জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা, না করা by বিভুরঞ্জন সরকার
হাইকোর্টের এক রায়ে জামায়াতে ইসলামীর
নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণার পর স্বাধীনতাবিরোধী এই দলটির রাজনীতি নিষিদ্ধ করার
দাবিও জোরালো হয়ে উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক চেতনায়
বিশ্বাসী নাগরিক সমাজ এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে আইনি
প্রক্রিয়ায় জামায়াত নিষিদ্ধ করার দাবি তোলা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ
ট্রাইব্যুনাল জামায়াতকে অপরাধী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করে সরকারি-বেসরকারি
কোনো প্রতিষ্ঠানে স্বাধীনতাবিরোধীদের স্থান না দিতে এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক
প্রতিষ্ঠানে যাতে তারা স্থান না পায়, তাও নিশ্চিত করার পরামর্শ আদালত
সরকারকে দিয়েছেন। কিন্তু সরকার এই পরামর্শ বিবেচনায় নেবে কি না তা এখনও
পরিষ্কার নয়। তবে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবির প্রতি সরকার যে
সহমত পোষণ করে না সেটা স্পষ্ট হয়েছে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও
এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বক্তব্য থেকেই। সৈয়দ আশরাফ গত ৩
আগস্ট বলেছেন, জামায়াতে ইসলামকে নিষিদ্ধ করার কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা কোনো ইস্যুতে একমত প্রকাশ করে সাধারণত
বক্তৃতা-বিবৃতি দেন না। আওয়ামী লীগ যা বলে বিএনপির অবস্থান হয় তার বিপরীতে।
আবার বিএনপি কোনোকিছুতে হ্যাঁ বললে আওয়ামী লীগ অবধারিতভাবেই তাতে না বলে।
কিন্তু জামায়াত নিষিদ্ধের প্রশ্নে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলের দুই নেতা
প্রায় এক সুরে কথা বলেছেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ২ আগস্ট বলেছেন,
বিএনপি কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা সমর্থন করে না। রাজনীতিকে রাজনৈতিক
প্রক্রিয়ায় মোকাবেলা করা উচিত। সৈয়দ আশরাফ এবং মির্জা ফখরুল জামায়াত
নিষিদ্ধের প্রশ্নে প্রায় অভিন্ন মত প্রকাশ করলেও আওয়ামী লীগের অন্য
নেতা-মন্ত্রীরা কিন্তু ভিন্ন কথা বলেছেন। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত
সংবিধানের সঙ্গে গঠনতন্ত্র সাংঘর্ষিক হওয়ায় জামায়াত ইসলামের নিবন্ধন অবৈধ ও
বাতিল ঘোষণা সঠিক ও স্বাভাবিক বলে মন্তব্য করে বলেছেন, এর মাধ্যমে জামায়াত
এদেশে থাকার অধিকার হারিয়েছে। বাংলাদেশে থাকার কোনো অধিকার নেই তাদের। আইন
প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেছেন, উচ্চ আদালতে জামায়াতের
নিবন্ধনকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। এটি জামায়াত নিষিদ্ধের প্রথম ধাপ। এখন
আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জামায়াত নিষিদ্ধ হবে। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ
সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মাহবুবউল আলম হানিফ বলেছেন, রাজনীতি
কলুষমুক্ত করতে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়া জরুরি। তথ্যমন্ত্রী ও
জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেছেন, জামায়াতকে দলগতভাবে নিষিদ্ধ করা
দরকার এবং এর প্রত্যেক সদস্যের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়াও দরকার।
জামায়াত একটি সশস্ত্র জঙ্গিবাদী সংগঠন, তার গণতন্ত্রে থাকার অধিকার নেই।
দেখা যাচ্ছে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা না করা নিয়ে সরকারি দলের মধ্যে
ভাবনাচিন্তার ঐক্য নেই। এ অবস্থায় হাইকোর্ট জামায়াতের নিবন্ধন নিষিদ্ধ
