কালো পতাকায় বাধা
বিএনপির
চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে আয়োজিত
কালো পতাকা কর্মসূচিকে পুলিশ যে কায়দায় বাধা দিয়ে পণ্ড করে দিয়েছে, তা
কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক আচরণ নয়। বরং এতে সংশ্লিষ্টদের বেপরোয়া মনোভাবটাই
স্পষ্ট হয়ে ওঠে। খালেদা জিয়ার কারাদণ্ডকে কেন্দ্র করে বিএনপি হরতাল-অবরোধের
মতো রাজপথ গরম করা কর্মসূচি দিয়ে একটা অরাজক অবস্থা তৈরি করতে পারে—এমন
আশঙ্কা অনেকের মনে ছিল। কিন্তু বাস্তবে তারা সে ধরনের কোনো কর্মসূচি নেয়নি।
এমন অবস্থায় কালো পতাকা প্রদর্শনের মতো নিরীহ ও নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচি
পালনেও বাধা দেওয়ার ঘটনা দুঃখজনক। অতীতের নানা পর্বে বিভিন্ন ধরনের
হিংসাত্মক কর্মসূচির দুঃসহ স্মৃতি আমাদের তাড়া করে। তবে এ কথা অনস্বীকার্য
যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সহনশীলতা ও রীতিনীতির অনুশীলন ছাড়া আমরা
কাঙ্ক্ষিত গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা কল্পনা করতে পারি না। গণতান্ত্রিক
ব্যবস্থায় বিরোধী দল ও ভিন্নমতের জন্য অবশ্যই স্থান করে দিতে হবে। আদালতের
রায় বা কোনো সিদ্ধান্ত পক্ষে গেলে একধরনের আর বিপক্ষে গেলে ভিন্ন ধরনের
প্রতিক্রিয়া দেখানো আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। কোনো
রাজনৈতিক দলের এমনকি মাঝারি পর্যায়ের কোনো নেতার নিতান্ত আটক বা দণ্ডের
ঘটনায় সারা দেশে হরতালের মতো কর্মসূচির মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা দেশবাসীর
রয়েছে। সেদিক থেকে বিএনপি নেত্রীর কারাদণ্ডের পর কোনো ধরনের হিংসাশ্রয়ী
কর্মসূচি না দেওয়াকে একটি অগ্রগতি হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। কিন্তু অবস্থা
যদি এমন দাঁড়ায় যে বিএনপির নেতা-কর্মীরা রাস্তার পাশে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে
কালো পতাকাও প্রদর্শন করতে পারবেন না, তবে তাকে গণতান্ত্রিক আচরণ বলা যায়
না। গত শুক্রবার শেখ রাসেল জাতীয় শিশু-কিশোর পরিষদ আয়োজিত অনুষ্ঠানে
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছিলেন, ‘সরকার কারও রাজনৈতিক অধিকার
ক্ষুণ্ন করছে না।
সরকার কোনো দলের গণতান্ত্রিক অধিকারে বাধা দেয় না।
জ্বালাও-পোড়াও থেকে সরে এসে সুষ্ঠু রাজনৈতিক আন্দোলন করলে প্রয়োজনে
বিএনপিকে সহযোগিতা করা হবে।’ এই আশ্বাসের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ বিএনপির
কালো পতাকা মিছিলে বাধা, তাদের কর্মসূচি ভন্ডুল করে দেওয়া, এমনকি
নেতা-কর্মীদের নির্বিচারে গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটল। কিন্তু দেশবাসী বিস্ময়ের
সঙ্গে দেখল যে সরকারের কথা ও কাজে মিল নেই। এর আগেও আমরা ক্ষমতাসীন দলের
নেতা-কর্মীদের তরফে বিএনপির আন্দোলনের বিষয়ে অসংযত ও অসহনশীল
বক্তৃতা-বিবৃতি দিতে দেখেছি। আওয়ামী লীগের খোদ সাধারণ সম্পাদক বলেছেন,
‘বিএনপি আন্দোলন করতে ব্যর্থ হয়ে এখন নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের কথা বলছে।’
তার মানে আওয়ামী লীগ কি চায় বিএনপি রাজপথ গরম করা কর্মসূচি নিক! মহান
একুশের চেতনা জাতিকে একটি প্রতিবাদী সমাজ বিনির্মাণে প্রেরণা জুগিয়েছিল,
সুতরাং জাতি যখন ভাষার মাস পালন করছে, তখন শান্তিপূর্ণ কালো পতাকা মিছিল
কেবল অনুমতির দোহাই দিয়ে ভন্ডুল করে দেওয়া দুর্ভাগ্যজনক। আর পুলিশ যে
কায়দায় কাজটি করেছে তা নিন্দনীয়। প্রচলিত আইনের কোথাও কালো পতাকা মিছিলের
বিষয়ে আগাম অনুমতির কথা বলা নেই। সবচেয়ে বড় কথা, নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদ ও
সমাবেশের সব দরজা যদি সরকারই বন্ধ করে দেয়, তাহলে যে সম্ভাব্য চিত্রটি
সামনে আসে, সেটি মোটেই কাঙ্ক্ষিত নয়। অতএব, আগে অনুমতি নেয়নি এই অজুহাত
দেখিয়ে কোনো দলের নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বাধা দেওয়া যাবে
না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব জনজীবনে শান্তি বজায় রাখা।
কিন্তু তারা নিজেরাই যদি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বাধা দিয়ে অশান্তি সৃষ্টি
করে, সেটি কারও জন্য সুসংবাদ বয়ে আনবে না।
No comments