অপরিকল্পিত নগরে ফুটপাতও দখলে! by ড.হারুন রশীদ
বাংলাদেশ একটি রাজনীতি প্রভাবিত দেশ।
রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যে অনেক জনহিতকর ইস্যুও চাপা পড়ে যায়। ফলে যুগের পর
যুগ সমস্যার কোনো সমাধান হয় না। মাঝেমধ্যে সমস্যা নিয়ে আলোচনার টেবিল গরম
হলেও সে উত্তাপ ফুরিয়ে যায় সমস্যা সমাধানের আগেই। যানজট, গণপরিবহন সংকটের
মতো সমস্যা নিয়ে দিন দিন হিমশিম খাচ্ছে রাজধানীবাসী। কিন্তু সমস্যা যে
তিমিরে ছিল, রয়ে গেছে সেখানেই।
আসলে সমস্যা রয়েছে পরতে পরতে। ঢাকা দেশের রাজধানী, সবচেয়ে বড় নগরী এবং দেড় কোটির বেশি মানুষের বাস এখানে। এখানে দেশের প্রধান প্রশাসনিক কেন্দ্র সচিবালয় ছাড়াও রয়েছে নানা অফিস-আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল। এখানে অনেক বিদেশীও নানা কর্মসূত্রে আসছেন, অনেকে বসবাসও করছেন। সব মিলিয়ে মহাকর্মব্যস্ত এক নগরী ঢাকা। দুঃখজনক হলেও সত্যি ৪শ বছরের পুরনো ঐতিহাসিক ঢাকা নগরী বেড়ে উঠেছে সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে। ফলে নাগরিক সুবিধার অনেকটাই এখানে অনুপস্থিত। আসলে পরিকল্পিত নগর বলতে বোঝায় একটি পরিকল্পিত জনবসতি। পরিকল্পনা মাফিক সবকিছু হলে প্রত্যেক নগরেই মানুষ শৃংখলাপূর্ণ নাগরিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। এতে তার নাগরিক জীবন হয় মর্যাদাপূর্ণ, গ্রাম কিংবা মফস্বলের তুলনায় উন্নততর, স্বস্তিদায়ক। কিন্তু নগর পরিকল্পনাহীনভাবে বেড়ে উঠলে তাতে নাগরিকদের জীবন অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে। জনজীবনকে তা বিপর্যস্ত করে ফেলে। মানুষের ভোগান্তির কোনো শেষ থাকে না। অপরিকল্পিতভাবে বেড়ে ওঠার কারণে রাজধানীর মোট ২ হাজার ২৮৯ দশমিক ৬৯ কিলোমিটার রাস্তার একটি বড় অংশ নানা শ্রেণী-পেশার মানুষের দখলে। বিশেষ করে ঢাকার ফুটপাতগুলো দখলে থাকায় যারপরনাই ভোগান্তির শিকার হয় সাধারণ মানুষ। আসন্ন ঈদ মৌসুমে ফুটপাতগুলো পরিণত হয়েছে হকার মার্কেটে। যানজটের নিগড়ে পিষ্ট মানুষের কাছে এ যেন গোদের ওপর বিষফোঁড়া। সাধারণত হকাররাই ফুটপাত দখল করে রাখে। ফুটপাতে হকারদের বসা, না বসা নিয়ে নানা মত রয়েছে। কেউ বলছেন, ছিন্নমূল এসব মানুষজনকে যদি ফুটপাত থেকে উচ্ছেদ করা হয়, সেটা হবে তাদের রুটি-রুজির ওপর হস্তক্ষেপ। তাই স্থায়ী পুনর্বাসন ছাড়া হকার উচ্ছেদ হবে সম্পূর্ণ অমানবিক। বাংলাদেশ ছিন্নমূল হকার সমিতির তথ্যানুসারে বর্তমানে ঢাকা শহরে ১ লাখ ৩০ হাজার হকার রয়েছে। এর মধ্যে ৭০ হাজার স্থায়ী ও ৬০ হাজার অস্থায়ী। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সহায় সম্বলহীন এসব মানুষ ঢাকা শহরে কাজের সন্ধানে এসে হকার পেশায় যুক্ত হয়ে পড়ে। সামান্য পুঁজিতেই ফুটপাতে বসে যে কোনো ধরনের ছোটখাটো ব্যবসা করা যায়। আর সরকারি দলের পাতি মাস্তান, পুলিশ, অন্যান্য চাঁদাবাজ গোষ্ঠীকে বখরা দিয়ে বাকি যে আয় থাকে, তাও নিছক কম নয়। ওই দিয়েই এক একজনের আয়ে ৩-৪ জনের একটি সংসার চলে।
প্রায় দেড় কোটি মানুষের বসবাসের এই নগরী আসলে এক বিশাল বাজার। এ বাজারের অন্তত ২৫ শতাংশ অর্থনীতি পরিচালিত হয় বা নিয়ন্ত্রিত হয় এই হকারদের মাধ্যমেই। হকারদের কাছ থেকে সস্তায় জিনিসপত্র কেনা যায়। কারণ তাদের দোকান ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে হয় না বলে পণ্যের মূল্যের ওপর তার প্রভাব পড়ে না। ফলে মধ্যবিত্ত ও নিু-মধ্যবিত্তের লোকজন কেনাকাটার জন্য হকারদের ওপর নির্ভরশীল। এ কারণে হকার উচ্ছেদের ব্যাপারটি একপাক্ষিক নয়। তাদের উচ্ছেদ করলে কোথায় গিয়ে তারা দাঁড়াবে, এ বিষয়টিও অবশ্যই ভাবতে হবে। যানজট সৃষ্টির জন্য হকারদের দায়ী করা হলেও তারা আসলে এজন্য কতটা দায়ী সেটিও ভেবে দেখতে হবে। ঢাকার যানজটের প্রধান কারণ রাস্তা সংকট। ঢাকায় যে পরিমাণ জমি রয়েছে তার জন্য ২৫ ভাগ রাস্তা দরকার। সেখানে অলিগলিসহ আছে মাত্র ৭ ভাগ। মেইন রোড আছে ৩ ভাগ। এই ৩ ভাগের ৩০ ভাগ দখল করে অবৈধ দখলদাররা। যার মধ্যে একটি অংশ হচ্ছে হকার। রাজধানীর ৭০ শতাংশ ফুটপাত প্রাইভেট গাড়ি দখল করে রেখেছে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, যে পুলিশ হকার উচ্ছেদ করে সেই পুলিশই রাজধানীর ফুটপাত ও রোড ডিভাইডারে দেড় শতাধিক পুলিশবক্স স্থাপন করেছে। যার সবই অবৈধ। সিটি কর্পোরেশন থেকে কোনো অনুমতি না নিয়েই তা করা হয়েছে। ফুটপাত ও রোড ডিভাইডারের ওপর এসব বক্সের কারণে লোকজনের চলাচলে মারাÍক অসুবিধা সৃষ্টি হলেও কারও কিছ– করার নেই। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন পুলিশের চাপের মুখে এসব অবৈধ বক্স উচ্ছেদ করতে পারছে না। আইন প্রয়োগকারীরাই যদি আইন না মানেন, এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে?