করলেও জামায়াতের রাজনীতি খুব শিগগিরই দেশে বন্ধ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
তারা যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য যে তৈরি আছে সেটা বোঝা যায় তাদের
কর্মসূচি ঘোষণার ধরন দেখে। জামায়াত হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আইনি
ব্যবস্থা হিসেবে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে আপিল করেছে। আবার সরকারের ওপর চাপ
সৃষ্টির জন্য আগামী ১৩, ১৪ আগস্ট সারাদেশে ৪৮ ঘণ্টার হরতাল আহ্বান করেছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে
জামায়াতের কয়েকজন শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে দণ্ড ঘোষণার পর দেশে জামায়াত-শিবির
ব্যাপক সহিংসতা চালিয়েছে। সরকার জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের বিরুদ্ধে কঠোর
অবস্থানে আছে। জামায়াত-শিবিরের অনেক নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছে। কেউ কেউ
আÍগোপনে আছে। জামায়াতের সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে পড়েছে বলে মনে করা হলেও
বাস্তবে এখনও তারা হিংসাÍক কর্মকাণ্ড থেকে এতটুকুও দূরে সরেনি।
জামায়াত-শিবির নানামুখী অপতৎপরতা চালিয়েও তাদের নেতাদের দণ্ডের হাত থেকে
মুক্ত রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। সরকার একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের
প্রশ্নে অবিচল রয়েছে।
নিষিদ্ধ না করলেও বর্তমান সরকারের আমলে জামায়াতের পক্ষে প্রকাশ্যে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করা সহজ হবে বলে মনে হয় না। সেক্ষেত্রে জামায়াত আগামী দিনগুলোতে আসলে কোন কৌশল অবলম্বন করবে সেটা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানারকম জল্পনা-কল্পনা চলছে। জামায়াতের প্রধান মিত্র বিএনপির মধ্যেও জামায়াতকে নিয়ে নানারকম হিসাব-নিকাশ চলছে। জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ হোক অথবা তাদের নিবন্ধন বাতিল থাকুকÑ এই দুটোর কোনোটাতেই বিএনপির কোনো লোকসান নেই বলে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের ধারণা। জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের সিদ্ধান্ত যদি বহাল থাকে তাহলে তারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। জামায়াত নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপির লাভ দু’দিক থেকে। এক. নির্বাচনে আসন ভাগাভাগি নিয়ে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির কোনো ধরনের সমস্যা থাকবে না। দুই. দলীয় প্রার্থী না থাকায় জামায়াতের ভোট পাবে বিএনপি। কারণ জামায়াতের নেতা-কর্মী-সমর্থকরা কখনোই আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে না। আবার জামায়াত যদি নিষিদ্ধও হয় তাহলেও বিএনপিরই লাভ। কারণ সেক্ষেত্রেও অন্য কোনো দলের চেয়ে জামায়াতের বিএনপিতেই লীন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অন্য কোনো ইসলামী দলের সঙ্গে মিশে গেলে জামায়াতের রাজনীতি এক ধরনের ঝুঁকির মধ্যেই থাকবে। কিন্তু বিএনপিতে মিশলে তারা থাকবে ঝুঁকিমুক্ত। কারণ রাজনীতিতে যত প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থানই গ্রহণ করুক না কেন, বিএনপিকে অনেকেই সাম্প্রদায়িক দল হিসেবে সেভাবে মনে করে না। নিষিদ্ধ হওয়া কিংবা নিবন্ধন বাতিল হওয়াÑ দুই ক্ষেত্রেই অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে থাকার কোনো বিকল্প নেই জামায়াতের সামনে। মাঠের আন্দোলন যদি জামায়াত তীব্র করতে পারে তাহলে চূড়ান্ত বিচারে এর সুফল বিএনপির ঘরেই যাবে। জামায়াত এটা ভালো করেই জানে যে আগামী নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভ করে ক্ষমতায় যেতে না পারলে জামায়াতের দুর্দিন শেষ হবে না। সেজন্য জামায়াত যত প্রতিকূলতার মধ্যেই পড়–ক না কেন, নির্বাচনের সময় তারা বিএনপির পক্ষেই সর্বশক্তি নিয়ে প্রচারণায় নামবে।
