গোপনীয়তা রক্ষা ও আইন ভঙ্গের ‘ঐক্য’ নয়

আমরা দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করছি, সমাজের দায়িত্বশীলেরা যদি ঐক্য করে আইন থেকে বিচ্যুত হন, তাহলেও সেটা গণতান্ত্রিক বলে চালানোর চেষ্টা চলে। অনুসন্ধান কমিটির গোপনীয়তা রক্ষা ও নির্বাচন কমিশনের বিলম্বিত শপথ অনুষ্ঠান নিয়ে আমরা সেই রকম চেষ্টার অনুশীলন লক্ষ করছি। আশা করেছিলাম সমাজে একটা দাবি উঠবে যে নির্বাচন কমিশন হয়েছে যেভাবে, অন্যান্য সাংবিধানিক পদধারীদের নিয়োগ হবে সেভাবে। যদিও অনুসন্ধান কমিটি গোপনীয়তা রক্ষা করে প্রমাণ করেছে যে তারা রাজনীতিকদের বিনা অনুমতিতে গোপনীয়তা রক্ষাবিষয়ক অচলায়তন ভেঙে দিতে রাজি নয়।
তবে এবার যেটা প্রমাণ হলো, সেটা হলো আমরা যদি গোপনীয়তার দুর্গে আঘাত হানতে পারি, তাহলে রাষ্ট্র গঠনে আমরা কিছুটা অগ্রগতি নিশ্চিত করতে পারি। তবে সে জন্য সবার আগে যেটা বুঝতে হবে সেটা হলো, শাসকগোষ্ঠীর (সরকারি ও বিরোধী শিবির) ঐক্য এখনো দৃঢ়। এই দৃঢ়তার কাছে অনুসন্ধান কমিটি মাথা নত করেছে। সুতরাং অনুসন্ধান কমিটির সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেও বলতে হবে, তাঁরা দলগুলোর তালিকা ও শর্ট লিস্টেড ইসি সদস্যদের নামের গোপনীয়তা বজায় রেখে আইন ভেঙেছেন। আর সে জন্য তাঁদের দুঃখ প্রকাশ করা উচিত। জনস্বার্থকে জিতিয়ে দেওয়ার জন্য তাঁদের এই ত্যাগ স্বীকার করাটা জরুরি। তাঁরা যদি এটা স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানান যে ২০০৯ সালের তথ্য অধিকার আইন তাঁরা ভঙ্গ করেননি, তাহলে তার থেকে বেশি পরিহাসের আর কিছুই হতে পারে না। জনগণ শান্তি চায়।
এ কারণে দুই বড় দল যখনই কোনো বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে বলে একটা ধারণা জন্মে , তখনই মানুষ ভাবে এই বুঝি একটু শান্তির সম্ভাবনা বাড়ল। কিন্তু শাসনগত (প্রধানত অপশাসন) প্রশ্নে এই দুই দলের মধ্যে ঐক্য অটুট, এবারও তা অক্ষুণ্ন থেকেছে। বিএনপির আক্ষেপ সম্ভবত শুধু এই কারণে যে, রাষ্ট্র পরিচালনায় যেভাবে যা আওয়ামী লীগ করতে পারে, সেটা কেন তারা করতে পারে না। তারা নির্বাচন চায়, শুধু ওইভাবে করাটা করতে পারার জন্য। তারাও সুশাসন দেওয়ার কথা বলে তবে সেটার চেহারা দেখতে গেলে ওকে ক্ষমতায় নিতে হবে। এ কারণে মাত্র পাঁচজন সাংবিধানিক পদধারীর জন্য এত হুলুস্থুল ঘটার মধ্যে একই সংবিধানের আওতায় আটজন সাংবিধানিক পদধারী গতকাল রোববার শপথ নিলেন, অথচ এসব নিয়োগ নিয়ে টুঁ শব্দটি উঠল না। তাঁদের বাছাই প্রক্রিয়া নিয়ে কেউ কোনো কথা তুলল না। অথচ নতুন কমিশন সংবিধানের অধীনে যে শপথবাক্য পাঠ করবেন, সেই শপথ তাঁরাও পড়বেন। কোনো দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলনেরও ফারাক নেই। ইসি নিয়োগ দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। এই আটজনেরও নিয়োগ দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। উচ্চ আদালতের বিচারকেরা যেভাবে, সেই একইভাবে ইসি সদস্যরাও অপসারিত হবেন। ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে সিইসির পদমর্যাদা আপিল বিভাগের বিচারপতিদের এবং নির্বাচন কমিশনারদের পদমর্যাদা হাইকোর্টের বিচারপতিদের সমান।