রাজধানীর ভাসমান হকারদের পুনর্বাসনে গত ২৫ বছরে অন্তত দুই ডজন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন। স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী সময়ে ১৯৫২ সালে এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী ১৯৭৯ সালেও বাস্তবায়ন করা হয় দুটি প্রকল্প। ডিসিসির খাতাপত্রে এসব প্রকল্পের আওতায় সর্বমোট ১৮ হাজার হকারকে পুনর্বাসনের কথা বলা হয়েছে। রাজধানীর হকারদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে তৎকালীন ঢাকা পৌরসভা কর্তৃপক্ষ নগরীর সদরঘাট এলাকায় প্রথম প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে ১৯৫২ সালে। সদরঘাট হকার্স মার্কেট নামের ওই প্রকল্পে পুনর্বাসন করা হয় সর্বমোট ৮১২ হকারকে। এরপর ১৯৭৯ সালে সদরঘাট এলাকাতেই হকার পুনর্বাসনের ২য় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। লেডিস পার্ক হকার্স মার্কেট নামের ওই প্রকল্পে ৬৪৫ হকার পুনর্বাসিত হয়। তারপর আশির দশকের শেষার্ধে হকার পুনর্বাসনের ব্যাপকভিত্তিক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এভাবেই গত ২৫ বছর ধরে বিভিন্ন স্থানে প্রায় ১৮ হাজার হকারকে পুনর্বাসন করা হয়। কিন্তু এত প্রকল্প বাস্তবায়নের পরও নগরজুড়ে হকারের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, হকার পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার আদৌ কি কোনো শেষ আছে?
আসলে ফুটপাত দখলমুক্ত করার কথাই বলি আর হকার পুনর্বাসনের কথাই বলি- এ দুটি কাজ করতে হলে উভয়পক্ষ থেকেই দায়িত্বশীল কর্মপন্থা অবলম্বন করতে হবে। স্রোতের মতো হকাররা আসতে থাকবে আর তারা ফুটপাত দখল করে ব্যবসা-বাণিজ্য করবে, তারপর পুনর্বাসনের দাবি তুলবে- এটি কখনও বাস্তবসম্মত নয়। এজন্য সবাইকে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। একটি সুসমন্বিত পন্থায় এগিয়ে যেতে হবে। এ লক্ষ্যে প্রসঙ্গত আমরা কলকাতা শহরের হকারদের পুনর্বাসনের নীতিটি পর্যালোচনা করে দেখতে পারি। এই নীতিতে হকার পুনর্বাসনের ব্যাপারে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয় পুরসভা। হকার নীতি নামে পরিচিত এই নতুন নীতিতে বলা হয়েছে- ১. পুরসভা হকারদের চিহ্নিত করে পরিচয়পত্র দেয়ার ব্যবস্থা করবে। ২. নতুন কোনো হকার ফুটপাত দখল করে বসে পড়ছে কি-না তা মাঝেমধ্যেই সমীক্ষা করে দেখা হবে। ৩. পুরসভা হকারদের বিভিন্ন স্বাস্থ্য প্রকল্প, রাষ্ট্রীয় বীমা যোজনা ইত্যাদিতে অন্তর্ভুক্ত করবে। ৪. অপ্রাপ্ত বয়স্ক বা শিশু হকারদের পুনর্বাসন দিয়ে বিভিন্ন কর্মশিক্ষা, শিশু শিক্ষা প্রকল্প, জাতীয় শিশুশ্রম প্রকল্পে যুক্ত করা হবে। ৫. হকার সন্তানরা অবৈতনিক শিক্ষা এবং মিডডে মিল পাবে। ৬. ঋণ দেয়ার পাশাপাশি বিশেষ কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। ৭. খাবার ও আতশবাজি বিক্রি করে যারা, তাদের প্রয়োজনীয় লাইসেন্স নিতে হবে। ৮. ন্যূনতম ১৫ বর্গফুট ও সর্বাধিক ৪০ বর্গফুট জায়গা একজন হকারের জন্য নির্দিষ্ট হবে। যেখানে সম্ভব ও প্রয়োজন, সেখানে নির্দিষ্ট অনুপাতে শহরের তফসিলি