১৬ কোটি মানুষের কী অপরাধ? by মোস্তফা কামাল মজুমদার
আসন্ন
সাধারণ নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক মতানৈক্য সারা দেশকে রক্তক্ষয়ী
সংঘর্ষের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। দৃশ্যত পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক জোট ও দলগুলো
তাদের অবস্থান থেকে এক ইঞ্চিও সরতে চাচ্ছে না। এ নিয়ে সর্বশেষ বিরোধী দলের
নেতাকে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে আমন্ত্রণ নিয়ে দুই নেত্রীর মধ্যে টেলিফোনে যে
কথা কাটাকাটি হয়েছে, তাকে অনেকে নিরর্থক মনে করেছেন। রাজনৈতিক অচলবস্থা
নিরসনে নেতৃত্বের অপারগতার কারণে সাধারণ নাগরিকদের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের
উন্নয়ন সহযোগীদের মধ্যেও হতাশা বেড়েছে। ঢাকায় কর্মরত বেশ কিছু বাংলাদেশের
শুভাকাক্সক্ষী দেশের রাষ্ট্রদূতদের কর্মচঞ্চলতা এখনও ফলপ্রসূ না হওয়ায়
জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সবার অংশগ্রহণভিত্তিক
নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য তাগিদ দিয়েছেন।
অচলাবস্থার মূল কারণ নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে বিরোধ। নির্বাচন বর্তমান সরকারের তত্ত্বাবধানে নাকি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হবে- যে ব্যবস্থা ১৯৯৬ সাল থেকে চালু ছিল। ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ সালে তিনটি নির্বাচন কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। সব বিরোধী দল, এমনকি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন জোটের কয়েকটি শরিক দল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও তার মিত্র দলগুলো এ দাবির পক্ষে সারা দেশে শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলেছে।
আওয়ামী লীগ ও তার অন্ধ সমর্থক দলগুলো ক্ষমতাসীনদের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠানে বদ্ধপরিকর। তারা শুধু বিরোধী দলের কিছু সংসদ সদস্যকে নির্বাচনকালীন সরকারে অন্তর্ভুক্ত করতে রাজি আছেন। এর পক্ষে প্রধান যুক্তি- দুই বছরের সর্বশেষ কেয়ারটেকার সরকারের সময়কার দুরবস্থা, জরুরি অবস্থা এবং তার অধীনে রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের ওপর নেমে আসা নিষ্পেষণ এবং মাইনাস টু ফর্মুলা ইত্যাদি। কিন্তু এখানে একটা বিষয় দৃষ্টির আড়ালে থেকে যাচ্ছে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা না থাকার কারণেই অচলাবস্থার সূত্র ধরে জরুরি অবস্থা এসেছিল। বিরোধী দলের একটা দাবি উপেক্ষা করা যায় না। তারা বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির পরিবর্তন আওয়ামী লীগ তথা তার নেতৃত্বাধীন জোটের কোনো রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল না। এ রকম কোনো কর্মসূচি ২০০৮ সালের নির্বাচন মেনিফেস্টোতেও বলা হয়নি। যারা পঞ্চদশ সংশোধনী প্রণয়ন ও পাসের সঙ্গে জড়িত তাদের বিভিন্ন সময়ের কথাবার্তা থেকেও এটা পরিষ্কার যে, শুরুর দিকে কেউ এই মীমাংসিত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে চাননি। আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের তরফে বলা হয়েছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার সঙ্গে দুটি শর্ত জুড়ে দেয়া যেতে পারে : ১. নির্বাচনকালীন এই সরকারের মেয়াদ ৯০ দিনে সীমাবদ্ধ থাকবে এবং ২. এ সরকার বিদেশের সঙ্গে কোনো চুক্তি সই করতে পারবে