জাহানারা জামানের সেই ঝড়ের দিনগুলো
জাহানারা জামান ছিলেন জমিদারবাড়ির বড় বউ। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট তাঁর আকাশে ঝড় উঠল। ছিলেন সরকারি বাসায়। ছাড়ার নোটিশ দেওয়ার আগেই ছেড়ে দিলেন। উঠলেন ভূতের গলির একটা ছোট বাসায়। এবার ৩ নভেম্বর। মাথার ওপরে আকাশ ভেঙে পড়ল। স্বামীর দুটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ছিল মাত্র ১৭ হাজার টাকা। তাই নিয়ে চলে এলেন রাজশাহীতে। যে বাড়ি মানুষে গমগম করত, এসে দেখলেন সে বাড়ি ফাঁকা—কেউ আসেন না। পথেঘাটে চেনা মানুষও অচেনার মতো হেঁটে যায়। দেখেশুনে কষ্ট পেলেও হতাশ হলেন না জাহানারা জামান। শক্ত হাতে সংসারের হাল ধরলেন। তিনি নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, পরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী—জাতীয় চার নেতার অন্যতম শহীদ এ এইচ এম কামারুজ্জামানের স্ত্রী। ৫ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে এই সংগ্রামী নারীর জীবনাবসান ঘটে। জাহানারা জামান ছিলেন ছয় সন্তানের জননী।
দুই ছেলে—এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন ও এ এইচ এম এহ্সানুজ্জামান। চার মেয়ে—ফেরদৌস মমতাজ, রওশন আক্তার, দিলারা জামান ও কবিতা জামান। জাহানারার মৃত্যুর সময় এহ্সানুজ্জামান জিম্বাবুয়ে ছিলেন। আসতে পেরেছেন। কিন্তু কবিতা জামান ছিলেন আমেরিকায়। তিনি আসতে পারেননি। তাই মাকে শেষ দেখা তাঁর হয়নি। একইভাবে পঁচাত্তরে দুই ছেলে বাবাকে শেষবারের মতো দেখতে পাননি। তার দুই বছর আগে তাঁদের ভারতের নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে পড়াশোনার জন্য পাঠানো হয়েছিল। তখন খায়রুজ্জামান সপ্তম শ্রেণিতে আর এহ্সানুজ্জামান ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়তেন। বয়সে তাঁরা দেড় বছরের ছোট-বড়। মা-বাবার চাওয়া ছিল ছোট থেকেই তাঁরা মন্ত্রীর ছেলে নয়, সাধারণ মানুষের মতো বেড়ে উঠুক। মিশনের আর পাঁচটা সাধারণ ঘরের ছেলের মতো তাঁদের দুই ভাইকে সব কাজ করতে হয়েছে। কষ্ট করে থাকতে হয়েছে। ৩ নভেম্বর বাবাকে জেলখানার ভেতরে হত্যা করা হয়েছে, সেদিন এ খবর দুই ভাইয়ের কেউ জানতেন না। পরের দিন মিশনের স্বামীজি দুই ভাইকে গাড়িতে করে তাঁর অফিসে নিয়ে যান। সেখানে দুই ভাইয়ের সামনে আনন্দবাজার, যুগান্তরসহ চারটি দৈনিক পত্রিকা রেখে তিনি বাইরে চলে গেলেন। তাঁরা দুই ভাই দেখলেন চারটি পত্রিকাতেই জেলহত্যার ঘটনাকে প্রধান শিরোনাম করা হয়েছে। আনন্দবাজার-এর শিরোনাম ছিল ‘ওদেরকে কাঁদতে দিন’।
দুই ভাই শুধুই কাঁদলেন। কারও সঙ্গে কথা বলতে পারলেন না। এ সময় মায়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য তাঁরা ব্যাকুল ছিলেন। কিন্তু অনিশ্চয়তার কারণে মা চাননি ছেলেরা দেশে ফিরে আসুক। মা তাঁদের চিঠি লিখলেন, তাঁদের বড় হতে হবে, মানুষ হতে হবে। বাবার মতো যোগ্য হতে হবে। এ জন্য নিজের সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। এ ঘটনার দুই বছর পর মা জাহানারা জামান দুই ছেলের সঙ্গে দেখা করতে ভারতে যান। স্বামী মারা যাওয়ার পর জাহানারা জামান চার মেয়েকে নিয়ে রাজশাহীর কাদিরগঞ্জের বাসায় এসে যখন উঠলেন, তখন সে বাসা