‘মাসে এক-দুই হাজার করে টাকা জমিয়ে হজে’
বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর যে হাজার হাজার মানুষ সৌদি আরবে হজ পালন করতে যান, তাদের একটি বিরাট অংশই সারাজীবনের উপার্জন থেকে অল্প অল্প করে সঞ্চয় করেন এর অর্থ। বেশিরভাগেরই থাকেনা বিদেশে যাবার পূর্ব অভিজ্ঞতা। চলতি বছর বহু বাংলাদেশীর হজযাত্রা নিয়ে যে বিড়ম্বনার খবর আসছে, তাদেরও অধিকাংশই এরকম বাংলাদেশী মধ্যবিত্ত, যারা প্রায় সারাজীবন ধরে আর্থিক, মানসিক ও শারিরীক প্রস্তুতি নিয়েছেন। তেমনই একজন ঢাকার দনিয়া এলাকার একটি বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ রাশেদুল হাসান। তিনি এবার হজ্বে যাচ্ছেন। শিক্ষক রাশেদুল হাসান বহু বছর ধরে হজযাত্রার প্রস্তুতি নিয়েছেন। তার হজযাত্রায় ব্যয় হচ্ছে প্রায় আড়াই লাখ টাকার মতো। আর সাথে নিয়ে যাবেন সত্তর হাজার টাকার মতো। "এই টাকা জোগাড় করা সহজ ছিল না। কঠিন ছিল আমার জন্য। অনেক বছর ধরে আমি টাকা জমাচ্ছিলাম। মানুষ ফ্ল্যাট কেনার জন্য টাকা জমায়। আমি হজের জন্য জমাইছি। আমার ইনকাম থেকে প্রতি মাসে এক-দুই হাজার করে টাকা জমিয়েছি"- বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন রাশেদুল হাসান। নিজের বাবার হজ করার ইচ্ছা থেকে রাশেদুল হাসানের তাড়াতাড়ি হজের প্রতি আগ্রহ জন্মায়। "আমার আব্বার খুব ইচ্ছা ছিল হজ করবার। তিনিও টাকা জমিয়েছিলেন অনেকদিন ধরে। এই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন তিনি। অবসরগ্রহণের শেষ পর্যন্ত লাখখানেক টাকা জমাতে পারলেও শারিরীক অবস্থার জন্য তিনি আর হজে যেতে পারলেন না। এটা ২০০৯ সালের কথা। আব্বার অবস্থা দেখে আমার মনে হলো তাড়াতাড়ি আমাকে যেতে হবে। কারণ আমিও শারিরীক সক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারি"- বলছিলেন শিক্ষক রাশেদুল হাসান। কষ্ট করে টাকা জমিয়ে হজের ইচ্ছা পূরণ করছেন এই শিক্ষক।
পরিবারের জন্য দুই মাসের খরচ রেখে হজে যাচ্ছেন মি: হাসান। "মনের মধ্যে ভিন্ন এক অনুভূতি কাজ করছে। এর আগেতো কখনো বিদেশ যাইনি। তারপর হজ করতে যাচ্ছি। কেমন যে একটা ফিলিংস বুঝানো যাচ্ছে না" -নিজের অনুভূতি এভাবেই প্রকাশ করেছেন শিক্ষক রাশেদুল হাসান। হজ থেকে কত টাকা আয় করে সৌদি আরব? সারা পৃথিবী থেকে লক্ষ লক্ষ মুসলমান প্রতি বছর হজ করতে সৌদি আরবে যান। আর ঠিক ওই সময়টাতেই সৌদি আরবের আর্থিক লেনদেনের হার অনেকটাই বেড়ে যায়। অনেকের মনেই এই প্রশ্নটা আসে যে সৌদি আরবে হজ আর আল-উমরাহ-করতে যেসব মুসলমান যান, তাঁদের কাছ থেকে দেশটি আসলে কত অর্থ রোজগার করে? সৌদি আরবের অর্থনীতির কত ভাগ এই রোজগার থেকে আসে? এই বিষয় নিয়ে বিবিসির ফার্সি বিভাগের আলী কাদিমি বিশেষ প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। অর্থের অঙ্ক বের করতে গেলে প্রথমেই দেখা দরকার -হজ করতে ঠিক কত সংখ্যক মুসলমান সৌদি আরবে যান? গত বছর মোট ৮৩ লক্ষ মানুষ হজ করতে গিয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে ৬০ লাখেরও বেশি মানুষ আল-উমরাহতেও গিয়েছিলেন। গত এক দশকে গড়ে ২৫ লক্ষ মুসলমান হজ করেছেন। এর মধ্যে আবার দুটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। প্রথমত, বছরে একটা নির্দিষ্ট সময়েই হজ করা