বিশ্বজিতের বাবার প্রতিক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া কী?

বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড সাম্প্রতিককালের একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা। সে সময়ে এ অমানবিক ঘটনাটি দেশের সর্বত্র আলোড়ন তুলেছিল। নির্মম, নিষ্ঠুর ও নৃশংস এ ঘটনা বিচলিত করেছিল নাগরিক সাধারণকে। ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর সকালে পথচারি বিশ্বজিৎ দাসকে বাহাদুর শাহ পার্কের কাছে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর দেশব্যাপী আলোড়ন তোলা এ মামলার রায় প্রদান করেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৪। বিচারিক আদালতের রায়ে ২১ আসামির মধ্যে ৮ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। এ হত্যা মামলার ডেথ রেফারেন্স তথা মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন ও আসামিদের আপিলের ওপর শুনানি শেষে ৬ আগস্ট হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ রায় প্রদান করেন। প্রদত্ত রায়ে উচ্চ আদালত নিন্ম আদালতে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া ৮ আসামির মধ্যে দু’জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল, ৪ জনের মৃত্যুদণ্ড পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন ও অপর দু’জনকে খালাস দেন। নিন্ম আদালতে যাবজ্জীবন দণ্ডিত ১৩ আসামির মধ্যে ২ জন খালাস পেয়েছেন। যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত সব আসামি পলাতক। তাদের ব্যাপারে উচ্চ আদালত কোনো মন্তব্য করেনি। আসামিদের সবাই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের কর্মী। ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর সকাল ৯টার আগে ঢাকার জজকোর্ট এলাকায় ১৮ দলীয় জোট ডাকা অবরোধ কর্মসূচির পক্ষে আইনজীবীরা মিছিল বের করেন। ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও কবি নজরুল কলেজের ছাত্রলীগ নেতারা তাদের ধাওয়া করেন। ছাত্রলীগের ধাওয়া খেয়ে মিছিলকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। সে সময় ভিক্টোরিয়া পার্কসংলগ্ন তেলের পাম্পের কাছে ৩টি ককটেল ফোটে। তখন বিশ্বজিৎ ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিল। সে ভয়ে দৌড়ে একটি ডেন্টাল ক্লিনিকের দোতলায় উঠে যায়। তার দৌড় দেখে ছাত্রলীগের নেতারা ককটেল ফোটানোর জন্য তাকে দায়ী করে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা তাকে রড দিয়ে পেটাতে থাকেন। ধারালো চাপাতি দিয়ে হাতের নিচে কোপ দেয়ার পর প্রাণে বাঁচতে বিশ্বজিৎ দৌড়ে নিচে নামেন। নিজের পরিচয় দেন; কিন্তু ঘাতকচক্র তার কোনো কথায় বিশ্বাস করতে চায়নি। বিশ্বজিৎ দাস হত্যা মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের রায় শুনে হতাশা ব্যক্ত করেছেন তার মা-বাবা। তারা বলেন, রাষ্ট্রের কাছে তাদের চাওয়া বিশ্বজিতের হত্যাকারীরা যাতে পার পেয়ে না যায়। বিশ্বজিতের বাবা অনন্ত দাস বলেন, প্রকাশ্যে ১০ থেকে ১২ জন আমার ছেলেটাকে কুপিয়ে হত্যা করল। ছেলেটা বাঁচার জন্য কতই না আকুতি করেছিল। পাষণ্ডরা দানবের মতো কুপিয়ে তাকে হত্যা করে। তাদের ছবি দেশের পত্রিকা ও টেলিভিশনে প্রকাশিত হল। তারপরও তাদের মৃত্যুদণ্ড পরিবর্তন করা হল! তাদের খালাস দিতে হল? বিশ্বজিতের মা বলেন, আশায় বুক বেঁধেছিলাম অপরাধীদের শাস্তি বাস্তবায়িত হবে। কিন্তু এখন কী হল! তাদের সাজা কমল, খালাস পেল। আমরা এ রায় মানি না। উচ্চ আদালতের রায় বের হওয়ার পর বিশ্বজিতের বাবা-মায়ের সঙ্গে একই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে সাধারণ মানুষ। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একই ক্ষোভ, কীভাবে এ ধরনের জঘন্য খুনিরা আইনের হাত থেকে রেহাই পেতে পারে! ঘটনার সময়ে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মন্তব্য করেছিলেন, বিশ্বজিতের পরিবার ন্যায়বিচার পাবে না। বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করে তারা ওই সময়ে যে মন্তব্য করেছিলেন, বিশ্বজিতের বাবার মুখে সে কথারই প্রতিধ্বনি শোনা গেছে। যারা বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে একটু-আধটু ধারণা রাখেন তারা সবাই জানেন, বিচারক রায় দেন আদালতে প্রদত্ত তদন্ত প্রতিবেদন, সাক্ষ্য-প্রমাণ ও পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনা করে। অবশেষে উচ্চ আদালত এ মামলায় অদক্ষতা, অবিশ্বস্ততা ও অলসতার বাস্তব প্রমাণ পেয়েছে। মামলার তদন্তকারী সূত্রাপুর থানার উপপরিদর্শক