ঘুরে দাঁড়াতে গিয়ে বসে পড়বে না তো? by মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার
সরকারের শেষ বছরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের
প্রাক্কালে ‘জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের ব্যারোমিটার’, ‘অ্যাসিড টেস্ট’ বা
‘হাইভোল্টেজের নির্বাচন’ প্রভৃতি নামে আখ্যায়িত পাঁচ সিটি কর্পোরেশন
নির্বাচনে মহাজোট সরকার বড় ব্যবধানে, ০-৫ নির্বাচনী ম্যাচে হোয়াইট ওয়াশ
হওয়ার পর তাদের জনপ্রিয়তার মাত্রা সম্পর্কে বাস্তব ধারণা পেয়েছে। বিশেষ করে
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সব রকম উপায় অবলম্বন প্রশাসন, ইসলামিক
ফাউন্ডেশনের ডিজি, এনবিআরের চেয়ারম্যানকে ব্যবহার করাসহ সর্বশক্তি নিয়োগ
করেও যখন সরকার সমর্থিত আকর্ষণীয় ইমেজের প্রার্থীর এক লাখ ছয় সহস্রাধিক
ভোটের ব্যবধানের বিশাল পরাজয় ঠেকাতে পারেনি, তখন জনপ্রিয়তার নিুমুখী গতি
সম্পর্কে সরকারের ধারণা হয়েছে। আলোচ্য হোয়াইট ওয়াশের পর সরকার সম্পর্কে
তৃণমূল পর্যায়ের অনেক ভাসমান ভোটারই যখন ভাবছেন, ‘দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে
দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ’, অথবা, ‘করিয়াছ মেলা ভুল, দিতে হবে মাশুল’ এমন এক
সংকটের সময়ে সরকারি দলের নেতা-মন্ত্রীরা দলীয় নেতা-কর্মী-সমর্থকদের চাঙ্গা
করাতে মহাজোটের আবার ঘুরে দাঁড়ানোর তত্ত্ব উপস্থাপন করেছেন। তারা বলছেন,
সংসদ নির্বাচনে ভোটাররা ভিন্ন বিবেচনায় ভোট দেন। তাদের ভাষায়, ভোটারদের
কাছে সরকারের ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারলে দশম সংসদ
নির্বাচনে সরকারি দলের জয় সুনিশ্চিত। সরকারদলীয় নেতা-মন্ত্রীদের এ ঘুরে
দাঁড়ানোর তত্ত্বকে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় এবং
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সুনিশ্চিত করতে চেয়েছেন। জয় বলেছেন, তার
কাছে তথ্য আছে, আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় আসবে। অন্যদিকে অর্থমন্ত্রী
বলেছেন, ‘আমার কাছে কোনো তথ্য না থাকলেও বিশ্বাস আছে আওয়ামী লীগ আবারও
ক্ষমতায় আসবে।’ জয়ের বক্তব্য বিরোধী পক্ষ কর্তৃক ব্যাপকভাবে সমালোচিত হওয়ার
পর সরকারদলীয় কোনো কোনো নেতা বলেছেন, জয় জরিপের ভিত্তিতে এ কথা বলেছেন।
তবে তিনি কবে কোথায় কাদের দিয়ে কেমন জরিপ করালেন, সে সম্পর্কে বিস্তারিত
কিছু জানাননি।
এ কথা সত্য যে, রাজনৈতিক দলের জনপ্রিয়তা সব সময় এক রকম যায় না। দলগুলোর পারফরম্যান্সের সঙ্গে জনপ্রিয়তার হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। তবে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোতে ক্ষমতাসীন দলের জনপ্রিয়তা সরকারের মেয়াদান্তে কিছুটা হ্রাস পেয়ে থাকে। কারণ এসব সমস্যাসংকুল দেশে সরকারের পক্ষে জনগণের সব সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হয় না। তবে সব সমস্যার সমাধান না করেও জনগণের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে সাধ্য অনুযায়ী তাদের সঙ্গে নিয়ে সমস্যা সমাধানে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে কোনো সরকারের পক্ষে জনপ্রিয়তা ধরে রাখা অসম্ভব নয়। কিন্তু মহাজোট সরকারের ক্ষেত্রে তেমনটি ঘটেনি।