অথচ গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিবেচনায় বিচারপতিদের অবস্থান আরও অনেক উঁচুতে হওয়াই সংগত। কিন্তু আমরা কী দেখলাম। আটজন বিচারকের স্থায়ী নিয়োগ প্রক্রিয়ায় গাছের পাতাটিও নড়ল না। দুই বছর আগে ১০ বিচারককে অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে একজন মারা গেছেন। আর একজনকে স্থায়ী করা হয়নি। কেন করা হয়নি তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। সেটা কেউ দেবে না। কারণ আমাদের কোনো কার্যকর নাগরিক সমাজও নেই, যারা এ বিষয়ে উদ্বেগ অনুভব করবে। ক্ষমতা পুনরুদ্ধারে হাঁ করে থাকা বিএনপি নামের একটি দল যথারীতি নীরব। ইসি গঠন পরবর্তী বিবৃতিতে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘শেষ মুহূর্তে রুদ্ধশ্বাস দ্রুততার সঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণ অনেক সন্দেহের জন্ম দিয়েছে।’ কিন্তু এই আটজনের বিষয়ে তাঁদের মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই! এ কারণে জনগণকে বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে বুঝতে হবে, তাদের সামনে এমন কিছু কাজ জমে আছে, যে বিষয়ে কেবল তাদেরই মুখ খুলতে হবে। তাদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে সোচ্চার হতে হবে। তাদের বুঝতে হবে, জ্যেষ্ঠ রাজনীতিকদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ কীভাবে ‘গণতন্ত্র ও সুশাসন’ প্রতিষ্ঠা বলতে শুধু নির্বাচনসর্বস্ব একটি ব্যবস্থা হিসেবেই ধারণা দিয়ে চলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। কারণ তারা রুগ্‌ণ হয়ে পড়েছে। বিএনপি নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে যে লিখিত বিবৃতি দিয়েছে,
তাতে রাষ্ট্র পরিচালনা সম্পর্কে তাদের অত্যন্ত ক্রূর দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। তারা তাদের চরিত্র অনুযায়ী বলেছে, ‘একমাত্র নির্বাচনের মাধ্যমেই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালনের নীতিতে তারা বিশ্বাসী।’ সত্যিই ‘একমাত্র নির্বাচন’ই তাদের ধ্যানজ্ঞান। কারণ নির্বাচনই ÿক্ষমতা দিতে পারে। তারা বলেছে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের কারণেই ‘সৃষ্টি হয়েছে গভীর জাতীয় সংকট’। এই দাবি বহুলাংশে অসত্য। বরং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কাজ পদ্ধতিগতভাবে বাকি রাখার কারণেই শাসন-সংকট আজ গভীরতর হয়েছে। বিএনপি তার তালিকার গোপনীয়তা বজায় রাখলেও এখন উল্টো সরকারকে দোষারোপ করছে। তাই বলি তরুণদের যা বুঝতে হবে তা হলো, শাসনব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত থাকা (বিএনপি ও আওয়ামী লীগ যে যখন যে অবস্থায় থাকুক) ব্যক্তি ও