দুঃস্বপ্নে পাওয়া কিছু রাজকৌতুক! by ফারুক ওয়াসিফ

এক নাগরিক খুব করে দেশের ভালো চাইছিলেন। তো এক দরবেশ এক রাতে তার স্বপ্নে দেখা দিলেন। বললেন, ‘তোমার আবেগ দেখে আমি খুশি। বলো কী চাও?’ লোকটা আর কী বলবে। বললেন, ‘হে দয়াল দরবেশ, আমি চাই যে আমার দেশের নেতারা গণতান্ত্রিকও হবেন, আবার সবার উন্নয়নও করবেন।’ কথা শুনে দরবেশের কপালে চিন্তার রেখা ফুটল। তিনি বললেন, ‘সব কী আর আমি পারি রে! যা বর দিলাম, তোরা এমন নেতাই পাবি। কিন্তু কারও মধ্যে একসঙ্গে দুটি গুণ থাকবে না।’ সেই থেকে উন্নয়ন আর গণতন্ত্র একসঙ্গে আর হাঁটে না। বাংলাদেশের বিয়েশাদির দাওয়াতগুলোর রাজনৈতিক উপযোগিতা দারুণ। বাইরে যতই শত্রুতা থাক, দাওয়াতে সরকারি ও বিরোধী পক্ষের লোকজন হাসিমুখে কথা বলে। কখনো-সখনো মন খুলে কথাও বলে। তো এ রকম এক দাওয়াতে পাশাপাশি খেতে বসেছেন দুই দলের নেতা। তাঁদের মধ্যে গল্প হচ্ছে। বিএনপির নেতা আওয়ামী লীগ নেতার কাছে জানতে চাইলেন: আপনার দলের ভেতরের কী অবস্থা? আওয়ামী লীগের নেতা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন, ‘কী বলব, পরিস্থিতি গুরুতর, কিন্তু নিরাশ হওয়ার মতো না। কিন্তু আপনাদের কী অবস্থা?’ বোরহানিতে চুমুক দিতে দিতে বিএনপি নেতার জবাব: ‘আমাদের কথা তো জানেনই, কোনো আশা নেই, কিন্তু পরিস্থিতিটাকে গুরুতর করা যাচ্ছে না! যা-ই করছি, সরকার হেসে উড়িয়ে দিচ্ছে।’ তো, এক দেশে সম্পত্তি নিয়ে দুই শরিকে প্রচণ্ড ঝগড়া-মারামারি। বড় শরিকের ইচ্ছা ছোটটাকে কিচ্ছু দেবে না। তো বছরের পর বছর তারা এই নিয়ে লড়াই করে ক্লান্ত হলো। অবশেষে আর না পেরে তারা এক বৃদ্ধ শিক্ষকের কাছে গেল মীমাংসার জন্য। তিনি বললেন, ‘তোমরা কাল আসো।’ পরদিন শিক্ষক সমাধান দিলেন। তিনি এক ভাইকে একটা মুদ্রা দিয়ে বললেন, ‘তুমি টস করবে।’ অন্যজনকে বললেন, ‘তুমি হেডস না টেইলস, কী চাও তা ঠিক করো। সমাধান হলো যে টস জিতবে, সে-ই জমি ভাগ করবে।’ দুজনই হা হা রে রে করে বলে উঠল, ‘এটা কোনো সমাধান হলো না, ও তো একাই সব নিতে চায়। সেটাই তো সমস্যা!’ শিক্ষক বললেন, ‘রসো বৎস! যে টস জিতবে, সে ভাগ করবে বটে, তবে বেছে নেওয়ার প্রথম সুযোগটা পাবে অন্যজন।’ যখন মানুষকে চাকর ভাবা হতো, তখনকার কথা। বাড়ির কর্তা তার ‘চাকর’কে কী কাজে যেন ডাকছিলেন। উত্তর এল, ‘হুজুর, আমি আহার করি।’ হুজুরের মেজাজ চড়ে গেল। ‘বদমাশ, আহার কী রে! রানি ভিক্টোরিয়া করেন ভোজন, বড়লাট করেন আহার, আমি খাই আর তুই গিলিস।’ সেই থেকে বিরোধী দলের নেতা করলে হয় দুর্নীতি, সরকারি দল করলে হয় উন্নয়ন। প্রভাবশালী এক মন্ত্রী গুমরফাঁস নিয়ে বক্তৃতা করলেন। সবাই তো লাজবাব। কেননা প্রবাদ আছে, ডাক্তারের সঙ্গে তর্ক কোরো না, তাঁর কাছে ভেতরের তথ্য আছে। গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সময়কার কথা। ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার উপায় না দেখে রাগে-দুঃখে আত্মহত্যার পথ নিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের ওই বিদ্রোহী প্রার্থী। বাড়ির আঙিনায় কবর খুঁড়ে তার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় পুলিশ উঠিয়ে নিয়ে সোজা কারাগারে পাঠিয়েছে। ভোটে দাঁড়াতে না পেরে নিজের কবর নিজে খুঁড়লেও কিন্তু জেলবাস, হু কিন্তু! এক ভদ্রলোকের স্ত্রী কানে কম শোনেন। তো, তারা দুজন গাড়ি নিয়ে আরেক শহরে বেড়াতে গেছেন। উঠেছেন এক হোটেলে। রাতে ঘুমাচ্ছেন। এর মধ্যে স্ত্রীর গোঙানিতে স্বামীর ঘুম ভাঙল। কী ব্যাপার? স্ত্রীর মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা। ওষুধ আনতেই হবে। ভদ্রলোক কোনোভাবে বেরোলেন। কিন্তু ফেরার সময় মনে করতে পারলেন না, কত নম্বর ঘরে বউ আছে। কী আর করা। তিনি তাঁর গাড়ির দরজা খুলে একটানা হর্ন বাজানো শুরু করলেন। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই একটি ছাড়া সব ঘরের বাতি জ্বলে উঠল। তিনি বুঝে গেলেন, কোন ঘরে তার স্ত্রী আছেন। যখন অভিভাবকেরা পেরেশান, কিন্তু একজন শান্তিতে ঘুমাচ্ছেন, বুঝবেন তিনি শিক্ষামন্ত্রী। দুজন শিকারি বন্দুক নিয়ে বনে গেছে বাঘ শিকারে। তো একজন খাদে পড়ে আর নড়েচড়ে না। তখন অপরজন জরুরি নম্বরে ফোন করে জানতে চাইল, ‘আমার সঙ্গী মনে হয় মৃত, আমি কী করব?’ অপর প্রান্তের উত্তর: ‘প্রথমে নিশ্চিত হোন যে আপনার বন্ধু মৃত না জীবিত। জীবিত হলে এক কথা, মৃত হলে আরেক কথা।’ ফোনের অপর প্রান্তে ‘দুম’ শব্দ শোনা গেল। এবার ফোন কানে নিয়ে শিকারিটি বলল, ‘এবার নিশ্চিত সে মৃত, এবার কী করব?’কিন্তু সঙ্গীর মৃত্যু নিশ্চিত করতে গিয়ে শেষ গুলিটি খরচ করে ফেলেছিল শিকারিটি, আর বাঘের গুহার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল একা! দ্বিদলীয় রাজনীতির দুই পা হলো দুই দল। একটি পা কাটা পড়লে অন্য পা-ও কিন্তু পঙ্গু হয়। এটা না বোঝা বোকামি। এ জন্যই বলে, গাধা যখন বোঝা বয়, তখনো সে গাধা, বোঝা নামিয়ে রাখলেও সে গাধাই থাকে। কোনো কোনো দল সরকারে থাকা অবস্থাতে সঠিকভাবে ভুল করে, আবার কোনো দল বিরোধী দলে থাকলে করে নির্ভুল ভুল। এ রকম বিরোধী দলের অবস্থা ওই বেকার যুবকের মতো। সে সার্কাস তাঁবুর সামনে নোটিশ ঝোলানো দেখতে পেল: যে ১০০ ফুট খুঁটির ওপর উঠে নিচের জালে লাফিয়ে পড়তে পারবে, তার পুরস্কার ৫০ হাজার টাকা। যুবক ভাবল, এ আর এমন কী? কিন্তু সমস্যা বাধল ওঠার পরে। নিচে তাকিয়ে তার যে মাথা ঘোরায়! কিছুতেই তার নামার সাহস হয় না। ওদিকে রিংমাস্টার চেঁচাচ্ছেন, ‘লাফ দে ব্যাটা, লাফ দে।’ কিসের লাফ আর কিসের টাকা! ভয়ে কেঁদে ফেলে সে বলে, ‘আমারে এহন নামাইব ক্যাডা?’ ক্ষমতার কুতুব মিনার বা আন্দোলনের মঞ্চ, যেখানেই উঠে বসুন, নামার ব্যবস্থাটা করে রাখুন। সরকারি দলের এক কর্মী অ্যাকশনে যাবে। তাঁর স্নেহময়ী মা তার ব্যাগে খাবারদাবার গুছিয়ে দিচ্ছেন। ছেলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলছেন, ‘বাবা একটা একটা করে ওদের পেটাবি আর একটু জিরিয়ে নিবি। বেশি পরিশ্রম করবি না, খবরদার!’
ছেলের মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়ল কথাটা: কিন্তু ওরা যদি আমাকে মারে?
বা রে, তোকে মারবে কেন? তুই ওদের কী ক্ষতি করেছিস, তুই তো দায়মুক্ত পার্টি!