নবম সংসদ নির্বাচনে বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ায় মহাজোট সরকার প্রথম থেকেই জনগণের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করে দলীয় স্বার্থে কাজ করছে। এ সরকার জনগণের মতামত নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি। জনগণ চেয়েছে ঐক্য ও সহমর্মিতার রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করে দেশ ও দেশের উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যেতে, কিন্তু সরকারের রাজনীতিতে ঐক্য ও সহমর্মিতার পরিবর্তে প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার রাজনীতি প্রতিফলিত হয়েছে। জনগণ চেয়েছে সরকার গঠনের পরপরই ডিসিসি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। কিন্তু সরকার রাজনৈতিক জয়-পরাজয়ের অংক করে সাড়ে চার বছরেও সে নির্বাচন দিতে পারেনি। জনগণ চেয়েছে জাতীয় সংসদকে কার্যকর করতে সরকার সফল হোক। কিন্তু বিরোধী দলকে কোণঠাসা করতে গিয়ে সরকার সংসদকে কার্যকর করতে পারেনি। জনগণ চেয়েছে সরকার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থা নিক। কিন্তু দলীয় মূল্যসন্ত্রাসী সিন্ডিকেটকে ছাড় দিতে গিয়ে সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে সফল হতে পারেনি। জনগণ চেয়েছে সরকার দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করুক। কিন্তু সরকার পদ্মা সেতু, শেয়ারবাজার, ব্যাংকিং সেক্টরের লুটপাট, হলমার্ক, ডেসটিনি, বিসমিল্লাহ গ্র“পসহ বড় বড় দুর্নীতির ক্ষেত্রে নমনীয় ভূমিকা পালন করেছে। জনগণ চেয়েছে সরকার প্রতিটি স্থানীয় সরকার এককে নির্বাচিত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করুক। কিন্তু সরকার বিভক্ত ডিসিসি এবং জেলা পরিষদে নির্বাচন না দিয়ে দলীয় লোকজনকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। জনগণ চেয়েছে সরকারদলীয় অঙ্গসংগঠনগুলো জনগণকে সঙ্গে নিয়ে শান্তি ও উন্নয়ন সুনিশ্চিত করুক। কিন্তু দলীয় অঙ্গ সংগঠনগুলোকে সরকার টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজি এবং মারামারি-খুনোখুনি থেকে বিরত রাখতে পারেনি। সর্বোপরি জনগণ চেয়েছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হোক। কিন্তু সরকার গণইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে ক্ষমতায় থেকে নিজেদের নিয়োজিত নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন করে ক্ষমতা ধরে রাখার পরিকল্পনা করেছে। এভাবে পদে পদে সরকার গণবিরোধী সিদ্ধান্ত নিয়ে ক্রমান্বয়ে গণসমর্থন হারিয়েছে, যার প্রতিফলন ঘটেছে ১৫ জুন চার সিটি কর্পোরেশন এবং ৬ জুলাই গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে জনগণের দেয়া রায়ে। রশি যেমন আগুনে পুড়ে গেলেও তার পাক ছাড়ে না, সরকারি দলের অবস্থা যেন অনেকটা সে রকমই এখন। স্থানীয় নির্বাচনে জনগণের ‘না’ শোনার পর ঘুরে দাঁড়ানোর কথা বলা ছাড়া সরকারদলীয় নেতা-মন্ত্রীদের আর বলার কিইবা আছে। নেতা-কর্মী-সমর্থকদের চাঙ্গা রাখার জন্য তারা সে বুলি আওড়েছেন। কিন্তু জনগণকে সঙ্গে নিয়ে, তাদের দাবি মেনে নিয়ে সরকার যদি ঘুরে দাঁড়াতে চাইত, তাহলে হয়তো সে চেষ্টা বিফল হতো না। কিন্তু সরকার নিজ অবস্থানে অনড় থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর যে তত্ত্ব প্রচার করছে তাতে মনে হচ্ছে, এভাবে ঘুরে দাঁড়াতে গিয়ে সরকারকে শেষ মুহূর্তে বড় রকমের হোঁচট খেতে হতে পারে। অবশ্য সরকার যদি মনে করে, আমরা প্রতিযোগিতাই হতে দেব না। প্রধান বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ না নিলে কার সঙ্গে প্রতিযোগিতা হবে? আমরা এরশাদকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করিয়ে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করিয়ে সে নির্বাচনে বিজয় অর্জন করব, তাহলে ভিন্ন কথা। প্রধান বিরোধী দলকে নির্বাচনের বাইরে রেখে যেনতেন রকম নির্বাচন করলে কী পরিমাণ সহিংসতা হবে এবং ওই নির্বাচন দেশে-বিদেশে কতটা গ্রহণযোগ্যতা পাবে এবং ওই রকম একতরফা নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করতে পারলেও সে সরকারের আয়ু কতদিন বা কত মাস হবে সে সম্পর্কেও সরকারকে ভাবতে হবে।
