ট্রাফিক জ্যামের নষ্ট শ্রমঘণ্টা বনাম অন্যান্য পণ্ডশ্রম

ট্রাফিক জ্যামে প্রতিদিন ঢাকাবাসীর কত শ্রমঘণ্টা নষ্ট হয়, সেই হিসাবে বসবো না আমরা এখন। নন-ট্রাফিক অন্যান্য পণ্ডশ্রমের খতিয়ানটা একটু যাচাই করা হবে এ লেখায়। আগেই বলে দেয়া যায়, হিসাব শেষে দেখা যাবে ট্রাফিক জ্যামে নষ্ট হওয়া শ্রমঘণ্টার চেয়ে অন্যান্য পণ্ডশ্রমের সময়ের পরিমাণ অনেক অনেক বেশি। অথচ ট্রাফিক জ্যাম নিয়েই যত দুশ্চিন্তা আমাদের। হতে পারে পণ্ড হয়ে যাওয়া অন্যান্য শ্রমঘণ্টা যে আসলেই বৃথা গেছে, সেটাই বুঝতে পারছি না আমরা। প্রথম যে কথা- যে কেউই হতে পারেন, তিনি কতক্ষণ পড়েন তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনি কী পড়েন; কতক্ষণ কথা বললেন তার চেয়ে মূল্যবান তিনি কী বলেছেন; কোথায় যাচ্ছেন তার চেয়ে বেশি বিবেচ্য তিনি কেন সেখানে যাচ্ছেন। একইভাবে কত কাজ করলাম তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কী করলাম। রাজনীতির ওপর ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে কিছুদিন গ্রামে থাকব বলে পাটগ্রামে গেলাম যখন, কয়েকদিন পর এক সুহৃদ বলল- অমুক ভাবীর সঙ্গে আপনার পরিচয় ঘটা উচিত। উনি খুব পড়ুয়া। তো সরল বিশ্বাসে গেলাম একদিন তার কাছে। দু’টি শেলফে গাদাগাদি করে রাখা বইয়ের স্তূপ। কিন্তু বইগুলোর পুটে মুদ্রিত বই ও লেখকের নাম দেখে মনে মনে আওড়াতেই হল- water, water everywhere, nor any drop to drink. কোনো প্রতিষ্ঠানের বই হলে ভিন্ন কথা, ব্যক্তি-লেখকের বই প্রকাশ করতে কোনো যোগ্য কর্তৃপক্ষের অনুমোদন লাগে না, সেজন্যই বোধকরি যুক্তিবিদ্যার একটি কথা এমন যে- All the printed words are not true - মুদ্রিত সব কথাই সত্য নয়। এই সত্য মানে শুধু facts নয়- শুদ্ধ চিন্তা, মনোরঞ্জনের খোরাক ইত্যাদিও এর সঙ্গে যুক্ত। আমি নিশ্চিত হলাম, অতিরিক্ত সুগার যেমন কিডনি ড্যামেজ করে, এই বইগুলোর অতিরিক্ত পাঠ ওই নারীর মাথা নষ্ট করে দিয়েছে। শুধু চা খেয়েই চলে এসেছিলাম সেদিন। এ পর্যায়ে পাঠকের একটা ধমক খাওয়ার আশংকা তৈরি হয়েছে। পাঠক বলবেনই- যার মানসিক স্তর যেমন, সে তো তেমন বই-ই পড়বে এবং তা থেকে আনন্দ পাওয়ার চেষ্টা করবে। আপনার অসুবিধা কী? না, আমার কোনো অসুবিধা নেই। কত লোকই তো মিথ্যাকে সত্য জানছে, যে কথায় বা কাজে বিরক্তি উৎপাদন হওয়ার কথা, সে কথায় হাসছে তো হাসছেই এবং এভাবে আনন্দ পেতে পেতে একদিন মরেও যাচ্ছে। কখনও বা মরছে তৃপ্তি সহকারেই, হলি আর্টিজানের পাঁচ যুবক যেমন মরেছিল। তারা যে শ্রম দিয়েছে, সেটা তাদের দৃষ্টিতে সার্থক অবশ্যই। তবে তাদের