ইহকালের শান্তি ও পরকালের সুখ- দুইটাই বিনষ্ট হয়... by মোকাম্মেল হোসেন
আমাদের ময়মনসিংহ অঞ্চলে আন্ধাগোন্ধা দৌড়
বলে একটা কথা আছে। এর অর্থ হল, বেদিশা হয়ে দৌড়ানো। ইফতারের সময় হয়ে যাওয়ায়
বাস থেকে নেমেই একটা হোটেল লক্ষ্য করে আন্ধাগোন্ধা দৌড় দিলাম। হোটেলের
লোকজন প্লেটে ইফতার সাজিয়েই রেখেছিল। অজু করে চেয়ারে বসতেই তা পরিবেশন করা
হল। খাবারগুলোর দিকে একবার নজর বুলিয়ে সময় দেখার জন্য পকেট থেকে মোবাইল ফোন
বের করলাম, আর ঠিক তখনই এটি নেচে-গেয়ে উঠল। কল রিসিভ করে বললাম-
: আসসালামু আলাইকুম।
- ওয়ালাইকুম আসসালাম। জনাব, আপনে কি আজও রাস্তায় ইফতার করবাইন!
: করমু কী- অলরেডি ইফতার সামনে লইয়া বইসা গেছি...
- মানে?
হোটেলে ইফতার করার কথা শুনে লবণ বেগম ক্ষেপে গেল। বলল,
: তোমার কি বৌ-পোলাপান নাই?
- আছে। একাধিক।
: কী!
- ঘাবড়াইও না। একাধিক বৌয়ের কথা বলি নাই; পোলাপানের কথা বলছি।
: তাসিনের আব্বা!
- জ্বে।
: সারাদিন রোজা রাইখ্যা মাথা কিন্তু হট হইয়া রইছে!
- এই তো আর মাত্র চার-পাঁচ মিনিট। তারপরেই আজান দিবে...
: কথা সেইটা না।
- কী কথা!
: ছেলেরা তোমার অপেক্ষায় পথ চাইয়া রইছে!
- তুমি চাইয়া রইছ না?
: আমার অত ঠেকা পড়ে নাই...
এটা হচ্ছে অভিমানের কথা। আমি জানি, লবণ বেগম অধীর আগ্রহে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু উপায় কী? রাস্তার লালবাতি-সবুজবাতি নিয়ন্ত্রণের ভার যাদের হাতে ন্যস্ত, তাদের কাছে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের আবেগ-অনুভূতি মূল্যহীন। ফলে কোনোদিন বাসায়, কোনোদিন রাস্তায় ইফতার করার মধ্য দিয়েই রমজান অতিবাহিত হচ্ছে। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পানির গ্লাসের দিকে তাকাতেই মসজিদ থেকে আজান ভেসে এলো। ইফতার শেষ করে হোটেল থেকে বের হওয়ার পর ওয়াক্কেস সাহেবের সঙ্গে দেখা। তার হাতে একটা পোটলা দেখে জিজ্ঞেস করলাম,
: ঈদের কেনাকাটা শুরু কইরা দিছেন নাকি?
- আরে না!
: তাইলে পোটলার মধ্যে কী?
- লুঙ্গি।
: আপনের তো দেখতেছি বেজায় সাহস! শাড়ি না কিইন্যা আগে লুঙ্গি কিনছেন- ভাবি আপনেরে ছেঁচা দিব না?
- এইটার ইতিহাস ভিন্ন।
: কী রকম?
- আর বলবেন না! বাসের জন্য ফুটপাতে দাঁড়াইয়া রইছি- এক লোক আইসা বলল, স্যার, ঈদ উপলক্ষে আমার আব্বার জন্য দুইটা লুঙ্গি কিনছিলাম। হঠাৎ নগদ টাকার প্রয়োজন হওয়ায় এইগুলা বিক্রি করতে হইতেছে। আপনে যদি নেন, তাইলে অর্ধেক দামে দিয়া দিব।
লোকটার কথা শুনে জিজ্ঞেস করলাম-
: কত নিবা?
