কেন ডেনিস পুরুষদের বিয়ে করছেন থাই মেয়েরা?

ডেনমার্কের ছোট্ট একটি একটি জেলা থাই যেখানে প্রায় ১০০০ থাই নারী বসবাস করছে। এটি মূলত বেড়েছে গত দশ বছরে কারণ সেখানে সোমাই নামে একজন সাবেক যৌনকর্মী আরো অনেক থাই নারীকে ডেনিশ সঙ্গী খুঁজে পেতে সাহায্য করেছেন।
সেক্স ট্যুরিজমের জন্য পরিচিত থাইল্যান্ডের পাতায়া শহরে পঁচিশ বছর আগে ভ্রমণে গিয়ে ছিলেন ডেনমার্কের নেইলস মলবায়েক। সেখানে তার পরিচয় হয় থাই নারী সোমাইয়ের সাথে।
সে সম্পর্কে নেইলস নিজেই বলছেন, ‘২৪ বছর আগে সেসব কিছুই আপনার মাথায় আসবে না, কেবল প্রেম ছাড়া।’
এখন একতলা একটি বাসায় তাদের আবাস সেখানে বসে যখন কথাগুলো বলছিলেন তখন সোমাইয়ের পাশে তার দুই ভাগ্নি, যাদেরকে তিনি বড় করেছেন।
তাদের পাশেই বসা তার প্রাক্তন স্বামীর বোন। এবং তার পরেই উত্তর-পূর্ব থাইল্যান্ডে তার নিজের গ্রাম থেকে আসা এক বান্ধবী।
টেবিলে যিনি খাবার পরিবেশন করছিলেন তিনি সোমাইয়ের ভাগ্নের সাবেক স্ত্রী যিনি সম্প্রতি এই শহরে এসেছেন।
এই টেবিলে বসা সকল নারীকে ডেনিশ পুরুষদের সাথে বিয়ের মাধ্যমে সঙ্গী খুঁজে দিয়েছেন সোমাই।
খবরের কাগজে সে থাই নারীদের প্রোফাইল দিয়ে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করতেন, এরপর তার বাড়িতেই সম্ভাব্য পাত্রদের সাথে তাদের প্রথম সাক্ষাতের ব্যবস্থা করতেন এবং ভিনদেশের মাটি ও ভাষার মাঝে তাদের নতুন জীবন শুরুর জন্য বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
৩০ বছর আগে এই প্রত্যন্ত মৎস্য-প্রধান জেলাটিতে সোমাই ছিলেন একমাত্র থাই নাগরিক।
এখন সে এলাকাটি জুড়ে প্রায় এক হাজার জন থাই নারী, যাদের বেশিরভাগই বৈবাহিক সূত্রে বাসিন্দা।
ডেনিশ রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদ মাধ্যম ডিআর-এর তথ্য মতে, পুরো দেশে ১২ হাজার ৬২৫ জন থাই নাগরিক রয়েছেন আর তাদের মধ্যে ১০ হাজার ৪৯৫ জন নারী।
‘সোমাই কতজন থাই নারীকে বিয়েতে সহায়তা করেছেন?’- এ প্রশ্ন তাকে প্রায়ই শুনতে হয়। কিন্তু তার উত্তর, ‘আমি গণনা ছেড়ে দিয়েছি।’
১০ বছরের বেশি সময় ধরে বহু থাই-ডেনিশ জুটির ওপর নজর রাখার পর দুই পরিচালক সাইন প্লামবিচ এবং জানুস মেটয হার্টবাউন্ড নামে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন।
গতবছর টরোন্টো ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সেটির প্রিমিয়ার শো হয়।
অ্যামেরিকান অ্যানথ্রোপলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে শ্রেষ্ঠ নৃবিজ্ঞানী বিষয়ক ফিচার ফিল্ম হিসেবে এবং ডাবলিন ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে হিউম্যান রাইটস ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড পায় ।
অন্য ধরনের ভালোবাসা
সোমাই পাতায়ায় কাজ করতে গিয়ে পরিচয় হওয়া হবু বরের কাছ থেকে ১৯৯১ সালে পাওয়া চিঠি দেখান, যেখানে লেখা- ‘আমি উপলব্ধি করলাম যে আবার যদি তোমাকে দেখতে না পাই আমার হৃদয় ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। তুমি চাইলে আমার সাথে এসে থাকতে পারো এবং ডেনমার্কে জীবন কেমন সেটাও জানতে পারবে।’
বর্তমানে ৬৬ বছর বয়সী সোমাই বাস্তব জীবনেও হুবহু যেন তথ্যচিত্রের চরিত্র, এখনো প্রাণবন্ত এবং সক্রিয়।
নিজের জীবন সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তার বক্তব্য, ‘আমি বিদেশীদের বোঝাতে চাই যে আমরা এখানে শুধু টাকার জন্যই আসিনি। থাই মেয়েরা এখানে আসে কাজের জন্য এবং আমরা প্রচুর পরিশ্রম করি। এটা ফুল বিছানো কোনো পথ নয়।’
সোমাইর কথা যেন তথ্যচিত্রেরই প্রথম দৃশ্যের কথা মনে করিয়ে দেবে। যেখানে দেখা যায়, তার ভাগ্নি কেবলমাত্র দেশ ছেড়ে এসেছে এবং একজন ডেনিশ পুরুষের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। আর তাদের মাঝখানে একমাত্র সেতুবন্ধন একটি থাই-ডেনিশ অভিধান।
