ত্রিমুখী প্রেম কাল হলো সূচীর by নুরুজ্জামান লাবু ও উৎপল রায়
অনেক প্রেমের ফাঁদে আটকা পড়েছিল সুন্দরী
বিমানবালা আফরোজা ইসলাম সূচী। কেউ তাকে জোর করে কাছে পেতে চেয়েছিল কেউবা
গভীর প্রেমে মগ্ন হয়ে পড়েছিল তার।
অন্যদিকে সূচী নিজেই যার
প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েছিল ভালবাসার সেই মানুষটি বিয়ে করে ফেলে অপর এক নারী
চিকিৎসককে। এ নিয়ে চলে দীর্ঘ টানাপড়েন। শেষে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার
পথই বেছে নেন তিনি। পরিবার, পুলিশ ও সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে
এসব তথ্য।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিহত সূচীর পরিবারের এক সদস্য জানান, নানামুখী প্রেম ও প্রতারণার চাপে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন সূচী। আকর্ষণীয় চেহারা হওয়ার কারণে প্রথম দেখাতেই সবাই তার প্রেমে পড়ে যেত। এমনকি বিচ্ছেদ হয়ে যাওয়া স্বামী মোবারকও তাকে পুনরায় ফিরে পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। এসব কারণেই সূচী শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার মতো কঠিন পথটি বেছে নেয়। গত বুধবার দুপুরে উত্তরার ৫ নম্বর সেক্টরের ১ নম্বর রোডের ৪০ নম্বর অ্যাপার্টমেন্টের তৃতীয় তলায় সবার অগোচরে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি। গতকাল পরিবারের সদস্যদের নিয়ে পুলিশ ওই বাসায় তল্লাশি চালিয়ে সূচীর আত্মহত্যার আলামত উদ্ধারের চেষ্টা করে। তবে কিছু উদ্ধার করা যায়নি। ঘটনার তদারককারী উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ আলী মাহমুদ বলেন, এ ঘটনায় ইউডি মামলা হয়েছে। পুলিশ সূচীর মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, লন্ডন প্রবাসী মোবারকের সঙ্গে বিয়ে বিচ্ছেদের পরও মোবারক তার পিছু ছাড়ছিলেন না। নানা সময়ে সূচীকে ত্যক্ত-বিরক্ত করতেন তিনি। মোবাইলে আবার সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের জন্য চাপ দিতেন। এমনকি একদিন এয়ারপোর্ট এলাকায় গাড়ি থেকে নামার পর সূচীর ব্যাগ নিয়ে পর্যন্ত টানাটানি করেন মোবারক। বিচ্ছেদের পরও মোবারক সূচীকে নিজের স্ত্রী হিসেবে দাবি করেন। এদিকে মোবারকের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর ইউনাইটেড এয়ার লাইন্সে থাকা অবস্থায় মোর্শেদের সঙ্গে পরিচয় হয় সূচীর। একপর্যায়ে দু’জনে গভীর প্রেমে মত্ত হয়ে ওঠেন। কিন্তু প্রতারক প্রেমিক মোর্শেদ সূচীর পাশাপাশি এক নারী চিকিৎসকের সঙ্গেও প্রেম চালিয়ে যেতে থাকেন। মোর্শেদের সঙ্গে পারিবারিকভাবে বিয়ে হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হলে তাদের প্রেমে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় ওই নারী চিকিৎসক। নিজের পেটে মোর্শেদের সন্তান জানিয়ে মোর্শেদকে বিয়ে করতে বাধ্য করেন তিনি। মোর্শেদও বাধ্য হয়ে ওই নারী চিকিৎসকে বিয়ে করেন। এসব কিছুই জানতেন না বিমানবালা সূচী। মোর্শেদের প্রেমে অন্ধ হয়ে প্রেমিকের সম্মান রক্ষায় বিয়েতে সম্মতি দেন তিনি। কিন্তু মনের ভেতরে প্রতারিত হওয়ার তীব্র যন্ত্রণা বয়ে বেড়ায়। মায়ের সঙ্গে সবকিছু শেয়ার করলেও আর কেউ তার এই কষ্ট বুঝতে পারেনি। সূত্র জানায়, মোর্শেদের প্রেমে প্রতারিত হয়েই আত্মহত্যার পথ বেছে নেন সূচী।
এদিকে অপর একটি সূত্র জানায়, গত বছরের জুন মাসে সূচীর সঙ্গে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে যোগদান করা কেবিন ক্রু মির্জা আদনানও তার সঙ্গে প্রেমে জড়ানোর চেষ্টা করেন। এ নিয়েও বিরক্ত ছিলেন সূচী। কিন্তু আদনান ছিলেন নাছোড়বান্দা। সূচীর সহকর্মীদের একজন জানান, এক সময় আদনানের প্রতিও কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েন সূচী। ত্রিমুখী প্রেম আর সাবেক স্বামীর পেছনে লেগে থাকা, সব মিলিয়ে নিজের জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা এসে যায় সূচীর। চারদিকের মানুষের প্রেম-প্রতারণায় বেঁচে থাকাটা তার কাছে অর্থহীন হয়ে পড়ে।