লোকটা তখন বলল-
: স্যার, লুঙ্গি দুইটার দাম হইল সাড়ে ছয়শ’ টাকা। আপনে আমারে তিনশ’ টাকা দেন।
কথাবার্তার মাঝখানে সেখানে আরও কয়েকজন লোক আইসা দাঁড়াইতেই সুযোগ হাতছাড়া হইতে পারে ভাইব্যা আমি আর বিলম্ব করলাম না। লোকটার হাতে তিনশ’ টাকা দিয়া দিলাম। এই হইল পোটলার ইতিহাস...
বর্তমান বাজারে তিনশ’ টাকায় এক জোড়া লুঙ্গি পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আমি লুঙ্গিগুলো দেখার আগ্রহ প্রকাশ করে বললাম-
: দেখি, কোন কোম্পানির লুঙ্গি!
পোটলা থেকে লুঙ্গি দুটো বের করে ভাঁজ খুলতেই আমাদের দু’জনের চোখ কপালে উঠে গেল। হায় আল্লাহ! ছেঁড়াফাটা পুরনো লুঙ্গি মাড় দিয়ে কড়কড়া করার পর ইস্ত্রি করে কী সুন্দর করে প্যাকেট করা হয়েছে! প্রতারিত হয়েছেন বুঝতে পেরে ওয়াক্কেস সাহেব হায়-হায় করে উঠলেন।
ওয়াক্কাস সাহেবকে প্রতারিত হতে দেখে আমার ছোটবেলার একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। এটা অনেকটা গল্পের মতো। আমাদের পাশের গ্রামের নজু বেপারি রাতে একা হাট থেকে বাড়ি ফিরছিল। গোরস্তানের সামনে আসার পর সেখানে চট পরিহিত এক লোককে দেখে দাঁড়িয়ে পড়তেই লোকটা তাকে বলল-
: ডরাইস না। কাছে আয়।
নজু বেপারি কাছে যেতেই লোকটা জিজ্ঞেস করল-
: তর নাম কী?
- নজু বেপারি।
: বাড়ি কই?
- সেনেরচর।
নজু বেপারি সাহস অর্জন করে জিজ্ঞেস করল-
: হুজুর, আপনে গোরস্তানে কী করেন!
- আর বলিস না! এই গোরস্তানে আগমন করার পর নেকির অভাবে যেসব মুর্দা কবরে আজাবের সম্মুখীন হয়- আমি আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি কইরা তাদের নেকি ডাবল কইরা দেই। এর ফলে তাদের আর কবরের আজাব সহ্য করতে হয় না...
ডাবল হুজুরের সঙ্গে কথা বলতে বলতে নজু বেপারির সাহস বেড়ে গেল। একইসঙ্গে তার মনের কোণে লোভও উঁকি দিল। এক পর্যায়ে ডাবল হুজুরকে নজু বেপারি বলল-
: হুজুর, শুধু নেকিই ডাবল করেন? আর কিছু ডাবল করতে পারেন না!
- পারি। বউ ডাবল করতে পারি। তর কি ডাবল বৌ দরকার?
: না-না! একটা লইয়াই বেকায়দা অবস্থায় আছি। বৌ ডাবল দরকার নাই। তবে...
- তবে কী?
: ধনদৌলত ডাবল করতে পারলে মন্দ হইত না!
- ধনদৌলত ডাবল করার কাম আগে করতাম। এখন আর করি না। এই কাম করতে গিয়া দেখছি- মানুষ যত ধনসম্পদ পায়- তত তার লোভ বাইড়া যায়। লোভের কোনো সীমা-পরিসীমা থাকে না। টাকা-পয়সা, সোনাদানা একবার ডাবল কইরা দেওয়ার পর আবার ডাবল কইরা দিতে বলে। দ্বিতীয়বার ডাবল কইরা দেওয়ার পর আবার ডাবল কইরা দিতে বলে। তারপর আবার। আমারে একেবারে বেহুঁশ বানাইয়া ফেলে। সেইজন্য অই জায়গা থেইক্যা সইরা আসছি।
: আমার লোভ অত পাতলা না!