এই উপলব্ধি বা দৃষ্টিভঙ্গি মানবজাতির এক বড় নির্মমতা। কত নিষ্পাপ মনে মানুষ অল্পকে বড় জ্ঞান করে, কখনও বা ভ্রান্তিকে জড়ায় মায়াবন্ধনে! দেশের এক জনপ্রিয় ঔপন্যাসিকের যত বই পড়েছি আমি, শব্দার্থেই সেই সংখ্যা বহুবচন হয়নি। তার একটির বেশি বই না পড়লেও আমার মধ্যে কোনোই বঞ্চনাবোধ নেই যে, আমি বাংলা সাহিত্যের কণামাত্র মিস করছি। হ্যাঁ, তার আরও বই পড়তাম, পড়তে বাধ্য হতাম, যদি সেসবের চেয়ে মূল্যবান ও উপকারী বই পৃথিবীতে আর না থাকত। আমার সময় কম, মহাকালের প্রেক্ষাপটে বিদ্যুৎ ঝলকের মতো স্থায়িত্ব আমার এই ভুবনে- আমি তাই ডারউইনের ‘অরিজিন অফ স্পেসিস’ পড়ব, নাকি একজন মধ্যবিত্ত হিসেবে যা আমার অভিজ্ঞতার মধ্যেই রয়েছে, সেগুলো নতুন করে কথিত জনপ্রিয় উপন্যাসটির মধ্যে খুঁজব? হ্যাঁ, উপন্যাসও পড়তে হবে আমাকে, তবে নষ্ট করার মতো অতিরিক্ত সময় নেই বলে পড়ব মানিক, বিভূতি অথবা পরবর্তীকালের আরও অনেক বাংলা উপন্যাস, ন-বাংলার বিশাল ভাণ্ডারের দিকেও বাড়াব হাত। মরতে তো একদিন হবেই, এই জগৎ ও তার প্রাণীকুল সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা নিয়ে মরলে ভালো হয় না? সময়টা তাই ভাগ করা চাই যথেষ্ট অনুপাত জ্ঞান নিয়ে। তবে হ্যাঁ, উন্নতমানের গ্রন্থ পড়ার মানসিক উৎকর্ষ যদি এই লেখকসহ কারও না থাকে, সেটা ভিন্ন কথা। এটা দুর্ভাগ্য। কে যেন বলেছেন- দিনভর ঝুম বৃষ্টি, অথচ পড়তে জানে না, তার মতো দুর্ভাগা আর কেউ নেই। নতুন লেখকরা কি ক্ষেপলেন? কেন ক্ষেপবেন? আমি সবই পড়তে রাজি আছি, তবে প্রথমে দেখতে হবে লেখাটিতে যা রয়েছে বলে ধারণা করি, তা সময়ের মূল্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা। অথবা লেখাটি পাঠযোগ্য না হলেও পড়তে হতে পারে, যদি সেটা আমার বিশেষ কোনো কাজে আসে। পড়ার প্রশ্নটা শেষ করে নিই আগে। আমরা যে একটা অসুস্থ জাতিতে পরিণত হয়েছি, তার বড় প্রমাণ এই রাজধানীতে কদম ফেললেই পাওয়া যাবে ওষুধের দোকান; কিন্তু বই কেনার দোকান নেই, থাকলেও রিকশা ভাড়া দিতে হবে একশ’ টাকা। ইউরোপ-আমেরিকায় ওষুধ কিনতে হলে প্রেসক্রিপশন এক হাতে নিয়ে অন্য হাতে ড্রাইভ করতে হবে অন্তত আধঘণ্টা। সুস্থরা তো কালেভদ্রেই ওষুধ খাবে, নাকি? আপনি লাজ ফার্মায় যান, এমন কোনো ওষুধ নেই যা পাবেন না, কিন্তু গেল বছর নোবেল পেয়েছে যে বইটি, সেটি তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখুন, অনুবাদ তো নেই-ই, অরিজিনালিটিও কেউ আমদানি করেনি। কলেজে পড়া অবস্থাতেই আমার একটা অহঙ্কার ছিল যে, আমি অনেক কিছুই জানি। ব্রিটিশ মিউজিয়াম লাইব্রেরি ও আমেরিকার