প্রশাসন দলীয়করণের পরিণাম! by আবদুল লতিফ মণ্ডল
গত
৩ নভেম্বর ‘ওরা যেন পালাতে না পারেন’ শিরোনামে যুগান্তরের প্রথম পৃষ্ঠায়
একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘প্রশাসনে ক্ষমতার চরম
অপব্যবহারকারী ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের অনেকে মহাজোট সরকারের মেয়াদের
শেষ সময়টায় লিয়েন, শিক্ষা ছুটি ও বিদেশ সফরের নামে দেশ থেকে সটকে পড়ার জন্য
মরিয়া হয়ে উঠেছেন। ইতিমধ্যে কয়েকজন সন্তর্পণে চলেও গেছেন। বাকিরা পাততাড়ি
গোটানোর তালে আছেন। এ নিয়ে জনপ্রশাসনে কর্মরত সাধারণ কর্মকর্তা ও
কর্মচারীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে। এই ক্ষোভ শুধু
সরকারবিরোধী সমর্থক কর্মকর্তাদের মধ্যেই নয়, সাধারণ কর্মকর্তা ও কর্মচারী,
এমনকি সরকার সমর্থক কর্মকর্তাদের কেউ কেউ এ নিয়ে বেজায় নাখোশ। এসব
কর্মকর্তা ও কর্মচারী বলছেন, আওয়ামী ঘরানার কর্মকর্তা সেজে গত পৌনে পাঁচ
বছরে যারা প্রশাসনের ওপর নানাভাবে নির্যাতনের স্টিম রোলার চালিয়েছেন এবং
দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ সহায়-সম্পদের মালিক হয়েছেন,
তাদের এখন কোনো অবস্থাতেই দেশ ছাড়তে দেয়া উচিত হবে না।’ প্রতিবেদনে আরও
উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশ সচিবালয়ের কয়েকজন সিনিয়র সহকারী সচিব, উপসচিব ও
যুগ্ম সচিব প্রতিবেদককে বলেছেন, ‘ক্ষমতার অপব্যবহারকারী ও দুর্নীতিবাজ
কর্মকর্তাদের ক্ষমা নেই। তাই ওদের পালাতে দেয়া যাবে না।’
প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দলবাজি প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ সচিবালয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, প্রজাতন্ত্রের কর্মের সব ক্ষেত্রেই যেমন- সংযুক্ত দফতর, অধস্তন দফতর, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, আধা- স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, এন্টারপ্রাইজ ইত্যাদিতে এর বিস্তার ঘটেছে। নিজের স্বার্থ রক্ষার্থে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা থেকে সর্বনিু পর্যায়ের কর্মচারী দলবাজিতে লিপ্ত। পেশাজীবীরা যেমন- চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষক, কৃষিবিদরাও দলবাজিতে পিছিয়ে নেই। প্রজাতন্ত্রের নিরপেক্ষ ও নিরীহ কর্মচারীরা উপেক্ষিত। যুগান্তরের আলোচ্য প্রতিবেদনে এ অবস্থারই প্রতিফলন ঘটেছে।
তবে এটাও সত্য যে, প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দলবাজি বর্তমান সরকারের আমলেই শুরু হয়নি। গত ২০ বছরে দুটি বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ তাদের পালাক্রমিক শাসনামলে প্রশাসনকে দলীয়করণের কোনো চেষ্টাই বাকি রাখেনি। প্রশাসনে দলীয়করণে ব্যবহৃত দুটি মোক্ষম অস্ত্র হল পদোন্নতি ও প্রাইজ পোস্টিং। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ তাদের শাসনামলে প্রশাসন দলীয়করণে এ দুটি অস্ত্রের পূর্ণ ব্যবহার করেছে। প্রশাসনকে দলীয়করণে রাজনীতিকদের উদ্যোগ কর্মকর্তাদের দলবাজ হতে উৎসাহ দিয়েছে।
স্বাধীনতার পর থেকে আশির দশকের শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ সচিবালয়ের উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পদগুলোতে নিয়োগ ও পদোন্নতির ব্যাপারে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হলেও বিএনপির শাসনামলে ১৯৯২ সালে এসব পদে পদোন্নতিতে বড় ধরনের বিশৃংখলার শুরু হয়। অনেকের মতে, প্রশাসনকে দলীয়করণেরও এটি ছিল প্রথম সুপরিকল্পিত বড় পদক্ষেপ। তবে কেউ কেউ মনে করেন, স্বাধীনতার পর পরই তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতির ব্যত্যয় ঘটিয়ে বিপুলসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাকে ম্যাজিস্ট্রেট ও অন্যান্য পদে চাকরি প্রদান ছিল প্রশাসনকে দলীয়করণের প্রথম পদক্ষেপ। এদের অধিকাংশ কর্মকর্তা প্রশাসনে ‘আওয়ামীপন্থী’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় এসেছে, তখনই এসব কর্মকর্তা প্রশাসনে নানা ধরনের সুবিধা পেয়েছেন।
অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটের দাবি গণআন্দোলনে রূপ নিলে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি সরকারের পতন হয়। ১৯৯১ সালের ফেব্র“য়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। সরকার গঠনের এক বছর পার না হতেই বাংলাদেশ সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে বিএনপির প্রতি সহানুভূতি সৃষ্টি করতে এবং পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের সময় তা কাজে লাগাতে ১৯৯২ সালের ফেব্র“য়ারিতে প্রয়োজনীয় শূন্যপদ ছাড়াই বিএনপি সরকার বাংলাদেশ সচিবালয়ের উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পদে সাতশ’র বেশি কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়।
১৯৯২ সালে বিএনপি প্রয়োজনীয় শূন্যপদ ছাড়াই অনেকটা ‘গণপদোন্নতির’ যে নজির সৃষ্টি করে, ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ তা যত্নসহকারে অনুসরণ করে।
২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার শূন্যপদ ছাড়া পদোন্নতি ও প্রশাসনে দলীয়করণের গতিকে জোরদার করে। এ ছাড়া স্বাধীনতার পর চাকরিতে নিয়োজিত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যারা ‘আওয়ামীপন্থী’ হিসেবে বহুল পরিচিত, তাদের চাকরি হতে অবসর প্রদান করে। এখানেই শেষ নয়। ২০০৭ সালে অনুষ্ঠেয় সংসদ নির্বাচনে নিজেদের বিজয় সুনিশ্চিত করতে বিএনপি সরকার প্রশাসন সাজানোর উদ্যোগ নেয়। নির্বাচনে ভূমিকা রাখতে পারে প্রশাসনের এমন গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নিজেদের পছন্দসই লোক রাখতে প্রতিটি পদের বিপরীতে একাধিক বিকল্প কর্মকর্তার তালিকা প্রণয়ন করা হয়, যাতে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় প্রশাসনে বড় ধরনের রদবদল হলেও তাদের নিজেদের লোক এসব পদে থাকে। বহুল আলোচিত ১/১১-এর কারণে তাদের সে আশা পূরণ হয়নি।
২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার প্রয়োজনীয় সংখ্যক শূন্যপদ ছাড়াই বাংলাদেশ সচিবালয়ে উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পদে পদোন্নতি প্রদান এবং দলীয়করণের ধারা অব্যাহত রাখে। ক্ষমতা গ্রহণের মেয়াদ এক বছর পূর্ণ না হতেই ২০০৯ সালের ৭ সেপ্টেম্বরে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শূন্যপদ ছাড়াই সচিবালয়ে অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপসচিব পদে ৪৯৪ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়। প্রয়োজনীয় সংখ্যক শূন্যপদ না থাকা সত্ত্বেও ২০১২ সালের ফেব্র“য়ারিতে উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও উপসচিব পদে প্রায় সাতশ’ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়। শূন্যপদের অভাবে তাদের অধিকাংশকে পদোন্নতি পূর্বপদে পদায়ন করা হয়। শূন্যপদ ছাড়াই পদোন্নতি প্রদানের সর্বশেষ উদাহরণ গত ১৮ জুলাই তিনশ’র অধিক উপসচিবকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি প্রদান।
তাছাড়া এবার ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ প্রশাসনে দলীয়করণকে জোরদার করতে ‘আওয়ামীপন্থী’ হিসেবে পরিচিত যেসব মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাকে বিএনপি অবসর প্রদান করেছিল বা যারা আওয়ামী লীগের ভাবাদর্শে বিশ্বাসী, যারা স্বাভাবিক নিয়মে অবসর গ্রহণ করেছিলেন তাদের অনেককে স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়। তাদের অনেককে নিয়োগ দেয়া হয় বিভিন্ন কমিশনে। অনেকে মনে করেন, বর্তমান সরকারের আমলে প্রশাসনকে দলীয়করণ ও কর্মচারীদের দলবাজি অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, প্রশাসনে দলীয়করণের অন্য মোক্ষম অস্ত্রটি হল ভালো পোস্টিং। গত দু’দশকে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের শাসনামলে যে বিষয়টি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে তা হল, ক্ষমতাসীন দলের ভাবধারা ও আদর্শে বিশ্বাসী না হলে কোনো কর্মকর্তার পক্ষে মন্ত্রণালয়/বিভাগের সচিব; সংযুক্ত দফতর, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, আধা- স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার প্রধান এবং দ্বিতীয় স্তরের পদে পোস্টিং পাওয়া সম্ভব নয়। জনপ্রশাসনের মাঠ পর্যায়ে ডিসি, এসপি প্রভৃতি পদে পদায়নে এটা সমভাবে প্রযোজ্য। উপমহাদেশের অন্য দেশগুলোতে রাজনীতিকরা প্রশাসনে তথা আমলাতন্ত্রে বিভেদ সৃষ্টি করতে না পারলেও বাংলাদেশে রাজনীতিকরা, বিশেষ করে বড় দুটি দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের রাজনীতিকরা সফলভাবে এ কাজটি সমাধা করতে পেরেছেন। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মূলত ‘আওয়ামীপন্থী’ ও ‘বিএনপিপন্থী’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। দুই শিবিরে বিভক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে সুসম্পর্কের অভাব রয়েছে। একই ব্যাচের কর্মকর্তা হয়ে তারা একজন আরেকজনকে বিশ্বাস করতে পারেন না। এতে সরকারের কাজের গতি ব্যাহত হচ্ছে। কর্মকর্তাদের দক্ষতা ও সততা এখন প্রশ্নের সম্মুখীন। এ ছাড়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দলবাজি ও ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিকদের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ায় কারণে মাঠ পর্যায়ে সরকারি সিদ্ধান্তের নিরপেক্ষ বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও লাভবান হচ্ছেন বড় দুটি দলের রাজনীতিকরা।
প্রশাসন দলীয়করণের যে সর্বনাশা খেলায় রাজনৈতিক দলগুলো মেতে উঠেছে, তা থেকে তাদের সরে আসতে হবে। সংবিধানে প্রজাতন্ত্রের কর্মে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ ও কর্মের শর্তাবলী নিয়ন্ত্রণে আইন প্রণয়নের নির্দেশনা থাকলেও স্বাধীনতার চার দশকেও তা করা হয়নি। স্বাধীনতার পর চার দশকের তিন দশক দেশ শাসন করেছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। প্রজাতন্ত্রের কর্মে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ ও কর্মের শর্তাবলী নিয়ন্ত্রণে আইন প্রণীত হলে তারা খেয়ালখুশি মোতাবেক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যবহার করতে পারবেন না ভেবে তারা আইনটি প্রণয়ন করেননি। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার এবার ক্ষমতায় এসে আইনটি প্রণয়নের উদ্যোগ নিলেও এখন তারা তা থেকে সরে এসেছে। প্রশাসনে গতিশীলতা, স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার জন্য আইনটি দরকার। আগামীতে যে দলই ক্ষমতায় আসুক, তাদের উচিত হবে আইনটি প্রণয়ন করা এবং প্রশাসনে দলীয়করণ বন্ধের মাধ্যমে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দলবাজির অবসান ঘটানো। তাদের প্রস্তুত করতে হবে একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য।
আবদুল লতিফ মণ্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দলবাজি প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ সচিবালয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, প্রজাতন্ত্রের কর্মের সব ক্ষেত্রেই যেমন- সংযুক্ত দফতর, অধস্তন দফতর, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, আধা- স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, এন্টারপ্রাইজ ইত্যাদিতে এর বিস্তার ঘটেছে। নিজের স্বার্থ রক্ষার্থে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা থেকে সর্বনিু পর্যায়ের কর্মচারী দলবাজিতে লিপ্ত। পেশাজীবীরা যেমন- চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষক, কৃষিবিদরাও দলবাজিতে পিছিয়ে নেই। প্রজাতন্ত্রের নিরপেক্ষ ও নিরীহ কর্মচারীরা উপেক্ষিত। যুগান্তরের আলোচ্য প্রতিবেদনে এ অবস্থারই প্রতিফলন ঘটেছে।
তবে এটাও সত্য যে, প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দলবাজি বর্তমান সরকারের আমলেই শুরু হয়নি। গত ২০ বছরে দুটি বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ তাদের পালাক্রমিক শাসনামলে প্রশাসনকে দলীয়করণের কোনো চেষ্টাই বাকি রাখেনি। প্রশাসনে দলীয়করণে ব্যবহৃত দুটি মোক্ষম অস্ত্র হল পদোন্নতি ও প্রাইজ পোস্টিং। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ তাদের শাসনামলে প্রশাসন দলীয়করণে এ দুটি অস্ত্রের পূর্ণ ব্যবহার করেছে। প্রশাসনকে দলীয়করণে রাজনীতিকদের উদ্যোগ কর্মকর্তাদের দলবাজ হতে উৎসাহ দিয়েছে।