জাতি, উপজাতি, সংখ্যালঘু ও প্রতিবন্ধী হকারদের জন্য বিক্রির জায়গা নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। ৯. হকারদের বেঁধেছেদে রেখে যাওয়া দোকানের মালপত্র রাতে যাতে চুরি না যায় সেজন্য জিনিসপত্র সুরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা করা হবে। ১০. কোথায় কে বসবে তা পরিচয়পত্র দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিহ্নিত করে কাঠামোভিত্তিক ফি নির্ধারণ করা হবে। ১১. এছাড়া হকার নিয়ন্ত্রিত ফুটপাথে কঠিন বর্জ্য অপসারণ, শৌচাগার নির্মাণ, বিদ্যুৎ সংযোজন ও পানীয় জল, বিক্রেতাদের জন্য ছাউনি এবং কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে ফুটপাতেই প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে পুরসভা। ১২. হকার হিসেবে অন্তর্ভুক্তির জন্য পুরসভার নির্দিষ্ট ফরমে আবেদন করতে হবে। আবেদনকারীর বয়স অবশ্যই কমপক্ষে ১৮ বছর হতে হবে। পথচারীদের জন্য হকারদের কিছু নির্দেশিকাও মানতে হবে। পথচারী চলাচলের জন্য দুই-তৃতীয়াংশ ফুটপাত খালি রাখতে হবে। এছাড়া বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় পুরসভা কর্তৃপক্ষ যে কোনো জায়গায় হকারদের বসা, বিক্রি নিয়ন্ত্রণ ও নিষিদ্ধ রাখতে পারবে।
এটি যে একটি চমৎকার ও বাস্তবানু নীতি, সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশের বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে এর অনেক নীতিই সামঞ্জস্যপূর্ণ। হকারদের যদি পরিচয়পত্র দেয়া যায়, তাহলে তারা একটি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে আসবে। তাছাড়া যে কোনো সিদ্ধান্ত যেমন পুনর্বাসন বা অন্যান্য সেবা দেয়ার ক্ষেত্রেও হকারদের একটি সঠিক পরিসংখ্যান জানা থাকলে তা সহজ হবে। এছাড়া সার্বিকভাবে একটি শৃংখলাও প্রতিষ্ঠিত হবে। এটি উভয় পক্ষের জন্যই মঙ্গলজনক হবে নিঃসন্দেহে। এজন্য একটি হকার নীতিমালা করা গেলে বিষফোঁড়ার মতো এ সমস্যা থেকে বাঁচা যাবে।
ড. হারুন রশীদ : সাংবাদিক
আসলে সমস্যা রয়েছে পরতে পরতে। ঢাকা দেশের রাজধানী, সবচেয়ে বড় নগরী এবং দেড় কোটির বেশি মানুষের বাস এখানে। এখানে দেশের প্রধান প্রশাসনিক কেন্দ্র সচিবালয় ছাড়াও রয়েছে নানা অফিস-আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল। এখানে অনেক বিদেশীও নানা কর্মসূত্রে আসছেন, অনেকে বসবাসও করছেন। সব মিলিয়ে মহাকর্মব্যস্ত এক নগরী ঢাকা। দুঃখজনক হলেও সত্যি ৪শ বছরের পুরনো ঐতিহাসিক ঢাকা নগরী বেড়ে উঠেছে সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে। ফলে নাগরিক সুবিধার অনেকটাই এখানে অনুপস্থিত। আসলে পরিকল্পিত নগর বলতে বোঝায় একটি পরিকল্পিত জনবসতি। পরিকল্পনা মাফিক সবকিছু হলে প্রত্যেক নগরেই মানুষ শৃংখলাপূর্ণ নাগরিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। এতে তার নাগরিক জীবন হয় মর্যাদাপূর্ণ, গ্রাম কিংবা মফস্বলের তুলনায় উন্নততর, স্বস্তিদায়ক। কিন্তু নগর পরিকল্পনাহীনভাবে বেড়ে উঠলে তাতে নাগরিকদের জীবন অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে। জনজীবনকে তা বিপর্যস্ত