ওয়াকফ কী ও কেন? by মোহাম্মদ হাবিুবর রহমান

আরবি ‘ওয়াকফ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ স্থগিত করা, আবদ্ধ করা, স্থির রাখা, বাধা দেয়া, সংযত করা ইত্যাদি। মুসলিম আইনের পরিভাষায় এর অর্থ, কোনো বস্তুকে রক্ষা করা- এটাকে তৃতীয় ব্যক্তির মালিকানাভুক্ত হতে বাধা দেয়া।
শরিয়াহর পরিভাষায়, কোনো বস্তু আল্লাহর মালিকানায় রেখে তার উৎপাদন বা উপযোগকে দরিদ্রকে কিংবা যেকোনো কল্যাণকর খাতে দান করাকে ওয়াকফ বলা হয়। বিধিবদ্ধ ইসলামি আইনে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি কর্তৃক নিজ সম্পত্তি আল্লাহ তায়ালার মালিকানায় সোপর্দ করে তা থেকে প্রাপ্ত আয় ধর্মীয় বা জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয়ের নির্দেশ দেয়াকে ওয়াকফ বলা হয়। সংজ্ঞার বিশ্লেষণে বলা যায়, কোনো জিনিস নিজের মালিকানা থেকে মুক্ত করে স্থায়ীভাবে আল্লাহর মালিকানায় অর্পণ করা এবং তা থেকে প্রাপ্ত আয় অন্য কারো অনুকূলে দান করাকে ওয়াকফ বলা হয়ে থাকে। ইমাম আবু হানিফা রহ:-এর মতে, ‘কোনো বস্তুকে ওয়াকফকারীর মালিকানায় রেখে; এর উৎপাদন ও উপযোগকে গরিবদের মধ্যে কিংবা যেকোনো কল্যাণকর খাতে দান করে দেয়াকে ওয়াকফ বলা হয়।’ ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদ রহ:-এর মতে, কোনো বস্তুকে আল্লাহর মালিকানায় এমনভাবে দিয়ে দেয়া যে, এর উৎপাদন ও উপযোগ দ্বারা মানুষই উপকৃত হবে। ইমাম আবু ইউসুফ রহ:-এর মতে, ওয়াকফ করার পর সংশ্লিষ্ট জিনিসের ওপর ওয়াকফকারীর মালিকানাস্বত্ব রহিত হয়ে যায়। এসব সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করে আমরা বলতে পারি, ‘ওয়াকফ’ বলতে এমন বস্তুকে বুঝায়, যার মালিক ওই বস্তুর স্বত্ব ও আয় হস্তান্তরের অধিকার এই শর্তে ত্যাগ করেন যে, ওই বস্তুর মালিকানাস্বত্ব অক্ষুণ্ন থাকবে এবং তার আয় শরিয়াহসম্মত সৎকাজে ব্যয় হবে। যে আইনানুগ প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি দ্বারা এই ধরনের দান সম্পাদিত হয়, তাকেই প্রকৃতপক্ষে ওয়াকফ বলা হয়; কিন্তু সাধারণত ওয়াকফ শব্দটি ‘মাওকুফ’ অর্থাৎ প্রদত্ত সম্পত্তিকে বুঝায়। আধুনিক যুগে প্রাচীন ওয়াকফ (জায়গা, জমি বা অন্য কোনো স্থাবর সম্পত্তি)-এর বাইরে নতুন ধরনের কিছু ওয়াকফের প্রচলন ঘটছে। যেমন : ক্যাশ ওয়াকফ, বুদ্ধিভিত্তিক সম্পদ (Intellectual Property) বা নিজস্ব সৃষ্টিকর্ম ওয়াকফ ইত্যাদি। মানবতার কল্যাণে ব্যবহার করা সহজ হওয়ায় নগদ অর্থের ওয়াকফ করা ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করছে। নগদ অর্থ ওয়াকফের ব্যাপারে ফতোয়ায়ে আলমগিরিতে উল্লেখ করা হয়েছে- যে দেশে দিরহাম-দিনার, টাকা-পয়সা, কাপড়-চোপড়, ওজনযোগ্য বস্তু এবং পরিমাপযোগ্য বস্তু ওয়াকফ করার নিয়ম প্রচলিত আছে, সে দেশে এ জাতীয় বস্তু ওয়াকফ করা জায়েজ। তবে এ ক্ষেত্রে ওয়াকফ বস্তুর মূলকে অবশিষ্ট রেখে এর মাধ্যমে উপকার লাভ করা যাবে। টাকা ওয়াকফ করা হলে এ টাকা থেকে গরিব লোকদের ঋণ দেয়া হবে। অথবা মুদারাবার ভিত্তিতে ব্যবসা করে এর লভ্যাংশ গরিবদের মধ্যে বণ্টন করা হবে।