দায়িত্বে অবহেলা ও পেশাগত অসদাচরণ করেছেন কিনা তা তদন্ত করতে আদালত পুলিশের মহাপরিদর্শককে নির্দেশ দিয়েছেন। বিশ্বজিতের লাশের ময়নাতদন্তকারী সলিমুল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তৎকালীন ফরেনসিক বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী অধ্যাপক সম্পর্কে একই নির্দেশ দেয়া হয়েছে। উচ্চ আদালত স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ও বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের প্রতিও অনুরূপ নির্দেশ দেন। এ নির্দেশনা বাস্তবায়নের অগ্রগতি ও সময়ে সময়ে আদালতকে অবহিত করতে একজন আইনজীবীকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। রায়ের পর সরকার পক্ষ থেকে স্বীকার করা হয়, বিশ্বজিতের লাশের সুরতহাল রিপোর্ট ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে যে গুরুতর আঘাতের কথা উল্লেখ আছে, এর সঙ্গে সাক্ষ্য, আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, ভিডিও ফুটেজ ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে প্রতীয়মান হয়েছে, দুটো আইনি তদন্ত রিপোর্টই অসামঞ্জস্যপূর্ণ। তাই সঙ্গতভাবেই বিশ্বজিতের পিতার জিজ্ঞাসা ‘এত কিছুর পর যে রায় হল- আমার মনে বড় কষ্ট। আমি নিজে দেখেছি ছেলের সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত। হাতের নিচে কোপ, পিঠে কোপের সংখ্যা ৮টি। সারা শরীর রডের আঘাতে থেঁতলে গেছে। সুরতহাল করা পুলিশ সদস্য কিংবা ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক কেন এসব খুঁজে পেলেন না?’ উল্লেখ্য, সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের কারণে খুনিরা ছাড় পেতে পারে- এ আশঙ্কা থেকে বিশ্বজিতের বাবা ২০১৩ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করে তাদের আশঙ্কার কথা বলেছিলেন। ওই সময়ে বিশ্বজিতের পরিবার থেকে তদন্ত প্রতিবেদন দুটি প্রত্যাখ্যান করা হয়। তারা আরও অভিযোগ করেন, হত্যাকারীদের বাঁচানোর চেষ্টা চলছে। প্রথম থেকেই সরকারের তরফ থেকে অপরাধীদের প্রতি প্রশ্রয় লক্ষ্য করা যায়।
ঘটনাস্থলের কাছেই পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করলেও নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেন। সে সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ‘রানাপ্লাজার ঝাকা’ খ্যাত মহীউদ্দীন খান আলমগীর বলেছিলেন, ‘এ হত্যাকাণ্ডে ছাত্রলীগের জড়িত থাকার কোনো সম্ভাবনা নেই’। ঘটনা সম্পর্কে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রামাণ্য প্রতিবেদনের পর তার এ মন্তব্য নাগরিক সমাজে ক্ষোভ সৃষ্টি করে। ঘটনার পর থেকে আজ পর্যন্ত মামলার বিভিন্ন পর্যায়ে পুলিশের বিরুদ্ধে অসহযোগিতা ও প্রশ্রয়ের অভিযোগ উত্থাপিত হয়। ওই মামলার ২১ আসামির মধ্যে ১৩ জন এখনও অধরা রয়ে গেছে। পুলিশ বলছে তারা পলাতক। অথচ পত্রিকার প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, তারা ঢাকা শহরে ঘোরাফেরা করছে, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিচ্ছে। উচ্চ আদালতের মামলার পর সরকারি প্রতিক্রিয়াও এক রকম নেতিবাচক। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দু’জনের মৃত্যুদণ্ডের উল্লেখ করলেও অধিকাংশ আসামির সাজা হ্রাস বা ধরাছোঁয়ার বাইরের বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। উল্লেখ্য, ছাত্রলীগের ওইসব নেতা বলে আসছিলেন, তাদের কিছুই হবে না। এখন ঘটনাক্রমে তাদের বড়াই সত্যে পরিণত হতে চলেছে। ক্ষমতাসীন সরকারের দলপ্রীতি সম্পর্কে ধারণা রাখেন এমন পর্যবেক্ষকদের মন্তব্য, চূড়ান্ত পর্যায়ে যে দু’জনের ফাঁসি হয়েছে, তারাও হয়তো মাফ পেয়ে যাবেন। ক্ষমতাসীন সরকারের এ ধরনের আসামিদের মাফ করার নজির রয়েছে। সাম্প্রতিককালে দণ্ডপ্রাপ্ত দলীয় ভয়ংকর অপরাধীদের মাফ করার একটি প্রক্রিয়ার কথা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ‘ইদানীং ছাত্ররাজনীতি তার জৌলুস হারিয়ে দূষিত হয়ে পড়েছে। কিছু বিপথগামী তরুণ যারা চাঁদাবাজি, অস্ত্র-মাদক ব্যবসা, খুন, রক্তারক্তিতে জড়িয়ে পড়েছে, ওপরের সারির কিছু নেতা তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন।’ এ পর্যবেক্ষণ যে অসত্য নয়, চারপাশে তাকালেই তার প্রমাণ মিলবে। আর কতদিন এরকম বিশ্বজিৎরা হত্যার শিকার হয়েও বিচার পাবে না? ন্যায়বিচার এমনি এমনি প্রতিষ্ঠিত হয় না। সেজন্য সমাজেরও দায় আছে, দায়িত্ব আছে।
আবদুল লতিফ মাসুম : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
mal55ju@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.