- পাতলা, না ঘন- ফিল্ডে না নামলে বোঝার উপায় নাই।
: তাইলে মেহেরবানী কইরা একবার ফিল্ডে নাইম্যা দেখেন।
- দুনিয়াদারি কারবার- অনেক ঝামেলার! সেইজন্যই মরা মানুষ লইয়া পইড়া থাকি। আইচ্ছা, তুই যখন বলতেছস, দেখি...
: দেখি না, কখন আমার বাড়িতে যাবাইন- কইন!
- শুধু গেলেই তো হইব না পাগল! তর ঘরে নগদ টাকা-পয়সা, সোনাদানা কেমন আছে?
: সোনাদানা সামান্য পরিমাণ আছে। তবে নগদ টাকা-পয়সা তো নাই।
- আমার কেরামতির ফল পাইতে হইলে প্রচুর নগদ টাকা-পয়সা আর সোনাদানা লাগব। পারবি জোগাড় করতে?
: পারমু।
- ঠিক আছে। টাকা-পয়সা যোগাড় করার আগে তুই শহর থেইক্যা বড় দেইখ্যা দুইটা পিতলের কলসি কিইন্যা আনবি। কলসি দুইটা তর শোয়ার ঘরে গলা পর্যন্ত পুইত্যা রাখবি। এরপর একটা কলসির মধ্যে যতটা সম্ভব নগদ টাকা-পয়সা ও সোনাদানা জমাবি। আমি আগামী অমাবস্যার রাতে তর ঘরে যাইয়া ওই কলসিতে যে পরিমাণ টাকা-পয়সা ও সোনাদানা থাকবে- তা দ্বিগুণ বানাইয়া অপর কলসিতে ঢুকাইয়া দিব।
ডাবল হুজুরের কথামতো নজু বেপারি পরদিন শহর থেকে বড় আকারের দুটি পিতলের কলসি কিনে আনল। তারপর টাকা-পয়সা জোগাড়ের দিকে মন দিতেই তার স্ত্রী জবেদন নেছা ব্যাকুল কণ্ঠে বলে উঠল-
: আপনে এইসব কী শুরু করছুইন?
- কী শুরু করছি?
: গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি সব বেইচ্যা অহন জমি বেচা শুরু করছুইন!
- বেচনের দেখছস কী? আমার তো ইচ্ছা করতাছে বাড়ি ভিটা বেইচ্যা দিয়া সেই টাকাগুলাও কলসিতে রাখি...
অমাবস্যার রাতে নজু বেপারির বাড়িতে ডাবল হুজুর তশরিফ রাখলেন। তার সামনে গলা পর্যন্ত পুঁতে রাখা পাশাপাশি দুটি পিতলের কলসি। এর একটার মধ্যে টাকা-পয়সা ও অলংকার। অন্যটি খালি। লাল সালু কাপড় দিয়ে মুখ বাঁধা কলসি দুটি সামনে রেখে ডাবল হুজুর জিকির শুরু করলেন। জিকির করার ফাঁকে হুজুর একবার টাকা-পয়সা ও অলংকার রাখা কলসিতে ফুঁ দেন, আবার খালি কলসিতে ফুঁ দেন। নজু বেপারি একটু দূরে বসে সবকিছু প্রত্যক্ষ করছিল। রাত গভীর হওয়ার পর ইশারায় নজু বেপারিকে কাছে ডাকলেন ডাবল হুজুর। হুজুরের কাছে যাওয়ার পর নাকের কাছে একটা রুমাল ধরতেই নজু বেপারি ত্যানার মতো নেতিয়ে পড়ল। পরদিন জ্ঞান ফেরার পর নজু বেপারি দেখল, ডাবল হুজুর নেই; টাকা-পয়সা ও অলংকারের কলসিও নেই।
ওয়াক্কেস সাহেবকে সান্ত্বনা দেয়ার উদ্দেশে বললাম-
: ভাই, এই দেশে প্রতারকের অভাব নাই। প্রতারকরা কেউ লুঙ্গি-গামছা লইয়া, কেউ খাবার ও ওষুধ লইয়া, কেউ বাড়ি-গাড়ি-জমি লইয়া, কেউ চাকরি-ব্যবসা ও বিবাহ লইয়া, আবার কেউ সমবায় সমিতি-ব্যংক-বীমা ও শেয়ারবাজার লইয়া মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করতেছে। যারা এদের প্রতারণা সম্পর্কে সচেতন থাকে, তারা কোনো ভেজালে পড়ে না। কিন্তু সচেতন না থাকলেই বিপদ। ইহকালের শান্তি ও পরকালের সুখ- দুইটাই বিনষ্ট হয়...
মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক
: আসসালামু আলাইকুম।
- ওয়ালাইকুম আসসালাম। জনাব, আপনে কি আজও রাস্তায় ইফতার করবাইন!
: করমু কী- অলরেডি ইফতার সামনে লইয়া বইসা গেছি...
- মানে?
হোটেলে ইফতার করার কথা শুনে লবণ বেগম ক্ষেপে গেল। বলল,
: তোমার কি বৌ-পোলাপান নাই?
- আছে। একাধিক।
: কী!
- ঘাবড়াইও না। একাধিক বৌয়ের কথা বলি নাই; পোলাপানের কথা বলছি।
: তাসিনের আব্বা!
- জ্বে।
: সারাদিন রোজা রাইখ্যা মাথা কিন্তু হট হইয়া রইছে!
- এই তো আর মাত্র চার-পাঁচ মিনিট। তারপরেই আজান দিবে...
: কথা সেইটা না।
- কী কথা!
: ছেলেরা তোমার অপেক্ষায় পথ চাইয়া রইছে!
- তুমি চাইয়া রইছ না?
: আমার অত ঠেকা পড়ে নাই...
এটা হচ্ছে অভিমানের কথা। আমি জানি, লবণ বেগম অধীর আগ্রহে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু উপায় কী? রাস্তার লালবাতি-সবুজবাতি নিয়ন্ত্রণের ভার যাদের হাতে ন্যস্ত, তাদের কাছে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের আবেগ-অনুভূতি মূল্যহীন। ফলে কোনোদিন বাসায়, কোনোদিন রাস্তায় ইফতার করার মধ্য দিয়েই রমজান অতিবাহিত হচ্ছে। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পানির গ্লাসের দিকে তাকাতেই মসজিদ থেকে আজান ভেসে এলো। ইফতার শেষ করে হোটেল থেকে বের হওয়ার পর ওয়াক্কেস সাহেবের সঙ্গে দেখা। তার হাতে একটা পোটলা দেখে জিজ্ঞেস করলাম,
: ঈদের কেনাকাটা শুরু কইরা দিছেন নাকি?
- আরে না!
: তাইলে পোটলার মধ্যে কী?
- লুঙ্গি।
: আপনের তো দেখতেছি বেজায় সাহস! শাড়ি না কিইন্যা আগে লুঙ্গি কিনছেন- ভাবি আপনেরে ছেঁচা দিব না?
- এইটার ইতিহাস ভিন্ন।
: কী রকম?
- আর বলবেন না! বাসের জন্য ফুটপাতে দাঁড়াইয়া রইছি- এক লোক আইসা বলল, স্যার, ঈদ উপলক্ষে আমার আব্বার জন্য দুইটা লুঙ্গি কিনছিলাম। হঠাৎ নগদ টাকার প্রয়োজন হওয়ায় এইগুলা বিক্রি করতে হইতেছে। আপনে যদি নেন, তাইলে অর্ধেক দামে দিয়া দিব।
লোকটার কথা শুনে জিজ্ঞেস করলাম-
: কত নিবা?
লোকটা তখন বলল-
: স্যার, লুঙ্গি দুইটার দাম হইল সাড়ে ছয়শ’ টাকা। আপনে আমারে তিনশ’ টাকা দেন।
কথাবার্তার মাঝখানে সেখানে আরও কয়েকজন লোক আইসা দাঁড়াইতেই সুযোগ হাতছাড়া হইতে পারে ভাইব্যা আমি আর বিলম্ব করলাম না। লোকটার হাতে তিনশ’ টাকা দিয়া দিলাম। এই হইল পোটলার ইতিহাস...
