এরশাদের কাছে দেশ কতটা নিরাপদ? by সোহরাব হাসান
আমাকে বাধ্য হয়ে দল গঠন করতে হয়েছে।’ এর চেয়ে ডাহা মিথ্যে আর কী হতে পারে? তিনি নির্বাচন দিয়ে যদি ব্যারাকেই ফিরে যাবেন, তাহলে গণভোট দিয়েছিলেন কেন? তাঁর পূর্বসূরি জিয়াউর রহমান ১৯ দফার পক্ষে গণভোট দিয়েছিলেন, আর এরশাদ ১৮ দফার পক্ষে। রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থায় এরশাদ নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে রাজনৈতিক দলগুলোকে সংসদ নির্বাচনে আসার আহ্বান জানান। অন্যদিকে, বিভিন্ন দল থেকে লোক ভাগিয়ে নিয়ে প্রথমে ১৮ দফা বাস্তবায়ন পরিষদ, পরে জাতীয় পার্টি গঠন করেন। এরশাদ সাহেব দাবি করছেন, তিনি ব্যারাকে ফিরে যেতে চেয়েছেন। কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের আগে ১৯৮১ সালের ডিসেম্বরে তিনি যে পত্রিকার সম্পাদকদের ডেকে প্রকাশ্যে শাসনক্ষমতায় সেনাবাহিনীর ভাগ চাইলেন, তার জবাব কী। ১৯৮১ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে এরশাদ বিচারপতি সাত্তারকেই সমর্থন দিয়েছিলেন। কেননা, তাঁর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করতে এ রকম একজন দুর্বল রাষ্ট্রপতিই প্রয়োজন। আসলে সেনাবাহিনীর নাম ব্যবহার করে নিজে ক্ষমতা দখল করেছেন এবং আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিরোধের সুযোগ নিয়ে নয় বছর ক্ষমতায় থেকেছেন। এমনকি নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের পরও তিনি নতুন করে সামরিক শাসন জারির পাঁয়তারা করেছিলেন। তাঁর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল (অব) মঞ্জুর রশিদ খানের বইয়ে যার বিস্তৃত বিবরণ আছে (আমার সৈনিক জীবন: পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ, প্রথমা)। এরশাদ বলেছেন, ‘ইংরেজি সাইনবোর্ডের নিচে বাংলা চালু করা আমিই প্রথম শুরু করি। আমিই অগ্রদূত। আমি ক্যালেন্ডারে ইংরেজির নিচে বাংলা চালু করাও বাধ্যতামূলক করেছিলাম।’ কিন্তু এরশাদ যে কথাটি বলেননি, তা হলো, তিনিই একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে ফুল দেওয়াকে বেদাত কাজ বলে অভিহিত করেছিলেন। তাঁর এই বক্তব্যের প্রতিবাদ জানাতে গিয়েই ১৯৮৩ সালে দেশের খ্যাতনামা লেখক-বুদ্ধিজীবীরা গঠন করেছিলেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। সেই থেকে আজ অবধি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যেতে পারেননি। সাংবাদিক সমাজও এই স্বৈরশাসকের জন্য জাতীয় প্রেসক্লাবের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। এরশাদ সাহেব বলেছেন, আওয়ামী লীগের কাছে বিএনপি নিরাপদ নয়। আর বিএনপির কাছে আওয়ামী লীগ নিরাপদ নয়। খুবই হক কথা। এই দুটি দল একে অপরকে ঘায়েল করতে ব্যস্ত ছিল এবং এখনো আছে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে এরশাদের হাতে দেশ, রাজনীতি ও গণতন্ত্র নিরাপদ। যেই এরশাদ শহীদ মিনারে ফুল দেওয়াকে বেদাত বলতেন, যে এরশাদ কথায় কথায় পত্রিকা বন্ধ করে দিতেন, সেই এরশাদের কাছে কী করে দেশ নিরাপদ থাকে? যে ফেব্রুয়ারি মাসে এরশাদ জাতিকে নানা বিষয়ে সদুপদেশ দিচ্ছেন, ১৯৮৩ সালের সেই মাসেই (১৪ ফেব্রুয়ারি) ছাত্রমিছিলে গুলি করে জাফর, জয়নাল, দীপালিদের হত্যা করা হয়েছিল। আর ১৯৮৪ সালের ২৮ ফ্রেরুয়ারি মিছিলে ট্রাক উঠিয়ে দিয়ে খুন করা হয়েছিল ইব্রাহিম সেলিম ও দেলোয়ার হোসেন নামের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীকে। বিস্মৃতপ্রবণ বলে বাঙালির বদনাম আছে। কিন্তু এত নিকট অতীতের কথা কীভাবে ভুলে যাবে?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com
No comments