রাষ্ট্র, সরকার ও বিরোধী দলের কাছে কী চাই
দেশের রাজনৈতিক আলোচনায় সবাই অতীতের সূত্র ধরে বর্তমান আর আগামীর কথা বলছেন। প্রধানমন্ত্রী আর বিরোধী দলের নেতা দুজনেই অতীতের প্রসঙ্গে পরস্পরের প্রতি দোষারোপের বারুদ ছিটিয়ে দিয়েছেন ফোনালাপে। সভায়, সংবাদ সম্মেলনে এবং ক্বচিৎ হলেও জাতীয় সংসদে। সেই বারুদের আগুনে দেশ-জনগণ পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। কত স্বপ্ন, কত আশা, কত ভবিষ্যৎ পুড়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর একান্ত ব্যক্তিগত স্বজন হারানোর শোক এবং আমাদের, দেশ ও জাতির নেতা বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে নিহত হওয়ার জাতীয় অপূরণীয় শোক, জাতীয় চার নেতাকে জেলে হত্যা করার অপরাধ জনগণ ভুলবে না, ক্ষমা করবে না হত্যাকারীদের। গ্রেনেড হামলায় নিহত আইভি রহমানসহ সব রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধেও জনগণ ক্রুদ্ধ ও সোচ্চার। বিরোধী দলের বিরুদ্ধে এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য অভিযোগ জানাতে আইনি পদক্ষেপই প্রগতির পথ দেখাবে। সুযোগ পেলেই বিরোধী দলের নেতাকে ফোনে বা মাইকে অপ্রীতিকর শব্দে,
অভিযোগে ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতবিক্ষত করে ও অপমান করে প্রধানমন্ত্রী নিজের রক্তাক্ত হূদয়ের রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে চাইছেন। পাল্টাপাল্টি বিরোধীদলীয় নেতাও কটু কথা উত্তপ্ত স্বরে বলছেন। বাংলাদেশের জনগণের প্রায় শতকরা ৫০ ভাগ নারীসমাজের চাহিদা পূরণে অক্ষম এই দুই রাজনৈতিক নেতা। তাঁদের ব্যর্থতার কারণে যত্রতত্র পুরুষপ্রধান উপস্থিতিতে রাজনৈতিক আলোচনায় রাজনৈতিক নারী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করা হচ্ছে। পরিশীলিত রাজনৈতিক পরিপক্বতার অভাবে দুই প্রধান নারীনেত্রীর আচরণে, বক্তৃতায়, ভাষণে, দলের কর্মসূচি গ্রহণে এতটাই ব্যক্তিগত আক্রোশ ও প্রতি-উত্তরে আক্রোশ, পরস্পরকে ঘায়েল করার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে (১৯৯১ থেকে বর্তমানে ২০১৩ পর্যন্ত) যে রাজনীতিতে নারীর প্রবেশপথ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। শতকরা ৫০ ভাগ নারীসমাজের প্রতিনিধিত্বকারী নারী আন্দোলনের নেতৃত্ব রাজনীতিতে নারীর সম-অংশগ্রহণের লক্ষ্যে ১৯৪৭ সাল থেকে এই ভূখণ্ডে ব্রিটিশবিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনের ধারা অক্ষুণ্ন রেখেছেন। ইতিহাসে সেই নারীরা উপেক্ষিত। পুরুষ-অধ্যুষিত রাজনৈতিক দলের প্রান্তে রাজনৈতিক নারীদের কোণঠাসা করে ঠেলে রাখা হয়েছে; আগেও এবং এখনো। বর্তমানে সেই ধারা ভেতরে ভেতরে অক্ষুণ্ন রয়েছে। যদিও বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী পদে এবং মাননীয় স্পিকার পদে আওয়ামী লীগের সরকার নারীনেত্রীদের নির্বাচিত করেছে। কিন্তু তাঁদের স্বাধীন কাজের মননশীলতা লক্ষণীয় নয়। আওয়ামী লীগের নারী-পুরুষ সব সদস্যই; মন্ত্রী এবং নেতারাও প্রধানমন্ত্রী-মুখাপেক্ষী এবং তাঁর অঙ্গুলি হেলনে চলেন। ফলে শুধু নারী-মন্ত্রী-নেত্রীদের (দলীয়)
