আলুবাজারের বাজনদারেরা
টুপিতে রঙিন পালক। গায়ে রাজকীয় পোশাক। বাদ্য বাজিয়ে সারি বেঁধে এগিয়ে যাচ্ছে একটি দল। কর্নেটে বাজছে সুর, ‘মালকা বানুর দেশে রে, বিয়ার বাদ্যবালা বাজে রে...।’ সঙ্গে ড্রামের দ্রিমদ্রিম, করতালের ঝমঝমানি আর ট্রাম্পেটের পোঁ পোঁ আওয়াজ। গমগম করছে পুরো রাস্তা। বাজনদারদের দেখতে ছুটে আসছে ছেলের দল। বারান্দা থেকে উঁকি দিচ্ছেন বউ-ঝিরা। কায়েতটুলীর বাসিন্দা পারভীন হকের স্মৃতিতে এভাবেই ধরা দেয় ঢাকার বাজনদারেরা, যাঁদের পোশাকি নাম ব্যান্ড পার্টি। পারভীন বলেন, ঢাকার রাস্তায় বছর তিরিশেক আগেও নিয়মিত এদের দেখা যেত। ব্যান্ড পার্টি ছাড়া পুরোনো ঢাকার বিয়ে ভাবাই যেত না। মুসলমানি (সুন্নতে খতনা), কান ফোঁড়ানোর আয়োজনেও ব্যান্ড পার্টির ডাক পড়ত। এখন আর সেই চল প্রায় নেই। সামাজিক অনুষ্ঠানে ব্যান্ড পার্টি এখন খুব কমই চোখে পড়ে। ঢাকায় ব্যান্ড পার্টির ইতিহাস বেশ পুরোনো। এখানকার ছিল নবাবদের নিজস্ব বাদকদল। নাজির হোসেনের কিংবদন্তীর ঢাকায় বলা আছে,
বাদশাহ জাহাঙ্গীরের আমলে ঢাকার আলুবাজারে বাদক দলের আগমন। নাজির বলেছেন, ‘বাদক দলের প্রয়োজন হলে আল্লুর বাজার যেতেই হতো। আজ হয়তো অন্যান্য মহল্লায় বাদক দল দেখা যায়। তবে আল্লুর বাজার মহল্লার বাদক দলই ঢাকার আদি বাদক দল।’ আলুবাজারে এখন টিকে থাকা ব্যান্ড পার্টির সংখ্যা চারটি। এলাকার বাসিন্দারা বলেন, বছর পনেরো আগেও এই সংখ্যাটা ছিল দ্বিগুণ। এখানকার সবচেয়ে পুরোনো বাদক দল বাংলাদেশ ব্যান্ড পার্টি। গত শনিবার গিয়ে দেখা যায়, স্যাক্সোফোন, ছোট-বড় ড্রাম, বাঁশিসহ সব বাদ্যযন্ত্র অলস পড়ে আছে। ব্যান্ডটির কর্ণধার মো. ইব্রাহিম। তাঁরা তিন পুরুষের বাজনদার। বাবা মাস্টার কালু মিয়ার সময় জনপ্রিয়তা পায় প্রতিষ্ঠানটি। তবে মূল ব্যবসা তাঁর দাদার। বাদক দলটির পুরোনো সদস্য, কর্নেট বাদক মো. হুরমায়ূন বলেন, এই ব্যান্ড পার্টির বয়স প্রায় ১০০ বছর। হুদমায়ূন তাঁর খালাতো ভাইয়ের কাছে শিখে শখের বশে এই দলের সঙ্গে ঘুরতেন। এরপর এটাই তাঁর পেশা হয়ে যায়। ‘কাজটা করে আনন্দ পান?’ হুদমায়ূনের জবাব শুনে ধাক্কা লাগে, ‘আনন্দ পাই না, আনন্দ দেই। কষ্ট পাই।’ বললেন, কর্নেট-ট্রাম্পেট বাজানো খুব পরিশ্রমের কাজ। খুব জোর দিয়ে ফুঁ দিতে হয়। ধাতব বাঁশিতে দাঁত নষ্ট হয়ে যায়। এই বাঁশিবাদকদের শ্বাসকষ্ট-হৃদ্রোগ খুব স্বাভাবিক ঘটনা। নিজেও ভুগছেন। বাংলাদেশ ব্যান্ড পার্টির সদস্য ৪০ জনের মতো।
কিন্তু প্রায় সবাইকেই পাশাপাশি অন্য কোনো কাজ করতে হয়। হুজমায়ূন বলেন, আগে এই কাজ করে চলা যেত। এখন কেউ চলতে পারে না। ‘সিজনে’ সপ্তাহে গড়ে তিন দিন কাজ থাকে। বাকি চার দিন বসে খেতে হয়। যে আয় তাতে পোষায় না। আলুবাজারের নিউ ন্যাশনাল ব্যান্ড পার্টির স্বত্বাধিকারী মো. রিয়াজ বললেন, শুধু ব্যান্ড পার্টি নিয়েও এখন আর চলে না। তাঁর প্রতিষ্ঠান থেকে এখন ঢোল, পালকি, ঘোড়ার গাড়িও ভাড়া দেওয়া হয়। তিনি বলেন, পৌষ, মাঘ ও ফাল্গুন—এই তিন মাস ব্যবসার মৌসুম। শুধু এর ওপর নির্ভর করে চলে না। মূলত পুরোনো শিল্পীরাই ব্যবসা ধরে রেখেছেন। নতুনেরা কেউ আর এই পেশায় আসছেন না। এলাকার বাকি দুটো ব্যান্ড পার্টি, ঢাকা ব্যান্ড পার্টি ও ন্যাশনাল ব্যান্ড পার্টির চিত্রটাও এক। ব্যান্ড পার্টিগুলোতে চিকন কালো ক্ল্যারিওনেট এবং থলের মতো ব্যাগপাইপ বাজানোর মতো শিল্পী নেই। যাঁরা বাজাতে জানতেন, তাঁরা বেঁচে নেই। হুেমায়ূন-রিয়াজ দুজনই বললেন, আর ২০-২৫ বছর পর আলুবাজারের ব্যান্ডগুলো হয়তো আর থাকবে না।
No comments