এদিকে আদরের সন্তানকে হারিয়ে পাগল প্রায় হয়ে গেছেন সূচীর মা-বাবা। মা সুলতানা ইসলাম খান কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার মেয়েটার বুকভরা যন্ত্রণা ছিল। এই যন্ত্রণা সইতে না পেরেই সে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। তিনি বলেন, গত মঙ্গলবার সূচী আমাকে মুঠোফোনে বলে ‘মা তোমাকে খুব মিস করছি’। সেদিনই আমার মনে হয়েছে কিছু একটা হয়েছে। আমি তাকে হাজারবার জিজ্ঞাসা করেছি। কিন্তু আমাকে কিছু বলেনি। অথচ সে সবসময় সব কিছু আমার সঙ্গে শেয়ার করতো। কিন্তু এমন কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে মেয়েটা আমার কাউকে কিছু বলে নাই।
উত্তরা পশ্চিম থানা সূত্রে জানা গেছে, বিমানবালা সূচীর রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনার ৪৮ ঘণ্টা পর গতকাল দুপুরে উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি অপমৃত্যু (ইউডি) মামলা হয়েছে। মামলা নম্বর ৫। সূচীর মা সুলতানা ইসলাম বাদী হয়ে এ মামলাটি করেন। থানা সূত্রে জানা গেছে, মৃত্যু রহস্য উদঘাটনে তদন্ত কাজ চলছে। এ জন্য ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তদন্তের অংশ হিসেবে সূচীর কথিত প্রেমিক মাহবুব মোর্শেদ, মির্জা আদনান, বান্ধবী লিকমাকে নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে। তদন্তের প্রয়োজনে আরও কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
জানা গেছে, ঘটনার পর থেকে নজরদারির কারণে এক প্রকার ‘গৃহবন্দী’ অবস্থায় দিন কাটছে সূচীর কথিত প্রেমিক মোর্শেদের। স্থানীয় মসজিদে নামাজ পড়া ছাড়া ঘর থেকে বেরোচ্ছেন না তিনি। গতকাল মোর্শেদের বাসস্থান উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের ২ নম্বর রোডের ২২ নম্বর ভবনের বাসায় গিয়ে কথা বললে প্রথমে বাসার নিরাপত্তাকর্মী হাবিব জানায়, স্যার (মোর্শেদ) কদিন ধরে অসুস্থ। কারও সঙ্গে যোগাযোগ বা কথা বলছেন না। পরে আসতে হবে। পরে যোগাযোগ করা হলে মাহবুব মোর্শেদের ছোট ভাই পরিচয় দেয়া সোনাল নামে একজন জানান, বিমানবালা সূচীর সঙ্গে মোর্শেদের কোন প্রেমের সম্পর্ক ছিল না। তিনি বলেন, সূচীর সঙ্গে তার কোন প্রেম-ভালবাসার সম্পর্ক ছিল না। তার ভালবাসার সম্পর্ক ছিল ‘অন্য কারো’ সঙ্গে। এ বিষয়ে পুলিশকে যা বলার, বলা হয়েছে। এর বেশি কিছু আর বলতে চাই না। সূচীর মৃত্যুর জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে তাকেই (মোর্শেদ) দায়ী করা হচ্ছে- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, তারা (সূচীর পরিবার) কেন এমন বলছে, সেটা তারাই ভাল বলতে পারবে’।
ঘটনার তদারককারী উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ আলী মাহমুদ বলেন, সূচীর মা একটি ইউডি মামলা করেছেন। তদন্ত কাজও চলছে সমানতালে। তদন্তের গতি ও পোস্টমর্টেম রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে। তবে সবকিছু নির্ভর করছে ভিকটিমের পরিবারের ওপর। তারা যদি অভিযোগ না করে তাহলে আইনানুযায়ী পুলিশ তার ভূমিকা পালন করবে। এদিকে গতকাল দুপুরে উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশ ঘটনাস্থল সূচীর বাসস্থান উত্তরা ৫ নম্বর সেক্টরের ১ নম্বর রোডের ৪০ নম্বর ভবনের তৃতীয় তলায় সূচীর মা সুলতানা ইসলাম, বোন ও আত্মীয়দের সঙ্গে নিয়ে হাজির হয়। এসময় সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ পরিদর্শক মোহাম্মদ আলী মাহমুদ ফ্ল্যাটে থাকা সূচীর ব্যবহৃত সকল জিনিসপত্র তার মাকে বুঝিয়ে দেন।
No comments