গোষ্ঠী গোপনীয়তা বজায় রাখতে আগ্রহী। অনুসন্ধান কমিটিও সেই বৃত্ত ভাঙতে পারেনি। আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র এক ঝাঁক আমলাকেই শ্রেষ্ঠ মেনেছে। যেমন বিএনপির তালিকায় মাহবুব তালুকদার ও ড. তোফায়েল আহমেদের নাম ছিল। এই আমলা রাষ্ট্র একজন আমলাকেই পরম বন্ধু মনে করেছে। অনুসন্ধান কমিটি কাদের নিয়ে হবে বিএনপি সেখানে কিন্তু আমলা রাষ্ট্রের প্রতিভূ সাবেক আমলাদেরই দেখতে চেয়েছিল।
আমরা তথ্য অধিকার আইনে অনুসন্ধান কমিটির কাছে দরখাস্ত করেছিলাম এই আশায় যে বিষয়টি অন্তত কমিটির বৈঠকে তোলা হবে। মন্ত্রিসভা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে আমি সেই অনুরোধ করেছিলাম, কিন্তু সেটা ঘটেছে বলে জানা যায় না। মন্ত্রিপরিষদ সচিব আমাকে বলেছিলেন, সার্চ কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে গোপনীয়তা বজায় রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর এখন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম নিশ্চিত করছেন যে রাজনৈতিক দলগুলো গোপনীয়তা বজায় রাখতে চেয়েছে বলে তাঁরাও গোপনীয়তা বজায় রেখেছেন। এতে ধারণা করা যায়, অনুসন্ধান কমিটি ২০০৯ সালের আইন কী বলে সেটা খতিয়ে দেখেনি। দলগুলোর কথামতো গোপনীয়তা বজায় রেখে অনুসন্ধান কমিটি বদিউল আলম মজুমদার বনাম তথ্য কমিশন মামলায় হাইকোর্টের রায় অগ্রাহ্য করেছে বলে প্রতীয়মান হয়। তবে আক্ষেপ হলো দায়িত্বশীলেরা আইন মানবেন না, কিন্তু তার প্রতিকার আমরা মামলা লড়ে আদায় করব, এই সংস্কৃতি তো আরও ভয়ংকর। আইনের শাসন আমরা চাই কারণ তা বৃহত্তর জনস্বার্থ রক্ষা  করে। শর্ট লিস্টেড করার দিনেই যদি নামগুলো প্রকাশ করা হতো, তাহলে ফলাফল ভিন্ন হতে পারত। কিন্তু সেই ঝুঁকি কেউ নিতে চায়নি। অনুসন্ধান কমিটি সংসদ ও আদালতের আইনের বিপক্ষে গিয়ে রাষ্ট্রকে সুরক্ষা দিয়েছে। এবারের বাছাই-প্রক্রিয়ায় কোনো বিষয়কে যদি সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হিসেবে বিবেচনা করতে হয়, তবে তা হচ্ছে এই গোপনীয়তা। বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি কাজী মো. এজাহারুল হক আকন্দের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ ২০১৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ওই মামলায় যে রায় দিয়েছিলেন, সম্প্রতি তার পূর্ণ বিবরণ বেরিয়েছে। আমরা জানি,
অনুসন্ধান কমিটিকে দলগুলো গোপনীয়তা রক্ষা করতে কোনো চিঠি দেয়নি। তাই অবস্থাটি যা দাঁড়াল, তা আমরা হাইকোর্টের ওই রায়ে উল্লিখিত পর্যবেক্ষণের আলোকে বলতে পারি: ‘রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরা তাদের আয়-ব্যয়ের নিরীক্ষিত হিসাবের তথ্য “গোপনীয়” বলেনি। অথচ সেই তথ্য যখন চাওয়া হলো, তখন তথ্য প্রদানের দায়িত্বে নিয়োজিতরা দলগুলোর কাছে মতামত চাইলেন। আর তখন দলগুলোর অধিকাংশই, যাদের কিনা সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ দায়িত্ব হচ্ছে তথ্য প্রকাশ করা ও জনগণের কাছে জবাবদিহি করা, তারা নাগরিকের জানার অধিকার লঙ্ঘন করে এসব তথ্য না প্রকাশের পক্ষে মত দিল। এতে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার নীতির জলাঞ্জলি ঘটেছে, যা দুর্ভাগ্যজনক ও সমর্থনের অযোগ্য।’ বদিউল আলম মজুমদার তাঁর আইনি লড়াইয়ে জয়ী হয়েছেন। আশা করব কে এম নুরুল হুদাকমিশন অন্তত হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলে গিয়ে দলগুলোর আয়-ব্যয়ের তথ্য জানতে মানুষের অধিকারকে তাদের পূর্বসূরিদের মতো আরও কণ্টকিত করবে না। ওই মামলায় বিচারপতি কাজী মো. এজাহারুল হক আকন্দ যেভাবে উষ্মা প্রকাশ করেছেন, সেভাবে আমরাও অনুসন্ধান কমিটিসহ সংশ্লিষ্টদের উদ্দেশে বলতে পারি: ‘আমাদের মতো গণতান্ত্রিক দেশে’ জনগণকে অন্ধকারে রাখা এবং তাদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলা (আদালতের কথায়, ‘কিপিং দেম ইন ডার্ক অ্যান্ড প্লেয়িং হাইড অ্যান্ড সিক উইথ দেম’) জনগণের জানার অধিকার অস্বীকার করার নামান্তর।’ দুই বড় দল তাদের আয়-ব্যয়ের বৃত্তান্ত প্রকাশ করতে চায়নি বলে রকিব কমিশনআইন অমান্য করে ‘দলীয় গোপনীয়তা’ রক্ষা করেছে। সার্চ কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে নির্বাচন কমিশন গঠনসংক্রান্ত ‘আইন’ চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ রেখেছে।
কিন্তু মনমানসিকতা না পাল্টালে শুধু আইন তৈরি করলে আমরা নিস্তার পাব কি? আমরা এমন একটা সংস্কৃতি চাই, যেখানে এমন কতগুলো কমিটি ও সংস্থা কাজ করবে, যারা ‘আইন’মতে চলবে। দলগুলোর মন জুগিয়ে চলবে না। আর এই ব্যবস্থা চালু করতে চাইলে বিএনপি বর্ণিত নির্বাচন একমাত্র হাতিয়ার নয়। অনুসন্ধান কমিটি তথ্য অধিকার আইন ভঙ্গ করল। অথচ জোর গলায় তাদের অভিযুক্ত করারও (বিএনপিকে অন্যায্য ফায়দা না দিয়ে) এই সমাজে কেউ যেন নেই। মির্জা ফখরুল তাঁর বিবৃতিতে গোপনীয়তার বিরুদ্ধাচরণ (স্ববিরোধিতা) করলেও তথ্য অধিকার আইনের দোহাই দেননি, কারণ তঁারা কার্যত ‘আইন’ বিশ্বাস করেন না। নতুন নির্বাচন কমিশন ১৫ ফেব্রুয়ারি শপথ নেবে। অথচ ইচ্ছে করলেই একটা সাংবিধানিক শূন্যতা এড়ানো যেত। সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ বলেছে, বাংলাদেশে সিইসির নেতৃত্বে একটি নির্বাচন কমিশন থাকবে। এই ‘থাকবে’ মানে সব সময় থাকবে। মাঝেমধ্যে শূন্য থাকবে, সেটা বলা নেই। অথচ এই মুহূর্তে সিইসিসহ তিনটি পদ শূন্য। এ বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট বিধিবিধান নেই। বিদায়ী নির্বাচন কমিশনার মো. আবদুল মোবারকের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হলো। আমি তাঁর সঙ্গে একমত যে ‘পারপিচুয়াল সাকসেশনের’ (বিরতিহীন উত্তরাধিকার) বিধান করে এই শূন্যতা রোধ করা দরকার। বহু ক্ষেত্রে এ রকমই, দায়িত্বশীলদের মধ্যে আমরা সুচিন্তিতভাবে আইন ভাঙার ঐক্য দেখি। এর অবসান হোক।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.