কাপড় ওয়াকফ করা হলে তা গরিবদের প্রয়োজনের ভিত্তিতে দেয়া হবে। আবার তা উসুল করে নিতে হবে। একই গ্রন্থে মসজিদ মেরামত, পুল নির্মাণ, রাস্তা সংস্কার, কবরস্থান, পানি সরবরাহ এবং মুসলমানদের জন্য সরাইখানা নির্র্মাণের জন্য মালামাল ওয়াকফ করা জায়েজ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ফতোয়ায়ে শামিতে উল্লেখ রয়েছে- টাকা-পয়সা ওয়াকফ করা বৈধ। তবে ওয়াকফ বস্তুর মূলকে অবশিষ্ট রেখে কেবল তার উৎপাদন ও উপযোগ দ্বারাই উপকার লাভ করা বৈধ। এক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে- আসল টাকা ব্যয় করা যাবে না, বরং তার লভ্যাংশ ব্যয় করতে হবে। নগদ অর্থ (দিনার বা দিরহাম) ওয়াকফ বৈধ হওয়ার ব্যাপারে ইমাম ইবনে শিহাব জুহরি রহ:, ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ: প্রমুখের ইতিবাচক অভিমত রয়েছে। এ ছাড়া ১৪২৫ হিজরি সালে (২০০৪ খ্রি:) ওমানের রাজধানী মাসকাটে অনুষ্ঠিত ওআইসি ইসলামি ফিকহ অ্যাকাডেমির অধিবেশনে ১৫/৬/১৪০ নম্বর সিদ্ধান্তে নগদ অর্থ ওয়াকফ করা বৈধ হওয়ার পক্ষে ফতোয়া দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, আইডিবির সাবেক অর্থনীতিবিদ এবং বিশিষ্ট ব্যাংকার প্রফেসর ড. আবদুল মান্নান সামর্থ্যবানদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে তার আয় দারিদ্র্য বিমোচনসহ জনকল্যাণমূলক বিভিন্ন খাতে ব্যয়ের উদ্দেশ্যে সর্বপ্রথম বাংলাদেশে ক্যাশ ওয়াকফ সার্টিফিকেট চালু করেছিলেন। দেশের বেসরকারি খাতের সর্ববৃহৎ শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড ২০০৪ সালে মুদারাবা ওয়াকফ ক্যাশ ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট (MWCDA) নামে একটি নতুন প্রোডাক্ট চালু করে, যা বেশ জনপ্রিয়তা অর্জনে সক্ষম হয়েছে।
ওয়াকফের প্রকার
ওয়াকফকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা হয়। সেগুলো হলো- ০১. ধর্মীয় ওয়াকফ : মসজিদ, মাদরাসা, ঈদগাহ, কবরস্থান ইত্যাদি নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্যে যে ওয়াকফ করা হয়, সেগুলোকে ধর্মীয় ওয়াকফ বলা হয়। ০২. জনকল্যাণমূলক ওয়াকফ : সমাজের সব শ্রেণীর লোকদের উদ্দেশ্যে লাইব্রেরি, বৈজ্ঞানিক গবেষণা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, পরিবেশ ও প্রাণী সংরক্ষণ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের অর্থায়ন, পার্ক, রাস্তা, ব্রিজ, জলাধার ইত্যাদি নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্যে যে ওয়াকফ করা হয়, সেগুলোকে জনকল্যাণমূলক ওয়াকফ বলা হয়। ০৩. পারিবারিক ওয়াকফ : এ ধরনের ওয়াকফে ওয়াকফকৃত সম্পদ থেকে অর্জিত আয়ের একটি অংশ-পরিমাণ নিজের পরিবার, সন্তান-সন্ততি ও বংশধরদের ভরণপোষণের ব্যয়ভার বহনের জন্য ব্যয় হবে বলে উল্লে­খ করা হয়। নির্দিষ্ট অংশ-পরিমাণের চেয়ে বেশি অংশ-পরিমাণ দরিদ্র বা জনকল্যাণে ব্যয়িত হয়। হজরত উমর রা:-এর খিলাফতকালে (৬৩৫-৬৪৫ খ্রি:) এ ধরনের ওয়াকফের প্রচলন শুরু হয়েছিল। এমনকি, মুসলিম আইন অনুসারে শুধু পরিবার-বংশধরদের জন্য ওয়াকফ করাও বৈধ। মুসলিম স্কলারদের দৃষ্টিতে এ ধরনের পারিবারিক ওয়াকফও এক ধরনের জনকল্যাণ। কেননা, এর মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম খরচ ছাড়াই ওয়াকফকৃত সম্পদের আয় ও কল্যাণ পেতে থাকে এবং সরকারের পক্ষ থেকে এসব নাগরিকের জন্য দাতব্য কাজ করার দায়িত্ব কমে যায়। ওয়াকফ অফুরন্ত সওয়াব বা পুণ্য লাভের একটি উপায় যা মৃত্যুর পরও জারি থাকে। ইসলামের শুরু থেকে অদ্যাবধি মুসলিম উম্মাহ আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের এই সুন্দর ব্যবস্থা অনুসরণ করে এসেছে। মহানবী সা: নিজে ওয়াকফ করার ব্যাপারে উৎসাহিত করেছেন। ওয়াকফের উপকারিতা কিংবা ব্যক্তি, সমাজ, অর্থনীতি বা রাষ্ট্রের কল্যাণে ওয়াকফের ভূমিকা ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন আলোচ্য বিষয়। এক বাক্যে বলতে গেলে ওয়াকফের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো- জনগণের সেবা ও কল্যাণ সাধনের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জন। ওয়াকফ দেশের ব্যক্তি, সমাজ ও অর্থনীতির জন্য অফুরন্ত কল্যাণ বয়ে আনে। যেহেতু ওয়াকফ তহবিল সবার জন্য ব্যয় করা যায়, তাই জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার প্রয়োজন এর মাধ্যমে পূরণ করা যায়। বিভিন্ন সামাজিক কল্যাণকর কাজে ওয়াকফ তহবিল অর্থায়নের মাধ্যমে সরকারি উন্নয়ন বাজেটের বিপুল অংশ বেঁচে যেতে পারে। বেঁচে যাওয়া অর্থ সরকার অন্যান্য জনকল্যাণকর খাতে কার্যকরভাবে ব্যয় করতে পারে। এভাবে ওয়াকফ সরকারের ব্যয় ও দায়িত্বের বোঝা লাঘব করতে সাহায্য এবং অর্থনীতিতে সরকারের অংশগ্রহণ হ্রাস করে। সমাজের জন্য উপকারী কোনো বিশেষ উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য যত বেশি ওয়াকফের অর্থ সংগ্রহ করা হবে, সেই বিশেষ প্রকল্পে সরকারের ব্যয় তত হ্রাস পাবে। সরকারের ব্যয় হ্রাস পাওয়ায় তা সরকারের বাজেট ঘাটতি পূরণেও সহায়ক হয়। ফলে সরকারের বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস পায় এবং অর্থনীতির crowding-out effect নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করা যায়। তবে