সরকার যদি এই কট্টর গণবিরোধী লাইনে না গিয়ে পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে গণরায় পাওয়ার পরপরই নির্দলীয় সরকারের দাবি মেনে নিয়ে বিরোধী দলকে ইস্যুবিহীন করে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে সাংগঠনিক কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে সংসদ নির্বাচনে বিরোধী দলের উদ্দেশে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিত, তাহলে হার-জিত যাই হোক না কেন, সরকার নিজেকে গণবিরোধী অবস্থান থেকে সরিয়ে এনে নির্বাচনে একটি সম্মানজনক ফলাফল করতে পারত। কিন্তু সরকার সে লাইনে না গিয়ে গণবিরোধী অবস্থানে থাকায় ভোটাররা সরকারের এ অবস্থান পছন্দ করবে বলে মনে হয় না। ‘জামায়াত’ ও ‘জয়’ কার্ড খেলে সরকার তার জনপ্রিয়তা উদ্ধারের যে মিশনে নেমেছে, তা সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। জামায়াত নিষিদ্ধ হলে লাভ হবে বিএনপি ও জামায়াতের। কারণ এ দলটি নিষিদ্ধ হলে নিশ্চয়ই দলটির সব নেতা-কর্মী-সমর্থক আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক বাড়াবেন না। তারা আওয়ামীবিরোধী শিবিরেই তাদের সমর্থন দেবেন। আর তারা যদি আবার নতুন নামে রাজনীতি শুরু করেন, তাহলে স্বাধীনতা বিরোধিতার কলংক মুছে ফেলে তারা নতুন উদ্যমে রাজনীতি শুরু করতে পারবেন। এতে আওয়ামী লীগের লাভের পাল্লা ভারি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। বিএনপি সম্মিলিত প্রার্থী দিলে এ দলটির সমর্থন পাবে কিন্তু তখন আর দলটির বিরুদ্ধে স্বাধীনতাবিরোধী বা রাজাকারদের সঙ্গে জোট বাঁধার অভিযোগ আনীত হবে না। জয় বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র এবং প্রধানমন্ত্রীর পুত্র হলেও তৃণমূল পর্যায়ে তার পরিচিতি ও গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে এখনও সময় লাগবে। তিনি উচ্চশিক্ষিত হলেও স্থানীয় রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ে তার আরও অধিক সময় দেশে থেকে তৃণমূল পর্যায়ে নেতা-কর্মীদের সময় দেয়ার প্রয়োজন রয়েছে। কাজেই তাকে নিয়ে গ্রামগঞ্জ সফর করলেই যে ভোটারদের মতামত আওয়ামী লীগের দিকে ঝুঁকে পড়বে, এমনটা মনে করার সঙ্গত কারণ নেই।
ঘুরে দাঁড়ানোর অংশ হিসেবে রমজানের পর থেকে আওয়ামী লীগ টানা সাংগঠনিক কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে। এসব কর্মসূচিতে সরকারি দল নির্বাচনী প্রচারণা, দলীয় প্রার্থী বাছাই এবং তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতাদের দূরত্ব হ্রাসের উদ্যোগ নেবে। তাছাড়া দলীয় প্রচারণায় সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরে সরকারদলীয় মন্ত্রী-নেতারা বিরোধী দলের অপপ্রচারের জবাব দেবেন। তারা হেফাজত এবং ড. ইউনূস ইস্যু সম্পর্কে দলীয় অবস্থান স্পষ্ট করবেন এবং একই সঙ্গে চালাবেন দলীয় ইমেজ উদ্ধার এবং নির্বাচনী প্রস্তুতির কর্মসূচি। এ ছাড়া শরিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে মহাজোটের ঐক্য শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেবেন। সরকারদলীয় নেতাদের প্রদত্ত এসব কর্মসূচির ঘোষণা শুনতে ভালো। তবে এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার, রমজানের পর বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটও পূর্ণ শক্তি নিয়ে নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবিতে মাঠে নামবে। হরতালের পর লাগাতার হরতাল দিয়ে বিরোধী দল সরকারকে নির্দলীয় সরকারের দাবি মানতে বাধ্য করতে চাইবে। কাজেই বিরোধীদলীয় ওই জোরালো আন্দোলন মোকাবেলা করে উল্লিখিত সাংগঠনিক কর্মসূচিগুলো সরকারি দলের নেতারা কতটা মনোযোগের সঙ্গে সম্পন্ন করতে পারবেন, সে বিষয়ে ভাবার আছে।
সরকারি দলকে মনে রাখতে হবে, তারা রমজান-পরবর্তী রাজনীতির যে ছক এঁকেছেন, সে কাজে বিরোধী দলের নির্দলীয় সরকারের দাবি মেনে নিয়ে অগ্রসর হলে এক রকম সাড়া পাবেন, আর বিরোধীদলীয় দাবি না মেনে ওই কাজে অগ্রসর হলে তাদের কর্মকাণ্ডে গণপ্রতিক্রিয়া আসবে অন্য রকম। বিরোধী দলের প্রধান দাবি না মেনে অগ্রসর হলে সরকারদলীয় কর্মসূচি প্রবল বিরোধীদলীয় লাগাতার আন্দোলনে বাধাগ্রস্ত হতে পারে। বিরোধী দল যে দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফাঁদে পা দেবে না, সে বিষয়টি তাদের নেতারা একাধিকবার নিশ্চিত করেছেন। কাজেই তাদের জন্য রমজানের পর দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলন তীব্রতর করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই। সরকারি দলকে আরও মনে রাখতে হবে, যৌক্তিকতা ও গণসমর্থনের দিক থেকে রমজান-পরবর্তী রাজনীতিতে বিরোধী দল সরকারি দলের চেয়ে অনেকটা এগিয়ে থাকবে। এসব ভেবে সরকারি নীতিনির্ধারকদের উচিত ছিল পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের রায়ের সময় থেকে রমজান-পরবর্তী রাজনীতি শুরু হওয়ার মধ্যবর্তী সময়ে গণমুখী কাজ করে জনগণের মনে ইতিবাচক ভাবমূর্তি নির্মাণে মনোযোগী হওয়া।
তবে আলোচ্য সময়ে সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা তেমন ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়তে পারেননি। এর পরিবর্তে ওই সময় বেশ কয়েকজন সরকারদলীয় এমপির কোটি কোটি টাকা উপার্জনের তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। উদীয়মান আওয়ামী লীগ নেতা গোলাম মাওলা রনির সাংবাদিক পিটিয়ে আহত করা, ছাত্রলীগ-যুবলীগের চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি অব্যাহত থাকা এবং তার জের ধরে যুবলীগ ঢাকা দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদককে তারই আরেক সহকর্মীর পায়জামা-পাঞ্জাবি টুপি পরে রোজার মাসে ফিল্মি ভঙ্গিমায় গুলি করে হত্যা করার সিসিটিভি ফুটেজ ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার মধ্য দিয়ে অনুধাবন করা যায়, রমজানের পরে সরকারের ঘুরে দাঁড়ানোর আহ্বান দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে আবেদন সৃষ্টি করতে পারেনি। এ ধরনের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে ছাত্রলীগও উল্লিখিত সময়ে পিছিয়ে থাকেনি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নতুন কমিটি ছাত্রী হল, বিজ্ঞানাগার ও প্রশাসনিক ভবন নির্মাণের ৮০ কোটি টাকার চলমান কাজে ২ শতাংশ চাঁদা দাবি করে ওই নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দিয়ে শ্রমিকদের মারধর করে (প্রথম আলো, ১৬-০৭-১৩), দলীয় কর্মী হত্যা মামলার আসামি অস্ত্রধারী ক্যাডার হিসেবে পত্রিকায় ছবি প্রকাশিত হলেও সেই তৌহিদ আল তুহিনকে রাবি শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক করা হয়, রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রোকনউজ্জামান রিন্টু গভীর রাতে ফুর্তি