না। সরকারি দলের এ মনোভাবের পরিপ্রেক্ষিতে বিরোধী দলের নেতারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংরক্ষণের পক্ষে জোরালো বক্তব্য রেখে তাদের অবস্থান আরও পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন। এর পরেও পারস্পরিক আস্থাহীনতার যে বিরাট ফারাক পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে, তা টেকসই গণতন্ত্রের স্বার্থে দূর করা দরকার। এই মূল ইস্যু বাদ দিয়ে মামুলি বিষয়- ২৭-২৯ অক্টোবরের হরতাল বিরোধী দল প্রত্যাহার করেছে কিনা- নিয়ে টানাটানি করলে ফলপ্রসূ কিছু হবে বলে মনে হয় না। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের ভাষায় অবাধ, নিরপেক্ষ ও সবার অংশগ্রহণভিত্তিক নির্বাচন করার পরিবেশ তৈরি করা এখনকার জরুরি কাজ।
এ কথা বলার অর্থ এই নয় যে, একটা নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের তত্ত্বাবধানে অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান অসম্ভব। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমন একটা মার্জিত পর্যায়ে এখনো আসেনি যে, ক্ষমতায় আসীন ব্যক্তিরা তাদের নির্ধারিত ক্ষমতা বা ম্যান্ডেটের বাইরে যাবেন না- এতটুকু বিশ্বস্ততা অর্জন করেছেন। বা বিরোধী দলের মধ্যে আস্থা এমন পর্যায়ে আসেনি যে, তারা রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে নিয়োজিতের নিরপেক্ষতা ও সত্যনিষ্ঠার ব্যাপারে সন্দিহান নন। এখানে এ কথা বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান প্রণেতারা মানুষের স্বভাবজাত পক্ষপাত বা লোভকে তাদের বিচার-বুদ্ধির কাছে ছেড়ে না দিয়ে রাষ্ট্রের তিন অঙ্গ নির্বাহী, আইন ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি করেছিলেন। যার ফলে মাত্র কদিন আগেও বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সরকারেরও কিছু কর্মকাণ্ড অর্থের অভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কারণ তার প্রবর্তিত স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার জন্য চাহিদা মতো রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ঋণ গ্রহণের ক্ষমতা কংগ্রেস তাকে দেয়নি। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, ঢাকায় নিযুক্ত আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনাকেও তার দূতাবাস ও বাসস্থানের বাইরে ভ্রমণ এ কারণে অনেকটা সীমিত রাখতে হয়েছিল।
এটা পরিষ্কার যে, আমাদের দেশে রাষ্ট্র বা সরকারের কোনো অঙ্গ বিরোধী দলের নিয়ন্ত্রণে নেই যে, মার্কিন কংগ্রেসের মতো নির্বাহী বিভাগের ওপর চাপ প্রয়োগ করা যেতে পারে। আমাদের দেশের মতো সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় এরকম নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা প্রায় অসম্ভব, যদি না সংসদে কারও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকে বা দেশে কোয়ালিশন সরকার থাকে। এখানে শুধু উচ্চ আদালতের ক্ষমতা আছে নির্বাহী বা আইন বিভাগের ওপর চাপ সৃষ্টি করার। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে উচ্চ আদালত আগে থেকেই তার অবস্থান নিয়ে নিয়েছে।
এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, সংসদীয় ব্যবস্থায় সরকারের ছত্রছায়ায়ই আইন বিভাগ পরিচালিত হয়। আবার পার্লামেন্ট সংবিধান সংশোধনী বিল পাস করে এমনকি বিচার বিভাগের ক্ষমতা হ্রাস করারও ক্ষমতা রাখে। বর্তমান সংসদের ওপর নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ কতটা শক্তিশালী তা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। কারণ সংসদের নয়-দশমাংশ সদস্য সরকারি দলের বা জোটের। এরূপ অবস্থায় ক্ষমতাসীনরা চাইলে একদিনের মধ্যে একটা সংবিধান সংশোধনী বিল পাস করে শাসন ব্যবস্থা তথা সাংবিধানিক বিষয়ে ঐকমত্য ফিরিয়ে এনে শান্তিপূর্ণ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে এবং তা করলে তারা এদেশের গণতন্ত্রকামী ও শান্তিপ্রিয় মানুষের মনে স্থায়ী শ্রদ্ধার আসন দখল করতে সক্ষম হবে।
ঐকমত্য সৃষ্টিতে সমর্থ না হলে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর বর্তমান জটিলতা আরও প্রকট হবে। বর্তমান ব্যবস্থায় নির্বাচনী প্রচারণা সমান অধিকারভোগী প্রতিযোগীদের মধ্যে হবে না, হবে অসম প্রতিযোগিতার নির্বাচন। একদল প্রতিযোগী সরকারি সুযোগ-সুবিধা এবং মর্যাদা পাবে, অন্যদল সাধারণের কাতার থেকে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। মন্ত্রীরা সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি ভোগ করবেন। কারণ আইন প্রয়োগকারীরাসহ প্রশাসন প্রটোকল ও মর্যাদা রক্ষাসহ তাদের সন্তুষ্ট রাখার কাজে ব্যস্ত থাকতে বাধ্য হবে। রাশেদ খান মেননসহ সরকারি রাজনৈতিক জোটের প্রভাবশালী কিছু সদস্য অল্প কদিন আগে পর্যন্ত এমপিদের সংসদ সদস্য পদে আসীন রেখে অসম নির্বাচনী প্রতিযোগিতার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখেছেন। সরকারি মহল নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে এবং আসন্ন নির্বাচন কীভাবে অনুষ্ঠিত হবে এ নিয়ে বিভিন্ন বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে। কারণ এ ধরনের নির্বাচনের কোনো নজির এদেশে কখনও ছিল না। নির্বাচনী আচরণবিধি চূড়ান্ত করতে নির্বাচন কমিশন হিমশিম খাচ্ছে, কারণ এই বিধিতে নির্বাচনে সাধারণ প্রতিদ্বন্দ্বী ও এমপি-মন্ত্রী প্রতিদ্বন্দ্বীদের নির্বাচনকালীন সুযোগ ও মর্যাদা একরকম হবে না। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সর্বশেষ বক্তব্য হল, তারা রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য অপেক্ষা করছেন। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অতি সম্প্রতি সংসদে সংশোধিত হওয়ায় নির্বাচন কমিশনের ওপর থেকে এ বিষয়ে চাপ কিছুটা কমবে। কিন্তু এদেশের মানুষ একই নির্বাচনে মর্যাদার পার্থক্য নিয়ে প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখতে অভ্যস্ত নয়।
যদিও প্রবাদে আছে- একটা জনগোষ্ঠী যে ধরনের সরকারের জন্য উপযোগী সে ধরনের সরকারই পায়, তবুও বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ সম্ভবত বর্তমান অবস্থায় নিপতিত হওয়ার মতো কোনো অপরাধ করেনি। শত বিপত্তি অতিক্রম করে এদেশের মানুষ এখনও উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলার সামর্থ্যরে পরিচয় দিয়ে চলেছে। বিদেশের মাটিতে গরিব মানুষের শরীরে ঘামের বিনিময়ে ডলার উপার্জনের কারণেই তিন দশক ধরে বাংলাদেশ বাণিজ্যিক লেনদেনে একটা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকতে পেরেছে।