কেউ যদি নিছক সুনাম ও সুখ্যাতির উদ্দেশ্যে কোনো কিছু ওয়াকফ করে তা আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্য হবে না। অথবা কেউ যদি ওয়াকফ করে দান করার পর তা বলে বেড়ান, তবে এর সওয়াব নষ্ট হয়ে যাবে। আল্লাহ বলেন, হে মুমিনগণ! দানের কথা প্রচার করে এবং কষ্ট দিয়ে তোমাদের দান-খয়রাতকে সেই ব্যক্তির মতো নষ্ট করে দিও না, যে নিছক লোক দেখানোর জন্য নিজের সম্পদ ব্যয় করে এবং আল্লাহ ও পরকালের ওপর ঈমান রাখে। তার উপমা একটি মসৃণ পাথর যার ওপর কিছু মাটি থাকে। অতপর, তার ওপর প্রবল বৃষ্টিপাত তাকে পরিষ্কার করে রেখে দেয়; যা তারা উপার্জন করেছে এর কিছুই তারা তাদের কাজে লাগাতে পারবে না। (সূরা বাকারা, ২৬৪)।
দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে ওয়াকফকে কাজে লাগানোর জন্য উত্থাপিত এক প্রস্তাবে বলা হয়, আমাদের দেশে যারা বিপুল সম্পত্তির অধিকারী, তাদের সংখ্যা অনেক। তারা যদি তাদের সম্পত্তি শুধু সন্তানের জন্য না রেখে জাতিকে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ওয়াকফের মাধ্যমে দিয়ে যান, তাহলে সেটা হবে খুবই ভালো কাজ। এর পরিমাণ কোনো সম্পত্তির যেকোনো পরিমাণ অংশ হতে পারে। তা চার ভাগের এক ভাগ কিংবা তিন ভাগের এক ভাগ অথবা ১০ ভাগের একভাগ ইত্যাদি। অর্থাৎ প্রত্যেক বড় বড় ধনবান পরিবার, শিল্পপতি, যাদের সম্পদের পরিমাণ ১০০ কোটি বা তার বেশি, তারা তাদের মালিকানাধীন কারখানার মধ্য থেকে একটি বা দু’টি ওয়াকফ করে দিতে পারেন। তাদের নগদ অর্থেরও একটি অংশ ওয়াকফ করতে পারেন। তাহলে সেটি সমাজের জন্য অনেক বড় কাজ হবে। ওয়াকফের তহবিল বা সম্পত্তি ব্যবস্থাপনার জন্য একটা পরিচালনা কমিটি থাকে। প্রত্যেক ওয়াকফকারী তার ওয়াকফের জন্য একটি কমিটি করে দিতে পারেন। ওয়াকফকৃত সম্পত্তির মূল অংশ ব্যয় করা হয় না। ব্যয় করা হয় সেখান থেকে আয়ের বা লাভের অংশকে। এমনিভাবে যদি আমাদের দেশের ৫০ জন শিল্পপতি ৫০টি ওয়াকফ তহবিল বা ট্রাস্ট জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য গঠন করেন, তাহলে এটা বিরাট অবদান রাখতে পারে। এরপর যদি ট্রাস্টগুলো নিয়ে একটি ফেডারেশন গঠন করা যায়, তাহলে সেখান থেকে সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কাজ ভাগ করে নেয়া যেতে পারে। সবাই একই রকম কাজ এবং একই এলাকায় না করে কে কোন এলাকায় কাজ করবেন, তা ঠিক করে নিতে পারবেন। এমন সমন্বয়ের ব্যবস্থা যদি করা যায়, মানবতার কল্যাণে তা বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে।
লেখক : অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট, শরিয়াহ সেক্রেটারিয়েট
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড
mhr.mhrahman@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.