যায়। আর দ্বিতীয়ত, প্রতিটি দেশ থেকে কত মানুষ হজে আসবেন, তার একটা কোটা নির্ধারণ করে দেয় সৌদি আরব। এটাও মাথায় রাখতে হবে যে সৌদি আরবের বাসিন্দাদের একটা বড় অংশও কিন্তু হজে যান। যদিও তাঁরা বিভিন্ন দেশের নাগরিক হতেই পারেন। গত বছর সৌদি আরবের যত বাসিন্দা হজে গিয়েছিলেন, সেই সংখ্যাটা অন্যান্য দেশ থেকে আসা মুসলমানদের সংখ্যার প্রায় অর্ধেক। কিন্তু গত দশ বছর ধরেই মোটামুটিভাবে হাজিদের এক তৃতীয়াংশই সৌদি আরবের বাসিন্দা। এর একটা কারণ মক্কা খুব কাছে। তাই ধর্মীয় কর্তব্য মনে করে বেশ সস্তায় হজ সেরে নেন অনেকে। হজে একটা নির্দিষ্ট সময়ে যাওয়া গেলেও সারা বছর ধরে উমরাহ করতে যাওয়া যায়। যেমন গত বছরই প্রায় ৬০ লক্ষ মানুষ উমরাহ করতে গিয়েছিলেন। নানা দেশ থেকে যাঁরা সৌদি আরবে গেছেন, তাঁদের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষই উমরাহ করতে গেছেন। সাত বছর আগে উমরাহ করতে যাওয়া মানুষের সংখ্যা ছিল ৪০ লক্ষের কাছাকাছি। সৌদি আরবের হিসাব অনুযায়ী আগামী চার বছরের মধ্যে সংখ্যাটা বেড়ে এক কোটি ২০ লক্ষ হয়ে যাবে। গত বছর হজ থেকে সৌদি আরবের সরাসরি রোজগার হয়েছিল প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার। সৌদি আরবে যাওয়া তীর্থযাত্রীরা মোট ২৩ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছিলেন ওখানে গিয়ে। এই অর্থের একটা বড় অংশ কিন্তু সৌদি অর্থনীতিতেই যোগ হচ্ছে। মক্কার চেম্বার অব কমার্সের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাইরের দেশ থেকে আসা মুসলমানরা মাথাপিছু ব্যয় করেন ৪৬০০ ডলার, আর স্থানীয়রা মাথাপিছু প্রায় ১৫০০ ডলার ব্যয় করেন। তবে একেক দেশ থেকে আসা হজযাত্রীদের জন্য আবার একেক রকম খরচ। যেমন ইরান থেকে আসা মানুষদের মাথাপিছু ৩০০০ ডলার খরচ লাগে। এর মধ্যে যাত্রা, খাওয়া, কেনাকাটা সব খরচই ধরা হয়। পাকিস্তান, বাংলাদেশের যাত্রীদেরও মোটামুটি একইরকম খরচ হয়। ইরান থেকে আসা এক হজ যাত্রী নাম উল্লেখ না করার শর্তে বিবিসির ফার্সী বিভাগকে জানিয়েছেন যে এ বছর তাঁর হজের বাজেট প্রায় আট হাজার ডলার। এর মধ্যে নিশ্চয়ই তাঁর ব্যক্তিগত খরচও ধরা আছে। তবে কোনো না কোনোভাবে অর্থটা সৌদি অর্থনীতিতেই ঢুকছে। বিভিন্ন দেশের মধ্যে ইন্দোনেশিয়ার কোটাই সবচেয়ে বেশি। সেখান থেকে দুই লক্ষ কুড়ি হাজার মানুষ প্রতি বছর হজে যান। এটা মোট হজযাত্রী সংখ্যার প্রায় ১৪ শতাংশ। এরপরেই রয়েছে পাকিস্তান (১১%), ভারত (১১%) আর বাংলাদেশ (৮%)। নাইজেরিয়া, ইরান, তুর্কি, মিশর -এই দেশগুলোরও কোটা মোটামুটি একই রকম। অপরিশোধিত তেল বিক্রি করে সৌদি আরবের যা রোজগার হয়, তার থেকেও বেশি আয় করে তারা হজ থেকে। তবে তারা চেষ্টা করছে তেল বিক্রি করে তাদের আয় আরও বাড়াতে। ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড বা আইএমএফ ধারণা করছে, তেল উৎপাদন কম করার ব্যাপারে ওপেক যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার ফলে সৌদি আরবের অর্থনৈতিক উন্নয়নের হার এ বছর শূন্যে নেমে যাবে। সেদেশের সরকার সেই ক্ষতিটা অন্যান্য ক্ষেত্র থেকে পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে। যার মধ্যে একটা বড় ক্ষেত্র হলো ধর্মীয় পর্যটন থেকে আয়।
No comments