বাংলাদেশের চাষীরা শুধু চাল, গম ও ভুট্টার উৎপাদনই বাড়ায়নি, কৃষি বহুমুখী করে তারা সবজি এবং ফলের সরবরাহও বাড়িয়েছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় না হলে এখন এসব কৃষিপণ্যের সরবরাহ বাজারে প্রচুর থাকে। কোনো কোনো পণ্যের দাম আগের তুলনায় কমে গেছে। নিবেদিত গার্মেন্ট কর্মীরা কঠোর পরিশ্রম, এমনকি কখনও জীবন বাজি রেখে দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন বাড়িয়ে চলেছে। ক্রিকেটাররা দেশের মর্যাদা বাড়িয়েছে। এখন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা সারা বিশ্বের ঘরে ঘরে মিনি পর্দায় পত্পত্ করে ওড়ে। এ সাফল্য তাদের। এখনকার যুবকরা ইন্টানেটের মাধ্যমে সারা বিশ্বে ঘুরে বেড়ায় এবং আকাশছোঁয়া উন্নতির স্বপ্ন দেখে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের উচিত তাদের নিরাশ না করে ক্ষমতায়নের পরিবেশ আরও পরিচ্ছন্ন রাখা।
মোস্তফা কামাল মজুমদার : সাংবাদিক
অচলাবস্থার মূল কারণ নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে বিরোধ। নির্বাচন বর্তমান সরকারের তত্ত্বাবধানে নাকি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হবে- যে ব্যবস্থা ১৯৯৬ সাল থেকে চালু ছিল। ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ সালে তিনটি নির্বাচন কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। সব বিরোধী দল, এমনকি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন জোটের কয়েকটি শরিক দল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও তার মিত্র দলগুলো এ দাবির পক্ষে সারা দেশে শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলেছে।
আওয়ামী লীগ ও তার অন্ধ সমর্থক দলগুলো ক্ষমতাসীনদের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠানে বদ্ধপরিকর। তারা শুধু বিরোধী দলের কিছু সংসদ সদস্যকে নির্বাচনকালীন সরকারে অন্তর্ভুক্ত করতে রাজি আছেন। এর পক্ষে প্রধান যুক্তি- দুই বছরের সর্বশেষ কেয়ারটেকার সরকারের সময়কার দুরবস্থা, জরুরি অবস্থা এবং তার অধীনে রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের ওপর নেমে আসা নিষ্পেষণ এবং মাইনাস টু ফর্মুলা ইত্যাদি। কিন্তু এখানে একটা বিষয় দৃষ্টির আড়ালে থেকে যাচ্ছে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা না থাকার কারণেই অচলাবস্থার সূত্র ধরে জরুরি অবস্থা এসেছিল। বিরোধী দলের একটা দাবি উপেক্ষা করা যায় না। তারা বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির পরিবর্তন আওয়ামী লীগ তথা তার নেতৃত্বাধীন জোটের কোনো রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল না। এ রকম কোনো কর্মসূচি ২০০৮ সালের নির্বাচন মেনিফেস্টোতেও বলা হয়নি। যারা পঞ্চদশ সংশোধনী প্রণয়ন ও পাসের সঙ্গে জড়িত তাদের বিভিন্ন সময়ের কথাবার্তা থেকেও এটা পরিষ্কার যে, শুরুর দিকে কেউ এই মীমাংসিত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে চাননি। আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের তরফে বলা হয়েছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার সঙ্গে দুটি শর্ত জুড়ে দেয়া যেতে পারে : ১. নির্বাচনকালীন এই সরকারের মেয়াদ ৯০ দিনে সীমাবদ্ধ থাকবে এবং ২. এ সরকার বিদেশের সঙ্গে কোনো চুক্তি সই করতে পারবে না। সরকারি দলের এ মনোভাবের পরিপ্রেক্ষিতে বিরোধী দলের নেতারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংরক্ষণের পক্ষে জোরালো বক্তব্য রেখে তাদের অবস্থান আরও পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন। এর পরেও পারস্পরিক আস্থাহীনতার যে বিরাট ফারাক পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে, তা টেকসই গণতন্ত্রের স্বার্থে দূর করা দরকার। এই মূল ইস্যু বাদ দিয়ে মামুলি বিষয়- ২৭-২৯ অক্টোবরের হরতাল বিরোধী দল প্রত্যাহার করেছে কিনা- নিয়ে টানাটানি করলে ফলপ্রসূ কিছু হবে বলে মনে হয় না। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের ভাষায় অবাধ, নিরপেক্ষ ও সবার অংশগ্রহণভিত্তিক নির্বাচন করার পরিবেশ তৈরি করা এখনকার জরুরি কাজ।