করে ফেলে। মানুষের ভোগান্তির কোনো শেষ থাকে না। অপরিকল্পিতভাবে বেড়ে ওঠার কারণে রাজধানীর মোট ২ হাজার ২৮৯ দশমিক ৬৯ কিলোমিটার রাস্তার একটি বড় অংশ নানা শ্রেণী-পেশার মানুষের দখলে। বিশেষ করে ঢাকার ফুটপাতগুলো দখলে থাকায় যারপরনাই ভোগান্তির শিকার হয় সাধারণ মানুষ। আসন্ন ঈদ মৌসুমে ফুটপাতগুলো পরিণত হয়েছে হকার মার্কেটে। যানজটের নিগড়ে পিষ্ট মানুষের কাছে এ যেন গোদের ওপর বিষফোঁড়া। সাধারণত হকাররাই ফুটপাত দখল করে রাখে। ফুটপাতে হকারদের বসা, না বসা নিয়ে নানা মত রয়েছে। কেউ বলছেন, ছিন্নমূল এসব মানুষজনকে যদি ফুটপাত থেকে উচ্ছেদ করা হয়, সেটা হবে তাদের রুটি-রুজির ওপর হস্তক্ষেপ। তাই স্থায়ী পুনর্বাসন ছাড়া হকার উচ্ছেদ হবে সম্পূর্ণ অমানবিক। বাংলাদেশ ছিন্নমূল হকার সমিতির তথ্যানুসারে বর্তমানে ঢাকা শহরে ১ লাখ ৩০ হাজার হকার রয়েছে। এর মধ্যে ৭০ হাজার স্থায়ী ও ৬০ হাজার অস্থায়ী। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সহায় সম্বলহীন এসব মানুষ ঢাকা শহরে কাজের সন্ধানে এসে হকার পেশায় যুক্ত হয়ে পড়ে। সামান্য পুঁজিতেই ফুটপাতে বসে যে কোনো ধরনের ছোটখাটো ব্যবসা করা যায়। আর সরকারি দলের পাতি মাস্তান, পুলিশ, অন্যান্য চাঁদাবাজ গোষ্ঠীকে বখরা দিয়ে বাকি যে আয় থাকে, তাও নিছক কম নয়। ওই দিয়েই এক একজনের আয়ে ৩-৪ জনের একটি সংসার চলে।
প্রায় দেড় কোটি মানুষের বসবাসের এই নগরী আসলে এক বিশাল বাজার। এ বাজারের অন্তত ২৫ শতাংশ অর্থনীতি পরিচালিত হয় বা নিয়ন্ত্রিত হয় এই হকারদের মাধ্যমেই। হকারদের কাছ থেকে সস্তায় জিনিসপত্র কেনা যায়। কারণ তাদের দোকান ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে হয় না বলে পণ্যের মূল্যের ওপর তার প্রভাব পড়ে না। ফলে মধ্যবিত্ত ও নিু-মধ্যবিত্তের লোকজন কেনাকাটার জন্য হকারদের ওপর নির্ভরশীল। এ কারণে হকার উচ্ছেদের ব্যাপারটি একপাক্ষিক নয়। তাদের উচ্ছেদ করলে কোথায় গিয়ে তারা দাঁড়াবে, এ বিষয়টিও অবশ্যই ভাবতে হবে। যানজট সৃষ্টির জন্য হকারদের দায়ী করা হলেও তারা আসলে এজন্য কতটা দায়ী সেটিও ভেবে দেখতে হবে। ঢাকার যানজটের প্রধান কারণ রাস্তা সংকট। ঢাকায় যে পরিমাণ জমি রয়েছে তার জন্য ২৫ ভাগ রাস্তা দরকার। সেখানে অলিগলিসহ আছে মাত্র ৭ ভাগ। মেইন রোড আছে ৩ ভাগ। এই ৩ ভাগের ৩০ ভাগ দখল করে অবৈধ দখলদাররা। যার মধ্যে একটি অংশ হচ্ছে হকার। রাজধানীর ৭০ শতাংশ ফুটপাত প্রাইভেট গাড়ি দখল করে রেখেছে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, যে পুলিশ হকার উচ্ছেদ করে সেই পুলিশই রাজধানীর ফুটপাত ও রোড ডিভাইডারে দেড় শতাধিক পুলিশবক্স স্থাপন করেছে। যার সবই অবৈধ। সিটি কর্পোরেশন থেকে কোনো অনুমতি না নিয়েই তা করা হয়েছে। ফুটপাত ও রোড ডিভাইডারের ওপর এসব বক্সের কারণে লোকজনের চলাচলে মারাÍক অসুবিধা সৃষ্টি হলেও কারও কিছ– করার নেই। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন পুলিশের চাপের মুখে এসব অবৈধ বক্স উচ্ছেদ করতে পারছে না। আইন প্রয়োগকারীরাই যদি আইন না মানেন, এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে?
