বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৩৭৩ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। আবদুল ওয়াজেদ, বীর প্রতীক এক প্রতিরোধযোদ্ধা মধ্যরাতে ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টার্সে হইচই আর বাঁশির শব্দ। আবদুল ওয়াজেদ ঘুমিয়ে ছিলেন। শব্দে ঘুম ভেঙে গেল।


শুনলেন, পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের সেক্টর হেডকোয়ার্টার্সের সামনে প্রতিরক্ষা অবস্থান নিয়েছে। যেকোনো সময় আক্রমণ করতে পারে। ইপিআরের বাঙালি সদস্যরা অস্ত্র আর গুলি নিয়ে অবস্থান নিচ্ছেন বিভিন্ন স্থানে। আবদুল ওয়াজেদও দ্রুত অস্ত্র-গুলি নিয়ে যোগ দিলেন তাঁদের সঙ্গে। এ ঘটনা যশোরে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ।
সেদিন রাত সাড়ে ১১টার দিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কয়েকটি দল যশোর সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে শহরে প্রবেশ করে। তারা শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয়। একটি দল অবস্থান নেয় ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টারের কাছে। যশোর ইপিআর সেক্টরে তখন ইপিআরের বাঙালি সদস্য ছিলেন ৭০ জন। পাহারারত কয়েকজন ছাড়া বেশির ভাগ সদস্য এ সময় ঘুমিয়ে ছিলেন। তাঁরা ঘুম থেকে উঠে দ্রুত অস্ত্রাগারের তালা ভেঙে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণ মোকাবিলার প্রস্তুতি নেন।
শেষ পর্যন্ত সেই রাতে পাকিস্তানি সেনারা যশোর ইপিআর সেক্টরে আক্রমণ করেনি। তবে কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে। ইপিআরের বাঙালি সদস্যরা সতর্ক অবস্থায় থাকেন। পরদিন পাকিস্তানি সেনারা সেখান থেকে চলে যায়। ৩০ মার্চের পর আবদুল ওয়াজেদরা তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে শহরের কারবালা, চাঁচড়া ও কলেজ এলাকায় প্রতিরক্ষা অবস্থান নেন।
৩ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ইপিআরের তিন প্রতিরক্ষা অবস্থানেই আক্রমণ চালায়। ব্যাপক আক্রমণে ইপিআর সদস্যদের প্রতিরক্ষা অবস্থানে টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এরপর তাঁরা পিছু হটে ঝিকরগাছায় অবস্থান নেন। ১১ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঝিকরগাছায় আক্রমণ চালায়। তখন সেখানে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। সেদিন আবদুল ওয়াজেদ ও তাঁর সহযোদ্ধারা সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করেন। তাঁদের বীরত্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দল পিছে হটতে বাধ্য হয়।
পরদিন ১২ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আর্টিলারির সাপোর্ট নিয়ে ইপিআর অবস্থানে আবার আক্রমণ চালায়। আবদুল ওয়াজেদ ও তাঁর সহযোদ্ধারা এ দিন বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে তাঁরা অবস্থান ছেড়ে যেতে বাধ্য হন। সেদিন যুদ্ধে তাঁদের দুজন সহযোদ্ধা শহীদ ও কয়েকজন গুরুতর আহত হন।
আবদুল ওয়াজেদ ও তাঁর সহযোদ্ধারা এরপর অবস্থান নেন নাভারণে। কয়েক দিন পর সে অবস্থানেরও পতন হয়। সেখান থেকে তাঁরা বেনাপোল হয়ে ভারতে যান। ভারতে যাওয়ার কিছুদিন পর আবদুল ওয়াজেদ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ কারণে তাঁর পক্ষে পরে আর সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেওয়া সম্ভব হয়নি। সুস্থ হওয়ার পর আবদুল ওয়াজেদকে ৮ নম্বর সেক্টরের সদর দপ্তরে কোয়ার্টার মাস্টার হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই দায়িত্ব তিনি যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য আবদুল ওয়াজেদকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ২২৫।
আবদুল ওয়াজেদ স্বাধীনতার পর বিডিআর থেকে সুবেদার মেজর হিসেবে অবসর নেন। ১৯৭১ সালে তাঁর পদবি ছিল ল্যান্স নায়েক। তখন সেক্টর সদর দপ্তরে বেতন শাখায় কাজ করতেন।
আবদুল ওয়াজেদের পৈতৃক বাড়ি ঝালকাঠি জেলার সদর উপজেলার বিনয়কাঠি ইউনিয়নের বিষ্ণুদিয়া গ্রামে। তাঁর বাবার নাম ইয়াছিন উদ্দীন হাওলাদার, মা লতিফুন নেছা, স্ত্রী রাজিয়া বেগম। তাঁদের তিন ছেলে ও পাঁচ মেয়ে।
সূত্র: প্রথম আলোর ঝালকাঠি প্রতিনিধি আক্কাস সিকদার এবং মুক্তিযুদ্ধে রাইফেলস ও অন্যান্য বাহিনী, সুকুমার বিশ্বাস।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@mail.com

No comments

Powered by Blogger.