স্বাধীনতার পর থেকে আশির দশকের শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ সচিবালয়ের উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পদগুলোতে নিয়োগ ও পদোন্নতির ব্যাপারে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হলেও বিএনপির শাসনামলে ১৯৯২ সালে এসব পদে পদোন্নতিতে বড় ধরনের বিশৃংখলার শুরু হয়। অনেকের মতে, প্রশাসনকে দলীয়করণেরও এটি ছিল প্রথম সুপরিকল্পিত বড় পদক্ষেপ। তবে কেউ কেউ মনে করেন, স্বাধীনতার পর পরই তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতির ব্যত্যয় ঘটিয়ে বিপুলসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাকে ম্যাজিস্ট্রেট ও অন্যান্য পদে চাকরি প্রদান ছিল প্রশাসনকে দলীয়করণের প্রথম পদক্ষেপ। এদের অধিকাংশ কর্মকর্তা প্রশাসনে ‘আওয়ামীপন্থী’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় এসেছে, তখনই এসব কর্মকর্তা প্রশাসনে নানা ধরনের সুবিধা পেয়েছেন।
অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটের দাবি গণআন্দোলনে রূপ নিলে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি সরকারের পতন হয়। ১৯৯১ সালের ফেব্র“য়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। সরকার গঠনের এক বছর পার না হতেই বাংলাদেশ সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে বিএনপির প্রতি সহানুভূতি সৃষ্টি করতে এবং পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের সময় তা কাজে লাগাতে ১৯৯২ সালের ফেব্র“য়ারিতে প্রয়োজনীয় শূন্যপদ ছাড়াই বিএনপি সরকার বাংলাদেশ সচিবালয়ের উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পদে সাতশ’র বেশি কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়।
১৯৯২ সালে বিএনপি প্রয়োজনীয় শূন্যপদ ছাড়াই অনেকটা ‘গণপদোন্নতির’ যে নজির সৃষ্টি করে, ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ তা যত্নসহকারে অনুসরণ করে।
২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার শূন্যপদ ছাড়া পদোন্নতি ও প্রশাসনে দলীয়করণের গতিকে জোরদার করে। এ ছাড়া স্বাধীনতার পর চাকরিতে নিয়োজিত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যারা ‘আওয়ামীপন্থী’ হিসেবে বহুল পরিচিত, তাদের চাকরি হতে অবসর প্রদান করে। এখানেই শেষ নয়। ২০০৭ সালে অনুষ্ঠেয় সংসদ নির্বাচনে নিজেদের বিজয় সুনিশ্চিত করতে বিএনপি সরকার প্রশাসন সাজানোর উদ্যোগ নেয়। নির্বাচনে ভূমিকা রাখতে পারে প্রশাসনের এমন গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নিজেদের পছন্দসই লোক রাখতে প্রতিটি পদের বিপরীতে একাধিক বিকল্প কর্মকর্তার তালিকা প্রণয়ন করা হয়, যাতে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় প্রশাসনে বড় ধরনের রদবদল হলেও তাদের নিজেদের লোক এসব পদে থাকে। বহুল আলোচিত ১/১১-এর কারণে তাদের সে আশা পূরণ হয়নি।
২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার প্রয়োজনীয় সংখ্যক শূন্যপদ ছাড়াই বাংলাদেশ সচিবালয়ে উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পদে পদোন্নতি প্রদান এবং দলীয়করণের ধারা অব্যাহত রাখে। ক্ষমতা গ্রহণের মেয়াদ এক বছর পূর্ণ না হতেই ২০০৯ সালের ৭ সেপ্টেম্বরে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শূন্যপদ ছাড়াই সচিবালয়ে অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপসচিব পদে ৪৯৪ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়। প্রয়োজনীয় সংখ্যক শূন্যপদ না থাকা সত্ত্বেও ২০১২ সালের ফেব্র“য়ারিতে উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও উপসচিব পদে প্রায় সাতশ’ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়। শূন্যপদের অভাবে তাদের অধিকাংশকে পদোন্নতি পূর্বপদে পদায়ন করা হয়। শূন্যপদ ছাড়াই পদোন্নতি প্রদানের সর্বশেষ উদাহরণ গত ১৮ জুলাই তিনশ’র অধিক উপসচিবকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি প্রদান।