আর বাসযোগ্য ছিল না। এমনিতেই বাড়িটা পুরোনো ছিল। তার ওপর অনেক দিন ধরে পড়ে ছিল। ইউনুস আলী নামের একজন ঠিকাদারের সঙ্গে তাঁদের পরিবারের সখ্য ছিল। তিনি এসে মিস্ত্রি লাগিয়ে বাসাটা একটু ঠিকঠাক করে দিলেন। দোতলার যে ঘরে কামারুজ্জামান থাকতেন, সেই ঘরটি অবিকল রাখা হলো। কিন্তু সমস্যা হতে লাগল বর্ষার সময়। টানা দু–তিন দিন বৃষ্টি লেগে থাকত। তখন পুরোনো বাড়ির টাইলস চুইয়ে পানি পড়ত। এ অবস্থায় ঝড় উঠলে মনে হতো ছাদ ভেঙে পড়বে। কত দিন যে জাহানারা জামান চার মেয়েকে সঙ্গে করে নিচের ঘরে বসে রাত কাটিয়েছেন তার হিসাব নেই। ঢাকার বাসায় একটি গরু ছিল।
আসার সময় গরুটিও আনা হয়েছিল। রাখা হয়েছিল রাজশাহীর বাড়িতে। এই গরুর খাবার দেওয়ার কোনো লোক ছিল না। জাহানারা জামান নিজ হাতে বাসার পেছনে বসে গরুর জন্য খড় কাটতেন। কিন্তু এটা নিয়ে তাঁকে কেউ কোথাও বলতে শোনেনি, তিনি জমিদারবাড়ির বড় বউ, তিনি এ কাজ করবেন কেন। সে সময় সংসারে আয় বলতে বাসার সামনে ২২০ টাকা ভাড়ার দুটি দোকান ছিল। আর অ্যাডকো নামের একটি ওষুধ কারখানার এমডি ছিলেন কামারুজ্জামান। কিন্তু কখনো ওই প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো সম্মানী নেননি। সেই দুঃসময়ে ওই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি মাসে তাঁর পরিবারকে ৫০০ টাকা দেওয়া হতো। সে টাকা আবার গিয়ে নিয়ে আসতে হতো। চার বছর পর এহ্সানুজ্জামানকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। তারও এক বছর পরে আসেন খায়রুজ্জামান। প্রতি মাসে অ্যাডকোতে গিয়ে ৫০০ টাকা নিয়ে আসার দায়িত্ব পড়ে খায়রুজ্জামানের ওপরে। প্রতিষ্ঠানে গিয়ে এই টাকা আনতে তিনি খুবই অস্বস্তিবোধ করতেন। কিন্তু কোনো উপায় ছিল না। কারণ, এই আয়ের সঙ্গে তাঁদের দাদাবাড়ি ও নানাবাড়ি থেকে আসা চাল-ডালের সহযোগিতা নিয়েই তাঁদের চলতে হতো।
তাঁদের বাবা পাকিস্তান আমলে যখন সাংসদ ছিলেন তখন সম্মানী পেতেন ৫০০ টাকা। তাঁদের মায়ের হাতে ওই ৫০০ টাকা দিয়ে বলতেন এই দিয়েই সংসার চালাও। আবার দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে যখন মন্ত্রী হয়েছিলেন, তখন সম্মানী পেতেন দুই হাজার টাকা। ওই দুই হাজার টাকাই হাতে দিয়ে বলতেন এই দিয়ে সংসার চালাও। এ নিয়ে তাঁরা তাঁদের মাকে কোনো দিন আপত্তি করতে শোনেননি। আবার ঢাকায় তাদের বাসাতে যে মানের আসবাব, তাও একজন মন্ত্রীর বাসার সঙ্গে যায় না। এসব নিয়ে সন্তানেরা কেউ কোনো দিন মাকে হীনম্মন্যতায় ভুগতে দেখেননি। ছেলে খায়রুজ্জামান রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র হয়ে রাজশাহীর যে উন্নয়ন করেছেন, তা নিয়ে মা খুবই গর্বিত ছিলেন। তাঁর বড় মেয়ের স্বামী এ এস এম সাঈদ লালমনিরহাট-৩ আসনের সাংসদ। ছোট ছেলে এ এইচ এম এহ্সানুজ্জামান বুয়েট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে এখন জিম্বাবুয়ে বাটার ব্যবস্থাপনা পরিচালক। মেয়েরাও প্রতিষ্ঠিত। জাহানারা জামানের বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। সংগ্রামী এই নারীকে অন্তরের অন্তস্তল থেকে শ্রদ্ধা। আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ: প্রথম আলোর রাজশাহী প্রতিনিধি।
No comments