এ কথা বলার অর্থ এই নয় যে, একটা নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের তত্ত্বাবধানে অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান অসম্ভব। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমন একটা মার্জিত পর্যায়ে এখনো আসেনি যে, ক্ষমতায় আসীন ব্যক্তিরা তাদের নির্ধারিত ক্ষমতা বা ম্যান্ডেটের বাইরে যাবেন না- এতটুকু বিশ্বস্ততা অর্জন করেছেন। বা বিরোধী দলের মধ্যে আস্থা এমন পর্যায়ে আসেনি যে, তারা রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে নিয়োজিতের নিরপেক্ষতা ও সত্যনিষ্ঠার ব্যাপারে সন্দিহান নন। এখানে এ কথা বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান প্রণেতারা মানুষের স্বভাবজাত পক্ষপাত বা লোভকে তাদের বিচার-বুদ্ধির কাছে ছেড়ে না দিয়ে রাষ্ট্রের তিন অঙ্গ নির্বাহী, আইন ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি করেছিলেন। যার ফলে মাত্র কদিন আগেও বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সরকারেরও কিছু কর্মকাণ্ড অর্থের অভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কারণ তার প্রবর্তিত স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার জন্য চাহিদা মতো রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ঋণ গ্রহণের ক্ষমতা কংগ্রেস তাকে দেয়নি। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, ঢাকায় নিযুক্ত আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনাকেও তার দূতাবাস ও বাসস্থানের বাইরে ভ্রমণ এ কারণে অনেকটা সীমিত রাখতে হয়েছিল।
এটা পরিষ্কার যে, আমাদের দেশে রাষ্ট্র বা সরকারের কোনো অঙ্গ বিরোধী দলের নিয়ন্ত্রণে নেই যে, মার্কিন কংগ্রেসের মতো নির্বাহী বিভাগের ওপর চাপ প্রয়োগ করা যেতে পারে। আমাদের দেশের মতো সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় এরকম নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা প্রায় অসম্ভব, যদি না সংসদে কারও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকে বা দেশে কোয়ালিশন সরকার থাকে। এখানে শুধু উচ্চ আদালতের ক্ষমতা আছে নির্বাহী বা আইন বিভাগের ওপর চাপ সৃষ্টি করার। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে উচ্চ আদালত আগে থেকেই তার অবস্থান নিয়ে নিয়েছে।
এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, সংসদীয় ব্যবস্থায় সরকারের ছত্রছায়ায়ই আইন বিভাগ পরিচালিত হয়। আবার পার্লামেন্ট সংবিধান সংশোধনী বিল পাস করে এমনকি বিচার বিভাগের ক্ষমতা হ্রাস করারও ক্ষমতা রাখে। বর্তমান সংসদের ওপর নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ কতটা শক্তিশালী তা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। কারণ সংসদের নয়-দশমাংশ সদস্য সরকারি দলের বা জোটের। এরূপ অবস্থায় ক্ষমতাসীনরা চাইলে একদিনের মধ্যে একটা সংবিধান সংশোধনী বিল পাস করে শাসন ব্যবস্থা তথা সাংবিধানিক বিষয়ে ঐকমত্য ফিরিয়ে এনে শান্তিপূর্ণ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে এবং তা করলে তারা এদেশের গণতন্ত্রকামী ও শান্তিপ্রিয় মানুষের মনে স্থায়ী শ্রদ্ধার আসন দখল করতে সক্ষম হবে।