জামায়াতের সঙ্গে এক ধরনের রাজনৈতিক সমঝোতার চেষ্টা আওয়ামী লীগ তথা সরকারের পক্ষ থেকেও আছে বলে শোনা যায়। বিএনপি থেকে জামায়াতকে আলাদা করার কৌশল আওয়ামী লীগ যদি নিয়েও থাকে তাহলে এতে রাজনৈতিকভাবে তাদের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। জামায়াতও এটা খুব ভালো করেই বোঝে যে আওয়ামী লীগের সঙ্গে থেকে তাদের লাভের চেয়ে লোকসানই বেশি। তাই তারা সরকারের কোনো ফাঁদে পা দেবে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বিশ্বাস করেন না। রাজনৈতিক চাতুরিতে জামায়াতের সঙ্গেই আওয়ামী লীগ পেরে উঠবে বলে মনে হয় না। তবে জামায়াতের মতো একটি সন্ত্রাসী দলের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে বিএনপি কতদিন একসঙ্গে চলতে পারবে সে প্রশ্নও কারও কারও মনে আছে। বিএনপি এখনও নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলেই দাবি করে থাকে। অন্যদিকে জামায়াত মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী দল। এছাড়া জামায়াতকে গণতন্ত্রবিরোধী শক্তি হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়।
জামায়াত-শিবিরের প্রশ্নে আওয়ামী লীগ তথা সরকারকেও তার অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। জামায়াত-শিবিরকে শুধু আইনগতভাবে মোকাবেলা করতে চাইলে তাতে সাময়িক কিছু ফল পাওয়া গেলেও এই প্রক্রিয়ায় তাদের শিকড় উপড়ে ফেলা যাবে না। রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিকভাবেও তাদের বিচ্ছিন্ন করার সর্বাÍক পরিকল্পনা সরকারের থাকতে হবে। ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জামায়াত-শিবিরের কৌশল মোকাবেলা করতে হলে একমুখী তৎপরতায় ফল পাওয়া যাবে না। জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির প্রতি দেশের মানুষের ব্যাপক সমর্থন নেইÑ এটা যেমন সত্যি তেমনি তারা একেবারে জনবিচ্ছিন্ন এমনটা ভাবাও ঠিক নয়। নানা ধরনের অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা দেয়া থেকে শুরু করে বেহেশতি দরজা দেখানোর লোভ-প্রলোভনসহ নানাভাবে এরা মানুষের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছে এবং এক্ষেত্রে যে তারা একেবারে ব্যর্থ নয়, তার প্রমাণও আছে। একাত্তরে দেশবিরোধী গণধিকৃত ভূমিকা পালনের পরও জামায়াত যে কোথাও কোথাও নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারেÑ এটাকে কোনোভাবেই হালকা করে দেখা ঠিক নয়। সে জন্যই কেবল কথার ফানুস উড়িয়ে কিংবা আইনি ভয় দেখিয়ে জামায়াতকে জনবিচ্ছিন্ন করা যাবে না, সেজন্য দরকার সমন্বিত রাজনৈতিক উদ্যোগ ও কর্মপরিকল্পনা। জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণসচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক-সামাজিক শক্তিকে একযোগে কাজ করতে হবে। আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে জামায়াত-শিবিরকে মোকাবেলা করলে তারা সাংগঠনিকভাবে হয়তো কিছুটা দুর্বল হবে কিন্তু এভাবে তাদের নির্মূল করা যাবে না। জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করলেও এরা একেবারে নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে না। এদের কার্যপদ্ধতি সুচারু এবং সুসংগঠিত। মসজিদ-মাদ্রাসাকে কেন্দ্র করে এরা সক্রিয় থাকবে, সুযোগের অপেক্ষায় থাকবে এবং অনুকূল পরিস্থিতি পেলে আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। যেমনটা তারা করেছিল মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়কালে। এটা মনে রাখতে হবে যে, দারিদ্র্য-বৈষম্য-পশ্চাৎপদ চিন্তাচেতনাই হল জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির প্রধান ভিত্তি। সমাজে যদি ধর্ম বৈষম্য না থাকে, বেকারত্ব না থাকে, কোনো মানুষ যদি শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত না থাকে, দেশে যদি ন্যায়বিচার-সুশাসন নিশ্চিত হয় তাহলে জামায়াত-শিবির শুধু পরলোকের সুখ-সুবিধার কথা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারবে না। সেজন্য জামায়াত-শিবিরকে কার্যকরভাবে মোকাবেলার পূর্বশর্ত হল অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন এবং বৈষম্য কমিয়ে একটি সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার দিকে অগ্রসর হওয়া। ওই পথে না এগিয়ে জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে বাগাড়ম্বর করাটা শূন্যে গাদা ঘুরানোরই নামান্তর।
জামায়াত-শিবির কতটা হিংস ও পৈশাচিক হতে পারে তার প্রমাণ তারা একাত্তরে আলবদর-আলশামস বাহিনী গঠন করে বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের রাতের অন্ধকারে চোখ বেঁধে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে যেমন দিয়েছে, তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশেও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রগ কেটে কিংবা ঠাণ্ডা মাথায় খুন করে দিয়েছে। ইসলামের নাম করে তারা অসংখ্য নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে। ধর্ম এবং রাজনীতিকে একাকার করে জামায়াত-শিবির যে কত ধরনের অপকর্ম করতে পারে তার প্রমাণ অতি সাম্প্রতিককালেও তারা দিয়েছে। এই সন্ত্রাসী শক্তিকে যারা রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছে বা করার কৌশল নিচ্ছে তাদের সবাইকে একসময় চরম মূল্য দিতে হবে। জামায়াত-শিবির আন্তর্জাতিক জঙ্গি নেটওয়ার্কের সঙ্গে যে সম্পৃক্ত তার তথ্যও এখন আমাদের অজানা নয়। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী এক ধরনের ঐকমত্য তৈরি আছে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সরকার দেশের অভ্যন্তরে জঙ্গিবাদের সহযোগী রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করতে কেন দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগে এটা অনেকের কাছেই স্পষ্ট নয়। তবে এটা ঠিক এই অপশক্তির বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত এবং অপরিকল্পিত ও বিচ্ছিন্ন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা ঠিক হবে না।
বিভুরঞ্জন সরকার : সাংবাদিক ও কলাম লেখক
নিষিদ্ধ না করলেও বর্তমান সরকারের আমলে জামায়াতের পক্ষে প্রকাশ্যে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করা সহজ হবে বলে মনে হয় না। সেক্ষেত্রে জামায়াত আগামী দিনগুলোতে আসলে কোন কৌশল অবলম্বন করবে সেটা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানারকম জল্পনা-কল্পনা চলছে। জামায়াতের প্রধান মিত্র বিএনপির মধ্যেও জামায়াতকে নিয়ে নানারকম হিসাব-নিকাশ চলছে। জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ হোক অথবা তাদের নিবন্ধন বাতিল থাকুকÑ এই দুটোর কোনোটাতেই বিএনপির কোনো লোকসান নেই বলে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের ধারণা। জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের সিদ্ধান্ত যদি বহাল থাকে তাহলে তারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। জামায়াত নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপির লাভ দু’দিক থেকে। এক. নির্বাচনে আসন ভাগাভাগি নিয়ে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির কোনো ধরনের সমস্যা থাকবে না। দুই. দলীয় প্রার্থী না