‘প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরও তো জানা’ by সারফুদ্দিন আহমেদ
আমেরিকার লাখ লাখ নথি ‘লিক’ করে বিশ্বজুড়ে ‘কিলিক’ বাধিয়েছিল উইকিলিকস। বেফাঁস নথি ফাঁস হওয়ার পর দেশে-বিদেশে ফেঁসে গেল কত লোক, তার কোনো লেখাজোকা নাই। মাউসের ক্লিকে ক্লিকে কারও হাঁড়ির খবর, কারও নাড়ির খবর, কারও বাড়ির খবর, কারও গাড়ির খবর, কারও নারীর খবর ভেসে উঠল মনিটরের পর্দায়। এই ফাঁসের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় কেউ চাকরি হারাল, কারও মন্ত্রিত্ব গেল, কারও বউ পালাল। তারপরও সবাই বলল, বেশ হয়েছে। তথ্য গোপন রাখার জিনিস না। সবার তথ্য পাওয়ার হক আছে। তথ্যই সম্পদ। দামি কথা। এই দামি কথার মর্ম বুঝতে পেরেছে আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বুঝতে পেরেছে আমাদের সরকার।
শুধু বুঝেই তারা ক্ষান্ত হয়নি, আমাদেরও চোখের ভেতর বুড়ো আঙুল ঢুকিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে। এখন আমাদের কাছে মিনারেল ওয়াটারের মতো পরিষ্কার হয়েছে, প্রশ্নপত্র হচ্ছে জীবনঘনিষ্ঠ তথ্যসমৃদ্ধ নথি। এই নথি সর্বজনীন পদার্থ। জাতীয় সম্পদ। এটি উন্মুক্ত স্থানে রাখার জিনিস। কোল্ড স্টোরেজে রাখার বস্তু না। পরীক্ষার আগে মেধাবী ও অপদার্থ-সবারই এই পদার্থ হাতে পাওয়ার অধিকার আছে। শিক্ষার মতো একটি সর্বজনীন জিনিসকে মেধাবীরা বাপের সম্পত্তি মনে করবে; রাতদিন পড়াশোনা করে মগজের গোডাউন ভর্তি করে ফেলবে, অন্যদিকে এই পদার্থবঞ্চিত অপদার্থরা ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াবে, সেটা তো কোনো কাজের কথা না। তাই প্রশ্নপত্র ফাঁস করা অতি জরুরি। আমরা বুঝতে পারছি, টাকাপয়সা ধনসম্পদের মতো শিক্ষারও সমবণ্টন হওয়া দরকার। আমাদের সাম্যবাদী স্লোগান হওয়া দরকার, ‘প্রশ্ন ফাঁস করো এবং বিলিয়ে দাও’। ফি বছর পরীক্ষার তরিকা বদলানো, হগা-মগা-বগাদের পাতে জিপিএ-ফাইভের ঝোল ঢেলে দেওয়া আর প্রশ্ন ফাঁসের ব্যাপারে নির্বিকার থাকার নীতি আমরা এমনি এমনি নিয়েছি তা ভাবার প্রশ্নই আসে না। এর পেছনে আমাদের জবরদস্ত হেকমতওয়ালা একটা নেক মকসুদ আছে। জাতির বিবেকের সামনে জরুরি জনগুরুত্বসম্পন্ন প্রশ্ন ফাল দিয়ে উঠতে পারে, সেই মকসুদটা কী? বছর কয়েক এই কায়দায় শিক্ষাব্যবস্থাটাকে চালিয়ে যেতে পারলে এই বঙ্গভূমিতে কোটি কোটি গোবরভর্তি মাথার একটি হাইব্রিড জাতের‘ অমেরুদণ্ডী’ প্রজন্ম পয়দা করা যাবে। সেই প্রজন্মের সবাই ভালো রেজাল্ট করা অশিক্ষিত হবে। আমাদের ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, অফিস-আদালত মেধাহীন উচ্চশিক্ষিত লোকে কিলবিল করতে থাকবে। দুনিয়া দেখবে আমরা সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্য পূরণ করতে পারলাম। ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র দেখে পাস করা সেই প্রজন্ম অন্য সব ক্ষমতা পাবে; খালি প্রশ্ন করার ক্ষমতা পুরোপুরি হারিয়ে ফেলবে। তাদের সামনে একের পর এক প্রশ্নপত্র ফাঁস হতে থাকবে, তারা প্রশ্ন করবে না। শেয়ারবাজার-ব্যাংক থেকে লাখো কোটি টাকা লুট হয়ে যাবে, তারা প্রশ্ন করবে না। ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করা হবে, নির্বাচনে প্রকাশ্যে ব্যালট বাক্স ছিনতাই হবে, তারা প্রশ্ন করবে না। একই প্লেয়ারের একই সঙ্গে স্ট্রাইকার ও গোলকিপার হওয়ার মতো, পার্লামেন্টে একই সঙ্গে একটি দল সরকার ও বিরোধী দলে থাকবে, তারা প্রশ্ন করবে না।
গুম, খুন, ক্রসফায়ার, পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের মতো প্রাত্যহিক ঘটনা হয়ে উঠবে, তারা প্রশ্ন করবে না। সার্বভৌম দেশের পুঁজিবাজার দখলে বাইরের দেশগুলো কামড়াকামড়ি করবে, তারা প্রশ্ন করবে না। আন্দোলন-হরতালের নামে মানুষ পুড়িয়ে মারা হবে, তারা প্রশ্ন করবে না। সুদূরপ্রসারী নীলনকশার অংশ হিসেবে প্রশ্ন করায় অক্ষম এক অদ্ভুত, আজব ও অব্যক্ত সম্প্রদায় গড়ে তোলা হবে। সেই সম্প্রদায় চোখের সামনে সবকিছু দেখতে পারবে। কিন্তু পড়াশোনা বাইপাস করে ফাঁস করা প্রশ্নে পাস করার কারণে কোনো ছাইপাঁশ তারা বুঝতে পারবে না। বুঝতে না পারায় তারা বলতে পারবে না। মানুষ হচ্ছে এমন এক আজব কিসিমের জীব, যারা যত শিক্ষিত হয় তত খতরনাক হয়। তত প্রশ্ন তোলে। হীরক রাজার ভাষায়, ‘এরা যত বেশি পড়ে, তত বেশি জানে, তত কম মানে’। ছাত্রপাত্র যাতে খতরনাক না হয়, প্রশ্নে প্রশ্নে যাতে তারা কান ঝালাপালা করতে না পারে, কথায় কথায় তারা যাতে ‘জি স্যার!’ জি স্যার!’ করতে পারে, সেই জন্য এই সৃজনশীল প্রশ্ন ফাঁসের কায়দা আমদানি করা হয়েছে। আমরাও মহা আনন্দে বলে চলেছি, ‘ডু ইন রোম অ্যাজ রোমানস ডু’। আমরা বুঝে গেছি জীবনের পূর্ণিমায় রাহুগ্রাস চলছে। দশাননের গ্রাস থেকে জানকী মুক্ত হয়েছিল। মাছের পেট থেকে ইউনুস নবী ছাড়া পেয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের মুক্তি নেই। এই হতভাগা জাতির কুঁড়েঘরের যে জানালা দিয়ে শিক্ষার আলো ঢোকে, সেখানে এখন ‘উটের গ্রীবার মতো ক্ষমাহীন বিরুদ্ধতা’ এসে দাঁড়িয়েছে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে প্রশ্ন ফাঁসের ব্যাপারে যে অবস্থান নেওয়া হয়েছে, তাতে আমরা বুঝে গেছি প্রশ্নাতীতভাবেই এই ব্যর্থতার ‘পোস্টমর্টেম’ হবে না। পুরোনো কবরের বুকভাঙা হতাশা নিয়ে নির্মলেন্দু গুণের কবিতার মতো আমাদের দাপাতে হবে। আমাদের পরাজয় বত্রিশ দাঁতে হাসবে। আমরা প্রশ্ন করতে পারব না।
সারফুদ্দিন আহমেদ: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
sarfuddin 2003 @gmail. com
সারফুদ্দিন আহমেদ: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
sarfuddin 2003 @gmail. com
No comments