করতে গিয়ে বান্ধবীসহ ধরা পড়ার পর ৫ লাখ টাকা দিয়ে ছাড়া পাওয়ার খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয় (মানবজমিন, ৩০-০৭-১৩)। এছাড়া রমজানে মূল্যসন্ত্রাসী সিন্ডিকেটগুলোকেও সরকার নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি। এ সময় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক চুরি-ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের আসামি জামিন নিয়ে জেল থেকে বের হয়। সব মিলিয়ে পাঁচ সিটি নির্বাচনের পর থেকে রমজান পর্যন্ত সরকারি দল এমন কোনো ইতিবাচক ভাবমূর্তি নির্মাণ করতে পারেনি, যা দেখে জনগণ ঈদ-পরবর্তী সরকারি দলের রাজনৈতিক কর্মসূচির সমর্থনে ঝাঁপিয়ে পড়বেন।
এসব দেখে সমসাময়িক রাজনীতি বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করছেন, ঈদ-পরবর্তী রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় প্রত্যাশিত সফলতা পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মতো গণঅপছন্দের কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়াতে গিয়ে দলটি ঘুরে দাঁড়াতে না পেরে বসে পড়লে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
এ কথা সত্য যে, রাজনৈতিক দলের জনপ্রিয়তা সব সময় এক রকম যায় না। দলগুলোর পারফরম্যান্সের সঙ্গে জনপ্রিয়তার হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। তবে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোতে ক্ষমতাসীন দলের জনপ্রিয়তা সরকারের মেয়াদান্তে কিছুটা হ্রাস পেয়ে থাকে। কারণ এসব সমস্যাসংকুল দেশে সরকারের পক্ষে জনগণের সব সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হয় না। তবে সব সমস্যার সমাধান না করেও জনগণের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে সাধ্য অনুযায়ী তাদের সঙ্গে নিয়ে সমস্যা সমাধানে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে কোনো সরকারের পক্ষে জনপ্রিয়তা ধরে রাখা অসম্ভব নয়। কিন্তু মহাজোট সরকারের ক্ষেত্রে তেমনটি ঘটেনি।
নবম সংসদ নির্বাচনে বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ায় মহাজোট সরকার প্রথম থেকেই জনগণের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করে দলীয় স্বার্থে কাজ করছে। এ সরকার জনগণের মতামত নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি। জনগণ চেয়েছে ঐক্য ও সহমর্মিতার রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করে দেশ ও দেশের উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যেতে, কিন্তু সরকারের রাজনীতিতে ঐক্য ও সহমর্মিতার পরিবর্তে প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার রাজনীতি প্রতিফলিত হয়েছে। জনগণ চেয়েছে সরকার গঠনের পরপরই ডিসিসি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। কিন্তু সরকার রাজনৈতিক জয়-পরাজয়ের অংক করে সাড়ে চার বছরেও সে নির্বাচন দিতে পারেনি। জনগণ চেয়েছে জাতীয় সংসদকে কার্যকর করতে সরকার সফল হোক। কিন্তু বিরোধী দলকে কোণঠাসা করতে গিয়ে সরকার সংসদকে কার্যকর করতে পারেনি। জনগণ চেয়েছে সরকার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থা নিক। কিন্তু দলীয় মূল্যসন্ত্রাসী সিন্ডিকেটকে ছাড় দিতে গিয়ে সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে সফল হতে পারেনি। জনগণ চেয়েছে সরকার দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করুক। কিন্তু সরকার পদ্মা সেতু, শেয়ারবাজার, ব্যাংকিং সেক্টরের লুটপাট, হলমার্ক, ডেসটিনি, বিসমিল্লাহ গ্র“পসহ বড় বড় দুর্নীতির ক্ষেত্রে নমনীয় ভূমিকা পালন করেছে। জনগণ চেয়েছে সরকার প্রতিটি স্থানীয় সরকার এককে নির্বাচিত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করুক। কিন্তু সরকার বিভক্ত ডিসিসি এবং জেলা পরিষদে নির্বাচন না দিয়ে দলীয় লোকজনকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। জনগণ চেয়েছে সরকারদলীয় অঙ্গসংগঠনগুলো জনগণকে সঙ্গে নিয়ে শান্তি ও উন্নয়ন সুনিশ্চিত করুক। কিন্তু দলীয় অঙ্গ সংগঠনগুলোকে সরকার টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজি এবং মারামারি-খুনোখুনি থেকে বিরত রাখতে পারেনি। সর্বোপরি জনগণ চেয়েছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হোক। কিন্তু সরকার গণইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে ক্ষমতায় থেকে নিজেদের নিয়োজিত নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন করে ক্ষমতা ধরে রাখার পরিকল্পনা করেছে। এভাবে পদে পদে সরকার গণবিরোধী সিদ্ধান্ত নিয়ে ক্রমান্বয়ে গণসমর্থন হারিয়েছে, যার প্রতিফলন ঘটেছে ১৫ জুন চার সিটি কর্পোরেশন এবং ৬ জুলাই গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে জনগণের দেয়া রায়ে। রশি যেমন আগুনে পুড়ে গেলেও তার পাক ছাড়ে না, সরকারি দলের অবস্থা যেন অনেকটা সে রকমই এখন। স্থানীয় নির্বাচনে জনগণের ‘না’ শোনার পর ঘুরে দাঁড়ানোর কথা বলা ছাড়া সরকারদলীয় নেতা-মন্ত্রীদের আর বলার কিইবা আছে। নেতা-কর্মী-সমর্থকদের চাঙ্গা রাখার জন্য তারা সে বুলি আওড়েছেন। কিন্তু জনগণকে সঙ্গে নিয়ে, তাদের দাবি মেনে নিয়ে সরকার যদি ঘুরে দাঁড়াতে চাইত, তাহলে হয়তো সে চেষ্টা বিফল হতো না। কিন্তু সরকার নিজ অবস্থানে অনড় থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর যে তত্ত্ব প্রচার করছে তাতে মনে হচ্ছে, এভাবে ঘুরে দাঁড়াতে গিয়ে সরকারকে শেষ মুহূর্তে বড় রকমের হোঁচট খেতে হতে পারে। অবশ্য সরকার যদি মনে করে, আমরা প্রতিযোগিতাই হতে দেব না। প্রধান বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ না নিলে কার সঙ্গে প্রতিযোগিতা হবে? আমরা এরশাদকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করিয়ে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করিয়ে সে নির্বাচনে বিজয় অর্জন করব, তাহলে ভিন্ন কথা। প্রধান বিরোধী দলকে নির্বাচনের বাইরে রেখে যেনতেন রকম নির্বাচন করলে কী পরিমাণ সহিংসতা হবে এবং ওই নির্বাচন দেশে-বিদেশে কতটা গ্রহণযোগ্যতা পাবে এবং ওই রকম একতরফা নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করতে পারলেও সে সরকারের আয়ু কতদিন বা কত মাস হবে সে সম্পর্কেও সরকারকে ভাবতে হবে।
সরকার যদি এই কট্টর গণবিরোধী লাইনে না গিয়ে পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে গণরায় পাওয়ার পরপরই নির্দলীয় সরকারের দাবি মেনে নিয়ে বিরোধী দলকে ইস্যুবিহীন করে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে সাংগঠনিক কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে সংসদ নির্বাচনে বিরোধী দলের উদ্দেশে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিত, তাহলে হার-জিত যাই হোক না কেন, সরকার নিজেকে গণবিরোধী অবস্থান থেকে সরিয়ে এনে নির্বাচনে একটি সম্মানজনক ফলাফল করতে পারত। কিন্তু সরকার সে লাইনে না গিয়ে গণবিরোধী অবস্থানে থাকায় ভোটাররা সরকারের এ অবস্থান পছন্দ করবে বলে মনে হয় না। ‘জামায়াত’ ও ‘জয়’ কার্ড খেলে সরকার তার জনপ্রিয়তা উদ্ধারের যে মিশনে নেমেছে, তা সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। জামায়াত নিষিদ্ধ হলে লাভ হবে বিএনপি ও জামায়াতের। কারণ এ দলটি নিষিদ্ধ হলে নিশ্চয়ই দলটির সব নেতা-কর্মী-সমর্থক আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক বাড়াবেন না। তারা আওয়ামীবিরোধী শিবিরেই তাদের সমর্থন দেবেন। আর তারা যদি আবার নতুন নামে রাজনীতি শুরু করেন, তাহলে স্বাধীনতা বিরোধিতার কলংক মুছে ফেলে তারা নতুন উদ্যমে রাজনীতি শুরু করতে পারবেন। এতে আওয়ামী লীগের লাভের পাল্লা ভারি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। বিএনপি সম্মিলিত প্রার্থী দিলে এ দলটির সমর্থন পাবে কিন্তু তখন আর দলটির বিরুদ্ধে স্বাধীনতাবিরোধী বা রাজাকারদের সঙ্গে জোট বাঁধার অভিযোগ আনীত হবে না। জয় বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র এবং প্রধানমন্ত্রীর পুত্র হলেও তৃণমূল পর্যায়ে তার পরিচিতি ও গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে এখনও সময় লাগবে। তিনি উচ্চশিক্ষিত হলেও স্থানীয় রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ে তার আরও অধিক সময় দেশে থেকে তৃণমূল পর্যায়ে নেতা-কর্মীদের সময় দেয়ার প্রয়োজন রয়েছে। কাজেই তাকে নিয়ে গ্রামগঞ্জ সফর করলেই যে ভোটারদের মতামত আওয়ামী লীগের দিকে ঝুঁকে পড়বে, এমনটা মনে করার সঙ্গত কারণ নেই।
ঘুরে দাঁড়ানোর অংশ হিসেবে রমজানের পর থেকে আওয়ামী লীগ টানা সাংগঠনিক কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে। এসব কর্মসূচিতে সরকারি দল নির্বাচনী প্রচারণা, দলীয় প্রার্থী বাছাই এবং তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতাদের দূরত্ব হ্রাসের উদ্যোগ নেবে। তাছাড়া দলীয় প্রচারণায় সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরে সরকারদলীয় মন্ত্রী-নেতারা বিরোধী দলের অপপ্রচারের জবাব দেবেন। তারা হেফাজত এবং ড. ইউনূস ইস্যু সম্পর্কে দলীয় অবস্থান স্পষ্ট করবেন এবং একই সঙ্গে চালাবেন দলীয় ইমেজ উদ্ধার এবং নির্বাচনী প্রস্তুতির কর্মসূচি। এ ছাড়া শরিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে মহাজোটের ঐক্য শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেবেন। সরকারদলীয় নেতাদের প্রদত্ত এসব কর্মসূচির ঘোষণা শুনতে ভালো। তবে এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার, রমজানের পর বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটও পূর্ণ শক্তি নিয়ে নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবিতে মাঠে নামবে। হরতালের পর লাগাতার হরতাল দিয়ে বিরোধী দল সরকারকে নির্দলীয় সরকারের দাবি মানতে বাধ্য করতে চাইবে। কাজেই বিরোধীদলীয় ওই জোরালো আন্দোলন মোকাবেলা করে উল্লিখিত সাংগঠনিক কর্মসূচিগুলো সরকারি দলের নেতারা কতটা মনোযোগের সঙ্গে সম্পন্ন করতে পারবেন, সে বিষয়ে ভাবার আছে।
সরকারি দলকে মনে রাখতে হবে, তারা রমজান-পরবর্তী রাজনীতির যে ছক এঁকেছেন, সে কাজে বিরোধী দলের নির্দলীয় সরকারের দাবি মেনে নিয়ে অগ্রসর হলে এক রকম সাড়া পাবেন, আর বিরোধীদলীয় দাবি না মেনে ওই কাজে অগ্রসর হলে তাদের কর্মকাণ্ডে গণপ্রতিক্রিয়া আসবে অন্য রকম। বিরোধী দলের প্রধান দাবি না মেনে অগ্রসর হলে সরকারদলীয় কর্মসূচি প্রবল বিরোধীদলীয় লাগাতার আন্দোলনে বাধাগ্রস্ত হতে পারে। বিরোধী দল যে দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফাঁদে পা দেবে না, সে বিষয়টি তাদের নেতারা একাধিকবার নিশ্চিত করেছেন। কাজেই তাদের জন্য রমজানের পর দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলন তীব্রতর করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই। সরকারি দলকে আরও মনে রাখতে হবে, যৌক্তিকতা ও গণসমর্থনের দিক থেকে রমজান-পরবর্তী রাজনীতিতে বিরোধী দল সরকারি দলের চেয়ে অনেকটা এগিয়ে থাকবে। এসব ভেবে সরকারি নীতিনির্ধারকদের উচিত ছিল পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের রায়ের সময় থেকে রমজান-পরবর্তী রাজনীতি শুরু হওয়ার মধ্যবর্তী সময়ে গণমুখী কাজ করে জনগণের মনে ইতিবাচক ভাবমূর্তি নির্মাণে মনোযোগী হওয়া।
তবে আলোচ্য সময়ে সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা তেমন ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়তে পারেননি। এর পরিবর্তে ওই সময় বেশ কয়েকজন সরকারদলীয় এমপির কোটি কোটি টাকা উপার্জনের তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। উদীয়মান আওয়ামী লীগ নেতা গোলাম মাওলা রনির সাংবাদিক পিটিয়ে আহত করা, ছাত্রলীগ-যুবলীগের চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি অব্যাহত থাকা এবং তার জের ধরে যুবলীগ ঢাকা দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদককে তারই আরেক সহকর্মীর পায়জামা-পাঞ্জাবি টুপি পরে রোজার মাসে ফিল্মি ভঙ্গিমায় গুলি করে হত্যা করার সিসিটিভি ফুটেজ ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার মধ্য দিয়ে অনুধাবন করা যায়, রমজানের পরে সরকারের ঘুরে দাঁড়ানোর আহ্বান দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে আবেদন সৃষ্টি করতে পারেনি। এ ধরনের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে ছাত্রলীগও উল্লিখিত সময়ে পিছিয়ে থাকেনি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নতুন কমিটি ছাত্রী হল, বিজ্ঞানাগার ও প্রশাসনিক ভবন নির্মাণের ৮০ কোটি টাকার চলমান কাজে ২ শতাংশ চাঁদা দাবি করে ওই নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দিয়ে শ্রমিকদের মারধর করে (প্রথম আলো, ১৬-০৭-১৩), দলীয় কর্মী হত্যা মামলার আসামি অস্ত্রধারী ক্যাডার হিসেবে পত্রিকায় ছবি প্রকাশিত হলেও সেই তৌহিদ আল তুহিনকে রাবি শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক করা হয়, রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রোকনউজ্জামান রিন্টু গভীর রাতে ফুর্তি করতে গিয়ে বান্ধবীসহ ধরা পড়ার পর ৫ লাখ টাকা দিয়ে ছাড়া পাওয়ার খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয় (মানবজমিন, ৩০-০৭-১৩)। এছাড়া রমজানে মূল্যসন্ত্রাসী সিন্ডিকেটগুলোকেও সরকার নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি। এ সময় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক চুরি-ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের আসামি জামিন নিয়ে জেল থেকে বের হয়। সব মিলিয়ে পাঁচ সিটি নির্বাচনের পর থেকে রমজান পর্যন্ত সরকারি দল এমন কোনো ইতিবাচক ভাবমূর্তি নির্মাণ করতে পারেনি, যা দেখে জনগণ ঈদ-পরবর্তী সরকারি দলের রাজনৈতিক কর্মসূচির সমর্থনে ঝাঁপিয়ে পড়বেন।
এসব দেখে সমসাময়িক রাজনীতি বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করছেন, ঈদ-পরবর্তী রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় প্রত্যাশিত সফলতা পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মতো গণঅপছন্দের কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়াতে গিয়ে দলটি ঘুরে দাঁড়াতে না পেরে বসে পড়লে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
No comments