ত্রীর কথা ভুলে গেছে। জেনজুরো সেই যুদ্ধের মধ্যেই স্ত্রী-সন্তানের কথা ভুলে এক অভিজাত নারীর অঙ্কশয্যায় বিভোর। কারো উদ্বেগ যেনো নেই। তাদের অন্তঃসারশূন্য মনোভূমি দেখতে পাই, বিশেষত জেনজুরোর।
পৃথিবীর যব যুদ্ধই নারীর উপর দিয়ে একই পরিণতি বয়ে আনে।
মিজোগুচি উগেতসুতে এমন সব মানুষের সাক্ষাৎ ঘটিয়েছে, তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ পায়ের উপর যন্ত্রণাদগ্ধ। শান্তি নেই। উপশম নেই কিছুতেই। সৈন্যদেরও দেখি শেষে খাবার ছিনিয়ে খেতে। অনাহারে শরীর সামলাতে না পেরে বারবার আছড়ে পড়তে। বিশেষত নারীর উপর যা যা প্রবাহিত হতে পারে, বিভীষিকাময়, সবিই দেখি।
এমনই, শেষ দৃশ্যে পুত্র জেনিসি ধোয়া ওঠা এক বাটি স্যুপ তার মা মিয়াগির কবরে রাখে। যেন সে বেঁচে আছে, বেঁচে থাকাদের মতো করে—ঋত্বিক ঘটকের তিতাস একটি নদীর নাম-এ অনন্ত যেমন নদীর পাড়ে ভাত ছিটায় কাকরূপে মা এসে খাবে বলে। সেই সান্ত্বনাটুকু কোথায়, মিয়াগির!
No comments