মার্কিন ঘাঁটিতে সত্যিই হামলা হবে?
উত্তর কোরিয়া এ মাসের মাঝামাঝি সময়ে গুয়ামে মার্কিন ঘাঁটির কাছে চারটি মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার কথা বলেছে। বিবিসি অনলাইনসহ অন্যান্য সংবাদমাধ্যমে আজ বৃহস্পতিবার উত্তর কোরিয়ার এ হুমকির কথা জানানো হয়। এর আগে গতকাল বুধবার তারা বেশ তেড়েফুঁড়েই বলেছে যে গুয়ামে মার্কিন ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর বিষয়টি বিবেচনা করছে তারা। এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত মার্কিন অবস্থান হচ্ছে গুয়াম। একই সঙ্গে বিমান ও নৌঘাঁটি রয়েছে কোরীয় উপদ্বীপ আর দক্ষিণ চীন সাগরের মধ্যবর্তী এই স্থানে। উত্তর কোরিয়ার বার্তা সংস্থা কেসিএনএর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গুয়ামে মার্কিন অবস্থানে মাঝারি থেকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার কথা সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করছে পিয়ংইয়ং। এই ক্ষেপণাস্ত্র পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্র (ওয়ারহেড) বহনে সক্ষম। এমন ঘটনা যদি ঘটে, তাহলে তা হবে রাজগোখরার লেজে কোপ মারার মতো একটা বিষয়। পরিণতি ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ যে ডেকে আনবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এর আগেও উত্তর কোরিয়া অনেক হুমকি-ধমকি দিয়েছে। কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডে আঘাত হানার মতো সক্ষমতা অর্জনের কথাও জানান দিয়েছে। কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালানোর দুঃসাহস প্রদর্শন এটাই প্রথম। প্রশ্ন উঠেছে, উত্তর কোরিয়া সত্যিই কি মার্কিন ওই ঘাঁটিতে হামলা চালাবে? কেন চালাবে? একটু গভীরে যাওয়া যাক। মার্কিন ছত্রচ্ছায়ায় একের পর এক নিষেধাজ্ঞার জালে উত্তর কোরিয়া আষ্টেপৃষ্ঠে কোণঠাসা। সে দেশের মানুষ খেতে পায় না, দুর্ভিক্ষে প্রাণ যায়—এমন খবর প্রায়ই শোনা যায়। তাই বলে তাদের উচ্চাভিলাষী পারমাণবিক কর্মসূচি থেমে নেই। মরব, তবু বশ্যতা নয়—বাবার এই নীতিতে অটল থেকে একনায়কত্বের হাতল শক্ত করে ধরে রেখেছেন কিম জং-উন। ইরাক, লিবিয়া, তিউনিসিয়া, ইয়েমেন, মিসর—এসব দেশের একনায়কেরা পরাজয়ের পর কী পরিণতি বরণ করেছেন, তা তো তাঁর ভালো করেই জানা। এ কারণে পিছু হটার চেয়ে লড়াই করে টিকে থাকার পথ বেছে নিয়েছেন কিম জং-উন। এখানে দেশটির লক্ষ্যের চেয়ে বরং নেতা উনের একগুঁয়েমিটাই মুখ্য। এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের আরেক বড় দেশ চীন দেখছে, এখানে উড়ে এসে জুড়ে বসা মার্কিন আধিপত্য যদি কিঞ্চিৎ পরিমাণও খর্ব হয়, তবে তার প্রভাব বিস্তারের সুযোগটা বাড়ে। এ জন্য ঠারেঠোরে উত্তর কোরিয়াকে মদদ দিচ্ছে তারা। ভাবগতিক পরিষ্কার,Ñএগিয়ে যাও, বন্ধু। আমরা আছি তোমার সঙ্গে। ট্রাম্প এরই মধ্যে চীনের নীরব থাকার ভূমিকার কঠোর নিন্দা করেছেন। চীন সোজাসুজি বলেছ, তারা এসব ঝুটঝামেলায় নেই। এই সাহস আরও উসকে দিয়েছে উত্তর কোরিয়াকে। উনের এখন একটাই ব্রত—লড়ো না হয় মরো। গত সোমবার উত্তর কোরিয়ার ওপর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি বিদ্যমান উত্তেজনায় বারুদে ঠাসা স্ফুলিঙ্গ। বিশেষ করে উত্তর কোরিয়ার জন্য। সে দেশের মানুষ নানা নিষেধাজ্ঞায় এমনিতেই স্বাভাবিক সুন্দর জীবন থেকে বঞ্চিত, এর মধ্যে নতুন নিষেধাজ্ঞা তাদের জীবনকে আরও বিষিয়ে তুলবে। উত্তর কোরিয়ার অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিতেই এসব নিষেধাজ্ঞা। তাদের কোনো মানবসম্পদ বিদেশে যাবে না। তাদের সামুদ্রিক খাবার কেউ কিনবে না। খনিজ সম্পদ কেউ নেবে না। অবশ্য চীন আর রাশিয়া তলে তলে তাদের অপরিশোধিত তেল নিয়ে আর্থিক ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও সহায়তা করছে। জাতিসংঘ নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পরই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘটালেন আরেক বিস্ফোরণ। গত মঙ্গলবার তিনি বলেছেন, উত্তর কোরিয়া সবচেয়ে ভালো করবে আমেরিকাকে আরও কোনো হুমকি না দিলে। তাহলে তারা এমন গুলি আর আতঙ্কের মুখে পড়বে, যা এর আগে বিশ্ব কখনো দেখেনি। ট্রাম্পের এই হুমকির পরই গতকাল যুক্তরাষ্ট্রকে নতুন করে হুমকি দিয়েছে উত্তর কোরিয়া। এই হুমকিকে ‘ফালতু বড়াই’ বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মঙ্গলবার ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, উত্তর কোরিয়া এই প্রথম এমন এক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করেছে, যা ছোটখাটো হলেও পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্র বহনে সক্ষম। সে ক্ষেত্রে উত্তর কোরিয়া তাদের পলে পলে চেপে ধরা যুক্তরাষ্ট্রকে পাল্টা জবাব দেওয়ার হিম্মত দেখাতে পারে। কিম জং-উন অন্যান্য একনায়কের মতো এই নীতিতে এককাট্টা হতে পারেন, মরেছি যখন মেরেই মরি! সে ক্ষেত্রে হামলার জন্য সবচেয়ে কাছের মার্কিন ভূখণ্ড গুয়ামকে বেছে নেওয়াটা বিচিত্র কিছু নয়। কোরীয় উপদ্বীপ ও দক্ষিণ চীন সাগরের মাঝখানে থাকা গুয়াম একটি প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ। সেখানে দেড় লাখের বেশি মানুষের বাস। তারা মার্কিন নাগরিক বটে, তবে তারা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দিতে পারেন না। সেখানে মার্কিন বিমানঘাঁটি রয়েছে, যা অ্যান্ডারসেন এয়ার ফোর্স বেস নামে পরিচিত। এ ছাড়া একটি নৌঘাঁটিও রয়েছে। মার্কিন সেনা রয়েছে ছয় হাজারের মতো। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যাশটন কার্টার এই এলাকাকে ‘পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অবস্থান’ বলে বর্ণনা করেন। ১৮৯৮ সালে স্প্যানিশ-আমেরিকান যুদ্ধের পর এই ভূখণ্ড যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে পার্ল হারবারে হামলার দুদিন পর এটি চলে যায় জাপানি সেনাদের কবজায়। জাপানি সেনাদের ওই হামলায় প্রায় এক হাজার মানুষ নিহত হয়। ১৯৪৪ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর গুয়াম আবার দখল করে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। কাজেই এই ভূখণ্ড তাদের অনেক কষ্টের ফসল। গুয়ামে কোনো হামলা যেমন যুক্তরাষ্ট্র মেনে নেবে না, তেমনি উত্তর কোরিয়ার হুমকিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ারও কোনো কারণ নেই। কারণ, শত বাধার মুখেও কিন্তু তারা পারমাণবিক কর্মসূচি অটলভাবে এগিয়ে নিয়ে গেছে। কেবল তা-ই নয়, কাঙ্ক্ষিত সাফল্যও এসেছে। কিম জং-উন যেমন খ্যাপাটে, ট্রাম্পও কিন্তু যথেষ্ট গোলমেলে। কথায় আর কাজে একের পর এক ফারাক দেখিয়ে এর মধ্যে আন্তর্জাতিক মহলে একটা ধূম্রজাল তিনি তৈরি করে ফেলেছেন। এই ধোঁয়া থেকে যে কী হয়, তা দেখার বিষয়।
শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: সাংবাদিক, সাহিত্যিক
sharifrari@gmail.com
শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: সাংবাদিক, সাহিত্যিক
sharifrari@gmail.com
No comments