থাকায় জামায়াতের ভোট পাবে বিএনপি। কারণ জামায়াতের নেতা-কর্মী-সমর্থকরা কখনোই আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে না। আবার জামায়াত যদি নিষিদ্ধও হয় তাহলেও বিএনপিরই লাভ। কারণ সেক্ষেত্রেও অন্য কোনো দলের চেয়ে জামায়াতের বিএনপিতেই লীন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অন্য কোনো ইসলামী দলের সঙ্গে মিশে গেলে জামায়াতের রাজনীতি এক ধরনের ঝুঁকির মধ্যেই থাকবে। কিন্তু বিএনপিতে মিশলে তারা থাকবে ঝুঁকিমুক্ত। কারণ রাজনীতিতে যত প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থানই গ্রহণ করুক না কেন, বিএনপিকে অনেকেই সাম্প্রদায়িক দল হিসেবে সেভাবে মনে করে না। নিষিদ্ধ হওয়া কিংবা নিবন্ধন বাতিল হওয়াÑ দুই ক্ষেত্রেই অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে থাকার কোনো বিকল্প নেই জামায়াতের সামনে। মাঠের আন্দোলন যদি জামায়াত তীব্র করতে পারে তাহলে চূড়ান্ত বিচারে এর সুফল বিএনপির ঘরেই যাবে। জামায়াত এটা ভালো করেই জানে যে আগামী নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভ করে ক্ষমতায় যেতে না পারলে জামায়াতের দুর্দিন শেষ হবে না। সেজন্য জামায়াত যত প্রতিকূলতার মধ্যেই পড়–ক না কেন, নির্বাচনের সময় তারা বিএনপির পক্ষেই সর্বশক্তি নিয়ে প্রচারণায় নামবে।
জামায়াতের সঙ্গে এক ধরনের রাজনৈতিক সমঝোতার চেষ্টা আওয়ামী লীগ তথা সরকারের পক্ষ থেকেও আছে বলে শোনা যায়। বিএনপি থেকে জামায়াতকে আলাদা করার কৌশল আওয়ামী লীগ যদি নিয়েও থাকে তাহলে এতে রাজনৈতিকভাবে তাদের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। জামায়াতও এটা খুব ভালো করেই বোঝে যে আওয়ামী লীগের সঙ্গে থেকে তাদের লাভের চেয়ে লোকসানই বেশি। তাই তারা সরকারের কোনো ফাঁদে পা দেবে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বিশ্বাস করেন না। রাজনৈতিক চাতুরিতে জামায়াতের সঙ্গেই আওয়ামী লীগ পেরে উঠবে বলে মনে হয় না। তবে জামায়াতের মতো একটি সন্ত্রাসী দলের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে বিএনপি কতদিন একসঙ্গে চলতে পারবে সে প্রশ্নও কারও কারও মনে আছে। বিএনপি এখনও নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলেই দাবি করে থাকে। অন্যদিকে জামায়াত মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী দল। এছাড়া জামায়াতকে গণতন্ত্রবিরোধী শক্তি হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়।
জামায়াত-শিবিরের প্রশ্নে আওয়ামী লীগ তথা সরকারকেও তার অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। জামায়াত-শিবিরকে শুধু আইনগতভাবে মোকাবেলা করতে চাইলে তাতে সাময়িক কিছু ফল পাওয়া গেলেও এই প্রক্রিয়ায় তাদের শিকড় উপড়ে ফেলা যাবে না। রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিকভাবেও তাদের বিচ্ছিন্ন করার সর্বাÍক পরিকল্পনা সরকারের থাকতে হবে। ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জামায়াত-শিবিরের কৌশল মোকাবেলা করতে হলে একমুখী তৎপরতায় ফল পাওয়া যাবে না। জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির প্রতি দেশের মানুষের ব্যাপক সমর্থন নেইÑ এটা যেমন সত্যি তেমনি তারা একেবারে জনবিচ্ছিন্ন এমনটা ভাবাও ঠিক নয়। নানা ধরনের অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা দেয়া থেকে শুরু করে বেহেশতি দরজা দেখানোর লোভ-প্রলোভনসহ নানাভাবে এরা মানুষের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছে এবং এক্ষেত্রে যে তারা একেবারে ব্যর্থ নয়, তার প্রমাণও আছে। একাত্তরে দেশবিরোধী গণধিকৃত ভূমিকা পালনের পরও জামায়াত যে কোথাও কোথাও নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারেÑ এটাকে কোনোভাবেই হালকা করে দেখা ঠিক নয়। সে জন্যই কেবল কথার ফানুস উড়িয়ে কিংবা আইনি ভয় দেখিয়ে জামায়াতকে জনবিচ্ছিন্ন করা যাবে না, সেজন্য দরকার সমন্বিত রাজনৈতিক উদ্যোগ ও কর্মপরিকল্পনা। জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণসচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক-সামাজিক শক্তিকে একযোগে কাজ করতে হবে। আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে জামায়াত-শিবিরকে মোকাবেলা করলে তারা সাংগঠনিকভাবে হয়তো কিছুটা দুর্বল হবে কিন্তু এভাবে তাদের নির্মূল করা যাবে না। জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করলেও এরা একেবারে নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে না। এদের কার্যপদ্ধতি সুচারু এবং সুসংগঠিত। মসজিদ-মাদ্রাসাকে কেন্দ্র করে এরা সক্রিয় থাকবে, সুযোগের অপেক্ষায় থাকবে এবং অনুকূল পরিস্থিতি পেলে আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। যেমনটা তারা করেছিল মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়কালে। এটা মনে রাখতে হবে যে, দারিদ্র্য-বৈষম্য-পশ্চাৎপদ চিন্তাচেতনাই হল জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির প্রধান ভিত্তি। সমাজে যদি ধর্ম বৈষম্য না থাকে, বেকারত্ব না থাকে, কোনো মানুষ যদি শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত না থাকে, দেশে যদি ন্যায়বিচার-সুশাসন নিশ্চিত হয় তাহলে জামায়াত-শিবির শুধু পরলোকের সুখ-সুবিধার কথা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারবে না। সেজন্য জামায়াত-শিবিরকে কার্যকরভাবে মোকাবেলার পূর্বশর্ত হল অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন এবং বৈষম্য কমিয়ে একটি সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার দিকে অগ্রসর হওয়া। ওই পথে না এগিয়ে জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে বাগাড়ম্বর করাটা শূন্যে গাদা ঘুরানোরই নামান্তর।
জামায়াত-শিবির কতটা হিংস ও পৈশাচিক হতে পারে তার প্রমাণ তারা একাত্তরে আলবদর-আলশামস বাহিনী গঠন করে বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের রাতের অন্ধকারে চোখ বেঁধে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে যেমন দিয়েছে, তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশেও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রগ কেটে কিংবা ঠাণ্ডা মাথায় খুন করে দিয়েছে। ইসলামের নাম করে তারা অসংখ্য নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে। ধর্ম এবং রাজনীতিকে একাকার করে জামায়াত-শিবির যে কত ধরনের অপকর্ম করতে পারে তার প্রমাণ অতি সাম্প্রতিককালেও তারা দিয়েছে। এই সন্ত্রাসী শক্তিকে যারা রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছে বা করার কৌশল নিচ্ছে তাদের সবাইকে একসময় চরম মূল্য দিতে হবে। জামায়াত-শিবির আন্তর্জাতিক জঙ্গি নেটওয়ার্কের সঙ্গে যে সম্পৃক্ত তার তথ্যও এখন আমাদের অজানা নয়। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী এক ধরনের ঐকমত্য তৈরি আছে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সরকার দেশের অভ্যন্তরে জঙ্গিবাদের সহযোগী রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করতে কেন দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগে এটা অনেকের কাছেই স্পষ্ট নয়। তবে এটা ঠিক এই অপশক্তির বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত এবং অপরিকল্পিত ও বিচ্ছিন্ন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা ঠিক হবে না।
বিভুরঞ্জন সরকার : সাংবাদিক ও কলাম লেখক
No comments