দুর্নীতি রোধে আরও এগোতে হবে by ইমরুল কায়েস

নানারকম নেতিবাচক খবরের পাশাপাশি একটি খবর দেশের মানুষের জন্য কিছুটা স্বস্তি বয়ে এনেছে। তা হল বাংলাদেশে দুর্নীতির প্রবণতা ধীরে ধীরে কমে আসছে বলে জানিয়েছে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই)। সংস্থাটির বার্ষিক জরিপে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালে আগের বছরের তুলনায় বাংলাদেশে দুর্নীতি কমেছে। ২০১৬ সালে টিআইয়ের জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশ বিশ্বের ১৫তম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ ছিল। কিন্তু ২০১৭ সালে দুই ধাপ অগ্রগতি হয়ে ১৮০টি দেশের মধ্যে নিুক্রম অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান হয়েছে ১৭তম। ১০০-এর মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর ২৮। সমান স্কোর পেয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে একই কাতারে অবস্থান করছে গুয়াতেমালা, লেবানন, কেনিয়া ও মৌরিতানিয়া। ২০০১ সালে টিআইয়ের দুর্নীতি সূচকে যুক্ত হওয়ার পর বাংলাদেশের জন্য এটাই সবচেয়ে বড় স্কোর তথা অগ্রগতি। টিআইয়ের সূচক অনুযায়ী সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ নিউজিল্যান্ড (স্কোর ৮৯) এবং বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ সোমালিয়া (স্কোর ৯)। তবে উদ্বেগের বিষয় হল, দুর্নীতি সূচকে অগ্রগতি হলেও তা গড় মাত্রার এখনও অনেক নিচে। ১০০-এর মধ্যে ৪৩ স্কোরকে গড় মাত্রা ধরা হয়। আরেকটি বিব্রতকর দিক হল, বিগত বছরের তুলনায় দুই ধাপ অগ্রগতি হলেও দক্ষিণ এশিয়ায় দুর্নীতির বিচারে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়, যা হতাশাব্যঞ্জক। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ আফগানিস্তানের (স্কোর ১৫) পরই বাংলাদেশের অবস্থান। অথচ পাকিস্তানের মতো দেশের অবস্থানও বাংলাদেশের চেয়ে ভালো (স্কোর ৩২)। এটা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য একটি লজ্জাজনক বিষয়। তাই বলা যায়, দুর্নীতি কমার ক্ষেত্রে অগ্রগতি হলেও তা হচ্ছে ধীরগতিতে এবং এ অর্জন কোনোক্রমেই সন্তোষজনক পর্যায়ের নয়।
দুর্নীতিবিরোধী সাফল্য সন্তোষজনক না হওয়ার একটা বড় কারণ হল প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি এখন পর্যন্ত কার্যকরভাবে প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। বেসিক ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংকে বিগত বছরগুলোয় হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির খবর বেরিয়েছে। এসব দুর্নীতির সঙ্গে সমাজের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের যোগসাজশের খবর গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রযন্ত্রের কার্যকর কোনো ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান নয়। যদিও দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর কিছু কর্মকর্তা এখন জেলে আছেন, কিন্তু প্রকৃত দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে শুধু আদেশ তামিলকারী কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ দুর্নীতি প্রতিরোধে তেমন ভূমিকা রাখবে বলে মনে হয় না। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত রাঘববোয়ালদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করে কার্যকরভাবে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হলেই কেবল প্রকৃত অর্থে দুর্নীতিবিরোধী বড় অগ্রগতি অর্জন হবে। এ জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করা ও স্বাধীন ভূমিকা রাখার সুযোগ দেয়ার পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্নীতি প্রতিরোধের ব্যবস্থা কার্যকর করতে হবে। ব্যাংক খাতের দুর্নীতি রোধে বাংলাদেশ ব্যাংকের গোয়েন্দা ইউনিটকে আরও শক্তিশালী করার পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ প্রদানের প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারকে শুধু বক্তব্য-বিবৃতি দেয়া নয়, আপসহীন ও জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে। যে কোনো মূল্যে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। সব ধরনের দুর্নীতিবাজের জন্য আইনের সমান প্রয়োগ নিশ্চিত করার পাশাপাশি দুর্নীতিবিরোধী সচেতনতা বাড়াতে হবে। অবশ্য এসব ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা একান্তভাবে জরুরি। সরকারের তথা রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা ছাড়া দুর্নীতি বন্ধ করা সহজ নয়।
ইমরুল কায়েস : সাংবাদিক
kayeshdu@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.