কংগ্রেস লাইব্রেরিটি ঘুরে দেখার পর মনে হয়েছে ছাগলেরও অধম আমি। এখন মনে হয়, জানি হয়তো অনেক কিছুই; কিন্তু যেসব বিষয় জানি না, সেগুলো দিয়ে কমপক্ষে একশ’ কোটি গ্রন্থ রচিত হতে পারে। পড়া প্রসঙ্গে শেষ কথা- সময় যেহেতু খুবই কম, পঠিতব্যের একটা অগ্রাধিকার তালিকা থাকা চাই। তা না হলে পঠিত বইয়ের তালিকা যত দীর্ঘই হোক, তাতে সময়ের অপটিমাম সদ্ব্যবহার হয় না। দেশটায় একটা আজব কাণ্ড ঘটে চলেছে। এখানে অনবরত কথা বলে যেতে পারেন যিনি, তিনিই বনে যাচ্ছেন সেলিব্রিটি; কথাগুলো কী, তাতে কিছুই যাচ্ছে-আসছে না কারও। ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে, মানুষকে উত্তেজিত করতে পারলেই হল, কোন্ ইনজেকশন পুশ করে শ্রোতার শরীরে স্টিমুলি অর্থাৎ উত্তেজক ঢোকানো হয়েছে- কেউ ব্যাখ্যা করতে চাইবে না। বক্তার এই শ্রমকে শুধুই পণ্ডশ্রম বলা যাবে না, এ তারও অতিরিক্ত কিছু- সর্বনাশা শ্রম। আবার দেখুন, এ দেশে সবাই ব্যস্ত; কিন্তু কোনো ব্যস্তকে যদি বলা হয়- আপনার অ্যাচিভমেন্টগুলো একটু শুনি- তিনি কিছুই বলতে পারেন না। আমার এক অনুজপ্রতিমকে ফোন করলে হঠাৎ হঠাৎ রিসিভ করে, ম্যাক্সিমাম ক্ষেত্রে ফোনব্যাকও করে না। তো একদিন তারই কাজে লাগবে এমন একটা কল রিসিভ না করে অনেক পরে ব্যাক করল যখন, তাকে বললাম- তুমি কি ড. ইউনূস অথবা ফজলে হোসেন আবেদ? যদি না হও, তাহলে কীসের এত ব্যস্ততা? রাগ কমছিল না, আরও বললাম- দ্যাখো, বাঙালির কাজের চেয়ে কাজের আড়ম্বর বেশি। আমি তোমার চেয়ে অনেক বেশি কাজ করি, কই তারপরও তো আমার প্রচুর অবসর। অল্প সময়ে বেশি কাজ করার কিছু ফর্মুলাও শিখিয়েছি তাকে। তেমন একটা হতে পারে- ডান হাতে লিখছি, আর বাঁ হাতে প্রয়োজনীয় কলগুলো টিপছি অথবা রিসিভ করছি। রবীন্দ্রনাথ আটের পিঠে শূন্যের জীবন পেয়েছিলেন। এই সময়ে অ্যাপ্রেশিয়েটেড-আন্ডার অ্যাপ্রিশিয়েটেড প্রায় আড়াই হাজার পেইন্টিংসহ যা করেছেন, একই প্রতিভার অন্য কাউকে একই কাজ করতে হলে আটের পিঠে দুই শূন্যের জীবন দরকার হবে তার। আরেক ধরনের পণ্ডশ্রম লক্ষ করুন। সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করি বলে নতুন-পুরনো নির্বিশেষে লেখকদের ডিল করতে হয়। ধরা যাক, একটা চাঞ্চল্যকর ধর্ষণের খবর ছাপা হল। মেইল খুললেই দেখা যাবে একের পর এক আসছে সেই ধর্ষণের ওপর লেখা। এতে দোষের কিছু নেই, ধর্ষণের প্রতিক্রিয়া ভয়াবহ হবে- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পণ্ডশ্রম বলছি এজন্য যে, লেখাগুলোয় বর্বর, অমানবিক, নরপিশাচ, মূল্যবোধের অবক্ষয় ইত্যাদি কিছু নেতিবাচক কথা ছাড়া আর কিছুই