বর্তমান বাজারে তিনশ’ টাকায় এক জোড়া লুঙ্গি পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আমি লুঙ্গিগুলো দেখার আগ্রহ প্রকাশ করে বললাম-
: দেখি, কোন কোম্পানির লুঙ্গি!
পোটলা থেকে লুঙ্গি দুটো বের করে ভাঁজ খুলতেই আমাদের দু’জনের চোখ কপালে উঠে গেল। হায় আল্লাহ! ছেঁড়াফাটা পুরনো লুঙ্গি মাড় দিয়ে কড়কড়া করার পর ইস্ত্রি করে কী সুন্দর করে প্যাকেট করা হয়েছে! প্রতারিত হয়েছেন বুঝতে পেরে ওয়াক্কেস সাহেব হায়-হায় করে উঠলেন।
ওয়াক্কাস সাহেবকে প্রতারিত হতে দেখে আমার ছোটবেলার একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। এটা অনেকটা গল্পের মতো। আমাদের পাশের গ্রামের নজু বেপারি রাতে একা হাট থেকে বাড়ি ফিরছিল। গোরস্তানের সামনে আসার পর সেখানে চট পরিহিত এক লোককে দেখে দাঁড়িয়ে পড়তেই লোকটা তাকে বলল-
: ডরাইস না। কাছে আয়।
নজু বেপারি কাছে যেতেই লোকটা জিজ্ঞেস করল-
: তর নাম কী?
- নজু বেপারি।
: বাড়ি কই?
- সেনেরচর।
নজু বেপারি সাহস অর্জন করে জিজ্ঞেস করল-
: হুজুর, আপনে গোরস্তানে কী করেন!
- আর বলিস না! এই গোরস্তানে আগমন করার পর নেকির অভাবে যেসব মুর্দা কবরে আজাবের সম্মুখীন হয়- আমি আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি কইরা তাদের নেকি ডাবল কইরা দেই। এর ফলে তাদের আর কবরের আজাব সহ্য করতে হয় না...
ডাবল হুজুরের সঙ্গে কথা বলতে বলতে নজু বেপারির সাহস বেড়ে গেল। একইসঙ্গে তার মনের কোণে লোভও উঁকি দিল। এক পর্যায়ে ডাবল হুজুরকে নজু বেপারি বলল-
: হুজুর, শুধু নেকিই ডাবল করেন? আর কিছু ডাবল করতে পারেন না!
- পারি। বউ ডাবল করতে পারি। তর কি ডাবল বৌ দরকার?
: না-না! একটা লইয়াই বেকায়দা অবস্থায় আছি। বৌ ডাবল দরকার নাই। তবে...
- তবে কী?
: ধনদৌলত ডাবল করতে পারলে মন্দ হইত না!
- ধনদৌলত ডাবল করার কাম আগে করতাম। এখন আর করি না। এই কাম করতে গিয়া দেখছি- মানুষ যত ধনসম্পদ পায়- তত তার লোভ বাইড়া যায়। লোভের কোনো সীমা-পরিসীমা থাকে না। টাকা-পয়সা, সোনাদানা একবার ডাবল কইরা দেওয়ার পর আবার ডাবল কইরা দিতে বলে। দ্বিতীয়বার ডাবল কইরা দেওয়ার পর আবার ডাবল কইরা দিতে বলে। তারপর আবার। আমারে একেবারে বেহুঁশ বানাইয়া ফেলে। সেইজন্য অই জায়গা থেইক্যা সইরা আসছি।
: আমার লোভ অত পাতলা না!
- পাতলা, না ঘন- ফিল্ডে না নামলে বোঝার উপায় নাই।
: তাইলে মেহেরবানী কইরা একবার ফিল্ডে নাইম্যা দেখেন।
- দুনিয়াদারি কারবার- অনেক ঝামেলার! সেইজন্যই মরা মানুষ লইয়া পইড়া থাকি। আইচ্ছা, তুই যখন বলতেছস, দেখি...
: দেখি না, কখন আমার বাড়িতে যাবাইন- কইন!