রাজনীতি এখন নিষ্ঠুরতার শিল্প। মনোবিজ্ঞানে নিষ্ঠুরতা আবার দুই প্রকারের। একটিকে বলে মর্ষকামী, অন্যটিকে বলে ধর্ষকামী। মর্ষকামী কষ্ট পেতে ভালোবাসে। নিজেকে দেওয়া কষ্টেও তার কুলায় না, তাই একজন অত্যাচারী সেবকের দরকার হয় তার। আর ধর্ষকামী সুখ পায় অন্যকে কষ্ট দিয়ে, সে জন্য তার চাই কষ্ট পাওয়ার গোবেচারা লোক। তো মর্ষকামী ধর্ষকামীকে গিয়ে বলল: ‘আমাকে মারো, আঘাত করো, কষ্ট দাও!’ ধর্ষকামী তাকে একটু চাবুক মারে। মর্ষকামী তখন আরও চায়। আরেকটু মারে। এভাবে মারতে মারতে মর্ষকামী যখন একেবারে আত্মহারা, তখন থেমে যায় ধর্ষকামী লোকটা। মর্ষকামী কাকুতিমিনতি করে। কিন্তু ধর্ষকামী মজা নিয়ে বলে, ‘এখনো সময় হয়নি!’ গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ও পরে বিএনপির ভূমিকা ছিল মর্ষকামীর। সরকারকে যতভাবে পারা যায় ততভাবে তারা উশকেছিল। কিন্তু একদিন হুঁশ ফিরল তাদের। খেলার নিয়মটা বদলে গেল। এখন সরকার যতই চাইছে বিএনপি আগের মতো হঠকারিতা করুক, ততই তারা মার খেয়ে চলেছে। সরকারই যেন এখন চাইছে, বিএনপি আমাকে মারছে না কেন? তাহলেই তো খপ করে ধরে ফেলতে পারি।
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের একটি গল্পের কথা মনে পড়ে গেল:
শীতের দুপুর। সব খাওয়া এক কালো বিড়াল ফাঁকা ফুটপাতে শোয়া। কোথা থেকে এক ইঁদুর এসে তার গোঁফ ধরে টানতে লাগল। বিড়ালের আরামের ঘুম তাতে ভাঙল না। এবার তার লেজে চিমটি কাটল ইঁদুরটি। বিরক্ত বিড়াল বাঁ চোখ মেলে জিজ্ঞাসা করে, ‘কী চাই?’
ইঁদুর বলে, ‘আজ্ঞে, আপনি আমাকে খান।’
: আরে আমার পেট ভরা। আর নিতে পারব না রে।
এ কথা বলেই সে আবার নাক ডাকাতে লাগল। ইঁদুর এদিক-ওদিক ঘুরে আবার এসে বিড়ালের পেটে দিল গুঁতা। বিড়াল চোখ মেলল বটে, কিন্তু কিছু বলল না। ইঁদুরের সেই একই আবদার, ‘আমাকে আপনার খেতেই হবে।’
তাচ্ছিল্যের চাহনি মেরে একটু সরে গিয়ে আবার চোখ বুজল বিড়াল। ইঁদুর একটু ঘোরাঘুরি করে ফিরে এসে বিড়ালকে দিল এক খামচা। বিরক্ত হলেও বিড়ালের মনে করুণা জাগ্রত হলো। বলল, ঠিক আছে খেতে পারি তবে পরে। তুমি ওয়েট করো। নাছোড়বান্দা ইঁদুর তাতেও খুশি না। শেষে একটা রফা হলো। কালো বিড়ালটা হাঁ করে ঘুমাবে আর ইঁদুর সেই হাঁয়ের মধ্যে নিজের মাথাটা ঢুকিয়ে বসে থাকবে। ঘুম ভাঙলে তবে বিড়াল তাকে খাবে। বিষয়টি নিশ্চিত করতে ইঁদুর জানতে চাইল, ‘হুজুরের ঘুম কখন ভাঙবে?’
: ওই যে মোড়ের ওপর অন্ধদের স্কুল দেখছ, সেই স্কুল ছুটি হলে অন্ধ বাচ্চারা এদিক দিয়েই যাবে। এই যে আমি আমার লেজটা রাস্তার ওপর মেলে রাখলাম। ওদের কেউ লেজে পা দিলেই তৎক্ষণাৎ আমি গাপ করে তোমার মাথাটা খাব—হাই তুলতে তুলতে বলল বিড়াল। ধরা দেওয়াই এখন ইঁদুরের কৌশল। বিড়ালটারও পেট ভারী, কতটা হজম করতে পারবে ঠিক নেই। তাই সে হাঁ করে ঘুমাল। সেই হাঁয়ের মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল ইঁদুর। অন্ধদের স্কুল কখন ছুটি হবে?
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
faruk.wasif@prothomalo.info

No comments

Powered by Blogger.