স্বাধীন ব্যক্তিসত্তার অভাবের কথা বলে নারী নেতৃত্বকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। যারা নারী নেতৃত্বের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, তাঁরা সেই হেফাজতি বা আল্লামা শফীসহ যাঁরা ‘নারী নেতৃত্ব হারাম’ বলে নতুন যুগের, নতুন সময়ের ও নারী নেতৃত্বের সুযোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে নাকচ করে দিতে চাইছেন, তাঁদের কণ্ঠেই কণ্ঠ মেলাচ্ছেন। শুধু রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের ক্ষমতায়িত নারীদের বিরুদ্ধে নয়, বাড়িতে-বাড়িতে, সমাজের অগ্রসরমাণ-ক্ষমতায়িত, কর্ম-দক্ষ, সিদ্ধান্ত গ্রহণে দক্ষ, নারীদের (মা, স্ত্রী, বোন, মেয়ে, ছেলের বউ, নাতনিসহ সব নারী) এগিয়ে যাওয়া থমকে দিতে চান সেই ধরনের চিন্তাধারার মানুষ। নারী শুধু বাবার, স্বামীর, ছেলের মুখাপেক্ষী থাকবে; যেকোনো স্বাধীনতা নারীকে দেবে তারই প্রভু পুরুষ। নিজে স্বাধীন হতে পারবে না নারী। ঠিক হেফাজতি নির্দেশনামা, আল্লামা শফীর নির্দেশনামা এবং একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলের প্রধান নেতার দলীয় নির্দেশ। হেফাজতিদের নারীবিদ্বেষ এত বিস্তার লাভের সুযোগ পাচ্ছে পারিবারিক আইন, ১৯৬১ ও পুরুষের বহু বিবাহ আইন, সম্পত্তিতে নারীর জন্য অসম-অধিকারের আইন, বিবাহবিচ্ছেদের পরে মায়ের কাছে মেয়ে ১৮ বছর ও ছেলে আট বছর থাকতে পারার আইন, বংশধারায় পুত্রের প্রাধান্য,
‘হিন্দু আইন’ রাষ্ট্রীয়ভাবে আইনি স্বীকৃতি না পাওয়া, হিন্দু বিয়ে ও বিচ্ছেদ রেজিস্ট্রি করার আইন না হওয়ার কারণে। সামাজিক-পারিবারিক নারী লাঞ্ছনার যত ঘটনা, সেগুলোতে হেফাজতিদের উসকানি থাকতে পারে, তবে পারিবারিক নারী নির্যাতনকারী পুরুষদের নৃশংসতাও হেফাজতিদের উসকানি দিচ্ছে বৈকি! বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, প্রগতিবিদ পুরুষদের কাছে আবেদন জানাচ্ছি, সকল পারিবারিক আইনের সঙ্গে যুক্ত সব নারী-বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিন। প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্রথম আলোর সম্পাদকসহ সব পুরুষ কর্মী, অন্যান্য লেখক-প্রতিবেদক এই উদ্যোগ নিতে পারেন প্রথম আলোয় লক্ষাধিক স্বাক্ষর ছাপিয়ে। জেলায় জেলায় বন্ধুসভা এই উদ্যোগ নিতে পারে। চীনের বেইজিংয়ে ১৯৯৫ সালে জাতিসংঘ আয়োজিত চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মেলনে গৃহীত নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে ১২ দফা কর্মসূচির দলিলে স্বাক্ষর করেছিলেন। বাংলাদেশের বেসরকারি নারী প্রতিনিধিদলের নেত্রী অধ্যাপক ড. নাজমা চৌধুরীর নেতৃত্বে আমরা বাংলাদেশের ৫২ জন প্রতিনিধি সেই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলাম। মুক্ত আকাশে ২০ হাজার পাখি উড়িয়ে ৩০ আগস্ট ’৯৫ নারী সম্মেলন শুরু হয়েছিল। ১৫ সেপ্টেম্বর সর্বসম্মতিতে শিক্ষা, দারিদ্র্য, পরিবেশ, অর্থনৈতিক, সহিংসতা, মিডিয়া, সিদ্ধান্ত গ্রহণে ক্ষমতা, মানবাধিকার, স্বাস্থ্য ইত্যাদি ১২টি ইস্যুতে দলিল গৃহীত হয়েছে। ২০১৩ পর্যন্ত ১৮ বছর ধরে সরকারি এই দলিল বিষয়ে বর্তমান বিরোধীদলীয় নেত্রী, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাঁর রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রদেয় অঙ্গীকার সম্পর্কে একটি বাক্যও উচ্চারণ করেননি।