নেই। ধর্ষক যে বর্বর অথবা এ ধরনের ঘটনার জন্য যে মূল্যবোধের অবক্ষয়ই দায়ী- এই অতি জানা কথাগুলো আবারও জানানোর যে চেষ্টা, সেটা পণ্ডশ্রম নয়তো কী? মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণগুলো ও তার প্রতিকারের যদি সুনির্দিষ্ট রিকমেন্ডেশন থাকত লেখাগুলোয়, তাহলেই না বলা যেত তা সার্থক শ্রম। অথচ তারপরও ছাপাতে হবে সেসব। না ছাপালে তারা ভাবেন, প্রতিভার মূল্যায়ন করিনি আমরা! পুরনো, জরাজীর্ণ, ক্লিশে, একঘেয়ে কথায় জর্জরিত হয়ে পড়েছে দেশ। তবে কি নতুন যারা বেড়ে উঠছে, তাদের জন্যই এসব পুরনো কথা? আমরা যেমন বারংবার বলে যাই বঙ্গবন্ধুর কথা, তা না হলে নতুন প্রজন্ম জানতেই পারবে না তাকে, তেমন? তাহলে তো সেসব কথা বলার আগে বলে নিতে হবে- এখন যে কথাগুলো বলা হবে, সেগুলো শুধু নতুন প্রজন্মের জন্য। আমরা একটা কাজ করতে পারি কিনা, ভেবে দেখা দরকার। পত্রিকার পাতা ও টেলিভিশনের পর্দা- লেখা ও অনুষ্ঠানগুলো নতুন ও পুরনো প্রজন্মে ভাগ করে ফেলতে পারি। পুরনোকে পুরনো কথা শুনিয়ে কী লাভ! হ্যাঁ, পুরনো কথা নতুন ঢংয়ে বললেও একটা কথা থাকত। রাজনৈতিক নেতাদের সব কথাই কেন পত্রিকার পাতায় অথবা টেলিভিশনে প্রকাশ করা হয়, সেটাও এক বড় ধন্দ। কিছু নিরর্থক কথা ব্ল্যাকআউট করলে কী এমন ক্ষতি! এসব কথা অনেকটা পত্রিকার বিনোদনের পাতায় প্রকাশিত কোনো উঠতি নায়িকা কোন্ মলে শপিং করতে যায় অথবা সে নানিকে না দাদিকে বেশি ভালোবাসে ইত্যাদি খবরের মতো গুরুত্বহীন। হুমায়ুন আজাদকে প্রায়ই মনে পড়ে। আশির দশকে রঙিন টেলিভিশনের সূচনা হল যখন, বলেছিলেন- বিটিভির আবর্জনাগুলো এবার রঙিন হল! কখনও কখনও আমার এমন মনে হয়, আচ্ছা একটা সপ্তাহ মিডিয়া বন্ধ থাকলে দেশটার কী হাল হবে, একবার পরীক্ষা করে দেখলে কেমন হয়? আমার ধারণা, তখনকার মিডিয়াহীন দেশ মিডিয়াসমেত দেশের চেয়ে ভালোই চলবে। উদ্বেগ নেই, উৎকণ্ঠা নেই, ফালতু কথার রিপ্রোডাকশন নেই, নিস্তেজ-নিস্তরঙ্গ সেই সমাজ এই কোলাহলপূর্ণ পরিবেশের চেয়ে খারাপ কীসে? কেউ হয়তো বলবেন, মিডিয়া না থাকলে তো অপরাধীদের পোয়াবারো। আমার প্রশ্ন- এখন কি তবে তাদের পোয়াতেরো? কী লাভটা হচ্ছে মিডিয়ার ভূমিকায়? আমরা তো ফাইনাল ব্যালান্সশিট দেখতে চাই, সেটাই বুদ্ধিমানের কাজ। সেখানে তো দেখছি একটা বিগ জিরো। বলাইয়া বইলা যায়, করাইয়া কইরা খায়! আমি আসলে লিখতে চেয়েছিলাম রাজনীতির পণ্ডশ্রম নিয়ে। এই পণ্ডশ্রমের পরিমাণ এত বেশি যে, সেজন্য আলাদা একটি লেখা হতে পারে। যেমন, জিয়াউর রহমান যখন একজন স্মার্ট প্রেসিডেন্ট হিসেবে কোদাল হাতে খালকাটা কর্মসূচির উদ্বোধন