রাজধানীর ভাসমান হকারদের পুনর্বাসনে গত ২৫ বছরে অন্তত দুই ডজন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন। স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী সময়ে ১৯৫২ সালে এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী ১৯৭৯ সালেও বাস্তবায়ন করা হয় দুটি প্রকল্প। ডিসিসির খাতাপত্রে এসব প্রকল্পের আওতায় সর্বমোট ১৮ হাজার হকারকে পুনর্বাসনের কথা বলা হয়েছে। রাজধানীর হকারদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে তৎকালীন ঢাকা পৌরসভা কর্তৃপক্ষ নগরীর সদরঘাট এলাকায় প্রথম প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে ১৯৫২ সালে। সদরঘাট হকার্স মার্কেট নামের ওই প্রকল্পে পুনর্বাসন করা হয় সর্বমোট ৮১২ হকারকে। এরপর ১৯৭৯ সালে সদরঘাট এলাকাতেই হকার পুনর্বাসনের ২য় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। লেডিস পার্ক হকার্স মার্কেট নামের ওই প্রকল্পে ৬৪৫ হকার পুনর্বাসিত হয়। তারপর আশির দশকের শেষার্ধে হকার পুনর্বাসনের ব্যাপকভিত্তিক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এভাবেই গত ২৫ বছর ধরে বিভিন্ন স্থানে প্রায় ১৮ হাজার হকারকে পুনর্বাসন করা হয়। কিন্তু এত প্রকল্প বাস্তবায়নের পরও নগরজুড়ে হকারের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, হকার পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার আদৌ কি কোনো শেষ আছে?
আসলে ফুটপাত দখলমুক্ত করার কথাই বলি আর হকার পুনর্বাসনের কথাই বলি- এ দুটি কাজ করতে হলে উভয়পক্ষ থেকেই দায়িত্বশীল কর্মপন্থা অবলম্বন করতে হবে। স্রোতের মতো হকাররা আসতে থাকবে আর তারা ফুটপাত দখল করে ব্যবসা-বাণিজ্য করবে, তারপর পুনর্বাসনের দাবি তুলবে- এটি কখনও বাস্তবসম্মত নয়। এজন্য সবাইকে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। একটি সুসমন্বিত পন্থায় এগিয়ে যেতে হবে। এ লক্ষ্যে প্রসঙ্গত আমরা কলকাতা শহরের হকারদের পুনর্বাসনের নীতিটি পর্যালোচনা করে দেখতে পারি। এই নীতিতে হকার পুনর্বাসনের ব্যাপারে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয় পুরসভা। হকার নীতি নামে পরিচিত এই নতুন নীতিতে বলা হয়েছে- ১. পুরসভা হকারদের চিহ্নিত করে পরিচয়পত্র দেয়ার ব্যবস্থা করবে। ২. নতুন কোনো হকার ফুটপাত দখল করে বসে পড়ছে কি-না তা মাঝেমধ্যেই সমীক্ষা করে দেখা হবে। ৩. পুরসভা হকারদের বিভিন্ন স্বাস্থ্য প্রকল্প, রাষ্ট্রীয় বীমা যোজনা ইত্যাদিতে অন্তর্ভুক্ত করবে। ৪. অপ্রাপ্ত বয়স্ক বা শিশু হকারদের পুনর্বাসন দিয়ে