মূলত নারীর সমান অধিকার বিষয়ে তাঁর দলীয় অবস্থান ‘হেফাজতি’ ‘জামায়াতি’ নীতিমালার সঙ্গে জোটের অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ। অন্যদিকে বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা; তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার স্বাক্ষরিত বেইজিং সম্মেলনের দলিলের ১২টি ইস্যু বিষয়ে কোনো বাক্য উচ্চারণ করেননি কখনো। নারীর প্রগতিতে প্রধানমন্ত্রী নিজেই তো কতগুলো ইস্যু বানিয়ে নারীর অবস্থানের জন্য উদ্যোগ নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছেন যে নারী-পুরুষের সমতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ১১ ধাপ এগিয়েছে। এই সমতার মৌলিক ভিত্তিটাই বাংলাদেশের পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে, প্রতিষ্ঠানে, কর্মস্থলে অত্যন্ত নড়বড়ে। যেকোনো সময় প্রাপ্ত ১১ ধাপ সমতা শিকড় উপড়ে ধূলিসাৎ হতে পারে। আমরা তাই চাই, সরকার বেইজিং সম্মেলনে জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত ১২টি ইস্যুর বিষয়ে কর্মসূচির ঘোষণা দেবে। আগামী নির্বাচনের ঘোষণাপত্রে এই ১২টি ইস্যু বিষয়ে নীতিমালা গ্রহণ করে নারীর পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতায়নের জন্য সব রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি ঘোষিত হোক, সেই কর্মসূচি রাষ্ট্রীয় কর্মসূচিতে গ্রহণের অঙ্গীকার করা হোক। সব রাজনৈতিক দলের কাছে আমাদের নারী আন্দোলনের প্রস্তাব থাকছে,
নারীর সামগ্রিক অগ্রগতি ও প্রগতির লক্ষ্যে জাতিসংঘ ও বিশ্ব নারী সমাজের গৃহীত (১৯৯৫) ১২টি ইস্যুকে গুরুত্ব দিয়ে সেই অনুসারে রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপের বিষয়ে অঙ্গীকার করা হোক। সরকারের ভেতরে, রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে, বিরোধী দলসহ সব রাজনৈতিক দলের ভেতরে, পরিবারে, সমাজে, সংস্কৃতিতে, অর্থনীতিতে ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে ‘হেফাজতি’ নারীনীতির মূলোৎপাটন করতে নারী সমাজ বদ্ধপরিকর। এবারের নির্বাচনে নারী ভোটাররা রুখে দাঁড়াবেন জামায়াতি রাজনীতিকে, রুখে দাঁড়াবেন জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ দলের বিরুদ্ধে, প্রার্থীদের বিরুদ্ধে; আওয়ামী লীগের জামায়াতি মনোভাবের, দুর্নীতিবাজ, ত্বকী ও অন্যান্য হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের, পদ্মা সেতুসহ বিভিন্ন প্রজেক্টে লিপ্ত দুর্নীতিবাজদের, অসৎ অর্থলোভীদের, নারীর সম্মান ও সম-অধিকারের বিরুদ্ধ মতের প্রার্থীকে নারী ভোটাররা ভোট দেবেন না। আমরা চাই পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে, আইনে, কর্মক্ষেত্রে, রাজনীতিতে নারী-পুরুষ কেউ কারও অসম্মান করবেন না, নারী তাঁর নিজস্ব পরিচয়ে অবস্থান করবেন, নারীর চলাফেরায় কেউ বাধা দেবেন না, হেফাজতি দৃষ্টিভঙ্গির উচ্ছেদ করতে হবে প্রত্যেকের মন থেকে, বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। আমরা চাই নির্বিঘ্নে, সুষ্ঠুভাবে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণে আগামী নির্বাচন সময়মতো হোক।
মালেকা বেগম: নারীনেত্রী, অধ্যাপক, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।
মালেকা বেগম: নারীনেত্রী, অধ্যাপক, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।
No comments