করেছিলেন- অনেকে ভাবলেন না জানি কী একটা মহাযজ্ঞ শুরু হবে এবার। কিছুদিন পর এক অর্থনীতিবিদ বললেন, এই পণ্ডশ্রমগুলো না করলেই কি চলত না প্রেসিডেন্ট সাহেবের! যাকগে, কেউ যেন আবার বুঝে না বসেন, অ্যামিউজমেন্ট অর্থাৎ আনন্দ-ফুর্তি পণ্ডশ্রমের অংশবিশেষ। মোটেও না, যেমন পণ্ডশ্রম নয় বার্ধক্যের পিতা-মাতার সেবা করা কিংবা অন্যের বিপদে এগিয়ে যাওয়া। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় হাসাহাসি, অলস সময়ে সঙ্গীতে মনোনিবেশ কিংবা লং জার্নির ক্লেদ গায়ে মেখে কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে সেই ক্লেদ ধুয়ে ফেলা- এ সবই চিত্তসুখ। সুখের আয়োজন কখনও পণ্ড হয় না। আমি একবার বাসে রংপুর যাচ্ছিলাম, পড়ছিলাম কী যেন একটা মূল্যবান লেখা। এক সময় ড্রাইভার সাঈদীর ওয়াজের ক্যাসেট ছেড়ে দিল। পড়া বন্ধ করে মহানন্দে শুনতে থাকলাম সেই ওয়াজ। ওটাকে পণ্ডশ্রম বলব না আমি। মিথ্যা ও অপযুক্তি এত মধুর হতে পারে! আমাদের ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে’র শক্তি সত্যও বলতে পারে না এত মধুর স্বরে। জনসংখ্যার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ তাই সাঈদীর মধুর মিথ্যাই শোনে, কর্কশ সত্য শুনতে চায় না। সাঈদীর প্রসঙ্গ যখন এলোই, তখন আরেকটু বলি। এদিক-সেদিক তাকাতে থাকলে কখনও না কখনও পাঠক দেখতে পারবেন- দুই লোক তর্ক করে যাচ্ছে। একজন বলছে- তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না। অন্যজন ধর্মের বিধিবিধান পালন তো করেনই না, বরং উল্টো পথে হাঁটেন; কিন্তু উপরের নাস্তিকের সঙ্গে তর্কযুদ্ধে বলছেন- আপনি যা-ই বলেন ভাই, আমি কিন্তু বিশ্বাসী, ধর্মও মানি। দু’জনই আসলে ফ্যাশনসর্বস্ব। দ্বিতীয়জনেরটা ফ্যাশন এ কারণে যে, তার বিশ্বাসে যদি খাদ না থাকে, তাহলে স্বর্গ-নরকের কথা ভেবে তাকে ধর্মের বিধান মানলেই চলবে না শুধু, তা পালনও করতে হবে। এর অন্যথা হওয়া মানে তা চরম বোকামি। তো এই দু’য়ের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যে তর্কটা চলছে, সে তো পণ্ডশ্রমই। প্রকৃতপক্ষে সেই সহজ-সরল মানুষটিই ভালো আছেন, যিনি কারও সঙ্গে তর্কে লিপ্ত না হয়ে গভীর বিশ্বাসে ধর্মাচার পালন করে যাচ্ছেন। তার আত্মা থাকে পরম শান্তিতে। এই শ্রম নিঃসন্দেহে সার্থক শ্রম। শেষের প্যারাটায় লিখতে হচ্ছে- জাকারবার্গ নামের এক আমেরিকান ভদ্রলোক বিশ্ববাসীর লাইফ স্টাইলে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটিয়ে তাদের শ্রমঘণ্টা নষ্ট করার এক জাদুকরী আয়োজন সম্পন্ন করেছেন। দোষটা অবশ্য তাকে দেয়া চলে