তাছাড়া এবার ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ প্রশাসনে দলীয়করণকে জোরদার করতে ‘আওয়ামীপন্থী’ হিসেবে পরিচিত যেসব মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাকে বিএনপি অবসর প্রদান করেছিল বা যারা আওয়ামী লীগের ভাবাদর্শে বিশ্বাসী, যারা স্বাভাবিক নিয়মে অবসর গ্রহণ করেছিলেন তাদের অনেককে স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়। তাদের অনেককে নিয়োগ দেয়া হয় বিভিন্ন কমিশনে। অনেকে মনে করেন, বর্তমান সরকারের আমলে প্রশাসনকে দলীয়করণ ও কর্মচারীদের দলবাজি অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, প্রশাসনে দলীয়করণের অন্য মোক্ষম অস্ত্রটি হল ভালো পোস্টিং। গত দু’দশকে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের শাসনামলে যে বিষয়টি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে তা হল, ক্ষমতাসীন দলের ভাবধারা ও আদর্শে বিশ্বাসী না হলে কোনো কর্মকর্তার পক্ষে মন্ত্রণালয়/বিভাগের সচিব; সংযুক্ত দফতর, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, আধা- স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার প্রধান এবং দ্বিতীয় স্তরের পদে পোস্টিং পাওয়া সম্ভব নয়। জনপ্রশাসনের মাঠ পর্যায়ে ডিসি, এসপি প্রভৃতি পদে পদায়নে এটা সমভাবে প্রযোজ্য। উপমহাদেশের অন্য দেশগুলোতে রাজনীতিকরা প্রশাসনে তথা আমলাতন্ত্রে বিভেদ সৃষ্টি করতে না পারলেও বাংলাদেশে রাজনীতিকরা, বিশেষ করে বড় দুটি দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের রাজনীতিকরা সফলভাবে এ কাজটি সমাধা করতে পেরেছেন। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মূলত ‘আওয়ামীপন্থী’ ও ‘বিএনপিপন্থী’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। দুই শিবিরে বিভক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে সুসম্পর্কের অভাব রয়েছে। একই ব্যাচের কর্মকর্তা হয়ে তারা একজন আরেকজনকে বিশ্বাস করতে পারেন না। এতে সরকারের কাজের গতি ব্যাহত হচ্ছে। কর্মকর্তাদের দক্ষতা ও সততা এখন প্রশ্নের সম্মুখীন। এ ছাড়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দলবাজি ও ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিকদের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ায় কারণে মাঠ পর্যায়ে সরকারি সিদ্ধান্তের নিরপেক্ষ বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও লাভবান হচ্ছেন বড় দুটি দলের রাজনীতিকরা।
প্রশাসন দলীয়করণের যে সর্বনাশা খেলায় রাজনৈতিক দলগুলো মেতে উঠেছে, তা থেকে তাদের সরে আসতে হবে। সংবিধানে প্রজাতন্ত্রের কর্মে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ ও কর্মের শর্তাবলী নিয়ন্ত্রণে আইন প্রণয়নের নির্দেশনা থাকলেও স্বাধীনতার চার দশকেও তা করা হয়নি। স্বাধীনতার পর চার দশকের তিন দশক দেশ শাসন করেছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। প্রজাতন্ত্রের কর্মে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ ও কর্মের শর্তাবলী নিয়ন্ত্রণে আইন প্রণীত হলে তারা খেয়ালখুশি মোতাবেক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যবহার করতে পারবেন না ভেবে তারা আইনটি প্রণয়ন করেননি। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার এবার ক্ষমতায় এসে আইনটি প্রণয়নের উদ্যোগ নিলেও এখন তারা তা থেকে সরে এসেছে। প্রশাসনে গতিশীলতা, স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার জন্য আইনটি দরকার। আগামীতে যে দলই ক্ষমতায় আসুক, তাদের উচিত হবে আইনটি প্রণয়ন করা এবং প্রশাসনে দলীয়করণ বন্ধের মাধ্যমে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দলবাজির অবসান ঘটানো। তাদের প্রস্তুত করতে হবে একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য।
আবদুল লতিফ মণ্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
No comments