ঐকমত্য সৃষ্টিতে সমর্থ না হলে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর বর্তমান জটিলতা আরও প্রকট হবে। বর্তমান ব্যবস্থায় নির্বাচনী প্রচারণা সমান অধিকারভোগী প্রতিযোগীদের মধ্যে হবে না, হবে অসম প্রতিযোগিতার নির্বাচন। একদল প্রতিযোগী সরকারি সুযোগ-সুবিধা এবং মর্যাদা পাবে, অন্যদল সাধারণের কাতার থেকে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। মন্ত্রীরা সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি ভোগ করবেন। কারণ আইন প্রয়োগকারীরাসহ প্রশাসন প্রটোকল ও মর্যাদা রক্ষাসহ তাদের সন্তুষ্ট রাখার কাজে ব্যস্ত থাকতে বাধ্য হবে। রাশেদ খান মেননসহ সরকারি রাজনৈতিক জোটের প্রভাবশালী কিছু সদস্য অল্প কদিন আগে পর্যন্ত এমপিদের সংসদ সদস্য পদে আসীন রেখে অসম নির্বাচনী প্রতিযোগিতার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখেছেন। সরকারি মহল নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে এবং আসন্ন নির্বাচন কীভাবে অনুষ্ঠিত হবে এ নিয়ে বিভিন্ন বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে। কারণ এ ধরনের নির্বাচনের কোনো নজির এদেশে কখনও ছিল না। নির্বাচনী আচরণবিধি চূড়ান্ত করতে নির্বাচন কমিশন হিমশিম খাচ্ছে, কারণ এই বিধিতে নির্বাচনে সাধারণ প্রতিদ্বন্দ্বী ও এমপি-মন্ত্রী প্রতিদ্বন্দ্বীদের নির্বাচনকালীন সুযোগ ও মর্যাদা একরকম হবে না। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সর্বশেষ বক্তব্য হল, তারা রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য অপেক্ষা করছেন। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অতি সম্প্রতি সংসদে সংশোধিত হওয়ায় নির্বাচন কমিশনের ওপর থেকে এ বিষয়ে চাপ কিছুটা কমবে। কিন্তু এদেশের মানুষ একই নির্বাচনে মর্যাদার পার্থক্য নিয়ে প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখতে অভ্যস্ত নয়।
যদিও প্রবাদে আছে- একটা জনগোষ্ঠী যে ধরনের সরকারের জন্য উপযোগী সে ধরনের সরকারই পায়, তবুও বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ সম্ভবত বর্তমান অবস্থায় নিপতিত হওয়ার মতো কোনো অপরাধ করেনি। শত বিপত্তি অতিক্রম করে এদেশের মানুষ এখনও উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলার সামর্থ্যরে পরিচয় দিয়ে চলেছে। বিদেশের মাটিতে গরিব মানুষের শরীরে ঘামের বিনিময়ে ডলার উপার্জনের কারণেই তিন দশক ধরে বাংলাদেশ বাণিজ্যিক লেনদেনে একটা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকতে পেরেছে।
বাংলাদেশের চাষীরা শুধু চাল, গম ও ভুট্টার উৎপাদনই বাড়ায়নি, কৃষি বহুমুখী করে তারা সবজি এবং ফলের সরবরাহও বাড়িয়েছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় না হলে এখন এসব কৃষিপণ্যের সরবরাহ বাজারে প্রচুর থাকে। কোনো কোনো পণ্যের দাম আগের তুলনায় কমে গেছে। নিবেদিত গার্মেন্ট কর্মীরা কঠোর পরিশ্রম, এমনকি কখনও জীবন বাজি রেখে দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন বাড়িয়ে চলেছে। ক্রিকেটাররা দেশের মর্যাদা বাড়িয়েছে। এখন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা সারা বিশ্বের ঘরে ঘরে মিনি পর্দায় পত্পত্ করে ওড়ে। এ সাফল্য তাদের। এখনকার যুবকরা ইন্টানেটের মাধ্যমে সারা বিশ্বে ঘুরে বেড়ায় এবং আকাশছোঁয়া উন্নতির স্বপ্ন দেখে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের উচিত তাদের নিরাশ না করে ক্ষমতায়নের পরিবেশ আরও পরিচ্ছন্ন রাখা।
মোস্তফা কামাল মজুমদার : সাংবাদিক
No comments