১০ বছর ধরে নৃ-বিজ্ঞানী প্লামবিচ এবং পরিচালক মেটয থাইল্যান্ড ও ডেনমার্কে বহু দম্পতিকে অনুসরণ করেন।
সোমাইর ভাগ্নি যে বিয়ের জন্য এসেছে, একজন থাই নারীর সাথে বিয়ে বিচ্ছেদের পর একজন ডেনিশ পুরুষের দুর্দশা, একজন যৌনকর্মী যাকে পরিবারের দায়িত্ব নিতে থাইল্যান্ডে নিজের গ্রামে ফিরে যেতে হয়েছে। এবং সোমাই নিজে যিনি এখন থাইল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা অনুভব করেন।
২৫ বছর আগে সোমাই প্রথম একটি থাই-ডেনিশ জুটিকে গাঁটছড়া বাধার উদ্যোগ সম্পন্ন করেন।
মেয়েটি ছিল স্বামীর দ্বারা নির্যাতনের শিকার তার গ্রামের একটি মেয়ে।
এবং এরপর ‘একটার পর একটা, আমার কাজিন, প্রাক্তন স্বামীর বোন এবং একই গ্রামের কেউ না কেউ। এরপর আমার ভাগ্নি।’ এভাবে আরো অনেককে তিনি আনেন থাইল্যান্ডে থেকে।
প্রক্রিয়া সম্পর্কে সোমাই জানান, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন, সেসব কোপেনহেগেন থেকে কেউ না কেউ দেখে। এরপর আগ্রহী কাউকে কাউকে বাসায় আসতে বলা হয়।
জুটি মিলিয়ে দেয়ার কাজটি করলেও, এসবের বিনিময়ে কোনোদিন কোনোকিছু চাননি কিংবা পাননি সোমাই।
‘আমি কারো জন্য ভালোকিছু করতে পেরেছি যেটা তার পরিবারের আরো উন্নতির জন্য কাজে লেগেছে এতেই আমি গর্ববোধ করি। এমনো নারীরা আছে যাদের আগে কিছুই ছিল না, কিন্তু এখন তারা তাদের বাবা-মাকে খাবার কিনে দিতে পারছে, তাদের জন্য ঘর বানিয়ে দিচ্ছে।’
থাইল্যান্ডে এখনো যারা বিদেশীদের বিয়ে করে তাদের বিরুদ্ধে একধরনের কুসংস্কারপূর্ণ ধারণা প্রচলিত আছে, এমনকি আজকের যুগেও।
তথ্যচিত্রে দেখা যায়, অন্যান্য ডেনিশ নাগরিকদের পাশাপাশি সোমাই কঠোর পরিশ্রম করছেন।
এটাই কি ভালোবাসা?
জানতে চাইলে সোমাই বলেন, ‘এটা ব্যাখ্যা করা কঠিন। আমরা যখন অল্পবয়সী ছিলাম বিষয়টি হয়তো তখন বিষয়টি একরকম ছিল না। এটা কঠিন বিষয়, এটা গভীর বন্ধন। একে অপরের প্রতি যত্নশীল হওয়া। অন্য ধরনের ভালোবাসা।’
১৯৯৯ সাল থেকে ডেনিশ পুরুষ ও থাই নারীর মধ্যে গড়ে প্রতিবছর ২৫৩টি বিয়ে হয়। বিচ্ছেদের হার ছিল ৬০-৬৫%।
দারিদ্র্য
শুধু থাই নারীদেরই নয়, যেকোনো দেশে নারীদের বিদেশী পুরুষদের বিয়ে করা এবং তাদের সাথে বিদেশে চলে যাওয়ার মানে হল দেশটিতে অর্থনৈতিক বৈষম্য দায়ী।
১০ জনের পরিবারের জন্য খাবার জোটাতেই একদিন পাতায়ায় কাজের খোঁজে বের হয়ে গিয়েছিলেন সোমাই। যদিও কী কাজ করে তাকে এই অর্থ উপার্জন করতে হবে সেটা সম্পর্কেও তার পূর্ণ ধারণা ছিল। সেটা ছিল যৌনকর্মীর পেশা।
কবে থেকে থাই নাগরিকেরা বিদেশীদের বিয়ে করতে শুরু করে তার আনুষ্ঠানিক কোনো তথ্য নেই। তবে এই ধারাটি চালু হয় ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় থেকে যখন থাইল্যান্ডকে আমেরিকা সামরিক ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করতো।
এসব নারীদের তাদের নিজেদের দেশ যা দিতে পারেনি ডেনমার্কে অভিবাসন তাদের সেটাই জুটিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু একইসাথে এটা কারো ব্যক্তিগত পছন্দ এবং বিশ্বায়নের অংশ।
সোমাই জানান, তার মতো যে কারো ক্ষেত্রে যেকোনোমূল্যে দেশ ছাড়ার চিন্তার পেছনে অর্থনীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। তার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল সন্তানদের শিক্ষা এবং বাবা-মায়ের সুস্বাস্থ্য।
থাইল্যান্ডে বসবাস দারুণ, কেউ মারা যাচ্ছে না। কিন্তু সেটা এর চেয়ে আর ভালো হবে না। এটি প্রজন্মের পর প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পর্যন্ত এমনই থাকবে।
>>>নয়া দিগন্ত,
সোমাইয়ের একজন ভাগ্নি এবং তার ডেনিশ স্বামী ও সন্তান - ছবি : বিবিসি

No comments

Powered by Blogger.