না। ট্রাফিক জ্যামঘটিত নষ্ট শ্রমঘণ্টার জন্য যেমন গাড়ি দায়ী নয়, দায়ী মানুষ; অনুরূপে ফেসবুকজনিত পণ্ডশ্রমের জন্য যোগাযোগের এই চমৎকার মাধ্যমটি দায়ী নয়; মাত্রাজ্ঞানলুপ্ত কাণ্ডজ্ঞানহীন এর ব্যবহারকারীরাই স্বেচ্ছায় পণ্ড করছে তাদের শ্রম। বল্গাহীন এই গ্লোবাল মিডিয়ার নেই কোনো সম্পাদক, নেই সেন্সরশিপও। সময় নষ্ট করার ধুম লেগেছে তাই সর্বত্রই।
পুনশ্চ : ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় পড়ার পর দেখলাম সর্বোচ্চ আদালতের বেশকিছু পর্যবেক্ষণের সঙ্গে আমারগুলো মেলে না। তবে একটি অন্তত মিলে গেছে। সর্বোচ্চ আদালত বলেছেন- পার্লামেন্ট সার্বভৌম নয়, জনগণ ও সংবিধানই সার্বভৌম। ১৯৯৫ সালে আওয়ামী লীগ যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য আন্দোলন করছিল এবং ক্ষমতাসীন বিএনপি পার্লামেন্টে তেমন একটি বিল পাস করতে চাচ্ছিল না, আমি সাপ্তাহিক যায়যায়দিনে আমার নিয়মিত কলাম ‘চতুর্থ মাত্রা’য় একই কথা লিখেছিলাম। বলেছিলাম, পার্লামেন্টের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য যদি তুমুল বাকবিতণ্ডার পর এই মর্মে সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে, এখন থেকে বাংলাদেশের যেসব জমিতে ধান চাষ হয়, সেগুলোয় পপি (আফিমের উৎসফুল) চাষ করতে হবে- তাহলে কি আমাদের তা-ই মেনে নিতে হবে? আরও লিখেছিলাম- জনগণ যখন কোনো প্রার্থীকে ভোট দেয়, তখন তার ওপর পাঁচ বছরের জন্য নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ভার অর্পণ করে; কিন্তু সত্তা বন্ধক রাখে না। এই পাঁচ বছরের মধ্যে পার্লামেন্ট যদি এমন কোনো বিল পাস করে, যা ভোটারদের জীবন বিপন্ন করে তুলতে পারে, তাহলে তারা রাস্তার আন্দোলনের মাধ্যমে সেই পার্লামেন্টকে ভেঙে ফেলতে চাইতে পারে এবং তাতে সফল হওয়াও সম্ভব। বাস্তবে ঘটেওছিল তাই। আন্দোলনের চাপে বিএনপি ১৯৯৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি একটি একতরফা নির্বাচন করে সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুবাদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস করিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে পার্লামেন্ট ভেঙে ফেলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়েছিল। ২২ বছর পর সর্বোচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণে আমার সেই লেখার প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়ে খুব ভালো লেগেছে।
মাহবুব কামাল : সাংবাদিক
mahbubkamal08@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.