- শুধু গেলেই তো হইব না পাগল! তর ঘরে নগদ টাকা-পয়সা, সোনাদানা কেমন আছে?
: সোনাদানা সামান্য পরিমাণ আছে। তবে নগদ টাকা-পয়সা তো নাই।
- আমার কেরামতির ফল পাইতে হইলে প্রচুর নগদ টাকা-পয়সা আর সোনাদানা লাগব। পারবি জোগাড় করতে?
: পারমু।
- ঠিক আছে। টাকা-পয়সা যোগাড় করার আগে তুই শহর থেইক্যা বড় দেইখ্যা দুইটা পিতলের কলসি কিইন্যা আনবি। কলসি দুইটা তর শোয়ার ঘরে গলা পর্যন্ত পুইত্যা রাখবি। এরপর একটা কলসির মধ্যে যতটা সম্ভব নগদ টাকা-পয়সা ও সোনাদানা জমাবি। আমি আগামী অমাবস্যার রাতে তর ঘরে যাইয়া ওই কলসিতে যে পরিমাণ টাকা-পয়সা ও সোনাদানা থাকবে- তা দ্বিগুণ বানাইয়া অপর কলসিতে ঢুকাইয়া দিব।
ডাবল হুজুরের কথামতো নজু বেপারি পরদিন শহর থেকে বড় আকারের দুটি পিতলের কলসি কিনে আনল। তারপর টাকা-পয়সা জোগাড়ের দিকে মন দিতেই তার স্ত্রী জবেদন নেছা ব্যাকুল কণ্ঠে বলে উঠল-
: আপনে এইসব কী শুরু করছুইন?
- কী শুরু করছি?
: গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি সব বেইচ্যা অহন জমি বেচা শুরু করছুইন!
- বেচনের দেখছস কী? আমার তো ইচ্ছা করতাছে বাড়ি ভিটা বেইচ্যা দিয়া সেই টাকাগুলাও কলসিতে রাখি...
অমাবস্যার রাতে নজু বেপারির বাড়িতে ডাবল হুজুর তশরিফ রাখলেন। তার সামনে গলা পর্যন্ত পুঁতে রাখা পাশাপাশি দুটি পিতলের কলসি। এর একটার মধ্যে টাকা-পয়সা ও অলংকার। অন্যটি খালি। লাল সালু কাপড় দিয়ে মুখ বাঁধা কলসি দুটি সামনে রেখে ডাবল হুজুর জিকির শুরু করলেন। জিকির করার ফাঁকে হুজুর একবার টাকা-পয়সা ও অলংকার রাখা কলসিতে ফুঁ দেন, আবার খালি কলসিতে ফুঁ দেন। নজু বেপারি একটু দূরে বসে সবকিছু প্রত্যক্ষ করছিল। রাত গভীর হওয়ার পর ইশারায় নজু বেপারিকে কাছে ডাকলেন ডাবল হুজুর। হুজুরের কাছে যাওয়ার পর নাকের কাছে একটা রুমাল ধরতেই নজু বেপারি ত্যানার মতো নেতিয়ে পড়ল। পরদিন জ্ঞান ফেরার পর নজু বেপারি দেখল, ডাবল হুজুর নেই; টাকা-পয়সা ও অলংকারের কলসিও নেই।
ওয়াক্কেস সাহেবকে সান্ত্বনা দেয়ার উদ্দেশে বললাম-
: ভাই, এই দেশে প্রতারকের অভাব নাই। প্রতারকরা কেউ লুঙ্গি-গামছা লইয়া, কেউ খাবার ও ওষুধ লইয়া, কেউ বাড়ি-গাড়ি-জমি লইয়া, কেউ চাকরি-ব্যবসা ও বিবাহ লইয়া, আবার কেউ সমবায় সমিতি-ব্যংক-বীমা ও শেয়ারবাজার লইয়া মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করতেছে। যারা এদের প্রতারণা সম্পর্কে সচেতন থাকে, তারা কোনো ভেজালে পড়ে না। কিন্তু সচেতন না থাকলেই বিপদ। ইহকালের শান্তি ও পরকালের সুখ- দুইটাই বিনষ্ট হয়...
মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক
No comments