বিভিন্ন কর্মশিক্ষা, শিশু শিক্ষা প্রকল্প, জাতীয় শিশুশ্রম প্রকল্পে যুক্ত করা হবে। ৫. হকার সন্তানরা অবৈতনিক শিক্ষা এবং মিডডে মিল পাবে। ৬. ঋণ দেয়ার পাশাপাশি বিশেষ কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। ৭. খাবার ও আতশবাজি বিক্রি করে যারা, তাদের প্রয়োজনীয় লাইসেন্স নিতে হবে। ৮. ন্যূনতম ১৫ বর্গফুট ও সর্বাধিক ৪০ বর্গফুট জায়গা একজন হকারের জন্য নির্দিষ্ট হবে। যেখানে সম্ভব ও প্রয়োজন, সেখানে নির্দিষ্ট অনুপাতে শহরের তফসিলি জাতি, উপজাতি, সংখ্যালঘু ও প্রতিবন্ধী হকারদের জন্য বিক্রির জায়গা নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। ৯. হকারদের বেঁধেছেদে রেখে যাওয়া দোকানের মালপত্র রাতে যাতে চুরি না যায় সেজন্য জিনিসপত্র সুরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা করা হবে। ১০. কোথায় কে বসবে তা পরিচয়পত্র দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিহ্নিত করে কাঠামোভিত্তিক ফি নির্ধারণ করা হবে। ১১. এছাড়া হকার নিয়ন্ত্রিত ফুটপাথে কঠিন বর্জ্য অপসারণ, শৌচাগার নির্মাণ, বিদ্যুৎ সংযোজন ও পানীয় জল, বিক্রেতাদের জন্য ছাউনি এবং কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে ফুটপাতেই প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে পুরসভা। ১২. হকার হিসেবে অন্তর্ভুক্তির জন্য পুরসভার নির্দিষ্ট ফরমে আবেদন করতে হবে। আবেদনকারীর বয়স অবশ্যই কমপক্ষে ১৮ বছর হতে হবে। পথচারীদের জন্য হকারদের কিছু নির্দেশিকাও মানতে হবে। পথচারী চলাচলের জন্য দুই-তৃতীয়াংশ ফুটপাত খালি রাখতে হবে। এছাড়া বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় পুরসভা কর্তৃপক্ষ যে কোনো জায়গায় হকারদের বসা, বিক্রি নিয়ন্ত্রণ ও নিষিদ্ধ রাখতে পারবে।
এটি যে একটি চমৎকার ও বাস্তবানু নীতি, সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশের বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে এর অনেক নীতিই সামঞ্জস্যপূর্ণ। হকারদের যদি পরিচয়পত্র দেয়া যায়, তাহলে তারা একটি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে আসবে। তাছাড়া যে কোনো সিদ্ধান্ত যেমন পুনর্বাসন বা অন্যান্য সেবা দেয়ার ক্ষেত্রেও হকারদের একটি সঠিক পরিসংখ্যান জানা থাকলে তা সহজ হবে। এছাড়া সার্বিকভাবে একটি শৃংখলাও প্রতিষ্ঠিত হবে। এটি উভয় পক্ষের জন্যই মঙ্গলজনক হবে নিঃসন্দেহে। এজন্য একটি হকার নীতিমালা করা গেলে বিষফোঁড়ার মতো এ সমস্যা থেকে বাঁচা যাবে।
ড. হারুন রশীদ : সাংবাদিক
No comments